পানি সংগ্রহে ২০ কোটি ঘণ্টা by কাজী সোহাগ
প্রতিদিন
পানি সংগ্রহ করতেই নারীদের ব্যয় হয় ২০ কোটি ঘণ্টা। একই কাজে শ্রম ও সময়
ব্যয় করছে এ দেশের শিশুরাও। ক্ষতি হচ্ছে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম। ঘণ্টার পর
ঘণ্টা পাহাড় বেয়ে বহুদূরের ছড়া থেকে মাথায় করে অল্প পরিমাণ পানি বাড়িতে
বহন করে আনে শিশুরা। প্রায় একই চিত্র হাওর ও সমুদ্রতীরবর্তী লবণাক্ত
এলাকায়ও। যে কোন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে এসব এলাকার অধিবাসীর জন্য পানি
সংগ্রহ হয়ে ওঠে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের। জাতিসংঘ ও এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক
হেলথের গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। রোববার বিশ্ব পানি দিবসের আগে এ তথ্য
প্রকাশ করে এ দুটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে
আসছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য নিরাপদ পানি ও টেকসই উন্নয়ন। জাতিসংঘ এর আওতায়
৭টি মূল ক্ষেত্র নির্ধারণ করেছে, যার প্রতিটিই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানিসম্পদের সর্বাধিক গুরুত্বের স্বীকৃতি হিসেবে
১৯৯২ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়নবিষয়ক ৪৭তম অধিবেশনে প্রতি বছর ২২শে
মার্চ বিশ্ব পানি দিবস উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জাতিসংঘের ঘোষণা
অনুযায়ী নিরাপদ পানি একটি মানবাধিকার। এর সঙ্গে সাম্যতা বিষয়টি
অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কিন্তু দেশের অসংখ্য দুর্গম ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চল ও
জনগোষ্ঠীর জন্য এখনও নিরাপদ পানির সংস্থান করা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের
মারাত্মক প্রভাবে ইতিমধ্যে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া, বৃষ্টির পরিমাণ কমে
যাওয়া, নদী শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় সুপেয় পানির পরিমাণ কমতে শুরু
করেছে। ৩০ বছর ধরে পানি নিয়ে নিয়মিত গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান এনজিও ফোরাম ফর
পাবলিক হেলথের ম্যানেজার অ্যাডভোকেসি সাহা দীপক কুমার মানবজমিনকে বলেন,
লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় দুর্গম উপকূলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী ঢাকার তুলনায়
প্রায় ৩০০ গুণ বেশি দাম দিয়ে পানি কেনেন। অথচ চলতি বছরের বাজেটে এ বিষয়টিকে
সরাসরি উপেক্ষা করা হয়েছে। কারণ বাজেটে পার্বত্য ও হাওর অঞ্চলের জন্য কোন
বরাদ্দই রাখা হয়নি। এছাড়া প্রতিবন্ধীবান্ধব নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনসহ
অন্যান্য অবকাঠামো তৈরিতেও কোন বরাদ্দ রাখা হয়নি। এদিকে জাতিসংঘের
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে
উল্লেখ্য করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, উচ্চ বরেন্দ্র এলাকায় ২০০০ সালে
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ৬২ ফুট। বর্তমানে তা ১০৫ ফুট নিচে নেমে গেছে।
তাদের তথ্য মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ তলিয়ে যেতে পারে ৮টি জেলার বিস্তীর্ণ
অঞ্চল। ধানের উৎপাদন কমতে পারে ৮ ভাগ। জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান হার বজায়
থাকলে ২১০০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ জিডিপির ৯ ভাগ হারানোর ঝুঁকিতে থাকবে। ওদিকে
এনজিও ফোরামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশব্যাপী মোট বস্তিবাসীর সংখ্যা ৫
দশমিক ৪ মিলিয়ন হলেও বেশিরভাগ বস্তি ওয়াসার পানি সরবরাহ ব্যবস্থার
অন্তর্ভুক্ত নয়। ওয়াসার পানির লাইনে দাঁড়ানো বা অন্য কোন উপায়ে পানি সংগ্রহ
করতে গিয়ে একজন বস্তিবাসী তার কর্মঘণ্টা থেকে মূল্যবান সময় হারান। এছাড়া
দেশব্যাপী সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপদ পানি সরবরাহ
ব্যবস্থা নেই। প্রতিবেদনের তথ্য মতে দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা দরিদ্র কর্মজীবী
জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মস্থলে পানির কোন ব্যবস্থা নেই। ঢাকায় প্রতিদিন সৃষ্টি
হচ্ছে প্রায় ১২ লাখ ২০ হাজার ঘনমিটার পয়ঃবর্জ্য। এর ৭০ ভাগ শোধনাগারে
পৌঁছানোর বা শোধনের কোন ব্যবস্থা নেই। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিল্পকারখানার
পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিপুল তরল বর্জ্য সৃষ্টি হয়। ঢাকার চারপাশের ৭
হাজার শিল্পকারখানা থেকে প্রতিদিন ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন কিউবিক মিটার তরল
বর্জ্য বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীতে গিয়ে পড়ে। পাগলায়
অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র পয়ঃশোধনাগারটি মোট তরল শিল্পবর্জ্যের ১০ ভাগ
শোধন করার ক্ষমতা রাখে। সিডর-আইলাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত
বরগুনা জেলায় অবৈধভাবে ইটের ভাটায় ব্যবহারের জন্য প্রতি মাসে অন্তত চার লাখ
৬২ হাজার মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, সিডর-আইলাসহ বিভিন্ন
প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ঠেকিয়ে এসব বৃক্ষই জানমালসহ নিরাপদ
পানি প্রযুক্তি ও বিভিন্ন স্থাপনার সুরক্ষা কবচ হিসেবে কাজ করেছে। সিলেটের
সারী নদীর আশেপাশে কয়লার কারবারে যত্রতত্র নদী খুঁড়ে শুরু হয় কয়লা উত্তোলন ও
বেচাকেনা। ফলে পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ সারী নদীসহ সমগ্র এলাকার পরিবেশ
নষ্ট হচ্ছে।
No comments