প্রান্তসীমায় সীমান্তের নারীরা
কাকন চক্রবর্তী (সর্বডানে) ব্যাতিক্রমী এক উদাহরণ যিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন |
জিরো
লাইন থেকে সাকুল্যে ৩ কিলোমিটার দূরে ছোট্টগ্রাম হাকিমপুর। মাটির ঘরের
ভেতর কাঠের দরজার পেছন থেকে সাবধানে উঁকি দিলো এক কিশোরী। ১৭ বছর বয়সী
নাজিয়া আজম (ছদ্মনাম) সারা দিন নিজের ঘরের ভেতরই থাকেন। তার বয়স যখন ১৫,
তখন তার এক কাজিনের বন্ধু শেখ শওকত তাকে অপহরণ করে। সে জানায়, আমি পাশের
গ্রামে মুহররমের অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিলাম। তখন কিছু লোক এসে আমাকে ধরে
শওকতের বাড়িতে নিয়ে যায়। আমি পরের ৭ মাস একটি কক্ষে তালাবদ্ধ অবস্থায়
ছিলাম। এ সময় আমাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। নাজিয়াকে
অপহরণকারীরা বলেছিল, তার বাবা-মা তাকে শেখ শওকতের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।
তার ভাষায়- শেখ আমাকে বলেছিল, যদি আমি সহযোগিতা করি, তাহলে সে আমাকে পুনে ও
হায়দরাবাদে অন্য পুরুষদের কাছে পাঠিয়ে দেবে। একদিন আমি তাদের বলি, আমার
পেট খুব ব্যথা করছে। এরপর তারা আমাকে স্থানীয় এক ভিখারির কাছে নিয়ে যায়।
আমি তার সহায়তায় পালিয়ে আসি। কথাগুলো বলতে গিয়ে থরথর করে কাঁপছিল নাজিয়া।
স্পষ্টত, এখনও তাকে দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায়। সে পালিয়ে আসার পর শেখ
শওকতকে পুলিশ আটক করে। তবে কিছুদিন পরই জামিনে মুক্তি পায়। এরপর নাজিয়ার
বাবা-মা আর তাকে স্কুলে পাঠানোর সাহস পাননি। নাজিয়া জানায়, সে (শেখ শওকত)
এখন মুক্ত। তাই আমরা সবাই ভীত। আমার সবচেয়ে বড় আফসোস হচ্ছে, আমি স্কুলে
যেতে পারছি না। আমি ভাল ছাত্রী। আমি একজন সমাজকর্মী হতে চাই। একই ধরনের
মানবপাচারের ঘটনা নাজিয়ার আগেও তার গ্রামের একজনের সঙ্গে হয়েছে।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের আশপাশে বসবাসকারী তরুণী মেয়েরা সবসময় ভয়ে থাকে-
হয়তো তারাও মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়তে পারে। সন্ধ্যার পর কোন মেয়েই আর
ঘরের বাইরে বের হয় না।
সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে ব্যাপক দারিদ্র্যতা রয়েছে; বিশেষ করে বাংলাদেশী অংশে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কারা-হেফাজতে নির্যাতনের শিকার মানুষদের নিয়ে কাজ করে মাসুম (বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ) নামের একটি এনজিও। সংগঠনটির সচিব কিরিটি রায় বলেন, সকল পর্যায়ের লোকজন দারিদ্র্যের সুযোগ নেয়। সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পুলিশ, রাজনীতিবিদ, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত; এক কথায় প্রত্যেকে। যখন নারীরা কোন চাকরির খোঁজে আসে, তখন তাকে প্রলুব্ধ করে অনেকে। এদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হয় নানা দেশে, বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলোতে। বিদেশে পাঠানো না গেলে, মুম্বই, দিল্লি বা কলকাতায় পাঠানো হয়। সোনাগাছির কুখ্যাত পতিতাপল্লী এলাকার যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করে কলকাতা ভিত্তিক এনজিও দুর্বার। এনজিওটির প্রধান উপদেষ্টা স্বরজিত জানা বলেন, যেসব মেয়ে যৌন ব্যবসায় আসেন, তাদের ১০০ জনের মধ্যে মাত্র ২ জন পাচার হয়ে আসে। তিনি বলেন, গল্পটা একই। দারিদ্র্যই মূল কারণ। দেশের সবচেয়ে গরিব এলাকার মেয়েরাই সোনাগাছিতে আসে কেবল টাকা কামাতে। বাংলাদেশের অনেক নারীও সীমান্ত পার হয়ে এখানে আসে। যদিও তারা নিজেদের নাগরিকত্বের কথা স্বীকার করবে না। যেহেতু তারা ভারতীয় বাঙালিদের মতো দেখতে ও একই ভাষায় কথা বলেন, সেহেতু এখানে মিশে যাওয়া তাদের জন্য সহজ। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে অবস্থিত বনগাঁ এলাকার ২৫ বছর বয়সী সামিরা হোসেন জানালেন, তিনি যৌনকর্মী হতে চান! তার বাবা মারা গেছেন, মা অসুস্থ। সংসারে আছে ২ স্কুলপড়ুয়া ভাই। তাই সংসারের উপার্জনের কাজটা তাকেই করতে হবে। তিনি বলেন, আমি টাকা আয় করতে চাই। আমি তেমন পড়ালেখা করিনি। আমার এক বন্ধু জানালো, এখানে এসে আমরা ভালো অর্থ আয় করতে পারবো। তাই আমি সোনাগাছিতে এসেছি এবং আমি সত্যিই একজন যৌনকর্মী হতে চাই। সীমান্তের কাছে অবস্থিত গ্রামগুলোর বেশির ভাগ মেয়ে মাত্র দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। তাদের ভাইয়েরা হয়তো সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। তারালি গ্রামের রেশমা বিবির বিয়ে হয়েছিল ১৭ বছর বয়সে। তিনি হেসে জানান, ধান চাষে আমি আমার স্বামীকে সাহায্য করি। আমরা একদিন কিছু জমির মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখি। তবে আশাব্যঞ্জক ব্যতিক্রম কদাচিৎ দেখা যায়। যেমন রেশমার প্রতিবেশী ২১ বছর বয়সী কাকন চক্রবর্তী ভূগোলে মাস্টার্স করছেন। তিনি জানালেন, আমি ও আমার ছোট বোন যখন ছোট ছিলাম তখন আমার মা মারা যান। আমার পিতা এরপর আমাদেরকে নানীর ঘরে রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। আমার বোন বর্ধমানে লেখাপড়া করছে। সেখানে এক আন্টির কাছে থাকছে সে। চক্রবর্তীর গল্প উৎসাহব্যঞ্জক হলেও, কেবলই একটি ব্যতিক্রম। দারিদ্র্য ও উন্নত জীবনের প্রত্যাশা সীমান্তের নারীদের প্রান্তসীমায় এনে দাঁড় করিয়েছে। কম্যুনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার সংসদ সদস্য ও মুখপাত্র মোহাম্মদ সেলিম এ প্রসঙ্গে বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিষ্কার অভাব রয়েছে। একই সঙ্গে ব্যবস্থাপনায় রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। দারিদ্র্যের কারণে আমাদের নারীরা সরবরাহ আর চাহিদার কলুষিত এক চক্রে আটকে পড়ছে। কলুষিত? জিজ্ঞেস করে নাজিয়া। এটা বললে সমস্যাকে খাটো করে দেখা হবে। আমাকে এখন কেউই বিয়ে করবে না। আমার শিক্ষাজীবন শেষ। কোন আশা নেই। আপনার কোন ধারণাই নেই আমার জীবনটা আসলে কেমন। কষ্টমিশ্রিত হাসি নিয়ে কথাগুলো বলছিল নাজিয়া আজম।
(বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী মানুষের জীবনযাত্রা আর বাস্তবতা নিয়ে খালিজ টাইমসের তিন অংশের সিরিজ প্রতিবেদনের তৃতীয় ও শেষ অংশের অনুবাদ)
সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে ব্যাপক দারিদ্র্যতা রয়েছে; বিশেষ করে বাংলাদেশী অংশে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কারা-হেফাজতে নির্যাতনের শিকার মানুষদের নিয়ে কাজ করে মাসুম (বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ) নামের একটি এনজিও। সংগঠনটির সচিব কিরিটি রায় বলেন, সকল পর্যায়ের লোকজন দারিদ্র্যের সুযোগ নেয়। সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পুলিশ, রাজনীতিবিদ, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত; এক কথায় প্রত্যেকে। যখন নারীরা কোন চাকরির খোঁজে আসে, তখন তাকে প্রলুব্ধ করে অনেকে। এদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হয় নানা দেশে, বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলোতে। বিদেশে পাঠানো না গেলে, মুম্বই, দিল্লি বা কলকাতায় পাঠানো হয়। সোনাগাছির কুখ্যাত পতিতাপল্লী এলাকার যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করে কলকাতা ভিত্তিক এনজিও দুর্বার। এনজিওটির প্রধান উপদেষ্টা স্বরজিত জানা বলেন, যেসব মেয়ে যৌন ব্যবসায় আসেন, তাদের ১০০ জনের মধ্যে মাত্র ২ জন পাচার হয়ে আসে। তিনি বলেন, গল্পটা একই। দারিদ্র্যই মূল কারণ। দেশের সবচেয়ে গরিব এলাকার মেয়েরাই সোনাগাছিতে আসে কেবল টাকা কামাতে। বাংলাদেশের অনেক নারীও সীমান্ত পার হয়ে এখানে আসে। যদিও তারা নিজেদের নাগরিকত্বের কথা স্বীকার করবে না। যেহেতু তারা ভারতীয় বাঙালিদের মতো দেখতে ও একই ভাষায় কথা বলেন, সেহেতু এখানে মিশে যাওয়া তাদের জন্য সহজ। বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে অবস্থিত বনগাঁ এলাকার ২৫ বছর বয়সী সামিরা হোসেন জানালেন, তিনি যৌনকর্মী হতে চান! তার বাবা মারা গেছেন, মা অসুস্থ। সংসারে আছে ২ স্কুলপড়ুয়া ভাই। তাই সংসারের উপার্জনের কাজটা তাকেই করতে হবে। তিনি বলেন, আমি টাকা আয় করতে চাই। আমি তেমন পড়ালেখা করিনি। আমার এক বন্ধু জানালো, এখানে এসে আমরা ভালো অর্থ আয় করতে পারবো। তাই আমি সোনাগাছিতে এসেছি এবং আমি সত্যিই একজন যৌনকর্মী হতে চাই। সীমান্তের কাছে অবস্থিত গ্রামগুলোর বেশির ভাগ মেয়ে মাত্র দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। তাদের ভাইয়েরা হয়তো সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। তারালি গ্রামের রেশমা বিবির বিয়ে হয়েছিল ১৭ বছর বয়সে। তিনি হেসে জানান, ধান চাষে আমি আমার স্বামীকে সাহায্য করি। আমরা একদিন কিছু জমির মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখি। তবে আশাব্যঞ্জক ব্যতিক্রম কদাচিৎ দেখা যায়। যেমন রেশমার প্রতিবেশী ২১ বছর বয়সী কাকন চক্রবর্তী ভূগোলে মাস্টার্স করছেন। তিনি জানালেন, আমি ও আমার ছোট বোন যখন ছোট ছিলাম তখন আমার মা মারা যান। আমার পিতা এরপর আমাদেরকে নানীর ঘরে রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। আমার বোন বর্ধমানে লেখাপড়া করছে। সেখানে এক আন্টির কাছে থাকছে সে। চক্রবর্তীর গল্প উৎসাহব্যঞ্জক হলেও, কেবলই একটি ব্যতিক্রম। দারিদ্র্য ও উন্নত জীবনের প্রত্যাশা সীমান্তের নারীদের প্রান্তসীমায় এনে দাঁড় করিয়েছে। কম্যুনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার সংসদ সদস্য ও মুখপাত্র মোহাম্মদ সেলিম এ প্রসঙ্গে বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিষ্কার অভাব রয়েছে। একই সঙ্গে ব্যবস্থাপনায় রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। দারিদ্র্যের কারণে আমাদের নারীরা সরবরাহ আর চাহিদার কলুষিত এক চক্রে আটকে পড়ছে। কলুষিত? জিজ্ঞেস করে নাজিয়া। এটা বললে সমস্যাকে খাটো করে দেখা হবে। আমাকে এখন কেউই বিয়ে করবে না। আমার শিক্ষাজীবন শেষ। কোন আশা নেই। আপনার কোন ধারণাই নেই আমার জীবনটা আসলে কেমন। কষ্টমিশ্রিত হাসি নিয়ে কথাগুলো বলছিল নাজিয়া আজম।
(বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী মানুষের জীবনযাত্রা আর বাস্তবতা নিয়ে খালিজ টাইমসের তিন অংশের সিরিজ প্রতিবেদনের তৃতীয় ও শেষ অংশের অনুবাদ)
No comments