এ দেশের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সর্বনাশ করল কে? by মুহম্মদ জাফর ইকবাল

আমি জানি এ মুহূর্তে দেশের মানুষ এই প্রশ্নের উত্তরে খালেদা জিয়ার নাম বলবে। দেশের মানুষকে দোষ দেয়া যাবে না, কারণ টানা হরতালের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের। যারা কট্টর বিএনপি কিংবা জামায়াতপন্থী তারা অবশ্যই গলার রগ ফুলিয়ে বলবে, সব দোষ এই সরকারের। এ সরকার যদি গোয়ার্তুমি না করত তাহলেই তো পেট্রলবোমা ফাটাতে হতো না, হরতাল ডাকতে হতো না। রাজনীতির মাঠের ব্যাপারগুলো আমি মোটেও বুঝি না। মান্না-খোকার টেলিফোন আলাপটি প্রকাশ হওয়ার পর বলা যেতে পারে আমি প্রথমবার মাঠের রাজনীতি খানিকটা বুঝতে পেরেছি। মাঠের রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের কী হচ্ছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না এবং আপাতদৃষ্টিতে আমাদের কাছে যেটাকে খুবই খারাপ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়, মাঠের রাজনীতিতে সেটা আসলে হয়তো খুবই ভালো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত! এই যে আমরা ভাবছি, দিনের পর দিন হরতাল ডেকে দেশের যাবতীয় সর্বনাশ করার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বারোটা বাজিয়ে দিয়ে বিএনপি ধীরে ধীরে সবার মন বিষিয়ে দিচ্ছে, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, সেটা হয়তো শুধু আমাদের ধারণা। বিএনপির নেতানেত্রীরা হয়তো মনে করছেন, এটা আসলে প্রায় ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের মতো বিশাল মহান একটি সফল আন্দোলন। কাজেই এসব ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই, দর্শক হিসেবে পুরো ব্যাপারটা দেখা ছাড়া আর কোনো কিছু করারও নেই। কোনো কিছু বলার ও করার না থাকলেও কিছু কিছু বিষয় মনে করিয়ে দেয়া যেতে পারে। এসএসসি পরীক্ষার সময় হরতাল না দেয়ার জন্য মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী অনেক অনুনয়-বিনয় করেছেন, বলা যেতে পারে আক্ষরিক অর্থে শুধু পা ধরতে বাকি রেখেছেন; কিন্তু বিএনপির (এবং তাদের সঙ্গে থাকা অন্য দলগুলোর) মন গলেনি। দিনের পর দিন হরতাল ডাকা হয়েছে এবং একটার পর একটা পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে, পিছিয়ে দিতে হয়েছে। প্রায় ১৫ লাখ কিশোর-কিশোরী তাদের ৩০ লাখ বাবা-মা এবং কোটিখানেক আপনজন গত দুই মাস নিয়মিতভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেদের ভাগ্যকে অভিশাপ দিয়েছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রায় একই সময়ে ও-লেভেল পরীক্ষার তারিখ পড়েছিল এবং তখন কিন্তু তাদের পরীক্ষার জন্য অবরোধে ছাড় দেয়া হয়েছিল! (২১ জানুয়ারি ২০১৫, বিডিনিউজ২৪.কম) আমার প্রশ্নটি খুবই সহজ, যারা ও-লেভেল (কিংবা এ-লেভেল) পরীক্ষা দিচ্ছে তারাও বাংলাদেশের ছেলেমেয়ে, বিএনপি তাদের জন্য যদি ছাড় দিতে পারে তাহলে বাংলাদেশের অন্য ছেলেমেয়েদের জন্য কেন ছাড় দেয়া হবে না? বরং বলা যেতে পারে, যারা এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে সংখ্যায় তারা অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, তাদের মাঝে আছে এ দেশের মধ্যবিত্ত-নিুমধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েরা, মফস্বল আর গ্রামের ছেলেমেয়েরা। আমি ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তা করে হাল ছেড়ে দিয়েছি, বিষয়টি হয়তো বোঝার জন্য খুবই সহজ; কিন্তু গ্রহণ করার জন্য খুবই কঠিন। এই দেশ যারা চালায় এবং অচল করে রাখে, দুই দলের কর্তাব্যক্তিরাই আসলে উচ্চবিত্তের মানুষ। তাদের ছেলেমেয়েরা সম্ভবত এসএসসি পরীক্ষা দেয় না, তারা সম্ভবত ইংরেজি মিডিয়ামে ও-লেভেল, এ-লেভেলে পড়ে। কাজেই দেশ যদিও বা গোল্লায় যায়, অন্তত নিজেদের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষাটা যেন ঠিকমতো দেয়া যায় সেজন্য এই ব্যবস্থা। কিন্তু আমি যেটুকু জানি তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি, ইংরেজি মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরাও প্রায় সমানভাবে ভুগছে।
যাই হোক, এটুকু ছিল আমার ভূমিকা, এবারে আসল বক্তব্যে আসি।
২.
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যেভাবে দেশের লেখাপড়াকে আক্ষরিত অর্থে পঙ্গু করার সংগ্রামে নেমেছেন, সেটাকে তাদের দলের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র পেট্রলবোমার আক্রমণের সঙ্গে তুলনা করা যায় (যারা বিএনপির রাজনীতি সমর্থন করেন, তারা সম্ভবত আমি এককভাবে একজনের নাম উল্লেখ করায় একটু বিরক্ত হচ্ছেন, কারণ কাগজে কলমে এটি ২০টি ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত, একজনকে দায়ী করা ঠিক নয়। কিন্তু আমরা সবাই জানি, যদিও পুরো আন্দোলনটি করা হচ্ছে গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য, কিন্তু এই দলগুলোতে গণতন্ত্রের ‘গ’কেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবকিছুই একজনের সিদ্ধান্ত, সেজন্য আমিও একজনের নাম লিখছি)। পেট্রলবোমা যে রকম খুব দ্রুত একজনকে ধরাশায়ী করে ভয়ংকর যন্ত্রণা দিতে পারে, ঠিকভাবে পোড়াতে পারলে আক্রান্ত মানুষটি খুব কষ্ট পেয়ে মারা যায় এবং যদি কোনোভাবে বেঁচে যায় তাহলে যে রকম সারাজীবনের জন্য একটা ক্ষতচিহ্ন বহন করতে হয়, হরতাল-অবরোধ দিয়ে লেখাপড়াকে আক্রমণ করাটাও অনেকটা সে রকম। সপ্তাহের পাঁচ দিন স্কুল-কলেজে না গিয়ে মাত্র দু’দিনে ক্লাস পরীক্ষা নেয়ার চেষ্টা করলে খুব দ্রুত সেই একই রকম ক্ষতি হয়। যদি বা শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দিয়ে ছেলেমেয়েরা পাস করেও ফেলে, এই দীর্ঘ দুই মাসের ক্ষতিটুকু কিন্তু তাদের সারাজীবন বহন করতে হবে।
তবে আমি আজকে লেখাপড়ার ওপর এই নিষ্ঠুর আক্রমণের কথা বলার জন্য কাগজ কলম নিয়ে বসিনি, আমি সবার অগোচরে লেখাপড়ার ওপর যে ‘স্লো পয়জনিং’ হচ্ছে তার কথা বলতে বসেছি। তবে মূল বক্তব্যের আগে আমাকে একটু পুরনো ইতিহাস বলতে হবে।
সেই যখন থেকে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়ে শিক্ষক হয়েছি, তখন থেকে আমি জানি একজন ছেলে বা মেয়ে কী শিখেছে তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার শেখার আগ্রহ আছে কি-না, শেখার ক্ষমতা আছে কি-না সেই বিষয়টি। এ দেশের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে আমার দুঃখের সীমা ছিল না। লেখাপড়ার নামে তাদের কিছু জিনিস মুখস্থ করানো হতো, পরীক্ষার হলে গিয়ে সেটা তাদের উগলে দিতে হতো। পড়াশোনার পুরো বিষয়টা ছিল খুব কষ্টের, কারণ মানুষের মস্তিষ্ক মোটেও কোনো কিছু মুখস্থ করার জন্য তৈরি হয়নি। মানুষের মস্তিষ্ক তৈরি হয়েছে বোঝার জন্য, জানার জন্য কিংবা বিশ্লেষণ করার জন্য। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মনে রাখার বিষয়টা মানুষের থেকে ভালো পারে শিম্পাঞ্জিরা!
তাই প্রথম যখন সৃজনশীল পদ্ধতির পরীক্ষার বিষয়টি সামনে এসেছিল, আমার আনন্দের সীমা ছিল না (তখন অবশ্য সেটাকে বলা হতো কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন পদ্ধতি; কিন্তু কাঠামোবদ্ধ নামটাকে কেমন যেন কটমটে মনে হয়েছিল বলে এর নামটাকে পাল্টে সৃজনশীল করে দেয়া হয়েছিল)। যাই হোক, সৃজনশীল প্রশ্নের মূল বিষয়টা ছিল খুবই সহজ। এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য আর কখনও ছাত্রছাত্রীদের কিছু মুখস্থ করতে হবে না। তারা যদি পুরো বইটা মন দিয়ে পড়ে তাহলেই হবে, প্রশ্নগুলোর উত্তর তারা ভেবে ভেবে দিতে পারবে। নতুন কিছু শুরু করা খুবই কঠিন, এখানেও সেটা দেখা গেল। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি শুরু করা মাত্রই অভিভাবকরা এর পেছনে লেগে গেলেন। স্বার্থপর অভিভাবকদের একটা মাত্র কথা- ‘স্বীকার করি এটা খুবই ভালো পদ্ধতি, কিন্তু আমার ছেলে কিংবা মেয়ে আগের পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে যাক, তারপর এই পদ্ধতি প্রবর্তন করা হোক।’ তারা সৃজনশীল পদ্ধতির বিরুদ্ধে রীতিমতো আন্দোলন শুরু করেছিলেন। আমার মনে আছে, আমরা যারা ছাত্রছাত্রীদের মুখস্থ করার যন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করার এই সুযোগটা পেয়ে লুফে নিয়েছিলাম, তারা সবাই মিলে সেটাকে রক্ষা করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গিয়েছিলাম। রীতিমতো যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত সারা পৃথিবীর ছেলেমেয়েরা যে পদ্ধতিতে (Bloom's Taxonomy) লেখাপড়া করে, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরাও সেই পদ্ধতিতে লেখাপড়া করার এবং পরীক্ষা দেয়ার একটা সুযোগ পেল। অন্যদের কথা জানি না, আমি খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন এই ছেলেমেয়েগুলোকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নিজের ছাত্রছাত্রী হিসেবে পাব। কারণ এই ছাত্রগুলোর মস্তিষ্ক থাকবে সতেজ, তীক্ষ্ণ ও সৃজনশীল, মুখস্থ করিয়ে করিয়ে সেগুলোকে ভোঁতা করিয়ে দেয়া হবে না।
কিছুদিনের ভেতরে আমি প্রথম দুঃসংবাদটি পেলাম, সেটি হচ্ছে সৃজনশীল প্রশ্নের গাইডবই বের হয়ে গেছে। খবরটি ছিল আমার কাছে অবিশ্বাস্য, কারণ সৃজনশীল প্রশ্নটাই করা হয়েছে যেন ছাত্রছাত্রীদের আর প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করতে না হয় সেজন্য। তার থেকেও আরও ভয়াবহ ব্যাপার ঘটতে থাকল, শুধু যে বাজারে গাইডবই বের হতে থাকল তা নয়, আমাদের দেশের বড় বড় পত্রিকাগুলোও ‘শিক্ষাপাতা’ বা এ ধরনের নাম দিয়ে তাদের পত্রিকায় গাইডবই ছাপাতে শুরু করল! এগুলো হচ্ছে সেই পত্রিকা যারা এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। দেশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রীতিমতো সংগ্রাম করে, পত্রিকার মূল কাজ সংবাদ ছাপানোর পাশাপাশি তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান আর্ট-কালচার নিয়ে ঠেলাঠেলি করে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য জান কোরবান করে দেয়। আমার খুব ইচ্ছে এসব পত্রিকার ‘মহান’ সম্পাদকদের সঙ্গে কোনোদিন মুখোমুখি বসে জিজ্ঞেস করি, তারা কেমন করে এ দেশের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এত বড় প্রতারণা করেন? (আমার মনে আছে, আমি কোনো একটি লেখায় এ ধরনের একটা পত্রিকার গাইডবইয়ের উদাহরণটি তুলে জিজ্ঞেস করেছিলাম, যদি গাইডবই ছাপানো বেআইনি হয় তাহলে পত্রিকায় গাইডবই ছাপানো কেন বেআইনি হবে না? আমরা কেন এই পত্রিকাগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারব না?)।
যাই হোক, বাজারে এবং দৈনিক পত্রিকায় গাইডবই বের হওয়ার পর থেকে অনেক শিক্ষকই স্কুলের পরীক্ষায় এই গাইডবই থেকে প্রশ্ন তুলে নিতে শুরু করলেন। সেসব শিক্ষকের ছাত্রছাত্রীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল- একসময় শুধু পাঠ্যবইয়ের প্রশ্নগুলোর উত্তর ‘মুখস্থ’ করলেই চলত, এখন এর সঙ্গে সঙ্গে তাদের পুরো গাইডবইয়ের প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করা শুরু করতে হল। আমি পড়লাম মহাবিপদে, এ দেশের ছেলেমেয়েদের অনেকেই জানে আমি এই সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি যেন শুরু হতে পারে তার জন্য অনেক চেঁচামেচি করেছি। তারা সরাসরি আমাকে অভিযোগ করতে শুরু করল। আমি তখন তাদের বুঝিয়ে বলতাম, যদি দুই নম্বরী শিক্ষক হয় তাহলে সৃজনশীল গাইডবই পড়ে হয়তো স্কুলের পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া সম্ভব হতে পারে, কিন্তু পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি কিংবা এইচএসসি’র প্রশ্নগুলো কখনোই কোনো গাইডবই থেকে আসবে না। পরীক্ষার আগে এ প্রশ্নগুলো প্রথমবার তৈরি করা হবে। কাজেই যারা গাইডবই মুখস্থ করবে, সত্যিকারের পরীক্ষায় তাদের কোনোই লাভ হবে না। বরং উল্টো ব্যাপার ঘটবে, মুখস্থ করে করে পরীক্ষা দেয়ার কারণে তারা আসল পরীক্ষাগুলোতে নিজে নিজে ভাবনাচিন্তা করে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাবে।
এতদিন আমি ছাত্রছাত্রীদের এভাবে বুঝিয়ে এসেছি এবং তারাও আমার যুক্তি মেনে নিয়েছে। এ বছর হঠাৎ করে আমি প্রথমবার সত্যিকারের বিপদে পড়েছি। আমার কাছে একজন এসএসসি’র বাংলা প্রশ্নপত্র পাঠিয়েছে, সেই প্রশ্নে গাইডবই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দেয়া আছে। প্রমাণ হিসেবে সে গাইড বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোও ফটোকপি করে দিয়েছে। ২০১৪ সালে যখন এইচএসসি’র প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে শুরু করল, তখন কিছুতেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্বীকার করতে রাজি হয়নি যে ব্যাপারটি আসলেই ঘটেছে। আমি এবারে এসএসসি’র প্রশ্ন এবং গাইডবইয়ের প্রশ্ন পাশাপাশি দিয়ে দিচ্ছি, পাঠকরা নিজের চোখেই দেখতে পাবেন। শুধু এই দুটি নয় আরও অনেক প্রশ্ন আছে, লেখার শেষে আমি লিংক দিয়ে দিচ্ছি, যার ইচ্ছে ডাউনলোড করে সেগুলো নিজের চোখে দেখে নিতে পারবেন।
এর চেয়ে ভয়ংকর কোনো ব্যাপার কি কেউ কল্পনা করতে পারবে? যারা গাইডবই ছাপায়, আনন্দে তাদের বগল বাজানোর শব্দ কি সবাই শুনতে পাচ্ছেন? সেই শব্দ কি শিক্ষা বোর্ড বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় পর্যন্ত পৌঁছাবে? এই গাইডবই বিক্রেতারা কি এখন খবরের কাগজ, রেডিও-টেলিভিশনে বড় বড় করে বিজ্ঞাপন দিতে পারবে না? সেখানে তারা ঘোষণা করবে, ‘আমাদের গাইডবই বাজারের সেরা, এখান থেকে এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন বেছে নেয়া হয়!’
যত স্বপ্ন ও আশা নিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি শুরু করা হয়েছিল, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতার (নাকি দুর্নীতি?) কারণে এখন কি পুরো বিষয়টা অর্থহীন হয়ে দাঁড়াচ্ছে না? শিক্ষা বোর্ডের কাছে নিশ্চয়ই রেকর্ড আছে, তারা খুব ভালোভাবে জানেন কারা এই প্রশ্ন করেছে। আমরা কি আশা করতে পারি না, যেসব প্রশ্নকর্তা এ দেশের লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীর লেখাপড়ার পুরোপুরি সর্বনাশ করে দিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে একটা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে ভবিষ্যতে যেন আর কখনোই এ রকম ঘটনা না ঘটে তার একটা গ্যারান্টি দেবেন? যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে, তাদের কখনও ধরা যায়নি; কিন্তু যারা গাইডবই থেকে প্রশ্ন নিয়ে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন করেন, তাদের ধরতে তো কোনো সমস্যা নেই। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী যেভাবে জোড়হাত করে খালেদা জিয়ার কাছে অনুরোধ করেছিলেন এসএসসি পরীক্ষার সময় হরতাল না দিতে, আমি ঠিক একইভাবে জোড়হাত করে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করব এসএসসি পরীক্ষায় গাইডবই থেকে প্রশ্ন তুলে না দিতে।
৩.
গাইডবই থেকে তুলে দেয়া প্রশ্ন দিয়ে তৈরি করা এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নের পাশাপাশি ভিন্ন আরও একটি প্রশ্নপত্র আমার হাতে এসেছে। এই প্রশ্নটি জাতীয় কারিকুলামে ইংরেজি মাধ্যমের পদার্থ বিজ্ঞানের প্রশ্নপত্র। প্রশ্নপত্রটির খানিকটা অংশ আমি এ লেখার সঙ্গে যুক্ত করে দেয়ার চেষ্টা করেছি জানি না সেটা পত্রিকায় দেখানো সম্ভব হবে কি-না। লেখার শেষে আমি এটারও লিংক দিয়ে দিচ্ছি- যে কেউ সেটা ডাউনলোড করে পুরোটা দেখে নিতে পারবেন।
এসএসসি পরীক্ষায় গাইডবই থেকে নেয়া প্রশ্ন দেখে আমি ক্ষুব্ধ হয়েছি; কিন্তু ইংরেজিতে লেখা পদার্থ বিজ্ঞানের এ প্রশ্নটি দেখে লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেছে। একটা এত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় ইংরেজি ভাষার এই নমুনা দেখেও আমার বিশ্বাস হতে চায় না, কেমন করে শিক্ষা বোর্ড ছাত্রছাত্রীদের হাতে এ প্রশ্ন তুলে দিল? প্রতিটি প্রশ্ন ভুল ইংরেজিতে লেখা। ছোটখাটো ভুল নয়, উৎকট ভুল। যেমন- Who is invented air pump? How many power of an electric fan? Which mirror use of solar oven? ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রশ্নটি দেখেই বোঝা যায় এটি আসলে চরম হেলাফেলার একটা উদাহরণ। ইংরেজি কারিকুলামে প্রশ্ন করার জন্য শুদ্ধ ইংরেজি লিখতে পারে এ রকম একজন শিক্ষকও এ দেশে নেই, তা হতে পারে না। এর অর্থ, যারা এর দায়িত্বে আছেন তাদের লজ্জাশরম বলে কিছু নেই! আমরা যারা এটা দেখি তারা লজ্জায় মুখ দেখাতে পারি না, আর যারা এ কাজটি করেন তারা একটুও লজ্জা পান না, বরং বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ান!
লেখার শুরুতে বলেছিলাম, খালেদা জিয়া তার দলবল নিয়ে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার যে ক্ষতি করেছেন সেটা পুষিয়ে নেয়া যাবে কি-না আমরা জানি না।
সেই সঙ্গে আমি সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই, খালেদা জিয়ার মতো রাতারাতি সর্বনাশ না করলেও খুব ধীরে ধীরে এ দেশের শিক্ষার সর্বনাশ করার কাজটি কিন্তু করে যাচ্ছে যাদের ওপর আমরা এ দেশের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার দায়িত্ব দিয়েছি, তারাই!
আবার হাতজোড় করে বলছি, বাঁচান! আমাদের ছেলেমেয়েদের সর্বনাশ থেকে বাঁচান।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; লেখক

No comments

Powered by Blogger.