পুড়ছে মানুষ জ্বলছে দেশ by আব্দুল কাইয়ুম

গতকাল ভোররাতে গুপ্ত ঘাতকেরা কুমিল্লায় বাসে পেট্রলবোমা মেরে কি নৃশংসভাবেই না সাতজন যাত্রীকে পুড়িয়ে মারল। এর আগের দিন ওরা গাজীপুরে চলন্ত ট্রেনেও পেট্রলবোমা মেরে পাঁচজনকে আগুনে পুড়িয়েছে। মনে হয় হরতাল-অবরোধের মধ্য দিয়েই আরও বেশ কিছুদিন চলতে হবে। এ অবস্থায় আমাদের বিনীত আবেদন, অন্তত পেট্রলবোমা ছুড়বেন না। আর রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলবেন না। কারণ, এগুলো কোনো রাজনীতি না। স্রেফ মানুষ খুন করা। এগুলো বন্ধ করুন। সহিংস রাজনীতির এই অস্ত্রটি যেভাবেই হোক বন্ধ করতে হবে। কোনো সভ্য দেশে রাজনীতির নামে পেট্রলবোমা ছুড়ে নিরীহ মানুষ মারা হয় না। এভাবে কি রাজনৈতিক দাবি আদায় করা যায়? গতকাল পর্যন্ত ৩০ দিনের অবরোধে অন্তত ৫৩ জন নিহত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে পেট্রলবোমা ও আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ৩১ জন। নিহত ব্যক্তিদের সবাই সাধারণ মানুষ। পেট্রলবোমা মেরে তাঁদের হত্যা করার কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি সবাই সমর্থন করে। এ জন্য দরকার গণসমাবেশ। প্রবল জনমত। এগুলোই হবে প্রধান রাজনৈতিক অস্ত্র। এভাবে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করলে কারও আপত্তি থাকবে না। কিন্তু পেট্রলবোমা কেন? যে আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে করার কথা, সে আন্দোলন কেন সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে? সরকারের তো কিছু হচ্ছে না। পুড়ে মরছে মানুষ। নষ্ট হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি। এই দেশ, এই মানুষ কি শুধু সরকারের? বিরোধী দলের নয়? পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে এক একটা সংসার। অনেক সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ পেট্রলবোমায় মারা যাচ্ছেন। এই গরিব মানুষদের পুড়িয়ে মারার অধিকার কারও নেই।
একইভাবে রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে মানুষ মারার আরেক জঘন্য পথ ধরেছে হরতাল-অবরোধকারীরা। এটাও একেবারে ঠান্ডা মাথায় খুন। রাতের অন্ধকারে কেন রেললাইনের নাটবল্টু খুলে রাখা হবে? এগুলো সন্ত্রাসীদের কাজ। একে রাজনীতি বলা যায় না। খুনোখুনি চলছে। এসব বন্ধ করতে হবে।
বিএনপি বলবে তাদের সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয় না, তাহলে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন কীভাবে করবে? খুবই যুক্তিসংগত কথা। বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি না দিয়ে সরকার অন্যায় করেছে। সরকারের অনুমতি পায়নি বলে ওরা সমাবেশ করতে পারেনি। মানে বিএনপি খুব আইন মেনে চলে। আইনের প্রতি তাদের যদি এতই আনুগত্য, তাহলে ওরা পেট্রলবোমা মারছে কেন? এটা কি আইন সমর্থন করে? এটা তো খুনোখুনি।
তার চেয়ে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিএনপি যদি নয়াপল্টনে তাদের কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করত। বলত, সরকারের অন্যায় মানি না। যদি জোর করে সমাবেশ করত, সেটা কি পেট্রলবোমার চেয়ে ভালো হতো না? কিন্তু বিএনপি সেই প্রথাগত রাজনীতির পথে না গিয়ে সন্ত্রাসের রাজনীতির পথ গ্রহণ করেছে। এটাই তাদের বড় ভুল। রাজনীতি করতে হবে মানুষকে সঙ্গে নিয়েই। সেখানে সন্ত্রাসীদের সহায়তায় নাশকতার কোনো স্থান নেই।
বিএনপি নিশ্চয়ই বলবে, নয়াপল্টনে তালা, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে তালা। পুলিশ দিয়ে ঘেরাও। যে যাচ্ছে তাকেই গ্রেপ্তার। এ অবস্থায় কীভাবে ওরা জোর করে সমাবেশ করবে। মানুষকে তো জড়ো হতেই দিচ্ছে না। সন্দেহ নেই যে এগুলো সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা। বলপ্রয়োগে রাজনীতি দমনের অপচেষ্টা করে অতীতে কেউ সফল হয়নি। এ কথা আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি ভালো আর কে জানে। তার পরও সরকার সেই অভিশপ্ত পথে চলছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক।
কিন্তু এ রকম দমননীতির মুখেও যে গণসমাবেশ-আন্দোলন করা যায়, সে তো এই হাল আমলেও দেখা গেছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ করে বিএনপি প্রায় একই কায়দায় আওয়ামী লীগের সমাবেশ, মিছিল দমন করার পথ নিয়েছিল। তখন বেগম মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিমসহ আরও কত নেতাকে পিটিয়ে ঠান্ডা করে দিয়েছিল বিএনপির সরকার। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের অন্তত ২২ জন নেতা-কর্মীকে মেরে ফেলা হলো। এ কারণে তো তখন আওয়ামী লীগ বাসে পেট্রলবোমা মারেনি। সাধারণ মানুষ হত্যা করেনি। সরকারের অনুমতির তোয়াক্কা না করে সেদিন ওরা সভা-সমাবেশ তো কম করেনি। আন্দোলন তো থেমে থাকেনি।
তারও আগে ছিল আওয়ামী লীগের সরকার। তখনো সে সময়ের বিরোধী দল বিএনপির বিরুদ্ধে প্রায় একই ধরনের নির্যাতন চালানো হয়েছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিএনপি হরতাল ডাকলেই সরকার তাদের নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় শুরু করত। একবার পুলিশের ছররা গুলিতে বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন খোকার সারা দেহ রক্তাক্ত হলো। সেই নির্যাতনের মুখেও তো বিএনপি গণ-আন্দোলনের পথ ছেড়ে পেট্রলবোমা তুলে নেয়নি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, বিএনপি বা আওয়ামী লীগ, কেউ আগে পেট্রলবোমার রাজনীতি করেনি। আমাদের দেশে কখনো এমন অমানবিক আন্দোলন হয়নি। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য কখনো এমন নৃশংসভাবে সাধারণ মানুষ মারা হয়নি। হয়তো বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটা নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এবারের মতো এমন ব্যাপক হারে পেট্রলবোমা মারা হয়নি। এটা নতুন। দেখা দরকার কীভাবে এই বিষ আমাদের রাজনীতিতে ঢুকল।
এটা কেবল সেসব লোকই করতে পারে, মানুষের জন্য যাদের কোনো দরদ নেই। দেশের জন্য দরদ থাকলে কোনো দল রাজনীতির নামে এমন নৃশংসতা করতে পারে না।
সুনির্দিষ্টভাবে বললে বলতে হয়, এই উপদ্রবটি এসেছে গত চার-পাঁচ বছরে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াত-শিবির চক্র সক্রিয় হয়ে নাশকতার রাজনীতি জোরদার করেছে। আগে রগকাটা, গলাকাটার রাজনীতি চলত। এবার এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পেট্রলবোমা। রেললাইনে নাশকতা।
সরকার ও বিএনপি এখন রেষারেষির পর্যায়ে চলে গিয়েছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। এ রকম পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। কারণ, একদিকে সরকার ক্রমেই পুলিশের ওপর আরও বেশি হারে নির্ভরশীল হচ্ছে। আর অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বে ২০-দলীয় জোটও পেট্রলবোমা-রেললাইনে নাশকতা আরও জোরেশোরে চালাতে শুরু করেছে। এই সর্বনাশা পথ থেকে সরে আসতে হবে। কিন্তু কীভাবে?
সবাই বলছেন, আলোচনা। একমাত্র আলোচনা ও রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমেই এই অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা যাবে। এটা ঠিক। কিন্তু সবাই বোঝেন ও জানেন যে, দুই পক্ষের কেউই এখনই সমঝোতার আলোচনায় বসতে রাজি নয়। ওরা শেষ দেখতে চায়। শেষ দেখতে দেখতে সবকিছু শেষ হয়ে গেলেও বোধ হয় তাদের আপত্তি নেই। কিন্তু এটা হবে এক আত্মঘাতী পথ।
তাহলে কি আমাদের চোখের সামনে জ্বলেপুড়ে সব শেষ হয়ে যাবে? না। উপায় আছে। বিশ্বে এমন কোনো সমস্যা নেই, যা সমাধানের অযোগ্য। আজকের রাজনৈতিক হিংসা, হানাহানি থেকে বেরিয়ে আসারও পথ আছে। খোলা মন ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা থাকলে সবই সম্ভব।
শুরু করতে হবে এভাবে। প্রথমে পেট্রলবোমা বন্ধ। রেললাইনে নাশকতা বন্ধ। এ দুটি বিষয়ে বিএনপির আপত্তি থাকার কথা নয়। কারণ যেখানে নাশকতা, সেখানে জনসমর্থন নেই। অন্যদিকে একই সঙ্গে বন্ধ করতে হবে বিএনপির বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন। বিএনপির চেয়ারপারসনের বাসায় বিদ্যুতের লাইন কাটা, টেলিফোন, ডিশ-লাইন, ওয়াইফাই লাইন কাটা, গেটে তালা, এসব নিম্নমানের কারসাজি একেবারে বন্ধ। সরকার যদি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মুক্তি দেয়, সভা-সমাবেশে বাধা না দেয়, তাহলে পরিস্থিতি অনেকটাই সহনীয় হয়ে আসবে। এরপর হয়তো আলোচনার একটা পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে এ বছর ফেব্রুয়ারির এই ভাষামাসের প্রথম দিনটি শুরু হয়েছে ৭২ ঘণ্টার হরতাল দিয়ে। বায়ান্নর ভাষাশহীদদের কথা স্মরণ করে কি এই মাসটি হরতাল-অবরোধের বাইরে রাখা যেত না? মহান একুশের এই মাসে আমরা ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাব, ফুলে ফুলে ভরে দেব শহীদ মিনার। সেটাও কি অবরোধের মধ্যেই করতে হবে? যারা একুশের শক্তি সম্পর্কে সচেতন নয়, জানে না কী ভীষণ শক্তি ধারণ করে এই ভাষার মাস, ওরাই কেবল ভাষার মাসের অসম্মান করতে পারে।
মহান একুশকে সামনে রেখে সরকার ও বিরোধী দল যেন রাজনৈতিক হানাহানির অবসান ঘটায়। এতে হয়তো দুই পক্ষকে দু-এক কদম পিছিয়ে আসতে হবে। কিন্তু দেশ এগিয়ে যাবে বেশ কয়েক কদম।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.