পেট্রলবোমায় ওদের স্বপ্ন পুড়ে ছাই by রুদ্র মিজান
‘জমি
বন্ধক রেখে ভিসার টাকা দিছি ভাই। এতগুলো টাকার কি হবে। আমারে বিদেশে যেতে
হবে। বিদেশে না গেলে আমার বউ, বাচ্চার কি হবে? আমার ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার
হয়ে যাবে। আমার পাসপোর্ট কই। আপা, আমার পাসপোর্টটা দেন।’ বিড়বিড় করে
কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের
নিবিড় পর্যবেক্ষণ বিভাগে চিকিৎসাধীন রাশেদুল ইসলাম। কক্সবাজার থেকে বাসযোগে
ঢাকায় যাওয়ার পথে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হন তিনি। এ
ঘটনায় নিহত হয়েছেন সাতজন। রাশেদসহ দগ্ধ ছয়জনকে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন
ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। রাশেদুল ইসলামসহ তার সঙ্গী তিনজন ছিলেন কাতারগামী।
বুধবার ছিল তাদের ফ্লাইট। বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে এসেছিলেন তারা। কিন্তু
কাতার যাওয়া হয়নি এ তিন ব্যক্তির। পেট্রলবোমা শুধু তাদের দগ্ধ করেনি, জীবন
কেড়ে নিয়েছে রাশেদের চাচা কাতারগামী মোহাম্মদ ইউসুফসহ অপর এক ব্যক্তির।
অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন রাশেদ। ভাই ইউসুফ ও ভাইপো
রাশেদকে বিমানবন্দরে বিদায় জানাতে সঙ্গে এসেছিলেন মুহাম্মদ হানিফ। তিনিও
দগ্ধ হয়েছেন। তাদের আত্মীয় আবদুর রশিদ জানান, বুধবার রাশেদ, ইউসুফসহ
তিনজনের ফ্লাইট ছিল। রাশেদ ছাড়া বাকি দুজনই মারা গেছেন। রাশেদের অবস্থাও
আশঙ্কাজনক। রাশেদের শরীরের ৮০ ভাগ দগ্ধ হয়েছে। হানিফের সাত ভাগ। আবদুর রশিদ
বলেন, জমি বন্ধক রেখে ভিসার টাকা দিয়েছেন তারা। আগুনে পাসপোর্ট, ভিসা সবই
গেছে। টাকা তো গেছেই। ইউসুফের জীবন গেছে। এখন রাশেদের জীবন নিয়ে টানাটানি।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ইউসুফ ও রাশেদের স্ত্রী-সন্তানদের কি হবে?
তাদের পাশে কে দাঁড়াবে? নেতারা কেন এ অস্থিরতার সমাধান করছেন না? এভাবে আর
কত মানুষের জীবন নষ্ট হবে? একগাদা প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি। স্বজনরা জানান,
রাশেদুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়া থানার প্রহরচান্দা
গ্রামে। তার পিতা মৃত সৈয়দ আহমদ। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি বড়।
রাশেদের স্ত্রীর নাম সুমি আক্তার। তাদের তিন বছর বয়সী এক পুত্রসন্তান
রয়েছে। একই এলাকার বাসিন্দা মুহাম্মদ হানিফের পিতার নাম সালেহ আহমদ।
সৌদি আরব যাওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছিল মানিকগঞ্জের বাসিন্দা জিলকদের। দেশ ছাড়ার আগে বন্ধুদের সঙ্গে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। ফেরার পথে অন্যদের সঙ্গে দগ্ধ হয়েছেন তিনিও। জিলকদের বাবা জহিরুল ইসলাম জানান, কৃষিজমির আয় দিয়ে টেনেটুনে সংসার চালাতে হয়। এজন্য জিলকদকে সৌদিতে পাঠানোর বন্দোবস্ত করেছিলেন তিনি। সৌদি যাওয়ার আগে জিলকদ তার বন্ধুদের সঙ্গে কক্সবাজার বেড়াতে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হন তিনি। এখন সৌদি যাওয়া তো দূরের কথা ২০ ভাগ পোড়া শরীর নিয়ে হাসপাতালে কাতরাতে হচ্ছে তাকে। সচ্ছল জীবনযাপনের স্বপ্ন তাদের ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে। জিলকদের শরীরের ২০ ভাগ দগ্ধ হয়েছে। জহিরুল জানান, দুই সন্তানের মধ্যে জিলকদ ইসলাম বড়। জিলকদের সঙ্গে দগ্ধ হয়েছেন বন্ধু শরীফও। শরীফের শরীরের দুই ভাগ দগ্ধ হয়েছে। তাদের বাড়ি মানিকগঞ্জের শিঙ্গাইর থানার কমলনগর গ্রামে। শরীফের পিতার নাম আবদুস সালাম।
বাসের মধ্যে ঘুমিয়ে ছিলেন ফরিদপুরের বাসিন্দা আরিফ শিকদার। ‘আগুন আগুন’ চিৎকার শুনে তার ঘুম ভাঙে। চোখ খুলে দেখেন, তার দুই পাশের দুই জানালার গ্লাস ভেঙে বের হচ্ছিলেন পাশের সিটের যাত্রীরা। তার চোখের সামনেই পুড়ে মরছেন কেউ কেউ। তারপর অনেক চেষ্টা করে জানালা দিয়ে নিজের মুখটা বের করে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করেন আরিফ। বাইরে থেকে কেউ একজন তাকে টেনে বের করেন। এর চেয়ে বেশি কিছু আর মনে নেই তার। আরিফ জানান, অভিমান করে পাঁচ দিন আগে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান তার ছোট ভাই সজীব শিকদার। বিদেশে যাওয়ার বিষয় নিয়ে বাড়িতে ঝগড়া করেছিল সজীব। তাই মালয়েশিয়াগামী ট্রলারডুবির পর থেকে মা-বাবা ছিলেন দুশ্চিন্তায়। তাদের ধারণা, সজীব ওই ট্রলারে থাকতে পারে। মা-বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারেন না আরিফ। তাই হরতাল-অবরোধ উপেক্ষা করে নিখোঁজ ভাইকে খুঁজতে কক্সবাজারে ছুটে যান তিনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও নিখোঁজ ভাইয়ের সন্ধান মেলেনি। বরং ফেরার পথে দগ্ধ হয়ে এখন হাসপাতালে কাতরাতে হচ্ছে নিজেকেই। তার শরীরের ১০ ভাগ দগ্ধ হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় ফোনে মা-বাবাকে জানিয়েছেন, সজীবকে খুঁজে পাননি। তিনি বাড়ি চলে আসবেন। রাত ৯টায় আল-হামরা পরিবহনের একটি টিকিট কিনেন আরিফ। পরে ওই পরিবহন কর্তৃপক্ষ তাদের বাস না ছেড়ে আইকন ইউলো লাইনের বাসে তাদের সব যাত্রীকে তুলে দেন। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম পেরোতে গিয়ে পেট্রলবোমায় পুড়ে ছাই হয়ে যায় বাস। আরিফ শিকদারের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার বাহ্মণপাড়া গ্রামে। তার পিতার নাম আমির আলী শিকদার। চার ভাই, তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তার একমাত্র পুত্রসন্তান মারুফের বয়স তিন বছর।
খই বিক্রি করে পাঁচ ভাই, দুই বোনের সংসার চালাতেন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম। গত ২৩ দিন তিনি কক্সবাজারে ছিলেন। সেখানে খই বিক্রি শেষে ফেরার পথে ওই ঘটনায় দগ্ধ হন তিনি। শফিকুলের চাচা মনির হোসেন বলেন, রাজনৈতিক এই অস্থিরতায় পেট তো আর থেমে থাকে না। খেতে হয়। পেটের দায়ে হরতাল-অবরোধ উপেক্ষা করেই শফিকুল কক্সবাজারে যায়। এখন তার কি হবে, কে দাঁড়াবে আমাদের মতো গরিবদের পাশে। তিনি জানান, শফিকুলের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানার কাফিকান্দি গ্রামে। তার পিতা আলাউদ্দিন একজন রিকশাচালক। দগ্ধ যাত্রীরা জানান, তারা সবাই আইকন ইউলো লাইনের বাসের যাত্রী ছিলেন। রাত সাড়ে ১০টায় বাসটি কক্সবাজার থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগমোহনপুর এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দুর্বৃত্তরা এতে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে। এতে ঘটনাস্থলেই সাতজন নিহত হন। আহত হন অন্তত ২৫, যাদের ১০ জনই দগ্ধ হয়েছেন।
ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থ শঙ্কর পাল জানান, কুমিল্লায় পেট্রলবোমায় দগ্ধ ছয়জনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। তাদের সবার শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি জানান, অবরোধ শুরুর পর এ পর্যন্ত বার্ন ইউনিটে সেবা নিয়েছেন ১০১ জন। নিহত হয়েছেন সাতজন। ভর্তি আছেন ৬১ জন।
সৌদি আরব যাওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছিল মানিকগঞ্জের বাসিন্দা জিলকদের। দেশ ছাড়ার আগে বন্ধুদের সঙ্গে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। ফেরার পথে অন্যদের সঙ্গে দগ্ধ হয়েছেন তিনিও। জিলকদের বাবা জহিরুল ইসলাম জানান, কৃষিজমির আয় দিয়ে টেনেটুনে সংসার চালাতে হয়। এজন্য জিলকদকে সৌদিতে পাঠানোর বন্দোবস্ত করেছিলেন তিনি। সৌদি যাওয়ার আগে জিলকদ তার বন্ধুদের সঙ্গে কক্সবাজার বেড়াতে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হন তিনি। এখন সৌদি যাওয়া তো দূরের কথা ২০ ভাগ পোড়া শরীর নিয়ে হাসপাতালে কাতরাতে হচ্ছে তাকে। সচ্ছল জীবনযাপনের স্বপ্ন তাদের ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে। জিলকদের শরীরের ২০ ভাগ দগ্ধ হয়েছে। জহিরুল জানান, দুই সন্তানের মধ্যে জিলকদ ইসলাম বড়। জিলকদের সঙ্গে দগ্ধ হয়েছেন বন্ধু শরীফও। শরীফের শরীরের দুই ভাগ দগ্ধ হয়েছে। তাদের বাড়ি মানিকগঞ্জের শিঙ্গাইর থানার কমলনগর গ্রামে। শরীফের পিতার নাম আবদুস সালাম।
বাসের মধ্যে ঘুমিয়ে ছিলেন ফরিদপুরের বাসিন্দা আরিফ শিকদার। ‘আগুন আগুন’ চিৎকার শুনে তার ঘুম ভাঙে। চোখ খুলে দেখেন, তার দুই পাশের দুই জানালার গ্লাস ভেঙে বের হচ্ছিলেন পাশের সিটের যাত্রীরা। তার চোখের সামনেই পুড়ে মরছেন কেউ কেউ। তারপর অনেক চেষ্টা করে জানালা দিয়ে নিজের মুখটা বের করে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করেন আরিফ। বাইরে থেকে কেউ একজন তাকে টেনে বের করেন। এর চেয়ে বেশি কিছু আর মনে নেই তার। আরিফ জানান, অভিমান করে পাঁচ দিন আগে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান তার ছোট ভাই সজীব শিকদার। বিদেশে যাওয়ার বিষয় নিয়ে বাড়িতে ঝগড়া করেছিল সজীব। তাই মালয়েশিয়াগামী ট্রলারডুবির পর থেকে মা-বাবা ছিলেন দুশ্চিন্তায়। তাদের ধারণা, সজীব ওই ট্রলারে থাকতে পারে। মা-বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারেন না আরিফ। তাই হরতাল-অবরোধ উপেক্ষা করে নিখোঁজ ভাইকে খুঁজতে কক্সবাজারে ছুটে যান তিনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও নিখোঁজ ভাইয়ের সন্ধান মেলেনি। বরং ফেরার পথে দগ্ধ হয়ে এখন হাসপাতালে কাতরাতে হচ্ছে নিজেকেই। তার শরীরের ১০ ভাগ দগ্ধ হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় ফোনে মা-বাবাকে জানিয়েছেন, সজীবকে খুঁজে পাননি। তিনি বাড়ি চলে আসবেন। রাত ৯টায় আল-হামরা পরিবহনের একটি টিকিট কিনেন আরিফ। পরে ওই পরিবহন কর্তৃপক্ষ তাদের বাস না ছেড়ে আইকন ইউলো লাইনের বাসে তাদের সব যাত্রীকে তুলে দেন। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম পেরোতে গিয়ে পেট্রলবোমায় পুড়ে ছাই হয়ে যায় বাস। আরিফ শিকদারের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার বাহ্মণপাড়া গ্রামে। তার পিতার নাম আমির আলী শিকদার। চার ভাই, তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তার একমাত্র পুত্রসন্তান মারুফের বয়স তিন বছর।
খই বিক্রি করে পাঁচ ভাই, দুই বোনের সংসার চালাতেন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম। গত ২৩ দিন তিনি কক্সবাজারে ছিলেন। সেখানে খই বিক্রি শেষে ফেরার পথে ওই ঘটনায় দগ্ধ হন তিনি। শফিকুলের চাচা মনির হোসেন বলেন, রাজনৈতিক এই অস্থিরতায় পেট তো আর থেমে থাকে না। খেতে হয়। পেটের দায়ে হরতাল-অবরোধ উপেক্ষা করেই শফিকুল কক্সবাজারে যায়। এখন তার কি হবে, কে দাঁড়াবে আমাদের মতো গরিবদের পাশে। তিনি জানান, শফিকুলের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানার কাফিকান্দি গ্রামে। তার পিতা আলাউদ্দিন একজন রিকশাচালক। দগ্ধ যাত্রীরা জানান, তারা সবাই আইকন ইউলো লাইনের বাসের যাত্রী ছিলেন। রাত সাড়ে ১০টায় বাসটি কক্সবাজার থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগমোহনপুর এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দুর্বৃত্তরা এতে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে। এতে ঘটনাস্থলেই সাতজন নিহত হন। আহত হন অন্তত ২৫, যাদের ১০ জনই দগ্ধ হয়েছেন।
ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থ শঙ্কর পাল জানান, কুমিল্লায় পেট্রলবোমায় দগ্ধ ছয়জনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। তাদের সবার শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি জানান, অবরোধ শুরুর পর এ পর্যন্ত বার্ন ইউনিটে সেবা নিয়েছেন ১০১ জন। নিহত হয়েছেন সাতজন। ভর্তি আছেন ৬১ জন।
No comments