ধর্ম, দেশ, সমাজ ও সংস্কৃতি by তানজীনা ইয়াসমিন চৌধুরী
শুরুতেই
বলা ভালো, আমি ইসলামিক স্কলার নই। তবুও ধর্মের ক্ষেত্রে দেশ ও
সংস্কৃতিভেদে কিছু খুঁটিনাটি বিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভ ও পর্যবেক্ষণের সুযোগ
পেয়েছি। আমার বর্তমান বসবাস জাপানে, যেখানে অধিকাংশ মানুষ ধর্মবিমুখ। তাদের
কিছু নির্দোষ প্রশ্ন তুলে ধরা যাক। যেমন_ আমাকে বলা হলো, 'অমুক তো
কেক-ব্রেড, সর্টেনিংযুক্ত (প্রাণীজ ফ্যাট) কেক খায় না, ম্যাকডোনাল্ডসের
খাবার খায় না। তোমরা খাও কেন? তোমরা কি অন্যরকম মুসলমান? অন্য গোত্র?'
বললাম, না, না, ইসলামে কোনো ক্লাস ডিভিশন নেই। 'তাহলে কি ও ভালো মুসলমান,
তোমরা খারাপ মুসলমান?' আরেক দিনের ঘটনা_ ফিসফিস করে আমাকে দেখিয়ে আমার
জাপানিজ প্রফেসর কাম ডিরেক্টরকে ক্লায়েন্টের প্রশ্ন : মেয়েটা মিসরীয়, ইরানি
না তুর্কি? না না, বাংলাদেশি। বাংলাদেশি! বাংলাদেশি মেয়ে এমন মাথা ঢাকা
সুট পরে? মঙ্গোলিয়ান ধাঁচের চেহারা হলে দূরপ্রাচ্যের কোনো দেশের ধরে নিত।
কারণ, ওদের কেউ কেউ টি-শার্ট, টপস, এমনকি শেপড গেঞ্জির সঙ্গেও মাথায়
স্কার্ফ দিয়ে 'হিজাব' পরে। আরেকজন বলছিলেন_ 'রাস্তায় সেদিন বাঙালি এক
পরিবারকে দেখেছি সাইকেল চালিয়ে যেতে।' কোন এলাকায়? 'গাক্কেনতসি।'
গাক্কেনতসিতে তো এমন কোনো বাঙালি নেই! কেন মনে হলো যে ওরা বাঙালি? 'তোমার
মতো মাথা ঢাকা ছিল!'
আমি নিশ্চিত, প্রবাসী বাঙালি নারীদের কমবেশী এ জাতীয় প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হয়। বিশেষ করে জাপানের মতো দেশে। এ ধরনের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস থেকেই অনেক মেয়ে প্রবাস জীবনে হিজাব পরতে শুরু করে। উদাহরণ আমি নিজেই। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম। ১০ বছর থেকে পাঞ্জেগানা নামাজ, রোজা ফরজ; কামিজ-ওড়না বাধ্যতামূলক, স্কুল-কলেজে যাওয়ার সময় হিজাব পরেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠেই বিয়ে হয়ে গেল, স্বামী বা আমি নিজেও কেন যেন আর তাগিদ অনুভব করলাম না হিজাবের। সেই তাগিদ পেলাম প্রবাস জীবনে। না, নিজের দেশের মতো রাস্তাঘাটে নোংরা দৃষ্টি থেকে বাঁচতে নয়। উপলব্ধি থেকে।
জাপানে আমাদের ছোট্ট শহরেই ৩০টির মতো দেশের মুসলিম দেখে নিজেই খুঁজতে শুরু করলাম, কেন আমাদের দেশে 'হিজাব' এত কম? কেন একেক দেশে হিজাবের রূপ একেক রকম? একটা দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ধর্মকে কতটা প্রভাবিত করে? সর্বোপরি আল কোরআনে হিজাবের নির্দেশনা কী দেওয়া আছে? খুব অল্প কথায় সুনির্দিষ্টভাবে আল কোরআনে সুরা আল নূরের আয়াত ৩০-৩১ এবং সুরা আহজহাবের আয়াত ৫৮-৫৯-এ 'মুসলিম নারী-পুরুষ' উভয়কেই শালীন পোশাক পরিধানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরিষ্কারভাবে প্রথমেই পুরুষের পর্দার কথা বলা হয়েছে। চোখ (দৃষ্টিকে অবনত) ও মনের পর্দা করতে। এরপর নারীর প্রতিও বলা হয়েছে, দৃষ্টিকে অবনত করতে, মনের পর্দা করতে এবং অতঃপর শরীরের পর্দা করতে। শরীরের পর্দা হবে এমন যে, নারীর সহজাত বা জন্মগত সৌন্দর্য ও সাধারণ অলঙ্কার (আটপৌরে ব্যবহার্য) ছাড়া অন্য কিছুই স্বামী এবং মাহরাম ব্যতীত কারও সামনে প্রদর্শিত হবে না। এখানে মাহরাম কারা তাও পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে। মাহরাম তারাই, যাদের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক নিষিদ্ধ।
কাজেই বয়ঃপ্রাপ্ত ছেলে এবং মেয়ে উভয়কে সমানভাবে এর প্রয়োজনীয়তা একেবারে নিজের উপলব্ধি, উদাহরণ দিয়ে না বুঝিয়ে জোর করে মেয়েটাকে ধরে খালি বোরকা পরিয়ে দিলে চলবে না। কিংবা শুধু মেয়ের ব্যাপারে দায়িত্ব পালন করে ছেলের চোখ, মন, দেহের পর্দার ব্যাপারে উদাসীন থাকলেও হিতে বিপরীতই হবে। আর ছেলেমেয়েতে এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা বৈপরীত্য আরেক প্রশ্নের জন্ম দেবে! মেয়ে দেখবে তার ভাই একটা ইভ টিজার আর বাবা-মা সেটা আমলেই আনেন না। এমন বাবা-মা কি মেয়ের কাছে যথাযথ সম্মান আশা করতে পারেন? উপরন্তু আপনার মেয়েই রাস্তায় একইভাবে অন্য যে ছেলে এমন শিক্ষা পায়নি তার দ্বারা অসম্মানিত হবে। তাই যার যার ঘর থেকেই শিক্ষা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উদ্যোগ নিতে হবে ধর্মীয় অনুশাসনেই।
মনে পড়ে যায় আমার দোতলায় থাকা থাই মুসলিম পরিবারের কথা। সদ্যজাত কন্যাসন্তান দেখতে গেছি_ দিন সাতেকের বাচ্চা। মাথায় হিজাব_ শরীরে শুধুই ডায়াপার! কারণ কী? মেয়ে না? হিজাব তো করতে হবে! এই হলো দেশভেদে হিজাবের ধারণা!
মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশের প্রতিবেশী বান্ধবী, ৫ সন্তান ও স্বামীসহ হজ করেছেন। আমাকে দেখলে আড্ডার শেষে অবশ্যই বলত_ 'কেন তুমি হিজাব করো না? কেন তুমি সাজসজ্জা করো?' কিন্তু আড্ডার ফাঁকে নামাজের সময় হলে আমি বাড়ি যাওয়ার জন্য উসখুস শুরু করতে করতে তার নির্বিকার ভাব দেখে এক পর্যায়ে ওয়াক্ত চলে যাওয়ার আগে বাড়ি চলে আসতাম। নামাজ পড়ে পার্কে গিয়ে দেখতাম নামাজের ওয়াক্ত পার হয়ে গেলেও তিনি পার্কেই আছেন! আমি খুব অবাক হতাম যে, ইসলামের মূল পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে হলো নামাজ। আর হিজাব স্রেফ আরও অনেক ফরজের মধ্যে অন্যতম! মূল স্তম্ভের ৫ ফরজের চেয়ে দৃশ্যমান ফরজের প্রতি এত গুরুত্ব!
আল্লাহ কোনো কিছুতেই বাড়াবাড়ি পছন্দ করেন না, মুসলিম মাত্রেরই তা জানা উচিত। বাংলাদেশের সমাজের প্রসঙ্গে আসি। বঙ্গের উৎস বিবেচনায় খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সাল থেকে বাংলাভাষী দ্রাবিড়, তিব্বতীয় ব্রাহ্মণদের পদচারণায় জাগ্রত এই ভূমিতে খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ থেকে ময়ুর, গৌড়, পাল সাম্রাজ্য পর্যন্ত চলল বৌদ্ধ শাসনামল। ১০৭০ সাল থেকে ১২০৪ পর্যন্ত স্থানীয় হিন্দু সেন শাসনামল। ১২০৪ সালে তুর্কি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি দিলি্লর সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেকের পৃষ্ঠপোষকতায় শাসক লক্ষণ সেনকে পরাস্ত করে মুসলিম শাসনামল শুরু করেন। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পর্যুদস্তের পর ব্রিটিশ শাসন শুরু হয় বাংলায়। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লবের পর পাকাপাকিভাবে ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া স্থাপিত হয়, শুরু হয় ব্রিটিশরাজ। এরপরের ইতিহাস সবার জানা।
লক্ষ্য করুন, আমাদের শাসকেরা (পাল শাসকরা ব্যতীত) কখনোই স্বদেশী বা বাঙালি ছিলেন না। কাজেই, তাদের মাধ্যমে যুগে যুগে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির পলিমাটি আমাদের সংস্কৃতিতে গোড়াপত্তন করে গেছে। আর ভারতবর্ষ ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে ভারত-পাকিস্তান হওয়ারও অনেক আগে বাংলাভাষীদের ভিত্তিতে লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ করেছিলেন। পরে তা-ই দেশভাগের সময় পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব বাংলা হয়েছে। কাজেই, আমরা আদতে আগে বাঙালির পরিচিতি পেয়েছি। অনেক পরে পেয়েছি মুসলমানের পরিচিতি। আমাদের সংস্কৃতিতেও তারই প্রতিফলন।
আরও অনুঘটক ছিল। ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন অপব্যাখ্যাজনিত অন্ধত্বের কারণে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা জ্ঞানচর্চায় ইংরেজদের সাহচর্যে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। তাদের এগিয়ে যাওয়া প্রগতিশীল, সংস্কারমুক্ত মুসলিমদের অনেক অনুপ্রাণিত করেছে। কেউ কেউ পূর্ণ পশ্চিমা কেতায় চলতে চেয়েছে বা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য জাতিকে অনুসরণ করতে চেয়েছে। অবশ্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বেগম রোকেয়ার মতো অনেকেই স্বমহিমায় ভাস্বর ছিলেন নিজের শিকড়বিচ্যুত না হয়েই। ফলে বাঙালি মুসলিমের নিজস্ব সংস্কৃতি ও পোশাক নিয়ে একটি বিভ্রান্তি ও অস্পষ্টতা থেকেই গেছে।
অন্যদিকে পরবর্তীকালে মাদ্রাসার ধর্মীয় শিক্ষায় সাধারণত পরিবারের সবচেয়ে কম বুদ্ধিসম্পন্ন ছেলেদের পাঠানো হতো। তাদের অন্য কোথাও ভবিষ্যৎ নেই বলেই আশঙ্কা হতো। ধর্মীয় বিভিন্ন ব্যাখ্যা তাদের মাধ্যমেই আমরা পেয়েছি। কিন্তু ধর্মের সঙ্গে নিজস্ব সংস্কৃতির প্রয়োজনের বিষয়টি তারা কতটা ব্যাখ্যা করতে পেরেছিল?
মসজিদের শহর ঢাকায় জন্মানো ও বেড়ে ওঠা আমি জীবনেও কোনো মসজিদের সীমানা প্রাচীর ডিঙাতে পারিনি, অনুমোদন ছিল না। আর জাপানে এসে ৩০টিরও বেশি মুসলিম দেশের নারীদের সঙ্গে মসজিদকেন্দ্রিক নানা কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখতে কোনো বাধা নেই। মসজিদ আমার কাছে এখন নিষিদ্ধ কোনো জায়গা নয়। এখানে দেখেছি, অফিসের ড্রেসকোড ও হিজাবের মধ্যে কীভাবে সামঞ্জস্য বিধান করা যায়। দেখেছি মেয়ে হয়েও কীভাবে ঘরের ভেতরে ও বাইরে নিদ্বর্িধায় কাজ করা যায়।
আমি নিশ্চিত, প্রবাসী বাঙালি নারীদের কমবেশী এ জাতীয় প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হয়। বিশেষ করে জাপানের মতো দেশে। এ ধরনের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস থেকেই অনেক মেয়ে প্রবাস জীবনে হিজাব পরতে শুরু করে। উদাহরণ আমি নিজেই। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম। ১০ বছর থেকে পাঞ্জেগানা নামাজ, রোজা ফরজ; কামিজ-ওড়না বাধ্যতামূলক, স্কুল-কলেজে যাওয়ার সময় হিজাব পরেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠেই বিয়ে হয়ে গেল, স্বামী বা আমি নিজেও কেন যেন আর তাগিদ অনুভব করলাম না হিজাবের। সেই তাগিদ পেলাম প্রবাস জীবনে। না, নিজের দেশের মতো রাস্তাঘাটে নোংরা দৃষ্টি থেকে বাঁচতে নয়। উপলব্ধি থেকে।
জাপানে আমাদের ছোট্ট শহরেই ৩০টির মতো দেশের মুসলিম দেখে নিজেই খুঁজতে শুরু করলাম, কেন আমাদের দেশে 'হিজাব' এত কম? কেন একেক দেশে হিজাবের রূপ একেক রকম? একটা দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ধর্মকে কতটা প্রভাবিত করে? সর্বোপরি আল কোরআনে হিজাবের নির্দেশনা কী দেওয়া আছে? খুব অল্প কথায় সুনির্দিষ্টভাবে আল কোরআনে সুরা আল নূরের আয়াত ৩০-৩১ এবং সুরা আহজহাবের আয়াত ৫৮-৫৯-এ 'মুসলিম নারী-পুরুষ' উভয়কেই শালীন পোশাক পরিধানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরিষ্কারভাবে প্রথমেই পুরুষের পর্দার কথা বলা হয়েছে। চোখ (দৃষ্টিকে অবনত) ও মনের পর্দা করতে। এরপর নারীর প্রতিও বলা হয়েছে, দৃষ্টিকে অবনত করতে, মনের পর্দা করতে এবং অতঃপর শরীরের পর্দা করতে। শরীরের পর্দা হবে এমন যে, নারীর সহজাত বা জন্মগত সৌন্দর্য ও সাধারণ অলঙ্কার (আটপৌরে ব্যবহার্য) ছাড়া অন্য কিছুই স্বামী এবং মাহরাম ব্যতীত কারও সামনে প্রদর্শিত হবে না। এখানে মাহরাম কারা তাও পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে। মাহরাম তারাই, যাদের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক নিষিদ্ধ।
কাজেই বয়ঃপ্রাপ্ত ছেলে এবং মেয়ে উভয়কে সমানভাবে এর প্রয়োজনীয়তা একেবারে নিজের উপলব্ধি, উদাহরণ দিয়ে না বুঝিয়ে জোর করে মেয়েটাকে ধরে খালি বোরকা পরিয়ে দিলে চলবে না। কিংবা শুধু মেয়ের ব্যাপারে দায়িত্ব পালন করে ছেলের চোখ, মন, দেহের পর্দার ব্যাপারে উদাসীন থাকলেও হিতে বিপরীতই হবে। আর ছেলেমেয়েতে এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা বৈপরীত্য আরেক প্রশ্নের জন্ম দেবে! মেয়ে দেখবে তার ভাই একটা ইভ টিজার আর বাবা-মা সেটা আমলেই আনেন না। এমন বাবা-মা কি মেয়ের কাছে যথাযথ সম্মান আশা করতে পারেন? উপরন্তু আপনার মেয়েই রাস্তায় একইভাবে অন্য যে ছেলে এমন শিক্ষা পায়নি তার দ্বারা অসম্মানিত হবে। তাই যার যার ঘর থেকেই শিক্ষা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উদ্যোগ নিতে হবে ধর্মীয় অনুশাসনেই।
মনে পড়ে যায় আমার দোতলায় থাকা থাই মুসলিম পরিবারের কথা। সদ্যজাত কন্যাসন্তান দেখতে গেছি_ দিন সাতেকের বাচ্চা। মাথায় হিজাব_ শরীরে শুধুই ডায়াপার! কারণ কী? মেয়ে না? হিজাব তো করতে হবে! এই হলো দেশভেদে হিজাবের ধারণা!
মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশের প্রতিবেশী বান্ধবী, ৫ সন্তান ও স্বামীসহ হজ করেছেন। আমাকে দেখলে আড্ডার শেষে অবশ্যই বলত_ 'কেন তুমি হিজাব করো না? কেন তুমি সাজসজ্জা করো?' কিন্তু আড্ডার ফাঁকে নামাজের সময় হলে আমি বাড়ি যাওয়ার জন্য উসখুস শুরু করতে করতে তার নির্বিকার ভাব দেখে এক পর্যায়ে ওয়াক্ত চলে যাওয়ার আগে বাড়ি চলে আসতাম। নামাজ পড়ে পার্কে গিয়ে দেখতাম নামাজের ওয়াক্ত পার হয়ে গেলেও তিনি পার্কেই আছেন! আমি খুব অবাক হতাম যে, ইসলামের মূল পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে হলো নামাজ। আর হিজাব স্রেফ আরও অনেক ফরজের মধ্যে অন্যতম! মূল স্তম্ভের ৫ ফরজের চেয়ে দৃশ্যমান ফরজের প্রতি এত গুরুত্ব!
আল্লাহ কোনো কিছুতেই বাড়াবাড়ি পছন্দ করেন না, মুসলিম মাত্রেরই তা জানা উচিত। বাংলাদেশের সমাজের প্রসঙ্গে আসি। বঙ্গের উৎস বিবেচনায় খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সাল থেকে বাংলাভাষী দ্রাবিড়, তিব্বতীয় ব্রাহ্মণদের পদচারণায় জাগ্রত এই ভূমিতে খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ থেকে ময়ুর, গৌড়, পাল সাম্রাজ্য পর্যন্ত চলল বৌদ্ধ শাসনামল। ১০৭০ সাল থেকে ১২০৪ পর্যন্ত স্থানীয় হিন্দু সেন শাসনামল। ১২০৪ সালে তুর্কি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি দিলি্লর সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেকের পৃষ্ঠপোষকতায় শাসক লক্ষণ সেনকে পরাস্ত করে মুসলিম শাসনামল শুরু করেন। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পর্যুদস্তের পর ব্রিটিশ শাসন শুরু হয় বাংলায়। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লবের পর পাকাপাকিভাবে ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া স্থাপিত হয়, শুরু হয় ব্রিটিশরাজ। এরপরের ইতিহাস সবার জানা।
লক্ষ্য করুন, আমাদের শাসকেরা (পাল শাসকরা ব্যতীত) কখনোই স্বদেশী বা বাঙালি ছিলেন না। কাজেই, তাদের মাধ্যমে যুগে যুগে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির পলিমাটি আমাদের সংস্কৃতিতে গোড়াপত্তন করে গেছে। আর ভারতবর্ষ ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে ভারত-পাকিস্তান হওয়ারও অনেক আগে বাংলাভাষীদের ভিত্তিতে লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ করেছিলেন। পরে তা-ই দেশভাগের সময় পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব বাংলা হয়েছে। কাজেই, আমরা আদতে আগে বাঙালির পরিচিতি পেয়েছি। অনেক পরে পেয়েছি মুসলমানের পরিচিতি। আমাদের সংস্কৃতিতেও তারই প্রতিফলন।
আরও অনুঘটক ছিল। ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন অপব্যাখ্যাজনিত অন্ধত্বের কারণে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা জ্ঞানচর্চায় ইংরেজদের সাহচর্যে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। তাদের এগিয়ে যাওয়া প্রগতিশীল, সংস্কারমুক্ত মুসলিমদের অনেক অনুপ্রাণিত করেছে। কেউ কেউ পূর্ণ পশ্চিমা কেতায় চলতে চেয়েছে বা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য জাতিকে অনুসরণ করতে চেয়েছে। অবশ্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বেগম রোকেয়ার মতো অনেকেই স্বমহিমায় ভাস্বর ছিলেন নিজের শিকড়বিচ্যুত না হয়েই। ফলে বাঙালি মুসলিমের নিজস্ব সংস্কৃতি ও পোশাক নিয়ে একটি বিভ্রান্তি ও অস্পষ্টতা থেকেই গেছে।
অন্যদিকে পরবর্তীকালে মাদ্রাসার ধর্মীয় শিক্ষায় সাধারণত পরিবারের সবচেয়ে কম বুদ্ধিসম্পন্ন ছেলেদের পাঠানো হতো। তাদের অন্য কোথাও ভবিষ্যৎ নেই বলেই আশঙ্কা হতো। ধর্মীয় বিভিন্ন ব্যাখ্যা তাদের মাধ্যমেই আমরা পেয়েছি। কিন্তু ধর্মের সঙ্গে নিজস্ব সংস্কৃতির প্রয়োজনের বিষয়টি তারা কতটা ব্যাখ্যা করতে পেরেছিল?
মসজিদের শহর ঢাকায় জন্মানো ও বেড়ে ওঠা আমি জীবনেও কোনো মসজিদের সীমানা প্রাচীর ডিঙাতে পারিনি, অনুমোদন ছিল না। আর জাপানে এসে ৩০টিরও বেশি মুসলিম দেশের নারীদের সঙ্গে মসজিদকেন্দ্রিক নানা কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখতে কোনো বাধা নেই। মসজিদ আমার কাছে এখন নিষিদ্ধ কোনো জায়গা নয়। এখানে দেখেছি, অফিসের ড্রেসকোড ও হিজাবের মধ্যে কীভাবে সামঞ্জস্য বিধান করা যায়। দেখেছি মেয়ে হয়েও কীভাবে ঘরের ভেতরে ও বাইরে নিদ্বর্িধায় কাজ করা যায়।
প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়, ফুকুওকা, জাপান
No comments