সংলাপ-সমঝোতার জন্য আকুতি
এ
এক দুঃসহ-অসহায় সময়। অবরোধ-হরতাল। ভাঙচুর, আগুন, পেট্রলবোমা, ক্রসফায়ার।
মারা যাচ্ছে মানুষ। কেউ বোমায়, কেউ গুলিতে। বার্ন ইউনিটে আর্তনাদ। আহাজারি
ক্রসফায়ারে নিহতদের স্বজনদেরও। অবরুদ্ধ অর্থনীতির চাকা। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত
কৃষক আর শ্রমজীবী মানুষ। রাজনীতিবিদরা যথারীতি অনড়। কিন্তু জনগণ যাবে
কোথায়? রাজনীতির সবচেয়ে বড় শিকার তারা। যদিও রাজনীতিবিদরা সবই করেন জনগণের
নামে। দমবন্ধ পরিস্থিতিতে কি ভাবছেন মানুষ। কি চান তারা? মানবজমিন
রিপোর্টাররা কথা বলেছেন, নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে। সবাই একবাক্যে
বলছেন, তারা চলমান অচলাবস্থা থেকে মুক্তি চান, তারা বাঁচতে চান, তারা
স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি
জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি আকুতি জানিয়েছেন তারা। তাদের চাওয়া, দুই
নেত্রী যেন সংলাপে বসেন এবং সমঝেতায় পৌঁছান। আমাদের রিপোর্টার
রোকনুজ্জামান পিয়াস, হামিদ বিশ্বাস, সিরাজুস সালেকিন ও ফররুখ মাহমুদ তুলে
এনেছেন সাধারণ মানুষের কথা।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সোহেলের বাড়ি কুমিল্লা, থাকেন ঢাকার কমলাপুরে। তিনি জানান, ব্যবসার অবস্থা ভাল না। আমরা চাই খালেদা জিয়া অবরোধ প্রত্যাহার করুক এবং শেখ হাসিনা আলোচনায় বসুক। মতিঝিলের চা দোকানি জাকির হোসেনের বাড়ি নোয়াখালী। তিনি বলেন, দেশের এ অবস্থায় আমাদের মতো গরিব-দুঃখী, দিনমজুর যারা আছি তাদের খুবই সমস্য হচ্ছে। যারা মন্ত্রী-মিনিস্টার তাদের তো কোন সমস্যা হচ্ছে না। আমি একটা চা দোকান করি, আমার ওপর নির্ভর করে সংসার চলে। কিন্তু এখন যে কিভাবে চলতেছি? তিনি বলেন, আমরা চাই তারা দু’জন বসে এর সমধান করুক। মো. বিল্লাল হোসেন, বাড়ি সাতক্ষীরা, থাকেন গোলাপবাগ রেলগেট। পেশায় জেনারেটর অপারেটর। তিনি বলেন, তারা রেষারেষি করতেছে। কেউ কাউকে ছাড় দেয়ার পাত্র না। অবস্থাটা ভাল মনে হচ্ছে না। এ অবস্থায় যারা ক্ষমতায় আছে বা যারা ক্ষমতায় যাবে তাদের যে কোন একজনকে ছাড় দেয়া লাগবো। উভয়দলের যারা নেতানেত্রী আছে তারা যদি চিন্তাভাবনা করে- আমাদের কারণে মানুষ মারা যাচ্ছেÑ এ চিন্তা করে যদি আলোচনায় বসে তবে দেশের জন্য ভাল হবে। বরিশালের গৌরনদীর স্থায়ী বাসিন্দা সেনাকল্যাণ সংস্থার স্টাফ মো. হানিফ থাকেন মতিঝিলেই। ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেন, দেশের বর্তমান অবস্থা আমি কারো কাছে বলবো না, আর বলতেও চাই না। দেশে সরকার আছে, কি করবে না করবে তারাই জানে। সরকারি চাকরিজীবী মো. ইউনূচের বাড়ি চিটাগাং, থাকেন ফকিরাপুল। তিনি বলেন, আসলে মন্তব্য যে কি করি? মাঝখানে আমরা জনগণ বেকায়দায় পড়ে গেছি। আমার মনে হয় দু’জন বসে একটা সমঝোতায় আসা উচিত। শাসনতো তারাই করবে। আজকে যে করতেছে, আগামীদিন আরেকজন করবে। ঘুরেফিরে তো এরাই করবে। তাই বসে আলোচনা করা উচিত, জনগণ যেন একটু শান্তিতে থাকতে পারে। পাবনার মতিন থাকেন মুগদা। পেশায় রিকশাচালক। তিনি বলেন, দেশের অবস্থা তো দেখতেছেন। দেশটা খাইলো তো দুইজন। আগে দেখা যেত রাতের বেলা রিকশা চালিয়ে ভাড়া দিয়েও ৩০০ টাকা থাকতো। আর এখন সারাদিন ভাড়া মেরেও ১০০ টাকা থাকে না। এখন দুইজনকে বসে আলাপ আলোচনা করে দেশটাকে ভাল করা লাগবো। আলাপ-আলোচনা করে যেটা ভাল হয় সেইটাই করা লাগবো।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের গ্রাহক অমল সাহা জানান, তিনি পেশায় একজন ব্যবসায়ী। রাজধানীর ইসলামপুরে তার থান কাপড়ের দোকান রয়েছে। ছোট আকারের দু’টি দোকানে কর্মচারীদের বেতন, দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎসহ যাবতীয় খরচ আছে দেড় লাখ টাকা। প্রায় এক মাস ধরে চলা অবরোধে বিক্রি শূন্যের কোঠায় নেমেছে। তাই দেড় লাখ টাকা খরচই এখন লোকসান হয়ে ঘাড়ে চেপে বসেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, দুনিয়ার কোথাও থেকে এ দেশ শিক্ষা নেয় না। এখানে চর্চা হয় পারস্পরিক গোঁয়ার্তুমি। সরকার ও বিরোধী দলের কর্মকা-ে মনে হয় না তারা সাধারণ মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করেন। যদিও উভয় দল দাবি করে আসছে- তাদের দু’কোণায় অনড় দাঁড়িয়ে থাকার লক্ষ্য শুধুই জনগণ। অমল সাহা তাদের এ দাবিকে ডাহা মিথ্যা বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সংলাপ, আলোচনা ও সমঝোতা কিছই বুঝিনা; মুক্তি চাই-বাঁচতে চাই।
মতিঝিল এলাকায় কথা হয় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এসএম শাহজাহান এর সঙ্গে, তিনি বলেন, এ দেশের মানুষ, নেতা কেউ ভাল না। উভয় দলকে বসা উচিত। কিন্তু বসেও কি সুফল আসবে, সংশয় তার। তিনি বলেন, একমাস আগে দেশে আসি। এসেই দেখি দেশ অচল। যুক্তরাষ্ট্রফেরত এ প্রবাসী ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে বলেন, নির্ধারিত সময়ের আগেই চলে যাচ্ছি।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আলী আকবর জানান, নির্বাচন হোক আর না হোক আসুন, বসুন, কথা বলুন। দেশে-বিদেশে সবাই বলছে সংলাপে বসতে। সংলাপে বসতে তাদের সমস্যা কোথায়? আবদুর রহমান শিবলু। ছাত্র। যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়ে। গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন বুকে নিয়ে। কিন্তু এখানে এসে দেখে হরতাল আর অবরোধ। সাধারণত হরতালে রাজধানীর স্কুলগুলোতে ক্লাস হয় না। আবদুর রহমানের দাবি, অবরোধে ক্লাস হলেও গত কয়েক দিনের হরতালে তার ৫ দিন ক্লাস হয়নি। সে বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পেতে চায়। ইডেন ও সিটি কলেজের দু’শিক্ষার্থী মুক্তা ও সারা। তারা বলেন, নিরাপত্তা চাই। দয়া নয়, নাগরিক হিসেবে আমাদের নিরাপত্তা দেয়া রাষ্ট্রের কর্র্তব্য। পোল্ট্রি মুরগি ব্যবসায়ী মো. সেলিম উদ্দিন জানান, যদি তাদের রাজনীতি জনগণের জন্য হয়ে থাকে তবে তাদের সংলাপে বসা উচিত। তিনি বলেন, সব জায়গায় তাদের স্বার্থ তাহলে জনগণ কোথায়? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নাগরিক জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লিমিটেড কিন্তু জনগণ আনলিমিটেড। তিনি সতর্ক করে বলেন, সাধারণ মানুষকে যেন আর ক্ষেপানো না হয়। একটি গলি পথের দোকানি তাপস বলেন, ক্ষমতাসীন সরকারের আচরণ স্বৈরতন্ত্রের মতো মনে হচ্ছে। তিনি স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তির আহ্বান জানান।
আবদুল কাদের ফুটপাতে ব্যবসা করেন। তিনি বলেন, সরকার অথবা দল কিছুই বুঝি না। আমরা চাই বাঁচতে। সুখে-শান্তিতে ব্যবসা করতে। তিনি বলেন, ধীরে ধীরে বাঁচার সবটুকু অধিকার কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমানুল্লাহ সরকার বলেন, বেঁচে থাকার গ্যারান্টি চাই। বর্তমানে একজন নাগরিকের জীবনের কোন মূল্য নেই। মতের মিল না থাকলে তাকে ধরে নিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে এনকাউন্টার হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। মাইনুল হাসান হীরা বলেন, ঘাত-প্রতিঘাত-অপঘাত ও নির্যাতন থেকে দেশের মানুষ মুক্তি চায়। মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন বলেন, গ্রহণযোগ্য সংলাপ চাই। যেনতেন সংলাপ বহু দেখেছি। কাজে আসেনি।
মো. মাসুদ মিয়া বলেন, দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। দেশ শূন্যের উপর ভাসছে। একদিন ধপাস্ করে নিচের দিকে পড়ে যাবে। আমরা অতিষ্ঠ, চরম অতিষ্ঠ। তিনি বলেন, এ অবরোধে কোন মন্ত্রী, এমপি, নেতা মারা যায়নি। মরছে সাধারণ মানুষ। জনগণের দোহাই দিয়ে তারা রাজনীতি করলেও তাদের রাজনীতির সহিংসতার শিকার সে জনগণই। পথচারী খোরশেদ আলম বলেন, অত্যাচার-নির্যাতন থেকে বাঁচতে চাই। ব্যবসা-বাণিজ্যের সুষ্ঠু পরিবেশ চাই। রিপন। ভোলা থেকে ঢাকার শ্যামলীতে বেড়াতে এসেছেন। তিনি এলাকার মুদি দোকানি। তড়িঘড়ি করে গাড়িতে উঠে যাওয়ার সময় তিনি বলে যান, শান্তি চাই। আলম সংক্ষেপেই বললেন, হরতাল-অবরোধ এগুলোর বিপক্ষে।
সুরুজ মোল্লা। পেশায় সিএনজি চালক। মতিঝিলে রাস্তার এক পাশে মাথায় হাত দিয়ে সিএনজি’র সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সারা দিনে পেয়েছেন ৭০০ টাকা। মালিকের কাছে জমা দিতে হবে ১০৫০ ও গ্যাস বাবদ ২৫০। এতো পুরো লোকসান! জবাবে সুরুজ বলেন, এভাবে কাটছে অবরোধের দিনগুলো। বিএসএফআইসি’র ডিজিএম ছানোয়ার হোসেন বলেন, অনতিবিলম্বে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) একজন অফিসার বলেন, সংলাপ চাই। তবে তা হতে হবে যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য।
কামরুল হাসান শিপন। ফুটপাতের দোকানি। তিনি বলেন, দুই নেত্রীর বাড়াবাড়িতে ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এমন অনেক দিন যাচ্ছে। যে দিনে একটি শার্টও বিক্রি হচ্ছে না। চলমান জট খোলার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন বিকল্প নেই বলে জানান তিনি। পথচারী সুমি আক্তার বলেন, আতঙ্কে আছি। অবরোধে ঘর থেকে বের হতে পারি না। এর একটা সমাধান হওয়া উচিত।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোবারক জানান, স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক ১২০০ টাকা বিক্রি হতো। বর্তমানে হচ্ছে মাত্র ৫০০ টাকা। কষ্টে আছি। সমাধান চাই। গেঞ্জির দোকানি মো. আবদুল হাই বলেন, ধার-কর্জ করে চলছি। ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কেবলই ঋণের নিচে তলিয়ে যাচ্ছি। মাসুদ মিয়া। পেশায় রিকশাচালক। কণ্ঠ শুকিয়ে গেছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, সারা দিনে ৩০০ টাকা আয় হয়। কি করবো বুঝতে পারছি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বাবু বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যে কোন সময় বড় ধরনের বিপর্যয় আসতে পারে। রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কারণে অতীতেও এমন সমস্যা তৈরি হয়েছিল। সামরিক শাসন জারি হয়েছিল। দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। এখন দুই দলের উচিত অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করা। আরেক শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন, দেশ গৃহযুদ্ধর দিকে এগুচ্ছে।
ধর্মীয় সংঘাত, শ্রেণীগত দ্বন্দ্ব এবং এলাকাগত বৈষম্য আজ স্পষ্ট। মানুষের বাক স্বাধীনতা নেই। সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, সঙ্কট উত্তরণে রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে আলাদা করে দেখতে হবে। সাংবিধানিক পদগুলোতে রাজনৈতিক কোন প্রভাব থাকা চলবে না।
শাহনূর শাকিল বলেন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে দেশে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পারস্পরিক সহনশীলতা, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র এবং জনমতের সুষ্ঠু প্রতিফলনই এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায়। সাঈদ মিজান বলেন, আলোচনার মাধ্যমে দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সমস্যার সমাধান করতে হবে। ব্যর্থ হলে দেশ আরও গভীর সঙ্কটে পড়ে যাবে। মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী ইমন বলেন, গণতন্ত্র হত্যা এবং গণতন্ত্র রক্ষার নামে পেট্রলবোমা মেরে যে মানুষ হত্যা করছে সে ধরনের গণতন্ত্র আমরা চাই না। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী কামরুল বলেন, দেশ সঙ্কটে পড়ছে। আমরা এই সঙ্কটের সমাধান চাই। বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে নয়, সঠিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের নুরুল্লাহ বলেন, বর্তমান এই পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকলে সাধারণ মানুষ কোন দলকে নয়, বরং দেশ রক্ষার আন্দোলনে রাস্তায় নেমে পড়বে। এই রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আগেই সরকারের উচিত গঠণমূলক সংলাপের আয়োজন করা। ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী শাহেদ বলেন, বর্তমান সরকারের ১৫৪ জন অনির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। তাতে মানুষের অধিকারকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। এতে গণতন্ত্রের সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি। তাই সমস্যা সমাধানে সব দলকে সঙ্গে নিয়ে সংলাপের আয়োজন করা জরুরি। শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার বলেন, দেশে বর্তমান সঙ্কটের জন্য বিএনপি দায়ী। তারা সঠিক সময়ে নির্বাচনে না এসে এখন দেশকে অস্থিতিশীল অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। বায়জীদ খান বলেন, রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। আমরা এখন কোন রাজনৈতিক দলের অধীনে যেতে চাই না।
পলাশী বাজারের মুদি দোকানদার মো. বাবুল বলেন, শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। ঘর থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। ব্যবসার অবস্থা খারাপ। সরকার হয়তো সঙ্কট উত্তরণের জন্য চেষ্টা করছে। তবে তাদের বিএনপি’র সঙ্গে সংলাপ করেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। ফার্মেসি দোকানদার বিশ্বজিৎ বলেন, সবসময় আতঙ্কের মধ্যে থাকি। দুই পক্ষই অনড় অবস্থানে রয়েছে। এ পর্যায়ে জনগণকে সচেতন হতে হবে। তাদের অধিকার আদায়ে আরও সোচ্চার হতে হবে। নাশকতাকারীকে দমন করতে হবে। মুদি দোকানদার আবদুল ওয়াদুদ বলেন, দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়ে গেছে। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারছি না। নিজেরাও ভয়ে থাকি। সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। অভিভাবক নিলুফার ইয়াসমিন বলেন, আমার ছেলে উদয়ন স্কুলে পড়ে। রাস্তায় আতঙ্ক নিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে সবসময় সাধারণ মানুষদের ব্যবহার করে। সঙ্কটের সমাধান চাই। রিকশাচালক খালেক বলেন, সরকারের অযৌক্তিক জেদের কাছে আমরা জিম্মি। চালের দাম বেড়ে গেছে। রাস্তায় নামতে পারি না। ককটেল ও পেট্রলবোমা আতঙ্ক কাজ করে। সরকারের উচিত অনড় অবস্থান থেকে সরে আসা। ব্যবসায়ী জামাল আহমেদ বলেন, দুই দলের রেষারেষিতে আমরা সাধারণ মানুষ বিপদে পড়েছি। অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। সরকার নমনীয় হলে সমস্যার সমাধান হবে। অভিভাবক সুলতানা জামাল বলেন, শুধু বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। আর হরতাল-অবরোধ দিলেও হবে না। দুই পক্ষকে এক টেবিলে বসতে হবে। না হলে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে দুই পক্ষকেই দেশ ছাড়া করবে। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের দোকানদার জাহাঙ্গীর বলেন, একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। বিএনপি’র এমন আন্দোলনের জন্য সরকারই দায়ী। সঙ্কট নিরসনে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। রিকশাচালক কাদের বলেন, কোন রাজনীতি করি না। তারপরও রাজনীতির স্বার্থের বলি আমরা। পেটের দায়ে রিকশা চালাই। দেশের বর্তমান অবস্থায় ভয়ে থাকি কখন কি ঘটে। তিনি বলেন, সরকার পুলিশ দিয়ে মানুষ মেরে সংলাপের পথ বন্ধ করে দিচ্ছে।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা রশিদুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব বেশি। তার জবাবদিহিও বেশি। কোন ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। তার উচিত ছাড় দেয়া। সরকারি বাঙলা কলেজের ছাত্র মামুনুর রশীদ বলেন, গাড়ি পুড়িয়ে কি লাভ? চোখের নিমিষে লাখ লাখ টাকা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। সরকার তো একচুলও নড়ছে না। একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ দাবি করেন নাশকতার সঙ্গে সরকার জড়িত। তিনি বলেন, পুলিশ পাহারার মধ্যে যেভাবে গাড়ি পোড়ানো হচ্ছে তাতে আমি বাজি ধরতে পারি সরকারের মদত ছাড়া এ ধরনের কাজ দুর্বৃত্তদের পক্ষে করা সম্ভব না। এ রকম চলতে থাকলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। শ্যামলী এলাকার গৃহিণী আসমা বেগম বলেন, রাস্তায় বের হতেই ভয় পাই। আতঙ্কে থাকি কখন গায়ে আগুন লেগে যায়। মাথার ওপর ককটেল পড়ে। জরুরি কাজ ছাড়া বাসা থেকে বের হই না। ব্যাংক কর্মকর্তা মাসুম আলী বলেন, দুই নেত্রীর কেউ থামছেন না। আমরা যাবো কোথায়। সাংবাদিকদের কাছে অনুরোধ আপনারা মানুষের আকুতি তুলে ধরেন। তাদের থামতে বলেন। তারা না থামলে দেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যাবে। বাচ্চাদের স্কুলে দিতে ভয় হয়। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। বাচ্চার পরীক্ষা অনিশ্চিত। স্কুল শিক্ষক আলতাফ হোসেন বলেন, দুই নেত্রীর কাউকে না কাউকে ছাড় দিতে হবে। নাহলে সমাধান সম্ভব না। যার দায়িত্ব বেশি তাকে আগে ছাড় দিতে হবে। কাপড় ব্যবসায়ী নাজমুল মিয়া বলেন, ব্যবসায়ীদের পথে বসার মতো অবস্থা। হরতাল-অবরোধের কারণে মাল ঢাকার বাইরে পাঠাতে পারছি না। গাড়ি ভাড়াও বেড়ে গেছে অনেক। দুইজনের জেদের বলি তো আমরা হতে পারি না। মনে হয় না এরা কেউ হার মানবে। তৃতীয় কেউ সুযোগ নিতে চাইলে আমাদের উচিত তাকেই সুযোগ করে দেয়া। মোহাম্মদপুরের ট্রাকচালক সুমন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাজনীতি যারা করে সবাই দুর্নীতিবাজ। তাদের তো চিন্তা নাই। তাদের কামাই তো বন্ধ হয় নাই। ঘরে বইসা থাকলে না খেয়ে মরা লাগবে। আর বাইরে আসলে আগুনে পুড়ে মরা লাগবে। ঋণের বোঝা আর টানতে পারতেছি না। গ্রীন রোড এলাকার ব্যবসায়ী মন্টু শেখ হতাশা প্রকাশ করে বলেন, মনে হয় না আর দ্ইু নেত্রী একসঙ্গে বসতে পারবেন। সবাই ক্ষমতার জন্য পাগল। দেশের মানুষের কথা আসলে তারা চিন্তা করে না। চিন্তা করলে তারা মিলেমিশে কাজ করত। গরিবের কথা মনে পড়ে শুধু ভোটের দিন। ভোট শেষ হলে তাদের মারতেও কষ্ট লাগে না। হাতিরপুল এলাকার মাছ ব্যবসায়ী মঞ্জু বলেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি কাউরে দিয়া দেশের উন্নতি হইবো না। একটা বছর দ্যাশ শান্তিতে আছিলো। আবার জ্বালাও-পোড়াও শুরু করছে। তারা কেউ চায় না আমরা শান্তিতে থাকি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রোমানা বলেন, দেশ দুইভাগে ভাগ করে এক ভাগ খালেদাকে, আরেকভাগ হাসিনাকে দেয়া উচিত। আমাদের উচিত দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া দেশের কোন ভবিষ্যৎ দেখছি না। আসাদ গেটের চা বিক্রেতা আনিস বলেন, একজন গুলি করে মানুষ মারে, আরেকজন আগুন দিয়ে মারে। এক ইঞ্চি জমির জন্য ভাই ভাইরে খুন করে। দুই নেত্রীর কাছে আর কি আশা করি। আল্লাহ্ তাদের সুমতি দিক।
ফ্যাট নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. সাইফুল ইসলাম জানান, আতঙ্কে আছি। বেশির ভাগ সময় ডিউটি থাকে ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোতে। যেতে ভীষণ কষ্ট হয়। এরই মধ্যে একদিন পেট্রলবোমার মুখোমুখি হই। অল্পের জন্য বেঁচে যাই। গুলশানের অফিস থেকে বের হতেই দেখি একটি বোমা দ্রুত ছুঁড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। ভাগ্যিস, আমার গাড়ির সামনের গাড়িতে বোমাটি পড়ে। মুহূর্তেই দিগি¦দিক ছোটাছুটি করে সবাই। ভয়ে সে দিন ডিউটিতে যেতে পারিনি। এ পর্যন্ত সাইটে যেতে পেরেছি মাত্র ৬ দিন। তাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এভাবে চলছে অবরোধের দিনগুলো। তিনি বলেন, দ্রুত মধ্যবর্তী নির্বাচন চাই। বেসরকারি মোবাইল অপারেটর কোম্পানি রবির অপারেশন বিভাগের কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সারাক্ষণ এক ধরনের আতঙ্কে থাকি। বর্তমানে অফিসের গাড়ি বন্ধ। যেতে হয় অন্য গাড়িতে চড়ে। ডিউটি ঢাকা বিভাগ। ফলে যেতে হয় প্রচুর জায়গায়। তিনি বলেন, দায়িত্বের কারণে বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়; পরিবারের লোকজন সব সময় টেনশনে থাকে। তিনি বলেন, আর কোন সংঘাত নয়, সমঝোতা চাই। প্যানাসনিক ডিজিটাল সাইন অ্যান্ড টেলিকমের মার্কেটিং অফিসার মো. রফিকুল ইসলাম জানান, যে করে হোক সমঝোতা চাই। ব্যবসায়ী মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, উভয় দলকে বসে সমঝোতার মাধ্যমে একটি সমাধানে আসতে হবে। মেহেদী হাসান ফুয়াদ বলেন, সংলাপের জন্য অনেক ডাকা হয়েছে। আসেনি। ২০১৯ সালের আগে কোন সংলাপ নয়। একটি ভবনের ম্যানেজার মো. আবদুস সালাম পাটোয়ারী জানান, দুই নেত্রীকে সংলাপে এসে সর্বদলীয় কমিটি গঠন করে একটি সমাধানে আসা উচিত। একই ভবনের সিকিউরিটি গার্ড আবদুল জব্বার বলেন, সমঝোতা চাই। চা দোকানের ছোট্ট কর্মচারী ইকবাল হোসেন রিপন। সে গ-গোল নয়, সংলাপ চায়। পত্রিকা স্টলের মালিক রফিকুল ইসলাম ও আওলাদ হোসেন মন্টু জানান, ভয়াবহ অবস্থা। আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চাই। সংলাপ, আলোচনা, সমঝোতা যে কোন উপায়ে শান্তি চাই। সৌদি প্রবাসী হারুন অর রশিদ জানান, ৬ মাসের ছুটি সংক্ষিপ্ত করে চলে যাবো। এভাবে কোন দেশ চলতে পারে না। মুচি বাবু বলেন, অনেক কষ্টে আছি। সমাধান চাই। পান-সিগারেটের দোকানি বাবর আলী বলেন, আর চলতে পারছি না। ধার-কর্জে জর্জরিত। শিপের চাকুরে মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতে মনে হচ্ছে দুই দল দিয়ে আর হবে না। তৃতীয় শক্তির দরকার। গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আলা উদ্দিন বলেন, বিক্রি শূন্য। চারদিকে ক্ষোভ আর আতঙ্ক। এরা দেশের ভাল চায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যায়েদ বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোই দায়ী। সরকারের অনড় অবস্থান সঙ্কট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান করতে হবে এবং সংলাপের উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। মনোবিজ্ঞান বিভাগের আবিদা সুলতানা বলেন, রাজনীতির বলি সবসময় সাধারণ মানুষই হয়। কিন্তু তারা এটা বোঝে না। যার কারণে রাজনীতিবিদরা সুযোগ নেয়। ভূগোল বিভাগের উৎপল সাহা বলেন, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সবাই অন্ধ। বর্তমান পরিস্থিতি মারাত্মক। এভাবে কোন দেশে মানুষ বাস করতে পারে না। জীবন হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হতে হয়। দুই দলের উচিত আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসা। রিকশাচালক রহিম বলেন, পেটের দায়ে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় গাড়ি বের করেছি। এভাবে চললে মারা যাবো। চাল, ডালের দাম বেড়ে গেছে। আরেক রিকশাচালক ফারুক বলেন, খ্যাপ নাই। ভয়ে মানুষ রাস্তায় বের হয় না। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী সাব্বির বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজটের সমস্যা রয়েছে। হরতাল-অবরোধে তা আরও প্রকট হয়েছে। দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। ঢাকা কলেজের বেলায়েত বলেন, বিএনপি যেভাবে আন্দোলন করছে তা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। মানুষ মেরে, ককটেল মেরে গণতন্ত্র রক্ষা করা যায় না। তারা নির্বাচনে না গিয়ে এখন আন্দোলন করছে কেন। ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী শাহনাজ বলেন, রাজনীতি বুঝি না। দেশে শান্তি থাকুকÑ সেটাই চাই। আরেক শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, দুই দলই আমাদের বোকা ভেবেছে। সাধারণ মানুষকে নিয়ে তারা তাদের রাজনীতির খেলা খেলছে। সাধারণ মানুষের উচিত এখন জেগে উঠা। নীলক্ষেতের মুদি দোকানদার মোশাররফ হোসেন বলেন, দেশে যে অচল অবস্থা চলছে তাতে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাজার ভাল যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে এর ফল ভাল হবে না। বইয়ের দোকানদার হানিফ মুন্সী বলেন, সরকারের একগুয়েমির কাছে সাধারণ মানুষের দাবি উপেক্ষিত হচ্ছে। আমরা গরিবরা খেতে পারছি না। ক্ষমতার মসনদে বসে তারা এসব সমস্যার কথা টের পান না। সরকারের উচিত সমঝোতায় বসা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদ্দাম বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সেহেতু গণতান্ত্রিক উপায়ে সবার ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার রয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকার যেহেতু অনির্বাচিত সেহেতু দেশের পরিস্থিতির জন্য এই সরকারই দায়ী। সঙ্কট নিরসনের জন্য সকল দলকে নিয়ে গঠনমূলক সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। যে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার ফিরে পাবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী রাব্বী বলেন, অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে আমরা উদ্বিগ্ন। সরকারের উচিত সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সংলাপ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সঙ্কটের সমাধান করতে হবে। এর উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সোহেলের বাড়ি কুমিল্লা, থাকেন ঢাকার কমলাপুরে। তিনি জানান, ব্যবসার অবস্থা ভাল না। আমরা চাই খালেদা জিয়া অবরোধ প্রত্যাহার করুক এবং শেখ হাসিনা আলোচনায় বসুক। মতিঝিলের চা দোকানি জাকির হোসেনের বাড়ি নোয়াখালী। তিনি বলেন, দেশের এ অবস্থায় আমাদের মতো গরিব-দুঃখী, দিনমজুর যারা আছি তাদের খুবই সমস্য হচ্ছে। যারা মন্ত্রী-মিনিস্টার তাদের তো কোন সমস্যা হচ্ছে না। আমি একটা চা দোকান করি, আমার ওপর নির্ভর করে সংসার চলে। কিন্তু এখন যে কিভাবে চলতেছি? তিনি বলেন, আমরা চাই তারা দু’জন বসে এর সমধান করুক। মো. বিল্লাল হোসেন, বাড়ি সাতক্ষীরা, থাকেন গোলাপবাগ রেলগেট। পেশায় জেনারেটর অপারেটর। তিনি বলেন, তারা রেষারেষি করতেছে। কেউ কাউকে ছাড় দেয়ার পাত্র না। অবস্থাটা ভাল মনে হচ্ছে না। এ অবস্থায় যারা ক্ষমতায় আছে বা যারা ক্ষমতায় যাবে তাদের যে কোন একজনকে ছাড় দেয়া লাগবো। উভয়দলের যারা নেতানেত্রী আছে তারা যদি চিন্তাভাবনা করে- আমাদের কারণে মানুষ মারা যাচ্ছেÑ এ চিন্তা করে যদি আলোচনায় বসে তবে দেশের জন্য ভাল হবে। বরিশালের গৌরনদীর স্থায়ী বাসিন্দা সেনাকল্যাণ সংস্থার স্টাফ মো. হানিফ থাকেন মতিঝিলেই। ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেন, দেশের বর্তমান অবস্থা আমি কারো কাছে বলবো না, আর বলতেও চাই না। দেশে সরকার আছে, কি করবে না করবে তারাই জানে। সরকারি চাকরিজীবী মো. ইউনূচের বাড়ি চিটাগাং, থাকেন ফকিরাপুল। তিনি বলেন, আসলে মন্তব্য যে কি করি? মাঝখানে আমরা জনগণ বেকায়দায় পড়ে গেছি। আমার মনে হয় দু’জন বসে একটা সমঝোতায় আসা উচিত। শাসনতো তারাই করবে। আজকে যে করতেছে, আগামীদিন আরেকজন করবে। ঘুরেফিরে তো এরাই করবে। তাই বসে আলোচনা করা উচিত, জনগণ যেন একটু শান্তিতে থাকতে পারে। পাবনার মতিন থাকেন মুগদা। পেশায় রিকশাচালক। তিনি বলেন, দেশের অবস্থা তো দেখতেছেন। দেশটা খাইলো তো দুইজন। আগে দেখা যেত রাতের বেলা রিকশা চালিয়ে ভাড়া দিয়েও ৩০০ টাকা থাকতো। আর এখন সারাদিন ভাড়া মেরেও ১০০ টাকা থাকে না। এখন দুইজনকে বসে আলাপ আলোচনা করে দেশটাকে ভাল করা লাগবো। আলাপ-আলোচনা করে যেটা ভাল হয় সেইটাই করা লাগবো।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের গ্রাহক অমল সাহা জানান, তিনি পেশায় একজন ব্যবসায়ী। রাজধানীর ইসলামপুরে তার থান কাপড়ের দোকান রয়েছে। ছোট আকারের দু’টি দোকানে কর্মচারীদের বেতন, দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎসহ যাবতীয় খরচ আছে দেড় লাখ টাকা। প্রায় এক মাস ধরে চলা অবরোধে বিক্রি শূন্যের কোঠায় নেমেছে। তাই দেড় লাখ টাকা খরচই এখন লোকসান হয়ে ঘাড়ে চেপে বসেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, দুনিয়ার কোথাও থেকে এ দেশ শিক্ষা নেয় না। এখানে চর্চা হয় পারস্পরিক গোঁয়ার্তুমি। সরকার ও বিরোধী দলের কর্মকা-ে মনে হয় না তারা সাধারণ মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করেন। যদিও উভয় দল দাবি করে আসছে- তাদের দু’কোণায় অনড় দাঁড়িয়ে থাকার লক্ষ্য শুধুই জনগণ। অমল সাহা তাদের এ দাবিকে ডাহা মিথ্যা বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সংলাপ, আলোচনা ও সমঝোতা কিছই বুঝিনা; মুক্তি চাই-বাঁচতে চাই।
মতিঝিল এলাকায় কথা হয় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এসএম শাহজাহান এর সঙ্গে, তিনি বলেন, এ দেশের মানুষ, নেতা কেউ ভাল না। উভয় দলকে বসা উচিত। কিন্তু বসেও কি সুফল আসবে, সংশয় তার। তিনি বলেন, একমাস আগে দেশে আসি। এসেই দেখি দেশ অচল। যুক্তরাষ্ট্রফেরত এ প্রবাসী ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে বলেন, নির্ধারিত সময়ের আগেই চলে যাচ্ছি।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আলী আকবর জানান, নির্বাচন হোক আর না হোক আসুন, বসুন, কথা বলুন। দেশে-বিদেশে সবাই বলছে সংলাপে বসতে। সংলাপে বসতে তাদের সমস্যা কোথায়? আবদুর রহমান শিবলু। ছাত্র। যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়ে। গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন বুকে নিয়ে। কিন্তু এখানে এসে দেখে হরতাল আর অবরোধ। সাধারণত হরতালে রাজধানীর স্কুলগুলোতে ক্লাস হয় না। আবদুর রহমানের দাবি, অবরোধে ক্লাস হলেও গত কয়েক দিনের হরতালে তার ৫ দিন ক্লাস হয়নি। সে বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পেতে চায়। ইডেন ও সিটি কলেজের দু’শিক্ষার্থী মুক্তা ও সারা। তারা বলেন, নিরাপত্তা চাই। দয়া নয়, নাগরিক হিসেবে আমাদের নিরাপত্তা দেয়া রাষ্ট্রের কর্র্তব্য। পোল্ট্রি মুরগি ব্যবসায়ী মো. সেলিম উদ্দিন জানান, যদি তাদের রাজনীতি জনগণের জন্য হয়ে থাকে তবে তাদের সংলাপে বসা উচিত। তিনি বলেন, সব জায়গায় তাদের স্বার্থ তাহলে জনগণ কোথায়? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নাগরিক জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লিমিটেড কিন্তু জনগণ আনলিমিটেড। তিনি সতর্ক করে বলেন, সাধারণ মানুষকে যেন আর ক্ষেপানো না হয়। একটি গলি পথের দোকানি তাপস বলেন, ক্ষমতাসীন সরকারের আচরণ স্বৈরতন্ত্রের মতো মনে হচ্ছে। তিনি স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তির আহ্বান জানান।
আবদুল কাদের ফুটপাতে ব্যবসা করেন। তিনি বলেন, সরকার অথবা দল কিছুই বুঝি না। আমরা চাই বাঁচতে। সুখে-শান্তিতে ব্যবসা করতে। তিনি বলেন, ধীরে ধীরে বাঁচার সবটুকু অধিকার কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমানুল্লাহ সরকার বলেন, বেঁচে থাকার গ্যারান্টি চাই। বর্তমানে একজন নাগরিকের জীবনের কোন মূল্য নেই। মতের মিল না থাকলে তাকে ধরে নিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে এনকাউন্টার হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। মাইনুল হাসান হীরা বলেন, ঘাত-প্রতিঘাত-অপঘাত ও নির্যাতন থেকে দেশের মানুষ মুক্তি চায়। মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন বলেন, গ্রহণযোগ্য সংলাপ চাই। যেনতেন সংলাপ বহু দেখেছি। কাজে আসেনি।
মো. মাসুদ মিয়া বলেন, দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। দেশ শূন্যের উপর ভাসছে। একদিন ধপাস্ করে নিচের দিকে পড়ে যাবে। আমরা অতিষ্ঠ, চরম অতিষ্ঠ। তিনি বলেন, এ অবরোধে কোন মন্ত্রী, এমপি, নেতা মারা যায়নি। মরছে সাধারণ মানুষ। জনগণের দোহাই দিয়ে তারা রাজনীতি করলেও তাদের রাজনীতির সহিংসতার শিকার সে জনগণই। পথচারী খোরশেদ আলম বলেন, অত্যাচার-নির্যাতন থেকে বাঁচতে চাই। ব্যবসা-বাণিজ্যের সুষ্ঠু পরিবেশ চাই। রিপন। ভোলা থেকে ঢাকার শ্যামলীতে বেড়াতে এসেছেন। তিনি এলাকার মুদি দোকানি। তড়িঘড়ি করে গাড়িতে উঠে যাওয়ার সময় তিনি বলে যান, শান্তি চাই। আলম সংক্ষেপেই বললেন, হরতাল-অবরোধ এগুলোর বিপক্ষে।
সুরুজ মোল্লা। পেশায় সিএনজি চালক। মতিঝিলে রাস্তার এক পাশে মাথায় হাত দিয়ে সিএনজি’র সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সারা দিনে পেয়েছেন ৭০০ টাকা। মালিকের কাছে জমা দিতে হবে ১০৫০ ও গ্যাস বাবদ ২৫০। এতো পুরো লোকসান! জবাবে সুরুজ বলেন, এভাবে কাটছে অবরোধের দিনগুলো। বিএসএফআইসি’র ডিজিএম ছানোয়ার হোসেন বলেন, অনতিবিলম্বে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) একজন অফিসার বলেন, সংলাপ চাই। তবে তা হতে হবে যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য।
কামরুল হাসান শিপন। ফুটপাতের দোকানি। তিনি বলেন, দুই নেত্রীর বাড়াবাড়িতে ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এমন অনেক দিন যাচ্ছে। যে দিনে একটি শার্টও বিক্রি হচ্ছে না। চলমান জট খোলার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন বিকল্প নেই বলে জানান তিনি। পথচারী সুমি আক্তার বলেন, আতঙ্কে আছি। অবরোধে ঘর থেকে বের হতে পারি না। এর একটা সমাধান হওয়া উচিত।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোবারক জানান, স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক ১২০০ টাকা বিক্রি হতো। বর্তমানে হচ্ছে মাত্র ৫০০ টাকা। কষ্টে আছি। সমাধান চাই। গেঞ্জির দোকানি মো. আবদুল হাই বলেন, ধার-কর্জ করে চলছি। ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কেবলই ঋণের নিচে তলিয়ে যাচ্ছি। মাসুদ মিয়া। পেশায় রিকশাচালক। কণ্ঠ শুকিয়ে গেছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, সারা দিনে ৩০০ টাকা আয় হয়। কি করবো বুঝতে পারছি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বাবু বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যে কোন সময় বড় ধরনের বিপর্যয় আসতে পারে। রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কারণে অতীতেও এমন সমস্যা তৈরি হয়েছিল। সামরিক শাসন জারি হয়েছিল। দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। এখন দুই দলের উচিত অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করা। আরেক শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন, দেশ গৃহযুদ্ধর দিকে এগুচ্ছে।
ধর্মীয় সংঘাত, শ্রেণীগত দ্বন্দ্ব এবং এলাকাগত বৈষম্য আজ স্পষ্ট। মানুষের বাক স্বাধীনতা নেই। সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, সঙ্কট উত্তরণে রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে আলাদা করে দেখতে হবে। সাংবিধানিক পদগুলোতে রাজনৈতিক কোন প্রভাব থাকা চলবে না।
শাহনূর শাকিল বলেন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে দেশে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পারস্পরিক সহনশীলতা, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র এবং জনমতের সুষ্ঠু প্রতিফলনই এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায়। সাঈদ মিজান বলেন, আলোচনার মাধ্যমে দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সমস্যার সমাধান করতে হবে। ব্যর্থ হলে দেশ আরও গভীর সঙ্কটে পড়ে যাবে। মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী ইমন বলেন, গণতন্ত্র হত্যা এবং গণতন্ত্র রক্ষার নামে পেট্রলবোমা মেরে যে মানুষ হত্যা করছে সে ধরনের গণতন্ত্র আমরা চাই না। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী কামরুল বলেন, দেশ সঙ্কটে পড়ছে। আমরা এই সঙ্কটের সমাধান চাই। বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে নয়, সঠিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের নুরুল্লাহ বলেন, বর্তমান এই পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকলে সাধারণ মানুষ কোন দলকে নয়, বরং দেশ রক্ষার আন্দোলনে রাস্তায় নেমে পড়বে। এই রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আগেই সরকারের উচিত গঠণমূলক সংলাপের আয়োজন করা। ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী শাহেদ বলেন, বর্তমান সরকারের ১৫৪ জন অনির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। তাতে মানুষের অধিকারকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। এতে গণতন্ত্রের সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি। তাই সমস্যা সমাধানে সব দলকে সঙ্গে নিয়ে সংলাপের আয়োজন করা জরুরি। শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার বলেন, দেশে বর্তমান সঙ্কটের জন্য বিএনপি দায়ী। তারা সঠিক সময়ে নির্বাচনে না এসে এখন দেশকে অস্থিতিশীল অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। বায়জীদ খান বলেন, রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। আমরা এখন কোন রাজনৈতিক দলের অধীনে যেতে চাই না।
পলাশী বাজারের মুদি দোকানদার মো. বাবুল বলেন, শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। ঘর থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। ব্যবসার অবস্থা খারাপ। সরকার হয়তো সঙ্কট উত্তরণের জন্য চেষ্টা করছে। তবে তাদের বিএনপি’র সঙ্গে সংলাপ করেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। ফার্মেসি দোকানদার বিশ্বজিৎ বলেন, সবসময় আতঙ্কের মধ্যে থাকি। দুই পক্ষই অনড় অবস্থানে রয়েছে। এ পর্যায়ে জনগণকে সচেতন হতে হবে। তাদের অধিকার আদায়ে আরও সোচ্চার হতে হবে। নাশকতাকারীকে দমন করতে হবে। মুদি দোকানদার আবদুল ওয়াদুদ বলেন, দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়ে গেছে। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে পারছি না। নিজেরাও ভয়ে থাকি। সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। অভিভাবক নিলুফার ইয়াসমিন বলেন, আমার ছেলে উদয়ন স্কুলে পড়ে। রাস্তায় আতঙ্ক নিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে সবসময় সাধারণ মানুষদের ব্যবহার করে। সঙ্কটের সমাধান চাই। রিকশাচালক খালেক বলেন, সরকারের অযৌক্তিক জেদের কাছে আমরা জিম্মি। চালের দাম বেড়ে গেছে। রাস্তায় নামতে পারি না। ককটেল ও পেট্রলবোমা আতঙ্ক কাজ করে। সরকারের উচিত অনড় অবস্থান থেকে সরে আসা। ব্যবসায়ী জামাল আহমেদ বলেন, দুই দলের রেষারেষিতে আমরা সাধারণ মানুষ বিপদে পড়েছি। অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। সরকার নমনীয় হলে সমস্যার সমাধান হবে। অভিভাবক সুলতানা জামাল বলেন, শুধু বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। আর হরতাল-অবরোধ দিলেও হবে না। দুই পক্ষকে এক টেবিলে বসতে হবে। না হলে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে দুই পক্ষকেই দেশ ছাড়া করবে। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের দোকানদার জাহাঙ্গীর বলেন, একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। বিএনপি’র এমন আন্দোলনের জন্য সরকারই দায়ী। সঙ্কট নিরসনে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। রিকশাচালক কাদের বলেন, কোন রাজনীতি করি না। তারপরও রাজনীতির স্বার্থের বলি আমরা। পেটের দায়ে রিকশা চালাই। দেশের বর্তমান অবস্থায় ভয়ে থাকি কখন কি ঘটে। তিনি বলেন, সরকার পুলিশ দিয়ে মানুষ মেরে সংলাপের পথ বন্ধ করে দিচ্ছে।
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা রশিদুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব বেশি। তার জবাবদিহিও বেশি। কোন ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। তার উচিত ছাড় দেয়া। সরকারি বাঙলা কলেজের ছাত্র মামুনুর রশীদ বলেন, গাড়ি পুড়িয়ে কি লাভ? চোখের নিমিষে লাখ লাখ টাকা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। সরকার তো একচুলও নড়ছে না। একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ দাবি করেন নাশকতার সঙ্গে সরকার জড়িত। তিনি বলেন, পুলিশ পাহারার মধ্যে যেভাবে গাড়ি পোড়ানো হচ্ছে তাতে আমি বাজি ধরতে পারি সরকারের মদত ছাড়া এ ধরনের কাজ দুর্বৃত্তদের পক্ষে করা সম্ভব না। এ রকম চলতে থাকলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। শ্যামলী এলাকার গৃহিণী আসমা বেগম বলেন, রাস্তায় বের হতেই ভয় পাই। আতঙ্কে থাকি কখন গায়ে আগুন লেগে যায়। মাথার ওপর ককটেল পড়ে। জরুরি কাজ ছাড়া বাসা থেকে বের হই না। ব্যাংক কর্মকর্তা মাসুম আলী বলেন, দুই নেত্রীর কেউ থামছেন না। আমরা যাবো কোথায়। সাংবাদিকদের কাছে অনুরোধ আপনারা মানুষের আকুতি তুলে ধরেন। তাদের থামতে বলেন। তারা না থামলে দেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যাবে। বাচ্চাদের স্কুলে দিতে ভয় হয়। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। বাচ্চার পরীক্ষা অনিশ্চিত। স্কুল শিক্ষক আলতাফ হোসেন বলেন, দুই নেত্রীর কাউকে না কাউকে ছাড় দিতে হবে। নাহলে সমাধান সম্ভব না। যার দায়িত্ব বেশি তাকে আগে ছাড় দিতে হবে। কাপড় ব্যবসায়ী নাজমুল মিয়া বলেন, ব্যবসায়ীদের পথে বসার মতো অবস্থা। হরতাল-অবরোধের কারণে মাল ঢাকার বাইরে পাঠাতে পারছি না। গাড়ি ভাড়াও বেড়ে গেছে অনেক। দুইজনের জেদের বলি তো আমরা হতে পারি না। মনে হয় না এরা কেউ হার মানবে। তৃতীয় কেউ সুযোগ নিতে চাইলে আমাদের উচিত তাকেই সুযোগ করে দেয়া। মোহাম্মদপুরের ট্রাকচালক সুমন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাজনীতি যারা করে সবাই দুর্নীতিবাজ। তাদের তো চিন্তা নাই। তাদের কামাই তো বন্ধ হয় নাই। ঘরে বইসা থাকলে না খেয়ে মরা লাগবে। আর বাইরে আসলে আগুনে পুড়ে মরা লাগবে। ঋণের বোঝা আর টানতে পারতেছি না। গ্রীন রোড এলাকার ব্যবসায়ী মন্টু শেখ হতাশা প্রকাশ করে বলেন, মনে হয় না আর দ্ইু নেত্রী একসঙ্গে বসতে পারবেন। সবাই ক্ষমতার জন্য পাগল। দেশের মানুষের কথা আসলে তারা চিন্তা করে না। চিন্তা করলে তারা মিলেমিশে কাজ করত। গরিবের কথা মনে পড়ে শুধু ভোটের দিন। ভোট শেষ হলে তাদের মারতেও কষ্ট লাগে না। হাতিরপুল এলাকার মাছ ব্যবসায়ী মঞ্জু বলেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি কাউরে দিয়া দেশের উন্নতি হইবো না। একটা বছর দ্যাশ শান্তিতে আছিলো। আবার জ্বালাও-পোড়াও শুরু করছে। তারা কেউ চায় না আমরা শান্তিতে থাকি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রোমানা বলেন, দেশ দুইভাগে ভাগ করে এক ভাগ খালেদাকে, আরেকভাগ হাসিনাকে দেয়া উচিত। আমাদের উচিত দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া দেশের কোন ভবিষ্যৎ দেখছি না। আসাদ গেটের চা বিক্রেতা আনিস বলেন, একজন গুলি করে মানুষ মারে, আরেকজন আগুন দিয়ে মারে। এক ইঞ্চি জমির জন্য ভাই ভাইরে খুন করে। দুই নেত্রীর কাছে আর কি আশা করি। আল্লাহ্ তাদের সুমতি দিক।
ফ্যাট নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. সাইফুল ইসলাম জানান, আতঙ্কে আছি। বেশির ভাগ সময় ডিউটি থাকে ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোতে। যেতে ভীষণ কষ্ট হয়। এরই মধ্যে একদিন পেট্রলবোমার মুখোমুখি হই। অল্পের জন্য বেঁচে যাই। গুলশানের অফিস থেকে বের হতেই দেখি একটি বোমা দ্রুত ছুঁড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। ভাগ্যিস, আমার গাড়ির সামনের গাড়িতে বোমাটি পড়ে। মুহূর্তেই দিগি¦দিক ছোটাছুটি করে সবাই। ভয়ে সে দিন ডিউটিতে যেতে পারিনি। এ পর্যন্ত সাইটে যেতে পেরেছি মাত্র ৬ দিন। তাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এভাবে চলছে অবরোধের দিনগুলো। তিনি বলেন, দ্রুত মধ্যবর্তী নির্বাচন চাই। বেসরকারি মোবাইল অপারেটর কোম্পানি রবির অপারেশন বিভাগের কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সারাক্ষণ এক ধরনের আতঙ্কে থাকি। বর্তমানে অফিসের গাড়ি বন্ধ। যেতে হয় অন্য গাড়িতে চড়ে। ডিউটি ঢাকা বিভাগ। ফলে যেতে হয় প্রচুর জায়গায়। তিনি বলেন, দায়িত্বের কারণে বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়; পরিবারের লোকজন সব সময় টেনশনে থাকে। তিনি বলেন, আর কোন সংঘাত নয়, সমঝোতা চাই। প্যানাসনিক ডিজিটাল সাইন অ্যান্ড টেলিকমের মার্কেটিং অফিসার মো. রফিকুল ইসলাম জানান, যে করে হোক সমঝোতা চাই। ব্যবসায়ী মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, উভয় দলকে বসে সমঝোতার মাধ্যমে একটি সমাধানে আসতে হবে। মেহেদী হাসান ফুয়াদ বলেন, সংলাপের জন্য অনেক ডাকা হয়েছে। আসেনি। ২০১৯ সালের আগে কোন সংলাপ নয়। একটি ভবনের ম্যানেজার মো. আবদুস সালাম পাটোয়ারী জানান, দুই নেত্রীকে সংলাপে এসে সর্বদলীয় কমিটি গঠন করে একটি সমাধানে আসা উচিত। একই ভবনের সিকিউরিটি গার্ড আবদুল জব্বার বলেন, সমঝোতা চাই। চা দোকানের ছোট্ট কর্মচারী ইকবাল হোসেন রিপন। সে গ-গোল নয়, সংলাপ চায়। পত্রিকা স্টলের মালিক রফিকুল ইসলাম ও আওলাদ হোসেন মন্টু জানান, ভয়াবহ অবস্থা। আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চাই। সংলাপ, আলোচনা, সমঝোতা যে কোন উপায়ে শান্তি চাই। সৌদি প্রবাসী হারুন অর রশিদ জানান, ৬ মাসের ছুটি সংক্ষিপ্ত করে চলে যাবো। এভাবে কোন দেশ চলতে পারে না। মুচি বাবু বলেন, অনেক কষ্টে আছি। সমাধান চাই। পান-সিগারেটের দোকানি বাবর আলী বলেন, আর চলতে পারছি না। ধার-কর্জে জর্জরিত। শিপের চাকুরে মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতে মনে হচ্ছে দুই দল দিয়ে আর হবে না। তৃতীয় শক্তির দরকার। গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আলা উদ্দিন বলেন, বিক্রি শূন্য। চারদিকে ক্ষোভ আর আতঙ্ক। এরা দেশের ভাল চায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যায়েদ বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোই দায়ী। সরকারের অনড় অবস্থান সঙ্কট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান করতে হবে এবং সংলাপের উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। মনোবিজ্ঞান বিভাগের আবিদা সুলতানা বলেন, রাজনীতির বলি সবসময় সাধারণ মানুষই হয়। কিন্তু তারা এটা বোঝে না। যার কারণে রাজনীতিবিদরা সুযোগ নেয়। ভূগোল বিভাগের উৎপল সাহা বলেন, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সবাই অন্ধ। বর্তমান পরিস্থিতি মারাত্মক। এভাবে কোন দেশে মানুষ বাস করতে পারে না। জীবন হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হতে হয়। দুই দলের উচিত আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসা। রিকশাচালক রহিম বলেন, পেটের দায়ে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় গাড়ি বের করেছি। এভাবে চললে মারা যাবো। চাল, ডালের দাম বেড়ে গেছে। আরেক রিকশাচালক ফারুক বলেন, খ্যাপ নাই। ভয়ে মানুষ রাস্তায় বের হয় না। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী সাব্বির বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজটের সমস্যা রয়েছে। হরতাল-অবরোধে তা আরও প্রকট হয়েছে। দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। ঢাকা কলেজের বেলায়েত বলেন, বিএনপি যেভাবে আন্দোলন করছে তা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। মানুষ মেরে, ককটেল মেরে গণতন্ত্র রক্ষা করা যায় না। তারা নির্বাচনে না গিয়ে এখন আন্দোলন করছে কেন। ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী শাহনাজ বলেন, রাজনীতি বুঝি না। দেশে শান্তি থাকুকÑ সেটাই চাই। আরেক শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, দুই দলই আমাদের বোকা ভেবেছে। সাধারণ মানুষকে নিয়ে তারা তাদের রাজনীতির খেলা খেলছে। সাধারণ মানুষের উচিত এখন জেগে উঠা। নীলক্ষেতের মুদি দোকানদার মোশাররফ হোসেন বলেন, দেশে যে অচল অবস্থা চলছে তাতে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাজার ভাল যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে এর ফল ভাল হবে না। বইয়ের দোকানদার হানিফ মুন্সী বলেন, সরকারের একগুয়েমির কাছে সাধারণ মানুষের দাবি উপেক্ষিত হচ্ছে। আমরা গরিবরা খেতে পারছি না। ক্ষমতার মসনদে বসে তারা এসব সমস্যার কথা টের পান না। সরকারের উচিত সমঝোতায় বসা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদ্দাম বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সেহেতু গণতান্ত্রিক উপায়ে সবার ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার রয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকার যেহেতু অনির্বাচিত সেহেতু দেশের পরিস্থিতির জন্য এই সরকারই দায়ী। সঙ্কট নিরসনের জন্য সকল দলকে নিয়ে গঠনমূলক সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। যে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার ফিরে পাবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী রাব্বী বলেন, অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে আমরা উদ্বিগ্ন। সরকারের উচিত সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সংলাপ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সঙ্কটের সমাধান করতে হবে। এর উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে।
No comments