সৌদি নেতৃত্বের নতুন বার্তা by মাসুম খলিলী
নতুন
বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রাসাদে ক্ষমতা সংহতকরণ
সম্পন্ন হয়েছে। সৌদি বাদশাহ তার বৈমাত্রেয় ভাই আবদুল্লাহর কাছ থেকে
উত্তরাধিকার গ্রহণের পর এ পর্যন্ত অনেক রাজকীয় ফরমান জারি করেছেন। এর
মাধ্যমে যেসব পরিবর্তন তিনি সম্পন্ন করেছেন তাতে সৌদি গন্তব্যে
গুরুত্বপূর্ণ বাঁক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। নতুন বিন্যাসে সৌদি আরব
তুরস্ক ও কাতারের সাথে ঐতিহ্যগত বিশেষ আঞ্চলিক সম্পর্ক এবং ফিলিস্তিন
প্রশ্নে ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকার দিকে ফিরে আসবে বলে
মনে হচ্ছে। নতুন সৌদি নেতৃত্বের কাছে মিসরের বিতর্কিত শাসক জেনারেল সিসি আর
ফাঁকা চেক পাবেন বলে মনে হচ্ছে না। যদিও তাকে এখনই পরিত্যাগ করা হবে এমন
ভাবনার কারণ হয়তো বা নেই।
তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন
মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিস্ট দমনের অন্যতম নায়ক হিসেবে খ্যাত সাবেক সৌদি গোয়েন্দাপ্রধান প্রিন্স বন্দর বিন সুলতানের কাছ থেকে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধানের অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটিও নিয়ে নেয়া হয়েছে। তিনি এখন আর বাদশাহর উপদেষ্টার পদেও নেই। কার্যত এর মাধ্যমে বন্দর বিন সুলতানের সব ধরনের ক্ষমতার অবসান ঘটল। একই সাথে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র থেকে মুসলিম ব্রাদারহুডকে নির্মূল করার জন্য তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তারও ইতি ঘটছে বলে মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে। এই দুঃস্বপ্ন বাস্তবায়নের আরেক নায়ক ছিলেন রয়েল কোর্টের সেক্রেটারি জেনারেল, বাদশাহ আবদুল্লাহর একান্ত সচিব ও নিয়োগ কমিটির প্রধান খালিদ আল তুয়াইজরি। রাজ পরিবারের কেউ না হয়েও আমেরিকা থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ ডিগ্রি নিয়ে আসা এ লোক বাদশাহ আবদুল্লাহর আমলে সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিলেন। আরব আমিরাতের ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স বিন জায়েদের সাথে যৌথ পরিকল্পনা নিয়ে মিসরে ড. মুরসির সরকারকে সরিয়ে সিসির নির্মম সেনা সরকার প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি মূল ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। সৌদি প্রশাসনের সর্বত্র থেকে ইসলামিস্টদের বিদায় করে লিবারেলিস্ট-সেকুলারিস্টদের বসানোর মূল কাজটিও করেন তিনি। বাদশাহ আবদুল্লাহর দাফন সম্পন্ন করার আগেই যে দু’টি কাজ বাদশাহ সালমান সম্পন্ন করেন তার মধ্যে একটি হলো মুকরিন বিন আবদুল আজিজকে ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণা আর বাকি কাজটি হলো খালিদ আল তুয়াইজরিকে রয়েল কোর্টের সেক্রেটারি জেনারেলসহ রাষ্ট্রের সব পদ থেকে অপসারণ করা। অপসারণের পর কয়েক ঘণ্টা সময় দেয়া হয় তার কাগজপত্র নেয়ার জন্য। এর পর তাকে আর রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। সৌদি প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত তার পরিবারের শতাধিক কর্মকর্তাকে তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এই পদক্ষেপ এ অঞ্চলের অস্থিরতা দূর করতে সহায়ক হবে বলে মনে করা হয়।
রণশীল এবং উদার
সালমান দায়িত্ব নেয়ার পর সৌদি সমাজের ধর্মীয় প্রভাব শিথিল করার উদ্যোক্তা অনেককে বিদায় করার পাশাপাশি এসব পদে ঐতিহ্যবাদীদের নিয়োগ দান করা হয়েছে। একজন রণশীল ধর্মীয় নেতা সাদ আল-শেখরিকে বাদশাহ সালমান ব্যক্তিগত উপদেষ্টা করেছেন। তিনি অবশ্য ভারসাম্য রাখার জন্য আল আরাবিয়া সংবাদ চ্যানেলের সাবেক প্রধান উদারপন্থী তরুণ আদেল আল-তোরাইফিকে নতুন তথ্যমন্ত্রী করেছেন। ক্ষমতার নতুন বিন্যাসে ক্ষমতাধর হিসেবে নতুন দু’জনের আবির্ভাব হয়েছে। তারা হলেন নবনিযুক্ত ক্রাউন প্রিন্স স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মোহাম্মদ বিন নায়েফ এবং নবনিযুক্ত প্রতিরামন্ত্রী, রয়েল কোর্টের জেনারেল সেক্রেটারি এবং একটি নবগঠিত মন্ত্রিসভা কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন সালমান। বাদশাহর অপর ছেলে আবদুল আজিজ পেট্রোলিয়াম উপমন্ত্রী হয়েছেন। নতুন বিন্যাসে সৌদি আরবে ধর্মীয় নেতৃত্বের ঐতিহ্যবাহী সুদাইরি পরিবারের সন্তানদের আবারো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আনা হয়েছে। আবদুল্লাহর সময় তাদের অনেকে ছিটকে পড়েছিলেন। তবে পারিবারিক ভারসাম্যকে সালমান সমুন্নত রেখেছেন। তার নতুন পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম হলো আবদুল্লাহর দুই ছেলে প্রিন্স মিশালকে রাজধানী রিয়াদের এবং প্রিন্স তুর্কিকে মক্কার গভর্নর পদ থেকে বিদায় করা। কিন্তু আবদুল্লাহর অপর ছেলে মুতায়েবকে ন্যাশনাল গার্ড প্রধান হিসেবে বহাল রাখা হয়েছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পদে আবদুল্লাহর অন্য এক ছেলেও বহাল রয়েছেন। নতুন ক্রাউন প্রিন্স মুকরিনের দুই ছেলেকেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আবদুল্লাহর রাজত্বের শেষ বছরে রাজকীয় নিয়োগে ক্রাউন প্রিন্সের সাথে পরামর্শ না করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে প্রিন্স মুতায়েব ও খালেদ তুয়াইজরির সাথে পরামর্শ করে। এসব নিয়োগের বেশির ভাগ এখন বাতিল হয়ে গেছে। বাদশাহ সালমান তার রাজত্বের সূচনা করেছেন জনগণের ভালোবাসা জয় করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। তিনি রাষ্ট্রের সব কর্মচারীর জন্য দুই মাসের বেতন সমান বোনাস এবং সব অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীর জন্য দুই মাস বোনাস পেনশন ঘোষণা করেছেন। বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্ররাও দুই মাস সমান অতিরিক্ত তহবিল পাবেন। এ জন্য ব্যয় হবে তিন হাজার কোটি ডলারের মতো। তেলের দাম কমে যাওয়ার জন্য আবদুল্লাহ যেখানে সরকারের খরচ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেখানে নতুন বাদশাহ জনগণকে বিশেষ সুবিধা দিতে বিপুল তহবিল ব্যয় করছেন।
কৌশলগত ভ্রান্তি
সৌদি আরবের মতাদর্শগত প্রবণতা নিয়ে এখন যে রেষারেষি ও বিরোধ চলছে, তা রণশীল সৌদি ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। দেশটি সাফল্যের সাথে জাতীয়তাবাদী, নাসেরবাদী ও বাথ পার্টির উত্থানপ্রবণতা মোকাবেলা করেছে। একই সাথে দেশটির বামপন্থী ও বিপ্লবী সরকারের সাথে ইন্টারেকশনের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। সৌদি আরবের সাথে মুসলিম ব্রাদারহুডের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল দীর্ঘ দিন। সৌদি কৌশলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এটি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কার্ড খেলেছে। কৌশলগত বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভালো খেলা কিভাবে খেলতে হয় তাতে দক্ষতা অর্জন করেছে। বিভিন্ন সঙ্কটে সৌদি আরব সুষম নীতি বজায় রাখা এবং একটি শূন্য সমষ্টি সমীকরণের মধ্যে স্খলন এড়াতে সম হয়েছে। কারো সাথে বিরোধ নিষ্পত্তি করেছে দক্ষতার সাথে আবার কারো সাথে সীমিত সঙ্ঘাতেও জড়িয়েছে। কিন্তু সব কিছু করা গেছে একধরনের ভারসাম্য বজায় রেখে এবং চূড়ান্ত কোনো লড়াইয়ে নিজে না জড়িয়ে। এভাবে দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ার হিসেবে থেকেছে। আর এ অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হয় সঙ্ঘাত ও রেষারেষিতে চরমভাবে কোনো পক্ষ গ্রহণ না করে।
বাদশাহ আবদুল্লাহর পররাষ্ট্রনীতিতে শেষ দিকে এসে স্বাভাবিক এ সৌদি কৌশল থেকে বিচ্যুতি ঘটে। এ অঞ্চলের সাম্প্রতিক অস্থির পরিস্থিতিতে এর প্রভাবই দেখা যাচ্ছে। দেশটির প্রতিবেশী ইয়েমেনের রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে হুতিদের কাছে। ইরান নিয়ন্ত্রিত এই বিদ্রোহী মিলিশিয়াকে মোকাবেলা করার মতো সুন্নি শক্তির মধ্যে এখন কেবলই রয়েছে আলকায়েদা। ইরাকে সুন্নি ভুক্তভোগীরা নির্বিচার গণহত্যার কাছাকাছি এবং অপমানের প্রান্তসীমায় পৌঁছার পরও সেখানকার অবস্থাকে উপো করেছে সৌদি আরব। এর ফলে তাদের রক্ষার জন্য আবির্ভূত হতে দেখা গেল আইসিসকে। সৌদি হিসাব-নিকাশ ও ভীতির কারণে সিরিয়ার বিপ্লব সাফল্যের মুখ দেখেনি। আর এ শূন্যস্থান দখল করেছে আলকায়েদা ও আইএস। এর বাইরেও দেখা গেছে রিয়াদের ফোকাস বারবার যথাস্থান থেকে সরে গেছে অন্যত্র। এর ফলে লেবানন হয়ে পড়েছে হিজবুল্লাহ নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে। আরব বিশ্বে সবচেয়ে সুসংহত ব্লক হিসেবে চিহ্নিত উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (জিসিসি) বিভক্তির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। কাতারকে অবরুদ্ধ করে রাখার হুমকি দেয়া হয়েছে। ওমান ইরানের সাথে একটি কৌশলগত মৈত্রী গড়ে নিজেকে প্রত্যাহার করার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে।
মরহুম আবদুল্লাহর আমলে ফিলিস্তিন প্রশ্নেও সৌদি নীতি ছিল বিভিন্ন ত্রুটি, ব্যক্তিগত ধারণা ও মেজাজ মর্জিনির্ভর। মক্কায় ফিলিস্তিনি পুনর্মিলন সম্মেলন করার পর আবদুল্লাহ হামাসের সাথে একটি ব্যক্তিগত বিবাদে জড়িয়ে পড়ায় উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়। ইসরাইলের গাজা যুদ্ধ এবং ইসরাইল-মিসরের অবরোধসংক্রান্ত ইস্যুতে সৌদি আরবের এক রকম নীরব অথবা ভুল পক্ষে অবস্থান ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জেরুসালেম রার দাবি করে ইরান যেখানে সাফল্যের সাথে ফিলিস্তিন কার্ড ব্যবহার করতে পেরেছে, সেখানে মরহুম বাদশাহ নিজের তলোয়ার ভেঙে শত্রুর সুবিধা করে দিয়েছেন। ইসরাইল-মিসরের গাজা অবরোধে নীরব সমর্থন দিয়ে ইরানি প্রভাব বলয়ে ঠেলে দিয়েছে ফিলিস্তিনিদের। ইয়েমেনের ব্রাদারহুড হিসেবে পরিচিত আল ইসলাহকে দুর্বল করতে আরব আমিরাতের হুতির সাথে গোপন সমঝোতাকে এগোতে দেয়ায় সেখানে এখন শিয়া মিলিশিয়ার অগ্রগতি রুখতে কাউকে পাশে পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রমবর্ধমান ইরানের প্রভাব মোকাবেলা করতে ইয়েমেন, ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যপন্থী ইসলামি আন্দোলনের সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বিদায়ী সৌদি শাসক সেই প্রয়োজন অনুভব করতে পারেননি। ফলে আইএস সৌদি সীমান্তে হানা দিলে নিজ দেশের অভ্যন্তরে যে রকম সাড়া পাওয়া উচিত ছিল সেটি পাওয়া যাচ্ছে না।
এটি অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই যে, আরব জাগরণ সৌদি রাজপরিবারের ক্ষমতার সামনে চ্যালেঞ্জ সৃর্স্টি করেছিল। আর এ জাগরণে ব্রাদারহুড ভূমিকা রাখায় তাদের প্রতি সৌদি দৃষ্টিভঙ্গির পুনর্বিবেচনাও অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য বা মাত্রার যে বিষয়টি থাকা উচিত ছিল সেটি এমনভাবে উপেক্ষিত হয় যে, তা সৌদি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার মূল ভিত্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জনগণের বড় অংশের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে রাজপরিবারের। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর আয়াতুল্লাহ খোমেনি বিপ্লব রফতানির কথা বললে দেশটির প্রভাব বিস্তারের পথে বাধা দিতে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সৌদি আরবের পক্ষ থেকে। এসব ক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য অর্জিতও হয়েছে। কিন্তু মধ্যপন্থী ইসলামি আন্দোলনকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে নির্মূল করার যে নীতির দিকে বাদশাহ আবদুল্লাহকে বন্দর-খালেদ চক্র ঠেলে দিয়েছে, তা সৌদি আরবের সার্বিক জনভিত্তিকে দুর্বল করেছে।
কাতার ও তুরস্কের সাথে দূরত্ব ঘুচবে
এরই মধ্যে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন তাতে আবদুল্লাহর নীতির সমালোচকেরা এখন নতুন বাদশাহর প্রশংসা করছেন। আবদুল্লাহ তার শাসনের শেষ বছরে অনেকটা বেপরোয়া ধরনের মনোভাব নিয়েছিলেন। সালমান চাচ্ছেন তার বড় ভাই বাদশাহ ফাহাদ আমলের সংযত মধ্যপন্থায় ফিরে যেতে। সেই সময় রাজপরিবার ইসলামপন্থী উদার নির্বিশেষে সবার সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। নতুন বাদশাহ ধারাবাহিকতার ওপর জোর দিয়েছেন, কিন্তু তার মতার প্রথম সাত দিনে এমন কিছু হয়েছে যাতে এ পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে উল্লেখযোগ্যভাবে। রাজনীতির বাইরে ব্যক্তিগত সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। ফলে এখন দেখার ব্যাপার হলো বিদেশে কারা সালমান বা নায়েফের বন্ধু সেটি। বাদশাহ সালমানের ঘনিষ্ঠ হলেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ। সালমান বাদশাহ হওয়ার পর কাতারের ওপর বৃহৎ প্রতিবেশী সৌদি আরবের অবরোধ আরোপ বা জিসিসি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার যে হুমকি ছিল, তা এখন অতীতের বিষয়। একইভাবে মোহাম্মদ বিন নায়েফ হলেন সিনিয়র তুর্কি কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফলে এ দুই দেশের টানাপড়েনেরও অবসান ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। ২০১১ আরব বিপ্লবের পর তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব নিরসন; ইরাক, ইয়েমেন, লেবানন ও সিরিয়ায় ইরানের প্রসারিত প্রভাব মোকাবেলার জন্যই প্রয়োজন তা নয়, একই সাথে তার প্রয়োজন নেতৃবৃন্দের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণেও। এই ফাটল খুব সম্ভবত জোড়া লেগে যাবে।
ব্রাদার নির্মূলে বন্ধুহীন বিন জায়েদ!
ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের জন্য যেমন সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটতে পারে তেমনিভাবে বৈরী সম্পর্কের কারণে অবনতিও ঘটতে পারে। একসময় বিন নায়েফের সাথে যারা ব্যক্তিগত শত্রুতা করেছিলেন এখন হয়তো তাদের মূল্য দেয়ার সময় এসেছে। মোহাম্মদ বিন নায়েফ এখনো ভুলে যাননি যে, আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স ও ব্রাদারহুড নির্মূল অভিযানের অন্যতম নায়ক মোহাম্মদ বিন জায়েদ ১২ বছর আগে রিচার্ড হাসের সাথে দুই ঘণ্টার কথোপকথনের সময় তখনকার সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মোহাম্মদের বাবা নায়েফ সম্পর্কে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলেন, ‘তাকে দেখে মনে হয় বানর থেকে মানুষ হয়েছে বলে ডারউইনের যে তত্ত্ব, তা সঠিক ছিল’। আবুধাবির শাসকের সাথে নিষ্পত্তি করার মতো আরো স্কোর সম্প্রতি বিন নায়েফের ঝুলিতে জমা হয়েছে। আমিরাতের রাজকীয় আদালত নিয়ন্ত্রিত ইরেম নিউজ মোহাম্মদ বিন নায়েফকে ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মুখপত্রে বলা হয়েছে, ‘বাদশাহ আবদুল আজিজের বিশিষ্ট নাতিদের মধ্যে থেকে মোহাম্মদ বিন নায়েফের নির্বাচনপ্রক্রিয়া পর্যবেকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। সালমান এ নিয়োগের ব্যাপারে এলিজিয়েন্স কাউন্সিলের পরামর্শ নেননি।’ অথচ বাদশাহ আবদুল্লাহও এ ধরনের নিয়োগে পরামর্শ করেননি। বিন জায়েদ চাচ্ছিলেন আবদুল্লাহর ছেলে মুতায়েব ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স হোক। গোপন সৌদি তথ্যানুসারে আবদুল্লাহর আস্থাভাজন একান্ত সচিব খালিদ আল তুয়াইজরি মুতায়েবকে ডেপুটি যুবরাজ করতে পরিকল্পনা করেন। মিসরের সিসির অফিস ম্যানেজার আব্বাস কামিলের পাঠানো এক তথ্যেও মুতায়েব ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে সালমানের ওপর অধিক চাপ প্রয়োগের আগেই বাদশাহ আবদুল্লাহ অসুস্থ হয়ে মারা যান। তুয়াইজরি, প্রিন্স বন্দর ও বিন জায়েদ এখন সময়ের অন্তরালে চলে গেছেন। এখন তাদের মধ্যে দু’জন অন্তত ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়ে অতীত হয়ে গেছেন। তৃতীয় জনের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে, সেটি আগ্রহের সাথে অবলোকন করতে হবে। এর মাধ্যমে রিয়াদ থেকে কায়রো পর্যন্ত ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে যে চক্র ছিল, সেটিও ভেঙে গেল।
সিসি হারাতে পারেন ফাঁকা চেক
আবদুল্লাহর রাজত্বের সময় সৌদি রাজনীতিতে সবচেয়ে বেপরোয়া পপাত ছিল মিসর ইস্যুতে। হোসনি মুবারকের শাসন এবং তার সহযোগীদের পতনে যে বিপ্লবী জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, খালিদ আল তুয়াইজরির নেতৃত্বে একদল সেটিকে মুসলিম ব্রাদারহুডের সৃষ্টি সৌদি রাজতন্ত্রের সামনে অনেক বড় ঝুঁকি হিসেবে বাদশাহর সামনে তুলে ধরে। এতে আবদুল্লাহ প্রভাবিত হয়ে সৌদি আরবের আগের অবস্থান থেকে সরে এসে মুরসির সরকারকে উৎখাত করে মিসরে পাশবিক সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আরব আমিরাত-ইসরাইল পরিকল্পনার সাথে জড়িয়ে পড়েন। এর ফলে মিসর সহিংসতা ও গোলযোগের দীর্ঘস্থায়ী ও গভীর ফাঁদে পরিণত হয়। আসল বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠার আগেই সামরিক অভ্যুত্থানের সমর্থনে এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া ছিল আবদুল্লাহর জন্য ভয়ানক; বিশ্বের চোখের সামনে সামরিক জান্তা হাজার হাজার মিসরীয়ের রক্তসাগরে অবগাহনের পরও তাদের সমর্থন জানিয়ে যাওয়া ছিল তার জন্য আরো বেশি ভয়ানক। সিসি সরকারকে সমর্থন জোগানোর ধারণা আবদুল্লাহর মনে এত গভীরভাবে বদ্ধমূল করা হয়েছিল যে, তার পররাষ্ট্রনীতির শীর্ষ অগ্রাধিকার হয়ে ওঠে এটি। সিসির অনুরোধে আবদুল্লাহ তার জন্য এমন কিছু করেন, যাতে রাষ্ট্রের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিদ্যমান সৌদি মর্যাদার বিষয় পর্যন্ত বিবেচনায় আনা হয়নি। সিসির জন্য আবদুল্লাহ কাতারের সাথে নিজ দেশকে প্রায় যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে যান আর জিসিসিকে পৌঁছান বিপর্যয়ের প্রান্তসীমায়। এই সিসির সরকারের জন্য তুরস্কের সাথে সম্পর্কে বড় ফাটল সৃষ্টি করেন আবদুল্লাহ। তার পর বিস্ময়করভাবে ‘সন্ত্রাসী’ তালিকায় যোগ করেন মুসলিম ব্রাদারহুডের নাম। অথচ পশ্চিমা সরকারগুলোও এ পদক্ষেপ তাদের বিরুদ্ধে নেয়নি। মিসরের অভ্যুত্থানের পক্ষে বেপরোয়া অবস্থানে সৌদি আরব তার কৌশলগত প্রতিপক্ষ ইরানের বিরুদ্ধে খেলার মতো অনেক কার্ড নিজের হাতছাড়া করে। সৌদি নীতিতে অনুভূত প্রধান প্রতিপরে বিরুদ্ধে কৌশলগত জোট গড়ার স্বার্থে আঞ্চলিকভাবে প্রভাবশালী তুরস্কের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার যে প্রয়োজন ছিল, সেটি বিসর্জন দেয়া হয় কেবল সিসির জন্য।
সৌদি রাজপ্রসাাদে এরই মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটেছে, তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। মিসরের প্রেসিডেন্ট আল সিসি ও আমিরাতের বিন জায়েদ আবদুল্লাহর দাফন অনুষ্ঠান থেকে দূরে ছিলেন। যে সময়ে সিসির জন্য সৌদি নগদ সহায়তা অনেক বেশি প্রয়োজন ছিল, তখন অধিক অস্থির হয়ে পড়েছে মিসরের পরিস্থিতি। সিনাইয়ে পূর্ণ স্কেলের সামরিক অভিযানের সাথে সারা দেশে বিক্ষোভ ক্রমবর্ধমান রূপ নিচ্ছে, যা কখনো শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে না। মিসরীয় পাউন্ডের দাম এখন স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে কম। সিসির জন্য বিকল্প ক্রমেই সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে। এটি মিসরীয় সেনাবাহিনীর জন্য মোটেই সুখকর নয় যে রিয়াদে তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক তুয়াইজরি হয়ে পড়েছেন কক্ষচ্যুত। এখন সালমান-নায়েফ মিসরকে যদি এই তহবিলের জোগান অব্যাহত না রাখার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠবে সিসির জন্য। এ ছাড়া প্রতিশ্রুত ও বাস্তব সাহায্য অবমুক্তির মধ্যেও একটি ব্যবধান থেকে যেতে পারে।
ভারসাম্যে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ
বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুতে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতির জন্য ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার পুরনো নীতিতে প্রত্যাবর্তনের একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সম্ভবত বাদশাহ সালমান ও উপ-ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ সৌদি আরবকে সে দিকে নিতে চাচ্ছেন। তবে তার মানে এটি হবে না যে, সৌদি আরব মিসরে সিসির শাসনকে একবারে পরিত্যাগ করবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ব্রাদারহুডকে নিয়ে আসার একটি সমঝোতামূলক পদক্ষেপ সামনে হয়তো দেখা যেতে পারে। যার প্রয়োজনের কথা আল বারাদি তার সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন পরিস্থিতিতে সৌদি-তুরস্ক-কাতার সমঝোতাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। সিংহাসনে বাদশাহ সালমান আরোহণের পর সবার সাথে একটি ব্যাপক পুনর্মিলন ও আস্থা ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। এটি মধ্যপন্থী ইসলামি আন্দোলন এবং এরদোগান-তামিমের জন্য ভালো সুযোগ এনে দিতে পারে। এমনকি এটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে মিসরকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সিসির জন্য সুযোগ সৃষ্টি করবে, যা তার জন্য একটি নিরাপদ প্রস্থানও নিশ্চিত করতে পারে। ব্রাদারহুডকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণারও পরিবর্তন হতে পারে। তিউনিসিয়ার আন নাহদা নেতা ড. রশিদ ঘানুশি আবদুল্লাহর মৃত্যুতে শোক জানাতে এলে সালমান নিজে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। ঘানুশি হলেন সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ ইসলামিস্ট (মুসলিম ব্রাদারহুড ঘরানার) নেতা, সৌদি আরবে যাকে এভাবে স্বাগত জানানো হলো। ওয়াক্ফ ও ইসলামিবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে সুলায়মান এবি আল-খাইলের নিয়োগও সৌদি নীতি পরিবর্তনের আরেকটি লক্ষণ হিসেবে মূল্যায়িত হচ্ছে। সৌদি আরবের গত সপ্তাহের রাজনৈতিক ভূমিকম্পের বিভিন্নমুখী পরোক্ষ ফলাফলও আসতে পারে। ব্রিটেনে ব্রাদারহুডের ব্যাপারে তদন্তকাজের সাথে জড়িত সিনিয়র ইউকে কর্মকর্তারা খুশি হবেন যে, তারা ব্রাদারহুডের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত না থাকার ব্যাপারে যে অনুসিদ্ধান্তে এসেছেন, তা প্রকাশ করতে পারবেন। ডেভিড ক্যামেরনের নির্দেশে স্যার জন জেনকিন্সের নেতৃত্বে পরিচালিত এ তদন্তের রিপোর্টটি সৌদি আরব ও আমিরাতের চাপে তারা এত দিন প্রকাশ করতে পারেননি। সালমান বাদশাহ হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত এ দুই দেশের নেতৃত্ব মিসরের সন্ত্রাসবাদে ব্রাদারহুডের কোনো সম্পৃক্ততা না পাওয়া ‘ভুল’ সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করছিল। এর মাধ্যমে ব্রাদারহুড সন্ত্রাসের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পাচ্ছিল। রিয়াদের নতুন কর্তারা এমন ধরনের একটি উপসংহারকে এখন স্বাগত জানাতে পারেন।
তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন
মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিস্ট দমনের অন্যতম নায়ক হিসেবে খ্যাত সাবেক সৌদি গোয়েন্দাপ্রধান প্রিন্স বন্দর বিন সুলতানের কাছ থেকে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধানের অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটিও নিয়ে নেয়া হয়েছে। তিনি এখন আর বাদশাহর উপদেষ্টার পদেও নেই। কার্যত এর মাধ্যমে বন্দর বিন সুলতানের সব ধরনের ক্ষমতার অবসান ঘটল। একই সাথে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র থেকে মুসলিম ব্রাদারহুডকে নির্মূল করার জন্য তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তারও ইতি ঘটছে বলে মনে হচ্ছে এ মুহূর্তে। এই দুঃস্বপ্ন বাস্তবায়নের আরেক নায়ক ছিলেন রয়েল কোর্টের সেক্রেটারি জেনারেল, বাদশাহ আবদুল্লাহর একান্ত সচিব ও নিয়োগ কমিটির প্রধান খালিদ আল তুয়াইজরি। রাজ পরিবারের কেউ না হয়েও আমেরিকা থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ ডিগ্রি নিয়ে আসা এ লোক বাদশাহ আবদুল্লাহর আমলে সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিলেন। আরব আমিরাতের ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স বিন জায়েদের সাথে যৌথ পরিকল্পনা নিয়ে মিসরে ড. মুরসির সরকারকে সরিয়ে সিসির নির্মম সেনা সরকার প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি মূল ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। সৌদি প্রশাসনের সর্বত্র থেকে ইসলামিস্টদের বিদায় করে লিবারেলিস্ট-সেকুলারিস্টদের বসানোর মূল কাজটিও করেন তিনি। বাদশাহ আবদুল্লাহর দাফন সম্পন্ন করার আগেই যে দু’টি কাজ বাদশাহ সালমান সম্পন্ন করেন তার মধ্যে একটি হলো মুকরিন বিন আবদুল আজিজকে ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণা আর বাকি কাজটি হলো খালিদ আল তুয়াইজরিকে রয়েল কোর্টের সেক্রেটারি জেনারেলসহ রাষ্ট্রের সব পদ থেকে অপসারণ করা। অপসারণের পর কয়েক ঘণ্টা সময় দেয়া হয় তার কাগজপত্র নেয়ার জন্য। এর পর তাকে আর রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। সৌদি প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত তার পরিবারের শতাধিক কর্মকর্তাকে তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এই পদক্ষেপ এ অঞ্চলের অস্থিরতা দূর করতে সহায়ক হবে বলে মনে করা হয়।
রণশীল এবং উদার
সালমান দায়িত্ব নেয়ার পর সৌদি সমাজের ধর্মীয় প্রভাব শিথিল করার উদ্যোক্তা অনেককে বিদায় করার পাশাপাশি এসব পদে ঐতিহ্যবাদীদের নিয়োগ দান করা হয়েছে। একজন রণশীল ধর্মীয় নেতা সাদ আল-শেখরিকে বাদশাহ সালমান ব্যক্তিগত উপদেষ্টা করেছেন। তিনি অবশ্য ভারসাম্য রাখার জন্য আল আরাবিয়া সংবাদ চ্যানেলের সাবেক প্রধান উদারপন্থী তরুণ আদেল আল-তোরাইফিকে নতুন তথ্যমন্ত্রী করেছেন। ক্ষমতার নতুন বিন্যাসে ক্ষমতাধর হিসেবে নতুন দু’জনের আবির্ভাব হয়েছে। তারা হলেন নবনিযুক্ত ক্রাউন প্রিন্স স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মোহাম্মদ বিন নায়েফ এবং নবনিযুক্ত প্রতিরামন্ত্রী, রয়েল কোর্টের জেনারেল সেক্রেটারি এবং একটি নবগঠিত মন্ত্রিসভা কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন সালমান। বাদশাহর অপর ছেলে আবদুল আজিজ পেট্রোলিয়াম উপমন্ত্রী হয়েছেন। নতুন বিন্যাসে সৌদি আরবে ধর্মীয় নেতৃত্বের ঐতিহ্যবাহী সুদাইরি পরিবারের সন্তানদের আবারো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আনা হয়েছে। আবদুল্লাহর সময় তাদের অনেকে ছিটকে পড়েছিলেন। তবে পারিবারিক ভারসাম্যকে সালমান সমুন্নত রেখেছেন। তার নতুন পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম হলো আবদুল্লাহর দুই ছেলে প্রিন্স মিশালকে রাজধানী রিয়াদের এবং প্রিন্স তুর্কিকে মক্কার গভর্নর পদ থেকে বিদায় করা। কিন্তু আবদুল্লাহর অপর ছেলে মুতায়েবকে ন্যাশনাল গার্ড প্রধান হিসেবে বহাল রাখা হয়েছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পদে আবদুল্লাহর অন্য এক ছেলেও বহাল রয়েছেন। নতুন ক্রাউন প্রিন্স মুকরিনের দুই ছেলেকেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আবদুল্লাহর রাজত্বের শেষ বছরে রাজকীয় নিয়োগে ক্রাউন প্রিন্সের সাথে পরামর্শ না করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে প্রিন্স মুতায়েব ও খালেদ তুয়াইজরির সাথে পরামর্শ করে। এসব নিয়োগের বেশির ভাগ এখন বাতিল হয়ে গেছে। বাদশাহ সালমান তার রাজত্বের সূচনা করেছেন জনগণের ভালোবাসা জয় করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। তিনি রাষ্ট্রের সব কর্মচারীর জন্য দুই মাসের বেতন সমান বোনাস এবং সব অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীর জন্য দুই মাস বোনাস পেনশন ঘোষণা করেছেন। বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্ররাও দুই মাস সমান অতিরিক্ত তহবিল পাবেন। এ জন্য ব্যয় হবে তিন হাজার কোটি ডলারের মতো। তেলের দাম কমে যাওয়ার জন্য আবদুল্লাহ যেখানে সরকারের খরচ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেখানে নতুন বাদশাহ জনগণকে বিশেষ সুবিধা দিতে বিপুল তহবিল ব্যয় করছেন।
কৌশলগত ভ্রান্তি
সৌদি আরবের মতাদর্শগত প্রবণতা নিয়ে এখন যে রেষারেষি ও বিরোধ চলছে, তা রণশীল সৌদি ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। দেশটি সাফল্যের সাথে জাতীয়তাবাদী, নাসেরবাদী ও বাথ পার্টির উত্থানপ্রবণতা মোকাবেলা করেছে। একই সাথে দেশটির বামপন্থী ও বিপ্লবী সরকারের সাথে ইন্টারেকশনের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। সৌদি আরবের সাথে মুসলিম ব্রাদারহুডের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল দীর্ঘ দিন। সৌদি কৌশলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এটি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কার্ড খেলেছে। কৌশলগত বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভালো খেলা কিভাবে খেলতে হয় তাতে দক্ষতা অর্জন করেছে। বিভিন্ন সঙ্কটে সৌদি আরব সুষম নীতি বজায় রাখা এবং একটি শূন্য সমষ্টি সমীকরণের মধ্যে স্খলন এড়াতে সম হয়েছে। কারো সাথে বিরোধ নিষ্পত্তি করেছে দক্ষতার সাথে আবার কারো সাথে সীমিত সঙ্ঘাতেও জড়িয়েছে। কিন্তু সব কিছু করা গেছে একধরনের ভারসাম্য বজায় রেখে এবং চূড়ান্ত কোনো লড়াইয়ে নিজে না জড়িয়ে। এভাবে দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ার হিসেবে থেকেছে। আর এ অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হয় সঙ্ঘাত ও রেষারেষিতে চরমভাবে কোনো পক্ষ গ্রহণ না করে।
বাদশাহ আবদুল্লাহর পররাষ্ট্রনীতিতে শেষ দিকে এসে স্বাভাবিক এ সৌদি কৌশল থেকে বিচ্যুতি ঘটে। এ অঞ্চলের সাম্প্রতিক অস্থির পরিস্থিতিতে এর প্রভাবই দেখা যাচ্ছে। দেশটির প্রতিবেশী ইয়েমেনের রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে হুতিদের কাছে। ইরান নিয়ন্ত্রিত এই বিদ্রোহী মিলিশিয়াকে মোকাবেলা করার মতো সুন্নি শক্তির মধ্যে এখন কেবলই রয়েছে আলকায়েদা। ইরাকে সুন্নি ভুক্তভোগীরা নির্বিচার গণহত্যার কাছাকাছি এবং অপমানের প্রান্তসীমায় পৌঁছার পরও সেখানকার অবস্থাকে উপো করেছে সৌদি আরব। এর ফলে তাদের রক্ষার জন্য আবির্ভূত হতে দেখা গেল আইসিসকে। সৌদি হিসাব-নিকাশ ও ভীতির কারণে সিরিয়ার বিপ্লব সাফল্যের মুখ দেখেনি। আর এ শূন্যস্থান দখল করেছে আলকায়েদা ও আইএস। এর বাইরেও দেখা গেছে রিয়াদের ফোকাস বারবার যথাস্থান থেকে সরে গেছে অন্যত্র। এর ফলে লেবানন হয়ে পড়েছে হিজবুল্লাহ নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে। আরব বিশ্বে সবচেয়ে সুসংহত ব্লক হিসেবে চিহ্নিত উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ (জিসিসি) বিভক্তির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। কাতারকে অবরুদ্ধ করে রাখার হুমকি দেয়া হয়েছে। ওমান ইরানের সাথে একটি কৌশলগত মৈত্রী গড়ে নিজেকে প্রত্যাহার করার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে।
মরহুম আবদুল্লাহর আমলে ফিলিস্তিন প্রশ্নেও সৌদি নীতি ছিল বিভিন্ন ত্রুটি, ব্যক্তিগত ধারণা ও মেজাজ মর্জিনির্ভর। মক্কায় ফিলিস্তিনি পুনর্মিলন সম্মেলন করার পর আবদুল্লাহ হামাসের সাথে একটি ব্যক্তিগত বিবাদে জড়িয়ে পড়ায় উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়। ইসরাইলের গাজা যুদ্ধ এবং ইসরাইল-মিসরের অবরোধসংক্রান্ত ইস্যুতে সৌদি আরবের এক রকম নীরব অথবা ভুল পক্ষে অবস্থান ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জেরুসালেম রার দাবি করে ইরান যেখানে সাফল্যের সাথে ফিলিস্তিন কার্ড ব্যবহার করতে পেরেছে, সেখানে মরহুম বাদশাহ নিজের তলোয়ার ভেঙে শত্রুর সুবিধা করে দিয়েছেন। ইসরাইল-মিসরের গাজা অবরোধে নীরব সমর্থন দিয়ে ইরানি প্রভাব বলয়ে ঠেলে দিয়েছে ফিলিস্তিনিদের। ইয়েমেনের ব্রাদারহুড হিসেবে পরিচিত আল ইসলাহকে দুর্বল করতে আরব আমিরাতের হুতির সাথে গোপন সমঝোতাকে এগোতে দেয়ায় সেখানে এখন শিয়া মিলিশিয়ার অগ্রগতি রুখতে কাউকে পাশে পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রমবর্ধমান ইরানের প্রভাব মোকাবেলা করতে ইয়েমেন, ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যপন্থী ইসলামি আন্দোলনের সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বিদায়ী সৌদি শাসক সেই প্রয়োজন অনুভব করতে পারেননি। ফলে আইএস সৌদি সীমান্তে হানা দিলে নিজ দেশের অভ্যন্তরে যে রকম সাড়া পাওয়া উচিত ছিল সেটি পাওয়া যাচ্ছে না।
এটি অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই যে, আরব জাগরণ সৌদি রাজপরিবারের ক্ষমতার সামনে চ্যালেঞ্জ সৃর্স্টি করেছিল। আর এ জাগরণে ব্রাদারহুড ভূমিকা রাখায় তাদের প্রতি সৌদি দৃষ্টিভঙ্গির পুনর্বিবেচনাও অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য বা মাত্রার যে বিষয়টি থাকা উচিত ছিল সেটি এমনভাবে উপেক্ষিত হয় যে, তা সৌদি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার মূল ভিত্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জনগণের বড় অংশের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে রাজপরিবারের। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর আয়াতুল্লাহ খোমেনি বিপ্লব রফতানির কথা বললে দেশটির প্রভাব বিস্তারের পথে বাধা দিতে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সৌদি আরবের পক্ষ থেকে। এসব ক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য অর্জিতও হয়েছে। কিন্তু মধ্যপন্থী ইসলামি আন্দোলনকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে নির্মূল করার যে নীতির দিকে বাদশাহ আবদুল্লাহকে বন্দর-খালেদ চক্র ঠেলে দিয়েছে, তা সৌদি আরবের সার্বিক জনভিত্তিকে দুর্বল করেছে।
কাতার ও তুরস্কের সাথে দূরত্ব ঘুচবে
এরই মধ্যে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন তাতে আবদুল্লাহর নীতির সমালোচকেরা এখন নতুন বাদশাহর প্রশংসা করছেন। আবদুল্লাহ তার শাসনের শেষ বছরে অনেকটা বেপরোয়া ধরনের মনোভাব নিয়েছিলেন। সালমান চাচ্ছেন তার বড় ভাই বাদশাহ ফাহাদ আমলের সংযত মধ্যপন্থায় ফিরে যেতে। সেই সময় রাজপরিবার ইসলামপন্থী উদার নির্বিশেষে সবার সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। নতুন বাদশাহ ধারাবাহিকতার ওপর জোর দিয়েছেন, কিন্তু তার মতার প্রথম সাত দিনে এমন কিছু হয়েছে যাতে এ পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে উল্লেখযোগ্যভাবে। রাজনীতির বাইরে ব্যক্তিগত সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। ফলে এখন দেখার ব্যাপার হলো বিদেশে কারা সালমান বা নায়েফের বন্ধু সেটি। বাদশাহ সালমানের ঘনিষ্ঠ হলেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ। সালমান বাদশাহ হওয়ার পর কাতারের ওপর বৃহৎ প্রতিবেশী সৌদি আরবের অবরোধ আরোপ বা জিসিসি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার যে হুমকি ছিল, তা এখন অতীতের বিষয়। একইভাবে মোহাম্মদ বিন নায়েফ হলেন সিনিয়র তুর্কি কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফলে এ দুই দেশের টানাপড়েনেরও অবসান ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। ২০১১ আরব বিপ্লবের পর তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যে সৃষ্ট দূরত্ব নিরসন; ইরাক, ইয়েমেন, লেবানন ও সিরিয়ায় ইরানের প্রসারিত প্রভাব মোকাবেলার জন্যই প্রয়োজন তা নয়, একই সাথে তার প্রয়োজন নেতৃবৃন্দের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণেও। এই ফাটল খুব সম্ভবত জোড়া লেগে যাবে।
ব্রাদার নির্মূলে বন্ধুহীন বিন জায়েদ!
ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের জন্য যেমন সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটতে পারে তেমনিভাবে বৈরী সম্পর্কের কারণে অবনতিও ঘটতে পারে। একসময় বিন নায়েফের সাথে যারা ব্যক্তিগত শত্রুতা করেছিলেন এখন হয়তো তাদের মূল্য দেয়ার সময় এসেছে। মোহাম্মদ বিন নায়েফ এখনো ভুলে যাননি যে, আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স ও ব্রাদারহুড নির্মূল অভিযানের অন্যতম নায়ক মোহাম্মদ বিন জায়েদ ১২ বছর আগে রিচার্ড হাসের সাথে দুই ঘণ্টার কথোপকথনের সময় তখনকার সৌদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মোহাম্মদের বাবা নায়েফ সম্পর্কে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলেন, ‘তাকে দেখে মনে হয় বানর থেকে মানুষ হয়েছে বলে ডারউইনের যে তত্ত্ব, তা সঠিক ছিল’। আবুধাবির শাসকের সাথে নিষ্পত্তি করার মতো আরো স্কোর সম্প্রতি বিন নায়েফের ঝুলিতে জমা হয়েছে। আমিরাতের রাজকীয় আদালত নিয়ন্ত্রিত ইরেম নিউজ মোহাম্মদ বিন নায়েফকে ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মুখপত্রে বলা হয়েছে, ‘বাদশাহ আবদুল আজিজের বিশিষ্ট নাতিদের মধ্যে থেকে মোহাম্মদ বিন নায়েফের নির্বাচনপ্রক্রিয়া পর্যবেকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। সালমান এ নিয়োগের ব্যাপারে এলিজিয়েন্স কাউন্সিলের পরামর্শ নেননি।’ অথচ বাদশাহ আবদুল্লাহও এ ধরনের নিয়োগে পরামর্শ করেননি। বিন জায়েদ চাচ্ছিলেন আবদুল্লাহর ছেলে মুতায়েব ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স হোক। গোপন সৌদি তথ্যানুসারে আবদুল্লাহর আস্থাভাজন একান্ত সচিব খালিদ আল তুয়াইজরি মুতায়েবকে ডেপুটি যুবরাজ করতে পরিকল্পনা করেন। মিসরের সিসির অফিস ম্যানেজার আব্বাস কামিলের পাঠানো এক তথ্যেও মুতায়েব ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে সালমানের ওপর অধিক চাপ প্রয়োগের আগেই বাদশাহ আবদুল্লাহ অসুস্থ হয়ে মারা যান। তুয়াইজরি, প্রিন্স বন্দর ও বিন জায়েদ এখন সময়ের অন্তরালে চলে গেছেন। এখন তাদের মধ্যে দু’জন অন্তত ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়ে অতীত হয়ে গেছেন। তৃতীয় জনের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে, সেটি আগ্রহের সাথে অবলোকন করতে হবে। এর মাধ্যমে রিয়াদ থেকে কায়রো পর্যন্ত ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে যে চক্র ছিল, সেটিও ভেঙে গেল।
সিসি হারাতে পারেন ফাঁকা চেক
আবদুল্লাহর রাজত্বের সময় সৌদি রাজনীতিতে সবচেয়ে বেপরোয়া পপাত ছিল মিসর ইস্যুতে। হোসনি মুবারকের শাসন এবং তার সহযোগীদের পতনে যে বিপ্লবী জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, খালিদ আল তুয়াইজরির নেতৃত্বে একদল সেটিকে মুসলিম ব্রাদারহুডের সৃষ্টি সৌদি রাজতন্ত্রের সামনে অনেক বড় ঝুঁকি হিসেবে বাদশাহর সামনে তুলে ধরে। এতে আবদুল্লাহ প্রভাবিত হয়ে সৌদি আরবের আগের অবস্থান থেকে সরে এসে মুরসির সরকারকে উৎখাত করে মিসরে পাশবিক সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আরব আমিরাত-ইসরাইল পরিকল্পনার সাথে জড়িয়ে পড়েন। এর ফলে মিসর সহিংসতা ও গোলযোগের দীর্ঘস্থায়ী ও গভীর ফাঁদে পরিণত হয়। আসল বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠার আগেই সামরিক অভ্যুত্থানের সমর্থনে এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া ছিল আবদুল্লাহর জন্য ভয়ানক; বিশ্বের চোখের সামনে সামরিক জান্তা হাজার হাজার মিসরীয়ের রক্তসাগরে অবগাহনের পরও তাদের সমর্থন জানিয়ে যাওয়া ছিল তার জন্য আরো বেশি ভয়ানক। সিসি সরকারকে সমর্থন জোগানোর ধারণা আবদুল্লাহর মনে এত গভীরভাবে বদ্ধমূল করা হয়েছিল যে, তার পররাষ্ট্রনীতির শীর্ষ অগ্রাধিকার হয়ে ওঠে এটি। সিসির অনুরোধে আবদুল্লাহ তার জন্য এমন কিছু করেন, যাতে রাষ্ট্রের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিদ্যমান সৌদি মর্যাদার বিষয় পর্যন্ত বিবেচনায় আনা হয়নি। সিসির জন্য আবদুল্লাহ কাতারের সাথে নিজ দেশকে প্রায় যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে যান আর জিসিসিকে পৌঁছান বিপর্যয়ের প্রান্তসীমায়। এই সিসির সরকারের জন্য তুরস্কের সাথে সম্পর্কে বড় ফাটল সৃষ্টি করেন আবদুল্লাহ। তার পর বিস্ময়করভাবে ‘সন্ত্রাসী’ তালিকায় যোগ করেন মুসলিম ব্রাদারহুডের নাম। অথচ পশ্চিমা সরকারগুলোও এ পদক্ষেপ তাদের বিরুদ্ধে নেয়নি। মিসরের অভ্যুত্থানের পক্ষে বেপরোয়া অবস্থানে সৌদি আরব তার কৌশলগত প্রতিপক্ষ ইরানের বিরুদ্ধে খেলার মতো অনেক কার্ড নিজের হাতছাড়া করে। সৌদি নীতিতে অনুভূত প্রধান প্রতিপরে বিরুদ্ধে কৌশলগত জোট গড়ার স্বার্থে আঞ্চলিকভাবে প্রভাবশালী তুরস্কের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার যে প্রয়োজন ছিল, সেটি বিসর্জন দেয়া হয় কেবল সিসির জন্য।
সৌদি রাজপ্রসাাদে এরই মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটেছে, তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। মিসরের প্রেসিডেন্ট আল সিসি ও আমিরাতের বিন জায়েদ আবদুল্লাহর দাফন অনুষ্ঠান থেকে দূরে ছিলেন। যে সময়ে সিসির জন্য সৌদি নগদ সহায়তা অনেক বেশি প্রয়োজন ছিল, তখন অধিক অস্থির হয়ে পড়েছে মিসরের পরিস্থিতি। সিনাইয়ে পূর্ণ স্কেলের সামরিক অভিযানের সাথে সারা দেশে বিক্ষোভ ক্রমবর্ধমান রূপ নিচ্ছে, যা কখনো শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে না। মিসরীয় পাউন্ডের দাম এখন স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে কম। সিসির জন্য বিকল্প ক্রমেই সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে। এটি মিসরীয় সেনাবাহিনীর জন্য মোটেই সুখকর নয় যে রিয়াদে তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক তুয়াইজরি হয়ে পড়েছেন কক্ষচ্যুত। এখন সালমান-নায়েফ মিসরকে যদি এই তহবিলের জোগান অব্যাহত না রাখার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠবে সিসির জন্য। এ ছাড়া প্রতিশ্রুত ও বাস্তব সাহায্য অবমুক্তির মধ্যেও একটি ব্যবধান থেকে যেতে পারে।
ভারসাম্যে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ
বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুতে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতির জন্য ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার পুরনো নীতিতে প্রত্যাবর্তনের একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সম্ভবত বাদশাহ সালমান ও উপ-ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ সৌদি আরবকে সে দিকে নিতে চাচ্ছেন। তবে তার মানে এটি হবে না যে, সৌদি আরব মিসরে সিসির শাসনকে একবারে পরিত্যাগ করবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ব্রাদারহুডকে নিয়ে আসার একটি সমঝোতামূলক পদক্ষেপ সামনে হয়তো দেখা যেতে পারে। যার প্রয়োজনের কথা আল বারাদি তার সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন পরিস্থিতিতে সৌদি-তুরস্ক-কাতার সমঝোতাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। সিংহাসনে বাদশাহ সালমান আরোহণের পর সবার সাথে একটি ব্যাপক পুনর্মিলন ও আস্থা ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। এটি মধ্যপন্থী ইসলামি আন্দোলন এবং এরদোগান-তামিমের জন্য ভালো সুযোগ এনে দিতে পারে। এমনকি এটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে মিসরকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সিসির জন্য সুযোগ সৃষ্টি করবে, যা তার জন্য একটি নিরাপদ প্রস্থানও নিশ্চিত করতে পারে। ব্রাদারহুডকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণারও পরিবর্তন হতে পারে। তিউনিসিয়ার আন নাহদা নেতা ড. রশিদ ঘানুশি আবদুল্লাহর মৃত্যুতে শোক জানাতে এলে সালমান নিজে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। ঘানুশি হলেন সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ ইসলামিস্ট (মুসলিম ব্রাদারহুড ঘরানার) নেতা, সৌদি আরবে যাকে এভাবে স্বাগত জানানো হলো। ওয়াক্ফ ও ইসলামিবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে সুলায়মান এবি আল-খাইলের নিয়োগও সৌদি নীতি পরিবর্তনের আরেকটি লক্ষণ হিসেবে মূল্যায়িত হচ্ছে। সৌদি আরবের গত সপ্তাহের রাজনৈতিক ভূমিকম্পের বিভিন্নমুখী পরোক্ষ ফলাফলও আসতে পারে। ব্রিটেনে ব্রাদারহুডের ব্যাপারে তদন্তকাজের সাথে জড়িত সিনিয়র ইউকে কর্মকর্তারা খুশি হবেন যে, তারা ব্রাদারহুডের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত না থাকার ব্যাপারে যে অনুসিদ্ধান্তে এসেছেন, তা প্রকাশ করতে পারবেন। ডেভিড ক্যামেরনের নির্দেশে স্যার জন জেনকিন্সের নেতৃত্বে পরিচালিত এ তদন্তের রিপোর্টটি সৌদি আরব ও আমিরাতের চাপে তারা এত দিন প্রকাশ করতে পারেননি। সালমান বাদশাহ হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত এ দুই দেশের নেতৃত্ব মিসরের সন্ত্রাসবাদে ব্রাদারহুডের কোনো সম্পৃক্ততা না পাওয়া ‘ভুল’ সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করছিল। এর মাধ্যমে ব্রাদারহুড সন্ত্রাসের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পাচ্ছিল। রিয়াদের নতুন কর্তারা এমন ধরনের একটি উপসংহারকে এখন স্বাগত জানাতে পারেন।
No comments