দগ্ধতার অন্য সমীকরণ by পাভেল পার্থ
রাজনৈতিক
সহিংসতায় নিদারুণ দগ্ধ দেশ। জীবন যেখানে হয়ে উঠছে এক অনিবার্য মরণসংখ্যা।
সব দরবার আর আহাজারি এখন চলমান এই দগ্ধতা ঘিরেই। চলতি আলাপখানি সব দগ্ধতার
ন্যায়বিচার চায়। কিন্তু দগ্ধতার এক অন্য সমীকরণ ঘিরে। যে সমীকরণের মূলে
কোনো ৫ জানুয়ারি নেই, নৌকা-ধানের শীষের সংঘাত নেই। সহিংসতার এই বাহাদুরি
নির্বাচন-মসনদ ঘিরে উসকায় না। কিন্তু এই দগ্ধতা টিকে আছে দীর্ঘ সময়জুড়ে।
পেট্রোল বোমা বা বারুদ নয়, বাঙালি-বাহাদুরির প্রশ্নহীন সহিংসতায় বছরের
প্রথম মাসেই আবারও দগ্ধ হলো নানা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। রাজনৈতিক সহিংসতার
বিচূর্ণ ছাইয়ের তলায় এসব দগ্ধ আহাজারি অনুচ্চারিত হয়েই থাকল। সরকার বা
বিরোধী দল, গণমাধ্যম কি গণতন্ত্র কেউ এসব জখম ও দগ্ধতার বিরুদ্ধে তেমন রা
করেনি। অন্যদিকে রাজনৈতিক সহিংসতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন সাহস নিয়ে
দাঁড়িয়েছে। দগ্ধতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র জনগণকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান
জানিয়েছে। পেট্রোল বোমা হামলাকারীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার পর্যন্ত
ঘোষণা করা হয়েছে। পেট্রোল বোমা হামলার সঙ্গে হয়তো কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে
আছে গণতন্ত্র উদ্ধার কি গণতন্ত্র রক্ষার রাজনীতি।
সাঁওতাল বা বাগদী জনপদে প্রশ্নহীন হামলার সঙ্গে কিন্তু এই 'গণতন্ত্র রক্ষা কি হত্যার' কোনো হদিস নেই। তাহলে কেন সেখানে হামলা ও দগ্ধতা থামছে না? সেখানে জিইয়ে থাকা এই দগ্ধতার সমীকরণ অন্য। রাষ্ট্রের অধিপতি মনস্তত্ত্বের 'গণতন্ত্র ডিসকোর্স' দিয়ে এই দগ্ধতার সমীকরণ টিকে থাকছে না। নির্দয়ভাবে সেখানকার জনগণের ভূমি, সম্পদ, জানমাল কি জমানা ছিনতাই এই দগ্ধতার মর্মমূলে। আর এটি ঘটে চলেছে বাঙালির প্রবল জাত্যভিমানের কারণেই। প্রশ্ন হলো, এই প্রবল জাত্যভিমান কে টিকিয়ে রাখছে? কে উসকে দিচ্ছে? রাষ্ট্রই বৈধতা দিয়ে চলেছে এই প্রশ্নহীন জাতদেমাগের। নয়াউদারবাদী চলমান করপোরেট ব্যবস্থা জোরদার রাখছে বৈষম্যের এই মনস্তত্ত্ব। রাষ্ট্র তাই দেশের বাঙালি বাদে অপরাপর সব জাতিকে কখনও নাম দিয়েছে 'উপজাতি'।
কাউকে 'উপ' হিসেবে চিহ্নিত করে রাষ্ট্র তাহলে কোন ধরনের গণতন্ত্র রক্ষা বা বিপর্যয়ের জন্য মায়াকান্না ছড়ায়? তার মানে কি এমনই হবে যে, সব 'উপ' পিষ্ট হবে, ক্ষতবিক্ষত হবে। কারণ গণতন্ত্র কেবল বৃহতের, প্রবলের। তাই হয়তো বোমা মেরে বা বোমার কবল থেকে একে বাঁচাতে হয়। 'গণতন্ত্র উদ্ধার কী বিপর্যয়' নিয়ে বাহাস আছে, কিন্তু সহিংসতার বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার। এমনকি রাষ্ট্রও। আর বিচারহীনতার নিশ্চুপ দগ্ধতা নিয়ে লড়ে যায় তাদের আত্মপরিচয়ের রক্তাক্ত ভূগোল, যাদের আমরা 'উপ' করে রাখতে চাই।
৭ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে রাজবাড়ীর পাংশার সরিষা ইউনিয়নের বৃত্তিডাঙা গ্রামের এক বাগদী পরিবারের মা ও মেয়ে ধর্ষিত হয়। এ ঘটনায় পাংশা থানায় ১০ জানুয়ারি একটি মামলা হয়েছে (সূত্র :মামলা নং-৩, ধারা-৭/৯(৩)/৩০)। পুলিশ কেবল ধর্ষক সাফিন শেখকে গ্রেফতার করেছে। ৮ জানুয়ারি রাজশাহীর তানোরের ময়েনপুর গ্রামে সন্ত্রাসীরা সাঁওতাল শিক্ষার্থী বাবলু হেমব্রমকে খুন করে। ৯ জানুয়ারি নওগাঁ সদরের আলঘোষ পাড়ার অজয় রবিদাসের বাড়িতে হামলা চালায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা। ১২ জানুয়ারি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের শ্যামপুর মৌজার ওসমানপুর গ্রামের সাঁওতাল নারী মনি টুডুকে জন্মমাটি থেকে উচ্ছেদের হুমকি দেয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা। নওগাঁর মহাদেবপুরের রাইগা ইউনিয়নের শুকু পাহানের পরিবারও জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদের আক্রমণ সামাল দিচ্ছে। ২৪ জানুয়ারি দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মোস্তফাপুর ইউনিয়নের চিড়াকুটা (হাবিবপুর) সাঁওতাল গ্রাম দগ্ধ-ভস্ম হয় বাঙালি জাত্যভিমানের পেট্রোলে। বরাবরের মতোই বাঙালি পুরুষরা আদিবাসী বসতজমিন দখল করতে আসে, আদিবাসীরা জানবাজি রেখে দাঁড়ায়। সংঘাতে নিহত হন হামলাকারী বাঙালি শফিউল ইসলাম সোহাগ। এ ঘটনায় 'জাতীয় আদিবাসী পরিষদ' ৫৮ সাঁওতাল পরিবারের বস্তুগত ক্ষয়ক্ষতির বিবরণী তৈরি করেছে। ৮ সদস্যের পরিদর্শন দলের মাধ্যমে তৈরি করা এই প্রতিবেদন ২৮ জানুয়ারি তারা সাংগঠনিকভাবে প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি রাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন নিয়ে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত উসকে দেওয়া হয়েছে। পেট্রোল বোমা সহিংসতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র সাহসী হুঁশিয়ারি ঘোষণা করলেও নিজভূমে পরবাসী জনগণের ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাবলয় বরাবরের মতো প্রশ্নহীন কায়দায় নিশ্চুপ।
এর আগেও এক দমবন্ধ সহিংস রক্তপাতের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ পাড়ি দিয়েছে ২০১৩ কি ২০১৪। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সব দলের অংশগ্রহণ বিতর্ক থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব জুলুমকেই সামাল দিতে হলো দেশের নিম্নবর্গকে। উচ্চবর্গের এতে কোনো একবিন্দু কাটাছেঁড়াও হলো না। গরিব বাঙালি মুসলিম পুরুষের চেয়ে দেশের বাঙালি হিন্দু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও দলিত নারী-পুরুষকেই রাজনৈতিক সহিংসতার জের বেশি টানতে হয়েছে। তখনও বিস্ময়করভাবে আমরা খেয়াল করেছি, রাজনৈতিক সহিংসতার বিবরণ দিতে গিয়ে আবারও সেই অধিপতি বাঙালি বয়ানের কায়দাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল সবখানে। গণতন্ত্রের কারবারি থেকে গণমাধ্যম সর্বত্র। ধরে নিচ্ছি, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতার অংশ হিসেবে তাদের জনপদও বাদ থাকেনি। কিন্তু ১৬ জানুয়ারি ২০১৪ ঘোড়াঘাট উপজেলার সিংড়া গ্রামের ভালেন মার্ডির ঘর ও খড়ের পালাও পুড়ে যায় একই আগুনের প্রশ্নহীন তীব্রতায়। নির্বাচন পেরিয়ে যাওয়ার অনেক দিন পর ২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ঋষিকুল ইউনিয়নের ছাতনিপাড়ায় আবারও সহিংস হামলা হয়। সহিংসতার আগুনে পুড়ে যায় লক্ষ্মী ওঁরাওয়ের গোয়ালঘর ও বসতবাড়ি। নিশ্চয়ই এসব ঘটনার সঙ্গে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। নৌকা কি ধানের শীষের রাজনীতি নেই। গণতন্ত্র রক্ষা বা ধ্বংসের কোনো চক্রান্ত নেই। তারপরও তো এসব নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জগৎ নির্দয়ভাবে দগ্ধ হয়ে চলেছে। নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে আত্মপরিচয় ও সম্পর্কের সীমানা।
মাটির তলায় হাজার বছর ধরে প্রাণসত্তার শরীর ক্ষয়ে তৈরি হয় জীবাশ্ম জ্বালানি পেট্রোল। জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর এই সভ্যতা হয়তো আজ এসব পেট্রোল-টেট্রল ছাড়া অচল। কিন্তু দুম করে কি সব হিংসা আর সহিংসতা পেট্রোল বোমার বোতলে বন্দি হয়ে গেল? দগ্ধতার এই সমীকরণ কি কেবল নির্বাচন-বিতর্ক আর গণতন্ত্র উদ্ধার বা ধ্বংস এমন বাহাসের তল থেকেই আমরা দেখতে থাকব? দগ্ধতা আর হিংসা কি কেবল টিকে আছে এসব কারণেই? যদি তাই থাকে তবে কেন জুম-জমিন পুড়ে? তবে কেন কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে এক লাখ স্থানীয় অধিবাসীকে উচ্ছেদ হতে হয়? কেন ইকোপার্ক, বনায়ন, বাঁধ বা খনির নামে তারা নিরুদ্দেশ হয়? জঙ্গল ও জমিন সুরক্ষায় জান দিতে হয়? হিংসা আর বৈষম্যের এই মনস্তত্ত্ব যদি ছিন্নভিন্ন করে না দাঁড়ায় রাষ্ট্র, তবে কি কোনোদিন পেট্রোল বোমা থামবে?
গবেষক ও লেখক
সাঁওতাল বা বাগদী জনপদে প্রশ্নহীন হামলার সঙ্গে কিন্তু এই 'গণতন্ত্র রক্ষা কি হত্যার' কোনো হদিস নেই। তাহলে কেন সেখানে হামলা ও দগ্ধতা থামছে না? সেখানে জিইয়ে থাকা এই দগ্ধতার সমীকরণ অন্য। রাষ্ট্রের অধিপতি মনস্তত্ত্বের 'গণতন্ত্র ডিসকোর্স' দিয়ে এই দগ্ধতার সমীকরণ টিকে থাকছে না। নির্দয়ভাবে সেখানকার জনগণের ভূমি, সম্পদ, জানমাল কি জমানা ছিনতাই এই দগ্ধতার মর্মমূলে। আর এটি ঘটে চলেছে বাঙালির প্রবল জাত্যভিমানের কারণেই। প্রশ্ন হলো, এই প্রবল জাত্যভিমান কে টিকিয়ে রাখছে? কে উসকে দিচ্ছে? রাষ্ট্রই বৈধতা দিয়ে চলেছে এই প্রশ্নহীন জাতদেমাগের। নয়াউদারবাদী চলমান করপোরেট ব্যবস্থা জোরদার রাখছে বৈষম্যের এই মনস্তত্ত্ব। রাষ্ট্র তাই দেশের বাঙালি বাদে অপরাপর সব জাতিকে কখনও নাম দিয়েছে 'উপজাতি'।
কাউকে 'উপ' হিসেবে চিহ্নিত করে রাষ্ট্র তাহলে কোন ধরনের গণতন্ত্র রক্ষা বা বিপর্যয়ের জন্য মায়াকান্না ছড়ায়? তার মানে কি এমনই হবে যে, সব 'উপ' পিষ্ট হবে, ক্ষতবিক্ষত হবে। কারণ গণতন্ত্র কেবল বৃহতের, প্রবলের। তাই হয়তো বোমা মেরে বা বোমার কবল থেকে একে বাঁচাতে হয়। 'গণতন্ত্র উদ্ধার কী বিপর্যয়' নিয়ে বাহাস আছে, কিন্তু সহিংসতার বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার। এমনকি রাষ্ট্রও। আর বিচারহীনতার নিশ্চুপ দগ্ধতা নিয়ে লড়ে যায় তাদের আত্মপরিচয়ের রক্তাক্ত ভূগোল, যাদের আমরা 'উপ' করে রাখতে চাই।
৭ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে রাজবাড়ীর পাংশার সরিষা ইউনিয়নের বৃত্তিডাঙা গ্রামের এক বাগদী পরিবারের মা ও মেয়ে ধর্ষিত হয়। এ ঘটনায় পাংশা থানায় ১০ জানুয়ারি একটি মামলা হয়েছে (সূত্র :মামলা নং-৩, ধারা-৭/৯(৩)/৩০)। পুলিশ কেবল ধর্ষক সাফিন শেখকে গ্রেফতার করেছে। ৮ জানুয়ারি রাজশাহীর তানোরের ময়েনপুর গ্রামে সন্ত্রাসীরা সাঁওতাল শিক্ষার্থী বাবলু হেমব্রমকে খুন করে। ৯ জানুয়ারি নওগাঁ সদরের আলঘোষ পাড়ার অজয় রবিদাসের বাড়িতে হামলা চালায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা। ১২ জানুয়ারি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের শ্যামপুর মৌজার ওসমানপুর গ্রামের সাঁওতাল নারী মনি টুডুকে জন্মমাটি থেকে উচ্ছেদের হুমকি দেয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা। নওগাঁর মহাদেবপুরের রাইগা ইউনিয়নের শুকু পাহানের পরিবারও জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদের আক্রমণ সামাল দিচ্ছে। ২৪ জানুয়ারি দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মোস্তফাপুর ইউনিয়নের চিড়াকুটা (হাবিবপুর) সাঁওতাল গ্রাম দগ্ধ-ভস্ম হয় বাঙালি জাত্যভিমানের পেট্রোলে। বরাবরের মতোই বাঙালি পুরুষরা আদিবাসী বসতজমিন দখল করতে আসে, আদিবাসীরা জানবাজি রেখে দাঁড়ায়। সংঘাতে নিহত হন হামলাকারী বাঙালি শফিউল ইসলাম সোহাগ। এ ঘটনায় 'জাতীয় আদিবাসী পরিষদ' ৫৮ সাঁওতাল পরিবারের বস্তুগত ক্ষয়ক্ষতির বিবরণী তৈরি করেছে। ৮ সদস্যের পরিদর্শন দলের মাধ্যমে তৈরি করা এই প্রতিবেদন ২৮ জানুয়ারি তারা সাংগঠনিকভাবে প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি রাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন নিয়ে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত উসকে দেওয়া হয়েছে। পেট্রোল বোমা সহিংসতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র সাহসী হুঁশিয়ারি ঘোষণা করলেও নিজভূমে পরবাসী জনগণের ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাবলয় বরাবরের মতো প্রশ্নহীন কায়দায় নিশ্চুপ।
এর আগেও এক দমবন্ধ সহিংস রক্তপাতের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ পাড়ি দিয়েছে ২০১৩ কি ২০১৪। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সব দলের অংশগ্রহণ বিতর্ক থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব জুলুমকেই সামাল দিতে হলো দেশের নিম্নবর্গকে। উচ্চবর্গের এতে কোনো একবিন্দু কাটাছেঁড়াও হলো না। গরিব বাঙালি মুসলিম পুরুষের চেয়ে দেশের বাঙালি হিন্দু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও দলিত নারী-পুরুষকেই রাজনৈতিক সহিংসতার জের বেশি টানতে হয়েছে। তখনও বিস্ময়করভাবে আমরা খেয়াল করেছি, রাজনৈতিক সহিংসতার বিবরণ দিতে গিয়ে আবারও সেই অধিপতি বাঙালি বয়ানের কায়দাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল সবখানে। গণতন্ত্রের কারবারি থেকে গণমাধ্যম সর্বত্র। ধরে নিচ্ছি, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতার অংশ হিসেবে তাদের জনপদও বাদ থাকেনি। কিন্তু ১৬ জানুয়ারি ২০১৪ ঘোড়াঘাট উপজেলার সিংড়া গ্রামের ভালেন মার্ডির ঘর ও খড়ের পালাও পুড়ে যায় একই আগুনের প্রশ্নহীন তীব্রতায়। নির্বাচন পেরিয়ে যাওয়ার অনেক দিন পর ২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ঋষিকুল ইউনিয়নের ছাতনিপাড়ায় আবারও সহিংস হামলা হয়। সহিংসতার আগুনে পুড়ে যায় লক্ষ্মী ওঁরাওয়ের গোয়ালঘর ও বসতবাড়ি। নিশ্চয়ই এসব ঘটনার সঙ্গে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। নৌকা কি ধানের শীষের রাজনীতি নেই। গণতন্ত্র রক্ষা বা ধ্বংসের কোনো চক্রান্ত নেই। তারপরও তো এসব নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জগৎ নির্দয়ভাবে দগ্ধ হয়ে চলেছে। নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে আত্মপরিচয় ও সম্পর্কের সীমানা।
মাটির তলায় হাজার বছর ধরে প্রাণসত্তার শরীর ক্ষয়ে তৈরি হয় জীবাশ্ম জ্বালানি পেট্রোল। জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর এই সভ্যতা হয়তো আজ এসব পেট্রোল-টেট্রল ছাড়া অচল। কিন্তু দুম করে কি সব হিংসা আর সহিংসতা পেট্রোল বোমার বোতলে বন্দি হয়ে গেল? দগ্ধতার এই সমীকরণ কি কেবল নির্বাচন-বিতর্ক আর গণতন্ত্র উদ্ধার বা ধ্বংস এমন বাহাসের তল থেকেই আমরা দেখতে থাকব? দগ্ধতা আর হিংসা কি কেবল টিকে আছে এসব কারণেই? যদি তাই থাকে তবে কেন জুম-জমিন পুড়ে? তবে কেন কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে এক লাখ স্থানীয় অধিবাসীকে উচ্ছেদ হতে হয়? কেন ইকোপার্ক, বনায়ন, বাঁধ বা খনির নামে তারা নিরুদ্দেশ হয়? জঙ্গল ও জমিন সুরক্ষায় জান দিতে হয়? হিংসা আর বৈষম্যের এই মনস্তত্ত্ব যদি ছিন্নভিন্ন করে না দাঁড়ায় রাষ্ট্র, তবে কি কোনোদিন পেট্রোল বোমা থামবে?
গবেষক ও লেখক
No comments