মিয়ানমারে এক টুকরো বাংলাদেশ by সোহরাব হাসান

গত ১৪ জানুয়ারি আমরা তিনজন যে ফ্লাইটে ব্যাংকক হয়ে ইয়াঙ্গুনে পৌঁছাই, সেই ফ্লাইটে চতুর্থ কোনো বাংলাদেশি ছিলেন না। কিন্তু ১৫ জানুয়ারি ফেরার পথে বেশ কজন তরুণ বাংলাদেশি কর্মকর্তাকে পেলাম, যাঁরা ইয়াঙ্গুনে চাকরি করেন, কেউ সপরিবারে এসেছেন, কেউ বা একা এসেছেন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ছুটি কাটাতে।
গত বছরের শুরুতে ঢাকা-ইয়াঙ্গুন সরাসরি ফ্লাইট চালু করে বাংলাদেশ বিমান। যাত্রীও কম নয়; কিন্তু ফ্লাইট সপ্তাহে এক দিন, সোমবার। ব্যবসা বা অন্যান্য কাজে যাঁরা যান, তাঁরা বিমানই পছন্দ করেন। মাত্র এক ঘণ্টার পথ। ব্যাংকক থেকে গেলে পুরো দিনটাই যাত্রাপথে চলে যায়।
যেকোনো দেশে বা শহরে দ্বিতীয়বার গেলে সাধারণত আকর্ষণ কমে যায়। কিন্তু ইয়াঙ্গুনে গিয়ে আমার সেটি মনে হয়নি। গত আট মাসের পরিবর্তনটিও চোখে পড়ার মতো। অনেক নতুন হোটেল নির্মিত হয়েছে। ফ্লাইওভার হচ্ছে। যেখান আমাদের একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে আড়াই-তিন বছর সময় লাগে, সেখানে তারা ১২ মাসে একেকটি বিশাল ফ্লাইওভার নির্মাণ করছে।
মিয়ানমারে প্রচুর বিদেশি পর্যটক আসছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেল, গত বছরের মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ পর্যটক এসেছেন। এ কারণে ইয়াঙ্গুনে হোটেল ভাড়াও বেশি। মোটামুটি মানের হোটেলের জন্য দিনে ১০০ ডলার গুনতে হয়। টেলিনর মিয়ানমারের আয়োজন ছিল ১১ জানুয়ারি। তাই সরাসরি যাওয়ার উপায় ছিল না। গত মার্চ মাসে বিমানে আসা-যাওয়ার সময় অনেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁরা বলেছিলেন, ইয়াঙ্গুনে বেশ কটি সংস্থায় শীর্ষ পদে বাংলাদেশি কর্মকর্তা আছেন। প্রথমেই নাম করতে হয় অ্যাকশন এইড মিয়ানমারের কান্ট্রি ম্যানেজার শিহাবউদ্দিন আহমদের; ইয়াঙ্গুনে যাওয়ার আগে তিনি ঢাকায় অ্যাকশন এইডে ছিলেন। তিন বছর ধরে তিনি সেখানে আছেন। স্থানীয় সাংবাদিক, রাজনীতিক ও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের সঙ্গেও তাঁর সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
অ্যাকশন এইড মিয়ানমারের ৩০০ সার্বক্ষণিক কর্মী ও ৩০০০ মাঠকর্মীর মধ্যে বিদেশি আছেন ২২ জন; যার তিনটি বিভাগের প্রধান পদে তিনজন বাংলাদেশি—তৌহিদ ইবনে করিম (নীতি ও কর্মসূচি), ইমরানুল হক (অর্থ উপদেষ্টা), ফারুক আহমদ শিক্ষা উপদেষ্টা। প্যাক্ট মিয়ানমার নামে যে আরেকটি বড় প্রতিষ্ঠান আছে, তারও প্রধান একজন বাংলাদেশি, ফাহমিদুল করিম ভূঁইয়া। এ ছাড়া হেল্প এজ, কেয়ার, ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালেও বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি কর্মকর্তা রয়েছেন। ব্র্যাক কাজ শুরু করেছে ২০১৪ সালের জুনে।
টেলিনরের আয়োজনে বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলাম আমি ও মাসুদ রুমি। সেখানেই পরিচয় হয় সংস্থার তিন বাংলাদেশি কর্মকর্তার সঙ্গে। করপোরেট রেসপন্সিবিলিটি বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ আবু হাসনাত মোহাম্মদ সুলতান রেজা, ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস বিভাগের প্রধান সনদ পাল চৌধুরী, বাস্তবায়ন বিভাগের প্রধান শানসিল আহমেদ শিবলি। তাঁদের সঙ্গে আছেন আরও ১২ জন বাংরাদেশি কর্মী। এ ছাড়া টাওয়ার বানানোর কাজে বাংলাদেশ থেকে অনেক শ্রমিককে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
শিবলিই পরিচয় করিয়ে দিলেন বিজন বিশীর সঙ্গে। তাঁর বাড়ি নেত্রকোনায়। বিখ্যাত লেখক প্রমথ নাথ বিশীর বংশধর। ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশ সমিতির সম্পাদক বিজন বিশী ১৫ বছর ধরে ইয়াঙ্গুনে আছেন। আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তিনি ইনসেফট্রার স্থানীয় প্রতিনিধিও। তাঁর সুবাদেই ইয়াঙ্গুনে অন্যান্য বাঙালি কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় ও আড্ডা হলো।
ইয়াঙ্গুনে সব মিলিয়ে শ খানেক বাংলাদেশি পরিবার আছে, কেউ বা পরিবারছাড়া। কিন্তু সেখানে সবাই মিলে একটি বড় পরিবার গড়ে তুলেছে, সুখে-দুঃখে একে অপরের পাশে থাকে। বাংলা নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসে সবাই একত্র হয়। আনন্দ-উৎসবে মাতে। সংস্কৃতিচর্চা করে। কখনো রাজধানী নেপিডো বা অন্য কোথাও বেড়াতে যায়। ইয়াঙ্গুনের বাংলাদেশ দূতাবাসও সব জাতীয় অনুষ্ঠানে তাদের আমন্ত্রণ জানায়। বাংলাদেশ দূতাবাসের ওয়েবসাইটে একটি বিজ্ঞপ্তি দেখলাম, মিয়ানমারে অবস্থিত বাংলাদেশি নাগরিকদের দূতাবাসে নাম-ঠিকানা দিতে বলা হয়েছে; যাতে তাদের বিপদে-আপদে সহায়তা করতে পারে। বিজন বিশী জানান, এখন দূতাবাসের কর্মকর্তারা নিয়মিত খোঁজখবর নেন। মিয়ানমারে অনেকের বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা আছে। তাঁরা ভাবেন, বাংলাদেশ মানেই রোহিঙ্গা। এই ধারণাটি যে ঠিক নয়, তার প্রমাণ রেখেছেন ইয়াঙ্গুনে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা। তাঁরা সে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে যে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখে চলেছেন, সে কথা স্বীকার করেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারাও। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বিেশষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন একজন বাংলােদশি অর্থনীতিবিদ, মির্জা তৌহিদুল ইসলাম।
বিজন বিশীই পরিচয় করিয়ে দেন অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ম্যানেজার শিহাবউদ্দিন আহমদের সঙ্গে; তাঁর সূত্রে আলাপ হয় তৌহিদ ইবনে ফরিদ, ইমরানুল হক, ফারুক আহমেদ, ফাহমিদুল করিম ভূঁইয়া এবং আরও অনেকের সঙ্গে। ইয়াঙ্গুনে বাঙালি পরিবারগুলোর মধ্যে সৌহার্দ্য ও প্রীতি এতটাই গাঢ় যে রাতের খাবারটা তারা একেক দিন একেকজনের বাসায় সারে। ১৩ ও ১৪ জানুয়ারি এ রকম দুটি পারিবারিক আয়োজনে আমার থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা হয়। বাংলাদেশ কোথায় যাচ্ছে? তাঁরা বললেন, রাজনৈতিক সমস্যা তো মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডেও আছে। সে জন্য কথায় কথায় হরতাল-অবরোধ হয় না। শিহাব ভাইয়ের এ-লেভেল পড়ুয়া ছেলেকে পড়িয়ে যখন বর্মী শিক্ষিকা চলে যাচ্ছিলেন, তখন রাতের কথা ভেবে ছেলেই তাঁকে গাড়ি চালিয়ে তাঁর বাসায় পৌঁছে দিল; গৃহশিক্ষকের প্রতি এই সৌজন্যবোধ কি বাংলাদেশে আশা করা যায়?
২০০৮ সালে নার্গিস আঘাত হানার পর অ্যাকশন এইড মিয়ানমারে কাজ শুরু করে। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনসহ সবাই তাঁদের কাজের প্রশংসা করেছেন। শিহাব ভাই জানালেন, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখানে বেশ জনপ্রিয়। তিনি যখন এসেছিলেন, প্রেসিডেন্ট তাঁর কেবিনেটের সব সদস্যকে নিয়ে বসেছিলেন। আবারও তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় গিয়ে আমার মনে হয়েছে, সেখানে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে স্থানীয় কর্মীদের সম্পর্কটি সমীহ ও শ্রদ্ধাবোধের। এখানে পদস্থের অহমিকা কিংবা অধস্তনের হীনম্মন্যতা নেই। সব অফিসেই ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। বিভিন্ন মার্কেটে বিপণনকর্মীর ৮০ শতাংশ নারী। একই সঙ্গে তাঁরা ঘরও সামলান।
বাংলাদেশি কর্মকর্তারা জানালেন, মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই ভালো। এখানে চুরি-ডাকাতি হয় না বললেই চলে। মানুষ খোলা গাড়িতে করে বস্তায় ভরে টাকা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়। কোনো সমস্যা হয় না। তাঁরা স্বীকার করলেন, ২০১১ সালে মুক্ত অর্থনীতি চালুর পর মিয়ানমারে বিদেশি বিনিয়োগ ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর তৎপরতা ব্যাপক বেড়েছে। কিন্তু এসব সংস্থায় যঁারা কাজ করেন, তাঁদের বাড়িভাড়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। গত তিন বছরে বাড়িভাড়া বেড়েছে কয়েক গুণ। বাংলাদেশি দেড়-দুই লাখ টাকার নিচে কোনো বাড়ি পাওয়া যায় না। টেলিনরের এক কর্মকর্তা জানালেন, তিনি ৪ লাখ টাকায় বাড়িভাড়া নিয়েছেন, সেটির আয়তন ২ হাজার বর্গফুটের বেশি নয়।
প্যাক্ট মিয়ানমারের একজন কর্মকর্তা জানান, মিয়ানমারে তাঁদের কাজের সুবিধা হলো, নারী-পুরুষ উভয়েই শিক্ষিত। মেয়েরা সংসার ও বাইরের কাজ করেন। ফলে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা আরও সহজ। অন্যান্য দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশের মতো মিয়ানমারেও মেয়েরা আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে অনেক বেশি তৎপর। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে যেমন। সমাজটি মাতৃপ্রধান না হলেও পরিবারে নারীর ভূমিকাই বেশি।
মিয়ানমারের বেশির ভাগ মানুষ অং সান সু চির সমর্থক। এমনকি বিদেশিরাও নেত্রী হিসেবে তাঁকে পছন্দ করেন। তবে একজন বাংলাদেশি কর্মকর্তা সু ফাউন্ডেশনের নামে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমকে সুনজরে দেখছেন না। তাঁর মতে, রাজনীতিক হিসেবে অং সান সু চির দায়িত্ব নীতি প্রণয়নে সহায়তা করা, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান চালানো নয়।
কোনো কোনো বাংলাদেশি কর্মকর্তা মিয়ানমারের মুক্ত পরিবেশ নিয়ে কিছুটা শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন। তাঁদের ভয়, গ্রামগঞ্জ থেকে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক এখানে আসছেন। হঠাৎ মুক্ত হাওয়ায় এসে যদি তাঁরা কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলেন, তখন পুরো কমিউনিটির বদনাম হবে। তিনি ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশার দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারে পানীয় বেচাকেনা কিংবা সেবনের ওপর কোনো বিধিনিষেধ নেই। তাই বাংলাদেশি শ্রমিকদের কিছুটা নজরদারিতে রাখার কথাও বললেন এই কর্মকর্তা।
মিয়ানমারে আমরা যে এক টুকরা বাংলাদেশ দেখে এলাম, সেটি যেমন শান্ত, শ্রীমণ্ডিত, তেমনি প্রাণের ছোঁয়ায় ঋদ্ধ। পরিসরটি ছোট্ট বলেই হয়তো এই অনুভূতি টের পাওয়া যায়।
মিয়ানমারের বাংলাদেশিরা ভালো আছেন। সুখে ও শান্তিতে আছেন। অন্তত তাঁদের তো হরতাল-অবরোধের নামে বোমাবাজির শিকার হতে হয় না। সেখানকার আবহাওয়াও চমৎকার।
পরের কিস্তি: বাঙালি–রোহিঙ্গা বিতর্ক ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.