প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর রাজনৈতিক আচরণ by মোঃ ফিরোজ মিয়া
প্রত্যেক কর্মচারীকে চাকরির ভেতরে ও বাইরে
কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। এ নিয়মানুবর্তিতাই সাধারণভাবে আচরণ হিসেবে
অভিহিত। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের এই আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী বিধিই আচরণবিধি
(কোড অব কন্ডাক্ট)। অনেকে মনে করেন, বর্তমানে প্রচলিত আচরণবিধি কর্মচারীদের
রাজনৈতিক আচরণ নিয়ন্ত্রণে পূর্ণাঙ্গ নয়। কিন্তু কর্মচারীদের রাজনৈতিক আচরণ
নিয়ন্ত্রণের জন্য বিদ্যমান আচরণবিধিতে পর্যাপ্ত বিধান রয়েছে। এছাড়া সময়ের
প্রয়োজনে এই আচরণবিধিকে অধিকতর সমৃদ্ধ করার জন্য সরকার সময়ে সময়ে যে
আদেশ-নির্দেশ জারি করেছে, তাও আচরণবিধির অংশ হিসেবে বিবেচিত এবং
কর্মচারীদের ওপর একইভাবে প্রযোজ্য। লিপিবদ্ধকৃত এসব আচরণ ছাড়াও চাকরির
শৃংখলাবিষয়ক আরও কিছু অলিখিত আচরণ রয়েছে, যা আইনানুযায়ী কর্মচারীরা পালন
করতে বাধ্য। যেমন- শৃংখলা ও আপিল বিধি অনুযায়ী কর্মচারী বা ভদ্রলোকের পক্ষে
অনুচিত যে কোনো আচরণই অসদাচরণ হিসেবে গণ্য। কিন্তু কর্মচারী বা ভদ্রলোকের
পক্ষে কোন কোন আচরণ অনুচিত, তা পূর্ণাঙ্গরূপে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। এজন্য
কর্মচারীর কোন আচরণ অনুচিত হিসেবে গণ্য হবে তা পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা,
মূল্যবোধ, প্রথা ইত্যাদি বিবেচনায় নির্ধারণ করতে হয়। সুতরাং বলা যায়,
কর্মচারীদের রাজনৈতিক আচরণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য আইনের অপর্যাপ্ততা
নয়, বরং তা নিজেদের অনুকূলে হলে প্রয়োগে বিরত থাকা বা পক্ষপাতমূলক প্রয়োগই
দায়ী।
একজন কর্মচারী চাকরিতে যোগদানের মুহূর্তেই আচরণবিধির বাধ্যবাধকতায় আবদ্ধ হয়। কিন্তু পত্রপত্রিকার খবরে প্রায়ই লক্ষ করা যায়, রাজনৈতিক দলের বা এর অঙ্গ সংগঠনের সদস্য বা কর্মী চাকরিতে যোগদানের পরও প্রকাশ্যে বা গোপনে রাজনৈতিক দলের সদস্য বা কর্মী হিসেবে বহাল থাকেন বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন বা নিজেকে রাজনৈতিক দলের সদস্য বা কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। আবার কেউ কেউ চাকরিতে যোগদানের আগে অরাজনৈতিক ব্যক্তি থাকলেও চাকরিতে যোগদানের পর নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রকাশ্যে বা গোপনে অংশগ্রহণ করেন বা নিজেকে কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক হিসেবে পরিচয় দেন। কতিপয় চাকরিজীবী সংগঠনও প্রকাশ্যে বা গোপনে রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে বা রাজনৈতিক সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে। এজন্য অনেক সময় অনেকে চাকরিতে অনৈতিক বিভিন্ন সুবিধাও পেয়ে থাকে। ইতিমধ্যে কর্মচারীদের কিছু অংশের জনতার মঞ্চ, পান্ডা গার্ডেন, উত্তরা ও গুলশানে বৈঠকে অংশগ্রহণ বেশ আলোড়ন ও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বা কর্মচারী সমিতিগুলো আদৌ এসব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে কিনা এবং কর্মচারীদের আচরণবিধিতে এ সংক্রান্ত কী বিধান রয়েছে?
সংবিধানের বিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কর্তব্য হল জনগণের সেবা করা বা সেবা করার চেষ্টা করা। এছাড়া বাংলাদেশ সার্ভিস রুলের বিধান অনুযায়ী একজন কর্মচারীর সমুদয় সময়ই সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। যার কারণে অর্পিত সরকারি দায়িত্ব পালন ছাড়া কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ কর্মচারীর নেই।
আচরণবিধির অন্যতম উদ্দেশ্য হল কর্মচারীদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা। কিন্তু কর্মচারীরা কোনো রাজনৈতিক দলের অনুকূলে কাজ করলে সর্বসাধারণ নিরপেক্ষ সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। এজন্যই আচরণবিধিতে কর্মচারীদের সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকারদলীয় হোক কিংবা বিরোধীদলীয়, কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সভা করা আচরণবিধির পরিপন্থী। একান্ত ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে কোনো কর্মচারীর কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মিলিত হওয়া বা দেখা করা আচরণবিধির পরিপন্থী নয়। কিন্তু দলগতভাবে মিলিত হওয়া বা দেখা করাটা আচরণবিধির পরিপন্থী।
আচরণবিধি অনুযায়ী কোনো কর্মচারী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের বা এর কোনো অঙ্গ সংগঠনের সদস্য হতে বা থাকতে পারেন না বা অন্য কোনোভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেন না। এছাড়া কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে, সাহায্যার্থে চাঁদা দিতে বা অন্য কোনো উপায়ে সহায়তা করতে পারেন না। কোনো রাজনৈতিক দলের সমাবেশে বা মিছিলে এককভাবে বা দলগতভাবে কিংবা কর্মচারী সমিতির ব্যানারে অংশগ্রহণ করতে, ওই সমাবেশ বা মিছিল আয়োজনে বা পরিচালনায় অংশ নিতে বা সহায়তা করতে পারেন না। এমনকি ওইরূপ কোনো সমাবেশে বা মিছিলে উপস্থিতও থাকতে পারেন না। তবে কোনো কর্মচারীকে কোনো সমাবেশের শান্তি-শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করা হলে বা প্রটোকলের দায়িত্ব প্রদান করা হলে তিনি ওই দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। এছাড়া মাননীয় মন্ত্রী বা মাননীয় সংসদ সদস্যদের উপস্থিতিতে কোনো সরকারি অনুষ্ঠানাদিতে দায়িত্ব ও কর্তব্যের অংশ হিসেবে কোনো কর্মচারীর অংশগ্রহণ দোষের নয়। কিন্তু ওই অনুষ্ঠানে কর্মচারী কর্তৃক কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান আচরণবিধির পরিপন্থী।
প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সংস্থা বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কোনো নির্বাচনে নিজে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো প্রার্থীকে সমর্থন করতে, ভোটারদের উদ্দেশে বক্তৃতা করতে, নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করতে বা অন্য কোনোভাবে সাহায্য বা সহায়তা করতে পারেন না। তবে তিনি যে এলাকার ভোটার, ওই এলাকায় ভোটের গোপনীয়তা রক্ষা করে ওই নির্বাচনে ভোট প্রদান করতে পারেন।
কোনো কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের নীরব সমর্থক হতে পারেন। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই এ সমর্থনের বিষয়টি জনসম্মুখে প্রকাশ করতে পারেন না এবং সরকারি কার্য সম্পাদনে এর কোনো প্রতিফলন ঘটাতে পারেন না। এছাড়া কর্মচারীর স্বামী বা স্ত্রী যদি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হন বা যে কোনো প্রকারে কোনো রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী তাৎক্ষণিকভাবে তা সরকারকে লিখিতভাবে অবহিত করবেন। অবহিত না করার ক্ষেত্রে তিনি আচরণবিধি লংঘনের জন্য অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত হবেন।
আচরণবিধি অনুযায়ী চাকরি সংক্রান্ত কোনো দাবির সমর্থনে কোনোরূপ রাজনৈতিক প্রভাব বা বাইরের কোনো প্রভাব বিস্তার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রায়ই লক্ষ করা যায়, কিছু কর্মচারী বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি, বাসা বরাদ্দ বা চাকরি সংক্রান্ত অন্য কোনো বিষয়ের দরখাস্তে মাননীয় মন্ত্রী, মাননীয় সংসদ সদস্য, কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি বা কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির সুপারিশ গ্রহণ করেন, যা সম্পূর্ণরূপে আচরণবিধির পরিপন্থী। আচরণবিধি অনুযায়ী কোনো কর্মচারী চাকরি সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে তার পক্ষে হস্তক্ষেপ করার জন্য কোনো অনুরোধ বা প্রস্তাব নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাননীয় মন্ত্রী বা মাননীয় সংসদ সদস্যের দ্বারস্থ হতে বা তদবির করতে বা তাদের বরাবরে কোনো দরখাস্ত করতে পারেন না। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছেও চাকরি সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো দরখাস্ত করা যায় না।
বিদ্যমান আচরণবিধি অনুযায়ী কতিপয় বিধিনিষেধ সাপেক্ষে কর্মচারীদের প্রতিনিধিত্বশীল সমিতি করার অধিকার রয়েছে। এসব সমিতি গঠনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল, সমিতির সদস্যপদ বা কার্যনির্বাহী পদগুলো কোনো একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যে সীমিত থাকবে এবং ওই নির্দিষ্ট শ্রেণীর সব কর্মচারীর জন্য তা উন্মুক্ত থাকবে। দ্বিতীয় শর্ত হল, এই সমিতি কোনোভাবেই কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হতে পারবে না বা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তৃতীয় শর্ত হল, এই সমিতি জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সংস্থা বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নির্বাচনে কোনো পক্ষের ব্যয়ভার বহন বা প্রদান করতে পারবে না। কোনো প্রার্থীকে সমর্থন করতে পারবে না এবং ভোটার তালিকাভুক্তির ব্যাপারে বা প্রার্থী মনোনয়নে কোনো সাহায্য করতে বা ওই ব্যাপারে কোনো দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারবে না। চতুর্থ শর্ত হল, এই সমিতি জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সংস্থা বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কোনো সদস্যের কোনো ব্যয়ভার বহন করতে বা ব্যয় নির্বাহের জন্য চাঁদা প্রদান করতে পারবে না এবং কোনো ট্রেড ইউনিয়নের ব্যয় নির্বাহের জন্য কোনো অর্থ বা চাঁদা প্রদান করতে পারবে না। কিন্তু বর্তমানে বেশকিছু চাকরিজীবী সমিতি উপরোক্ত শর্তগুলো পালন করছে না। কিছু সমিতি প্রকাশ্যেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছে এবং এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণে দিন দিন এর প্রবণতা বাড়ছে।
কর্মচারীদের প্রতিনিধিত্বকারী কোনো সংস্থা বা সমিতি বা সমিতির পরিচয়ে কোনো কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত থাকতে অথবা রাজনৈতিক কার্যকলাপে যুক্ত থাকতে পারেন না। এমনকি সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া চাকরিজীবী সমিতির সদস্যদের পক্ষে কোনো দাবিনামা পত্রপত্রিকায় বা অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন না। এছাড়া অফিস চলাকালীন অফিস ত্যাগ করে সভা-সমিতিতে যোগদান করা যায় না। অফিস অঙ্গনে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য মিছিল, স্লোগান এবং সভায় মাইকযোগে সমাবেশের আয়োজন করাও আচরণবিধির পরিপন্থী। অনেক সময় দেখা যায়, রাজনৈতিক সমাবেশে বিভিন্ন সরকারি পেশাজীবী সংগঠন বা সমিতির ব্যানারে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা দলবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করে, যা আচরণবিধির সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নয় এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত কোনো সমিতি বা সংগঠনের সদস্য হওয়া আচরণবিধি সমর্থন করে না। এ ধরনের সমিতি বা সংগঠন কেবল সম্পূর্ণরূপে সমাজসেবামূলক কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকলেও সরকারের অনুমোদন ছাড়া ওই সমাজসেবামূলক সমিতি বা সংগঠনের সদস্য হওয়াও আচরণবিধির পরিপন্থী।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের আচরণবিধির পরিপন্থী কার্যকলাপকে অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং অসদাচরণের জন্য শৃংখলা ও আপিল বিধি অনুযায়ী বিভাগীয় মামলা রুজুপূর্বক দণ্ড প্রদানের বিধান রয়েছে। চাকরিবিধি অনুযায়ী অসদাচরণ একটি গুরুতর অপরাধ। এই অপরাধের জন্য চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরি থেকে অপসারণ ও চাকরি থেকে বরখাস্ত দণ্ডসহ যে কোনো দণ্ড আরোপ করা যায়।
সবসময় জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সাংবিধানিক কর্তব্য এবং এ কর্তব্য পালনের জন্য চাকরির শৃংখলা বজায় রাখা একান্ত অপরিহার্র্য। কিন্তু আচরণবিধির পক্ষপাতহীন ও কঠোর প্রয়োগ ছাড়া চাকরির শৃংখলা বজায় রাখা কোনোক্রমেই সম্ভব নয় বিধায় আচরণবিধির কঠোর ও পক্ষপাতহীন প্রয়োগের মাধ্যমে কর্মচারীদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখা সবার কাম্য।
মোঃ ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, চাকরি সংক্রান্ত বিভিন্ন বইয়ের লেখক
একজন কর্মচারী চাকরিতে যোগদানের মুহূর্তেই আচরণবিধির বাধ্যবাধকতায় আবদ্ধ হয়। কিন্তু পত্রপত্রিকার খবরে প্রায়ই লক্ষ করা যায়, রাজনৈতিক দলের বা এর অঙ্গ সংগঠনের সদস্য বা কর্মী চাকরিতে যোগদানের পরও প্রকাশ্যে বা গোপনে রাজনৈতিক দলের সদস্য বা কর্মী হিসেবে বহাল থাকেন বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন বা নিজেকে রাজনৈতিক দলের সদস্য বা কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। আবার কেউ কেউ চাকরিতে যোগদানের আগে অরাজনৈতিক ব্যক্তি থাকলেও চাকরিতে যোগদানের পর নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রকাশ্যে বা গোপনে অংশগ্রহণ করেন বা নিজেকে কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক হিসেবে পরিচয় দেন। কতিপয় চাকরিজীবী সংগঠনও প্রকাশ্যে বা গোপনে রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে বা রাজনৈতিক সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে। এজন্য অনেক সময় অনেকে চাকরিতে অনৈতিক বিভিন্ন সুবিধাও পেয়ে থাকে। ইতিমধ্যে কর্মচারীদের কিছু অংশের জনতার মঞ্চ, পান্ডা গার্ডেন, উত্তরা ও গুলশানে বৈঠকে অংশগ্রহণ বেশ আলোড়ন ও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বা কর্মচারী সমিতিগুলো আদৌ এসব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে কিনা এবং কর্মচারীদের আচরণবিধিতে এ সংক্রান্ত কী বিধান রয়েছে?
সংবিধানের বিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কর্তব্য হল জনগণের সেবা করা বা সেবা করার চেষ্টা করা। এছাড়া বাংলাদেশ সার্ভিস রুলের বিধান অনুযায়ী একজন কর্মচারীর সমুদয় সময়ই সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। যার কারণে অর্পিত সরকারি দায়িত্ব পালন ছাড়া কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ কর্মচারীর নেই।
আচরণবিধির অন্যতম উদ্দেশ্য হল কর্মচারীদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা। কিন্তু কর্মচারীরা কোনো রাজনৈতিক দলের অনুকূলে কাজ করলে সর্বসাধারণ নিরপেক্ষ সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। এজন্যই আচরণবিধিতে কর্মচারীদের সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকারদলীয় হোক কিংবা বিরোধীদলীয়, কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সভা করা আচরণবিধির পরিপন্থী। একান্ত ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে কোনো কর্মচারীর কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মিলিত হওয়া বা দেখা করা আচরণবিধির পরিপন্থী নয়। কিন্তু দলগতভাবে মিলিত হওয়া বা দেখা করাটা আচরণবিধির পরিপন্থী।
আচরণবিধি অনুযায়ী কোনো কর্মচারী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের বা এর কোনো অঙ্গ সংগঠনের সদস্য হতে বা থাকতে পারেন না বা অন্য কোনোভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেন না। এছাড়া কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে, সাহায্যার্থে চাঁদা দিতে বা অন্য কোনো উপায়ে সহায়তা করতে পারেন না। কোনো রাজনৈতিক দলের সমাবেশে বা মিছিলে এককভাবে বা দলগতভাবে কিংবা কর্মচারী সমিতির ব্যানারে অংশগ্রহণ করতে, ওই সমাবেশ বা মিছিল আয়োজনে বা পরিচালনায় অংশ নিতে বা সহায়তা করতে পারেন না। এমনকি ওইরূপ কোনো সমাবেশে বা মিছিলে উপস্থিতও থাকতে পারেন না। তবে কোনো কর্মচারীকে কোনো সমাবেশের শান্তি-শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করা হলে বা প্রটোকলের দায়িত্ব প্রদান করা হলে তিনি ওই দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। এছাড়া মাননীয় মন্ত্রী বা মাননীয় সংসদ সদস্যদের উপস্থিতিতে কোনো সরকারি অনুষ্ঠানাদিতে দায়িত্ব ও কর্তব্যের অংশ হিসেবে কোনো কর্মচারীর অংশগ্রহণ দোষের নয়। কিন্তু ওই অনুষ্ঠানে কর্মচারী কর্তৃক কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান আচরণবিধির পরিপন্থী।
প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সংস্থা বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কোনো নির্বাচনে নিজে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো প্রার্থীকে সমর্থন করতে, ভোটারদের উদ্দেশে বক্তৃতা করতে, নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করতে বা অন্য কোনোভাবে সাহায্য বা সহায়তা করতে পারেন না। তবে তিনি যে এলাকার ভোটার, ওই এলাকায় ভোটের গোপনীয়তা রক্ষা করে ওই নির্বাচনে ভোট প্রদান করতে পারেন।
কোনো কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের নীরব সমর্থক হতে পারেন। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই এ সমর্থনের বিষয়টি জনসম্মুখে প্রকাশ করতে পারেন না এবং সরকারি কার্য সম্পাদনে এর কোনো প্রতিফলন ঘটাতে পারেন না। এছাড়া কর্মচারীর স্বামী বা স্ত্রী যদি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হন বা যে কোনো প্রকারে কোনো রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী তাৎক্ষণিকভাবে তা সরকারকে লিখিতভাবে অবহিত করবেন। অবহিত না করার ক্ষেত্রে তিনি আচরণবিধি লংঘনের জন্য অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত হবেন।
আচরণবিধি অনুযায়ী চাকরি সংক্রান্ত কোনো দাবির সমর্থনে কোনোরূপ রাজনৈতিক প্রভাব বা বাইরের কোনো প্রভাব বিস্তার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রায়ই লক্ষ করা যায়, কিছু কর্মচারী বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি, বাসা বরাদ্দ বা চাকরি সংক্রান্ত অন্য কোনো বিষয়ের দরখাস্তে মাননীয় মন্ত্রী, মাননীয় সংসদ সদস্য, কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি বা কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির সুপারিশ গ্রহণ করেন, যা সম্পূর্ণরূপে আচরণবিধির পরিপন্থী। আচরণবিধি অনুযায়ী কোনো কর্মচারী চাকরি সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে তার পক্ষে হস্তক্ষেপ করার জন্য কোনো অনুরোধ বা প্রস্তাব নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাননীয় মন্ত্রী বা মাননীয় সংসদ সদস্যের দ্বারস্থ হতে বা তদবির করতে বা তাদের বরাবরে কোনো দরখাস্ত করতে পারেন না। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছেও চাকরি সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো দরখাস্ত করা যায় না।
বিদ্যমান আচরণবিধি অনুযায়ী কতিপয় বিধিনিষেধ সাপেক্ষে কর্মচারীদের প্রতিনিধিত্বশীল সমিতি করার অধিকার রয়েছে। এসব সমিতি গঠনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল, সমিতির সদস্যপদ বা কার্যনির্বাহী পদগুলো কোনো একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যে সীমিত থাকবে এবং ওই নির্দিষ্ট শ্রেণীর সব কর্মচারীর জন্য তা উন্মুক্ত থাকবে। দ্বিতীয় শর্ত হল, এই সমিতি কোনোভাবেই কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হতে পারবে না বা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তৃতীয় শর্ত হল, এই সমিতি জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সংস্থা বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নির্বাচনে কোনো পক্ষের ব্যয়ভার বহন বা প্রদান করতে পারবে না। কোনো প্রার্থীকে সমর্থন করতে পারবে না এবং ভোটার তালিকাভুক্তির ব্যাপারে বা প্রার্থী মনোনয়নে কোনো সাহায্য করতে বা ওই ব্যাপারে কোনো দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারবে না। চতুর্থ শর্ত হল, এই সমিতি জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সংস্থা বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কোনো সদস্যের কোনো ব্যয়ভার বহন করতে বা ব্যয় নির্বাহের জন্য চাঁদা প্রদান করতে পারবে না এবং কোনো ট্রেড ইউনিয়নের ব্যয় নির্বাহের জন্য কোনো অর্থ বা চাঁদা প্রদান করতে পারবে না। কিন্তু বর্তমানে বেশকিছু চাকরিজীবী সমিতি উপরোক্ত শর্তগুলো পালন করছে না। কিছু সমিতি প্রকাশ্যেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছে এবং এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণে দিন দিন এর প্রবণতা বাড়ছে।
কর্মচারীদের প্রতিনিধিত্বকারী কোনো সংস্থা বা সমিতি বা সমিতির পরিচয়ে কোনো কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত থাকতে অথবা রাজনৈতিক কার্যকলাপে যুক্ত থাকতে পারেন না। এমনকি সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া চাকরিজীবী সমিতির সদস্যদের পক্ষে কোনো দাবিনামা পত্রপত্রিকায় বা অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন না। এছাড়া অফিস চলাকালীন অফিস ত্যাগ করে সভা-সমিতিতে যোগদান করা যায় না। অফিস অঙ্গনে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য মিছিল, স্লোগান এবং সভায় মাইকযোগে সমাবেশের আয়োজন করাও আচরণবিধির পরিপন্থী। অনেক সময় দেখা যায়, রাজনৈতিক সমাবেশে বিভিন্ন সরকারি পেশাজীবী সংগঠন বা সমিতির ব্যানারে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা দলবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করে, যা আচরণবিধির সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নয় এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত কোনো সমিতি বা সংগঠনের সদস্য হওয়া আচরণবিধি সমর্থন করে না। এ ধরনের সমিতি বা সংগঠন কেবল সম্পূর্ণরূপে সমাজসেবামূলক কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকলেও সরকারের অনুমোদন ছাড়া ওই সমাজসেবামূলক সমিতি বা সংগঠনের সদস্য হওয়াও আচরণবিধির পরিপন্থী।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের আচরণবিধির পরিপন্থী কার্যকলাপকে অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং অসদাচরণের জন্য শৃংখলা ও আপিল বিধি অনুযায়ী বিভাগীয় মামলা রুজুপূর্বক দণ্ড প্রদানের বিধান রয়েছে। চাকরিবিধি অনুযায়ী অসদাচরণ একটি গুরুতর অপরাধ। এই অপরাধের জন্য চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরি থেকে অপসারণ ও চাকরি থেকে বরখাস্ত দণ্ডসহ যে কোনো দণ্ড আরোপ করা যায়।
সবসময় জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সাংবিধানিক কর্তব্য এবং এ কর্তব্য পালনের জন্য চাকরির শৃংখলা বজায় রাখা একান্ত অপরিহার্র্য। কিন্তু আচরণবিধির পক্ষপাতহীন ও কঠোর প্রয়োগ ছাড়া চাকরির শৃংখলা বজায় রাখা কোনোক্রমেই সম্ভব নয় বিধায় আচরণবিধির কঠোর ও পক্ষপাতহীন প্রয়োগের মাধ্যমে কর্মচারীদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখা সবার কাম্য।
মোঃ ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, চাকরি সংক্রান্ত বিভিন্ন বইয়ের লেখক
No comments