বিপ্লবী আজিজুর রহমান by মুজতবা আহমেদ মোরশেদ
বৃহত্তর
দিনাজপুর তথা উত্তরাঞ্চলের রাজনীতিতে সেই মুখটির নাম ছিল মো. আজিজুর
রহমান। বাংলাদশের ভূখ- এবং লাল সবুজের একটি পতাকা পাবার জন্য যে স্বাধীনতা
সংগ্রাম তারই অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব এডভোকেট মো. আজিজুর রহমান, এনএনএ
(পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য)। স্বাধীনতার আন্দোলনকে বেগবান এবং সুশৃঙ্খল
করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী ৪ঠা মার্চ ১৯৭১ সালে বৃহত্তর
দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার সর্বদলীয়
সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। (দিনাজপুর ইনস্টিটিউটে সেই সভা
অনুষ্ঠিত হয়। তথ্য: ইতিহাসবিদ মেহরাব আলী সম্পাদিত দিনাজপুরের ইতিহাস
সমগ্র। খ- নং ৫। পৃষ্ঠা নং : ২৭৬। আবার সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হলে তিনি ১৩ই
এপ্রিল ১৯৭১ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় পরিষদের
সভাপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। (সূত্র: মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র)। প্রবাসী
সরকার সুনিয়ন্ত্রিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকালে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে
মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলো সম্পন্ন হলে, মুজিবনগর সরকার এডভোকেট মো. আজিজুর
রহমানকে মুক্তিযদ্ধের সমগ্র ৭নং সেক্টর এবং ৬ নং সেক্টরের অর্ধেক অঞ্চলের
জন্য লেফটেন্যাট পদমর্যাদায় সিভিল অ্যাফেয়ার্স এডভাইজার উক্ত পদে দায়িত্ব
প্রদান করে। (তথ্যসূত্র: ৩০শে আগস্ট ১৯৭১ সালে জেনারেল ওসমানী স্বাক্ষরিত
মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত গোপন পরিপত্র নং : ০০০৯জি/২)। লেফেটন্যাট জেনারেল
জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল অ্যাফেয়ার্স এডভাইজার হিসেবে তার সদর দপ্তর ছিল
ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত তরঙ্গপুরে অবস্থিত
মুক্তিযুদ্ধের ৭নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার। সেই গোপন পরিপত্র অনুযায়ী উক্ত
সেক্টরের সামরিক কমান্ডার এবং অধীনস্ত সবার জন্য তার নির্দেশ মানাটা ছিল
বাধ্যতামূলক। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য বিষয়েও পরামর্শ দেয়ার এখতিয়ার
তার ছিল। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তার সামরিক বিষয়ে প্রদত্ত পরামর্শ
গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে তাৎক্ষণিকভাবে সেক্টর কমান্ডারকে জানানোর
নির্দেশ ছিল। উক্ত সেক্টরের সকল মুক্তিযোদ্ধার রিক্রুটিং সংক্রান্ত
সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ছিল ল্যাফেটন্যাট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল অ্যাফেয়ার্স
এডভাইজার। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই পদমর্যাদায় মোট দশজন নিযুক্ত
ছিলেন এবং সবাই ছিলেন এমএনএ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য)। মোহম্মদ
আজিজুর রহমান বৃটিশ আমলে তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার মোহম্মদপুর গ্রামে ১৯২০
সালের ১লা নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতার নাম আলেকজান নেসা।
বৃটিশবিরোধী স্বদেশী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তার বিপ্ল্লবী পিতা মাওলানা
আকিমুদ্দিন সরকারের হাত ধরে তিনি স্কুল জীবনে ১৯৩৭ সালে শেরেবাংলা এ কে
ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পাটির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়
কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে লেখাপড়া শেষে ভারত পাকিস্তান ভাগ হলে তিনিও
সেখানের ছাত্রত্ব শেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে নিজ ভূমিতে ফিরে এসে দেশগড়ার
কাজে হাত দেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক শিষ্য হিসেবে
দেশে ফিরেই কিছু দিনের মধ্যেই তিনি ক্রমান্বয়ে পূর্ব পাকিস্তান শোষণ করার
পাকিস্তানি শাসকদের ষড়যন্ত্র উপলব্ধি করতে শুরু করেন এবং কালবিলম্ব না করে
তার শিক্ষা, মেধা, শ্রম এবং অর্থ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন এ অঞ্চলের মানুষের ভেতর
বাঙালি বোধটিকে জাগ্রত করতে। ১৯৪৮ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা পূর্ব
পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের (বর্তমান ছাত্রলীগ) সভাপতি দবিরুল ইসলাম
দিনাজপুরে রাজনৈতিক সভা থেকে গ্রেপ্তার হলে মো. আজিজুর রহমান ভারপ্রাপ্ত
সভাপতির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই উজ্জ্বল নেতার
রাজনৈতিক পদযাত্রায় দেখা যায়, তিনি ১৯৪২ সালে অবিভক্ত বাংলা মুসলিম ছাত্র
সংঘের সাংগঠনিক সম্পাদক। এরপর ১৯৪৪ সালে ডিস্টিংশনসসহ (সব বিষয়ে ৮৫% নম্বর)
তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে তৃতীয় স্থান অধিকার
করেন। ১৯৫০ সালে আইনজীবী হিসেবে দিনাজুপর বার কাউন্সিলে যোগদান করে
বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় নেতৃত্ব দান করেন। ১৯৫৪ সালে
যুক্তফ্রট সরকার প্রতিষ্ঠার নির্বাচনে ঘোড়াঘাট থেকে তেতুঁলিয়া প্রায় দুই শ‘
কিলোমিটারে মতো এই বিস্তৃত অঞ্চলে অক্লান্তভাবে সাংগঠনিক পরিশ্রম করেন।
তার আগুনঝরা বক্তৃতায় মানুষের চোখ খুলতে শুরু করে। এরই পাশাপাশি জনতার মাঝে
বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগাতে তিনি বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় ১৯৫৫ সালে
সাপ্তাহিক আওয়াজ নামে সর্বপ্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি
সম্পাদক এবং মালিক হিসেবে এই পত্রিকার মাধ্যমে শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন।
(তথ্য: ইতিহাসবিদ মেহরাব আলী সম্পাদিত দিনাজপুরের ইতিহাস সমগ্র। খ- নং ৫।
পৃষ্ঠা নং : ২৫৫ এবং ৫৮২)। ১৯৫৭ সালের ৯ ও ১০ই ফেব্রুয়ারিতে টাঙ্গাইলের
সন্তোষে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত কাগমারি সাংস্কৃতিক সম্মেলনে
তিনি দিনাজপুরের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন এবং সেই সম্মেলনে গণতন্ত্রের
মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর
রহমানের সঙ্গে পরবর্তী কার্যক্রম বিষয়ে একান্ত আলোচনায় মিলিত হন। বৃহত্তর
দিনাজপুর জেলার রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়, তিনি ১৯৬০-জুন ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত
বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন । কিন্তু ১৯৬৬ সালের
জুন মাসে ৬ দফা ঘোষণার প্রেক্ষিতে জেনারেল আইয়ুব খানের জেল জুলুমের ভয়ে
রাজপথ থেকে যখন বেশিরভাগ নেতাই সরে দাঁড়ালে, মো. আজিজুর রহমান মাথায়
গ্রেপ্তারের হুলিয়া নিয়েও জনতার অকুতোভয় সৈনিকের মতো গুটিকয় নেতাকর্মী নিয়ে
ভারপ্রাপ্ত সভাপতি (দৃশ্যত কার্যকর সভাপতি) হিসেবে রুখে দাঁড়ান। শুরু হয়
রাজনৈতিক জীবনের আরেক মোড়। আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার জন্যে
জীবনপণ সংগ্রাম শুরু করেন একজন বিপ্লবীর মতো। বৃহত্তর দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট
থেকে তেতুঁলিয়া পর্যন্ত কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও বাইসাইকেলে চড়ে, কখনও বাস আর
কখনও গরুর গাড়ি চড়ে হাতে টিনের বানানো চোঙ্গা নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে
ছুুটলেন, পথে পথে ডাকলেন বাঙালিকে। তার আইন পেশা একরকম লাটে উঠলো। নিজের
জমির ফসল আর কখনও প্রয়োজনে জমি বিক্রির অর্থে দল আর সংসার চালাতে লাগলেন।
সাধারণ মানুষের কাছে সাদা কাগজে বানানো অতিক্ষুদ্র আকারের চাঁদার বইসহ কিছু
তরুণ নিয়ে হাত পাতলেন দলের জন্যে চার আনা করে চাঁদা চাইতে। তার অকুতোভয়
প্রবল কর্মকা-ে বৃহত্তর দিনাজুপরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুও ভোঁতা
হয়ে গেল। তিনি উপেক্ষা করলেন সব বাধা। দিনাজপুরে আওয়ামী লীগ ক্রমান্বয়ে
শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগলো এবং তিনি তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার মোহম্মদপুর
গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেও তার সিংহহৃদয় দেশপ্রেমের কারণে অসাধারণ বাগ্মী মো.
আজিজুর রহমান বৃহত্তর দিনাজপুর আওয়ামী লীগ রাজনীতির অপরিহার্য এবং শীর্ষ
নেতা হয়ে ওঠেন। বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা বার কাউন্সিলের সভাপতি এবং
রাজনীতিবিদ হিসেবে দল এবং দলের বাইরে জনপ্রিয়তার প্রবল স্রোতই তাকে ১৯৬৮
এবং ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সভাপতি
হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এডভোকেট মো. আজিজুর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের
ভূমিকায় দেখা যায়, তিনি ১৯৭০ সালে বৃহত্তর দিনাজপুরের আসন থেকে এমএনএ
নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া জাতীয় সংসদ
অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দিলে প্রতিবাদী জনতা নেমে আসে
রাজপথে। শুরু হয় প্রতিরোধ সংগ্রাম। প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হলে তিনি
দিনাজপুর আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি হিসেবে সব দলের নেতাদের নিয়ে নিয়ে
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জনতাকে দৃপ্তভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে শুরু করেন। ছুটে
বেড়াতে থাকেন দিনাজপুর শহর থেকে ঠাকুরগাঁও মহকুমা শহর এবং তার নেতৃত্বে
জেলার সব এমএনএ এবং এমপিএবৃন্দকে নিয়ে প্রতিটি থানার স্থানীয় নেতাদের
সংগঠিত করে তোলেন। যুদ্ধের শেষধাপে দিনাজপুর এবং ঠাকুরগাঁও শহরে চূড়ান্ত
আঘাত হানার পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য শিলিগুঁড়ির ভারতীয় ক্যান্টনমেন্টে তিনি
জেনারেল জগজিত সিং আরোরার সঙ্গে মিলিত হন। তারই ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতা
সংগ্রামের এ অকুতোভয় নেতা মিত্রবাহিনীর অগ্রগামী দলের সঙ্গে ৪ঠা ডিসেম্বর
ঠাকুরগাঁও প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলার গৌরবের পতাকা উড়িয়ে দেন। ১৯৭২ সালে
স্বাধীনতা উত্তর সংবিধান তৈরি করার প্রত্যয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য
(এমএনএ)-এর মর্যাদার বদলে এমসিএ (কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি অব বাংলাদেশ)
হিসেবে সংবিধান প্রণয়নে নিয়োজিত হন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সকল
১৬৭ জন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) এবং ৩০০ জন প্রাদেশিক
পরিষদের সদস্য (এমপিএ) মিলিয়ে সংবিধান তৈরি করার প্রত্যয়ে এমসিএ
(কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি অব বাংলাদেশ) হিসেবে মর্যাদালাভ করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অন্যতম কা-ারি এবং বৃহত্তর দিনাজপুরের সূর্যসন্তান,
সর্বস্বত্যাগী অকুতোভয় এ জননেতা মো. আজিজুর রহমান ৪ঠা ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে
ঘাসিপাড়াস্থ ভাড়াবাড়িতে নিভৃতে ইন্তেকাল করেন। দিনাজপুর শহরে সোনাপীর
গোরস্থানে চিরনিদ্রায় তিনি শায়িত।
No comments