বর্ণবাদের বিরুদ্ধে নাগরিক সংহতি by হাসান ফেরদৌস
(যুক্তরাষ্ট্রের
মিয়ামির উইনউড এলাকায় গত রোববার পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে এক ব্যক্তি।
একই দিন এ রকম আরও বিক্ষোভ হয় যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে l ছবি: এএফপি) একের
পর এক নিরীহ ও নিরস্ত্র কৃষ্ণকায় মার্কিন নাগরিক পুলিশের হাতে নিহত
হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিচারব্যবস্থার ফাঁকফোকর গলে বেকসুর পার
পেয়ে যাচ্ছে পুলিশ। আমেরিকার প্রধান প্রধান শহরে রাষ্ট্রব্যবস্থার এই
স্পষ্ট বর্ণবাদী চরিত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছে।
রোববার, যখন এই প্রতিবেদন লিখছি, নিউইয়র্ক শহরের নানা স্থানে নাগরিক বিক্ষোভ চলছে। লোকসমাগমের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য না হলেও শহরের সব ধরনের মানুষ—সাদা, কালো অথবা বাদামি—এসব সমাবেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জানান দিচ্ছে, কালো মানুষদের বিরুদ্ধে নির্বিকার পুলিশি নির্যাতন তারা মেনে নেবে না।
অধিকাংশের ক্ষোভ ফার্গুসন, মিজৌরি ও নিউইয়র্কের স্টাটেন আইল্যান্ডে সাম্প্রতিক সময়ের দুটি ভিন্ন ভিন্ন পুলিশি ঘটনায়। প্রথম ঘটনায় ১৭ জুলাই নিউইয়র্কে স্টাটেন আইল্যান্ডে ৪৩ বছর বয়স্ক এরিক গার্নার পুলিশের হাতে শ্বাসরোধের কারণে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অভিযোগ রয়েছে, গার্নার খোলা রাস্তায় চোরাচালানির সিগারেট বিক্রি করছিলেন। পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা তাঁর গলা চেপে ধরেন। অ্যাজমা রোগী এরিক গার্নার বারবার বলতে থাকেন, আমি শ্বাস নিতে পারছি না। তা সত্ত্বেও পুলিশ কর্মকর্তা ড্যানিয়েল পান্তালেও তাঁর গলা থেকে হাত সরিয়ে নেননি। ফলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গার্নারের মৃত্যু হয়। পুরো ঘটনাটি ভিডিও টেপে ধরা ছিল। প্রায় তিন মাস তদন্ত ও জুরি শুনানির পর পুলিশকে খুনের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় ঘটনায়, ৮ আগস্ট মিজৌরির ফার্গুসনে পুলিশের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতির পর মাইকেল ব্রাউন নামের ১৮ বছরের এক কৃষ্ণকায় যুবক পুলিশ কর্মকর্তা ড্যারেন উইলসনের গুলিতে নিহত হন। এ সময় ব্রাউন নিরস্ত্র ছিলেন। প্রায় তিন মাস তদন্ত ও বিচারের পর মূলত শ্বেতকায় জুরি উইলসনকে নির্দোষ ঘোষণা করে।
শুধু কালো মানুষ বলেই কোনো দ্বিধা না করে পুলিশ গুলি চালায়—এ কথা এখন অনেকেই বলছে। গত সপ্তাহে এই নিউইয়র্কেই আলো-আঁধারিতে এক যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গুলি করে মেরে ফেলে এক নবিশ পুলিশ। তার একমাত্র অপরাধ, সে কালো। প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে ক্লিভল্যান্ড, ওহাইও এবং সাউথ ক্যারোলাইনার ইউটাওভিল-এ। এ কথা গোপন নয় যে এ দেশে পুলিশ বর্ণভিত্তিক পূর্ব-অনুমিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে ব্যবহার করে থাকে। কালোদের বা বাদামিদের জন্য একরকম ব্যবহার, শ্বেতকায়দের জন্য অন্য রকম। শুধু কালো, এ কারণে সম্পূর্ণ নিরীহ ও সামাজিকভাবে অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ পুলিশের হাতে অপদস্ত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, নামজাদা খেলোয়াড়, শিল্পী ও রাজনীতিক।
কালোদের প্রতি পুলিশি ব্যবহার যে বর্ণবাদী, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সে কথা সবচেয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডি ব্লাসিও। পুলিশ কর্মকর্তা পান্তালেও বেকসুর খালাস পাওয়ার ঘটনাটি, তাঁর কথায়, নিউইয়র্কের জন্য গভীর বেদনার ও লজ্জার। গার্ডেনারের পিতার দিকে তাকিয়ে তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘এ সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজের (মিশ্র বর্ণের) পুত্র দান্তের কথা ভেবেছি। দান্তের সঙ্গে আমি অনেক সময় কথা বলেছি, (কৃষ্ণ বর্ণের হওয়ার কারণে) এই শহরে তাকে কী ধরনের বিপদের সম্মুখীন হতে পারে।’ তাঁর এ কথার অর্থই ছিল, শুধু কালো হওয়ার অপরাধে মেয়রের পুত্র পর্যন্ত পুলিশি হয়রানি অথবা হত্যার শিকার হতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে পাওয়া উপাত্ত অনুসারে আমেরিকাজুড়ে শ্বেতকায়দের তুলনায় কৃষ্ণকায়দের পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার সম্ভাবনা ২১ ভাগ বেশি। ২০১০-১০১২ সালে সংঘটিত পুলিশের গুলিতে নিহত ১৫ থেকে ১৯ বছরের কিশোর-যুবকদের মোট সংখ্যা ১২ হাজার ১৭। এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে প্র-পুবলিকা নামক সংবাদ গবেষণা সংস্থা জানাচ্ছে, প্রতি ১০ লাখে পুলিশি গুলিতে নিহত কালোদের সংখ্যা ৩১ দশমিক ১৭ শতাংশ, শ্বেতকায়দের সংখ্যা ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। গুলি নিক্ষেপকারী এসব পুলিশের ৯০ শতাংশই শ্বেতকায়।
মার্কিন সরকারের তথ্য অনুসারে, আমেরিকার অধিকাংশ শহরের পুলিশ বাহিনীর সদস্যের ৮০ ভাগই শ্বেতকায়। ফার্গুসনে, যেখানে ৬৭ শতাংশ মানুষ কালো, তার পুলিশ বাহিনীতে রয়েছেন ৫৩ জন সাদা পুলিশ কর্মকর্তা। কালো পুলিশ কর্মকর্তার সংখ্যা মাত্র তিন। ফার্গুসনে ২০১৩ সালে পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করেছে এমন শ্বেতকায়ের সংখ্যা ৩৬, কৃষ্ণকায়ের সংখ্যা ৪৮৩।
অধিকাংশ ভাষ্যকারের ধারণা, এ দেশে পুলিশের কালোদের ব্যাপারে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, পুলিশ জানে কালোদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে, তা যদি বেআইনিও হয়, তবু বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। নাগরিক অধিকার নেতা, আল শার্পটন সে কথার ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এ দেশের বিচারব্যবস্থা দুই ধরনের—একটি শ্বেতকায় ও উচ্চবিত্তের জন্য, অন্যটি কালো ও নিম্নবিত্তের জন্য।
এই দুই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় দেশজুড়ে যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, কেউ কেউ তাকে নাগরিক বিদ্রোহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বামপন্থী সাপ্তাহিক নেশন পত্রিকা লিখেছে, এ মুহূর্তে আমেরিকায় যা ঘটছে, তা শুধু প্রতিবাদ ঝড় নয়, এ এক নাগরিক ‘অভ্যুত্থান’। প্রবল শীত ও হাড়কাঁপানো বৃষ্টি উপেক্ষা করে হোয়াইট হাউসের সামনে প্রতিবাদী মানুষ জমায়েত হচ্ছে প্রতিদিন। ‘হান্ডস আপ, ডোন্ট শুট’ এই স্লোগান নিয়ে নিউইয়র্কের ব্রুকলিন ব্রিজের ওপর মিছিল নিয়ে আসছে বিভিন্ন বর্ণ ও ধর্মের মানুষ। দিনের প্রায় সব সময়ই ছোটখাটো প্রতিবাদ সমাবেশ হচ্ছে টাইমস স্কয়ারে। কৃষ্ণ অধিকার আন্দোলন, ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কালারড পিপলের সদস্য ও নাগরিক অধিকারকর্মীরা ফার্গুসন থেকে মিজৌরির রাজধানী জেফারসন সিটি পর্যন্ত পুরো ১২৭ মাইল হেঁটে প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিয়েছেন। অনেকেই বলছেন, ষাটের দশকে মার্টিন লুথার কিংয়ের নেতৃত্বে এ দেশে যে নাগরিক অধিকার আন্দোলন হয়েছিল, আজকের আমেরিকায় সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থেকে শহরের মেয়র, পুলিশপ্রধান, ধর্মীয় নেতা ও সাধারণ নাগরিক—সবাই এ ব্যাপারে একমত যে চলতি বর্ণবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। ফার্গুসনের ঘটনার পর পুলিশ কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে ওবামা বলেন, ‘আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি বলছি, সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ নিরস্ত্র কৃষ্ণকায় যুবকদের ওপর পুলিশের ব্যবহারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, আমেরিকান হিসেবে এই ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয়।
ইতিমধ্যে নিউইয়র্ক শহরে কিছু কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যেমন: ‘রেশিয়াল প্রোফাইলিং’ নিষিদ্ধ হয়েছে, হয়রানি কমাতে পুলিশের বুকে ভিডিও ক্যামেরার ব্যবস্থা হচ্ছে। অ-শ্বেতকায় পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। তবে সবাই এ ব্যাপারে একমত যে শুধু আইন করে অথবা পুলিশ বিভাগে অ-শ্বেতকায়দের সংখ্যা বাড়িয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না। আমেরিকার বর্ণবাদী ব্যবস্থা টিকে আছে ধনী ও দরিদ্রের বিপুল বৈষম্যের ভিত্তিতে। এই ব্যবধান যত দিন না কমছে, প্রকৃত পরিবর্তন অসম্ভব।
রোববার, যখন এই প্রতিবেদন লিখছি, নিউইয়র্ক শহরের নানা স্থানে নাগরিক বিক্ষোভ চলছে। লোকসমাগমের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য না হলেও শহরের সব ধরনের মানুষ—সাদা, কালো অথবা বাদামি—এসব সমাবেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জানান দিচ্ছে, কালো মানুষদের বিরুদ্ধে নির্বিকার পুলিশি নির্যাতন তারা মেনে নেবে না।
অধিকাংশের ক্ষোভ ফার্গুসন, মিজৌরি ও নিউইয়র্কের স্টাটেন আইল্যান্ডে সাম্প্রতিক সময়ের দুটি ভিন্ন ভিন্ন পুলিশি ঘটনায়। প্রথম ঘটনায় ১৭ জুলাই নিউইয়র্কে স্টাটেন আইল্যান্ডে ৪৩ বছর বয়স্ক এরিক গার্নার পুলিশের হাতে শ্বাসরোধের কারণে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অভিযোগ রয়েছে, গার্নার খোলা রাস্তায় চোরাচালানির সিগারেট বিক্রি করছিলেন। পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা তাঁর গলা চেপে ধরেন। অ্যাজমা রোগী এরিক গার্নার বারবার বলতে থাকেন, আমি শ্বাস নিতে পারছি না। তা সত্ত্বেও পুলিশ কর্মকর্তা ড্যানিয়েল পান্তালেও তাঁর গলা থেকে হাত সরিয়ে নেননি। ফলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গার্নারের মৃত্যু হয়। পুরো ঘটনাটি ভিডিও টেপে ধরা ছিল। প্রায় তিন মাস তদন্ত ও জুরি শুনানির পর পুলিশকে খুনের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় ঘটনায়, ৮ আগস্ট মিজৌরির ফার্গুসনে পুলিশের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতির পর মাইকেল ব্রাউন নামের ১৮ বছরের এক কৃষ্ণকায় যুবক পুলিশ কর্মকর্তা ড্যারেন উইলসনের গুলিতে নিহত হন। এ সময় ব্রাউন নিরস্ত্র ছিলেন। প্রায় তিন মাস তদন্ত ও বিচারের পর মূলত শ্বেতকায় জুরি উইলসনকে নির্দোষ ঘোষণা করে।
শুধু কালো মানুষ বলেই কোনো দ্বিধা না করে পুলিশ গুলি চালায়—এ কথা এখন অনেকেই বলছে। গত সপ্তাহে এই নিউইয়র্কেই আলো-আঁধারিতে এক যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গুলি করে মেরে ফেলে এক নবিশ পুলিশ। তার একমাত্র অপরাধ, সে কালো। প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে ক্লিভল্যান্ড, ওহাইও এবং সাউথ ক্যারোলাইনার ইউটাওভিল-এ। এ কথা গোপন নয় যে এ দেশে পুলিশ বর্ণভিত্তিক পূর্ব-অনুমিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে ব্যবহার করে থাকে। কালোদের বা বাদামিদের জন্য একরকম ব্যবহার, শ্বেতকায়দের জন্য অন্য রকম। শুধু কালো, এ কারণে সম্পূর্ণ নিরীহ ও সামাজিকভাবে অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ পুলিশের হাতে অপদস্ত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, নামজাদা খেলোয়াড়, শিল্পী ও রাজনীতিক।
কালোদের প্রতি পুলিশি ব্যবহার যে বর্ণবাদী, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সে কথা সবচেয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডি ব্লাসিও। পুলিশ কর্মকর্তা পান্তালেও বেকসুর খালাস পাওয়ার ঘটনাটি, তাঁর কথায়, নিউইয়র্কের জন্য গভীর বেদনার ও লজ্জার। গার্ডেনারের পিতার দিকে তাকিয়ে তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘এ সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজের (মিশ্র বর্ণের) পুত্র দান্তের কথা ভেবেছি। দান্তের সঙ্গে আমি অনেক সময় কথা বলেছি, (কৃষ্ণ বর্ণের হওয়ার কারণে) এই শহরে তাকে কী ধরনের বিপদের সম্মুখীন হতে পারে।’ তাঁর এ কথার অর্থই ছিল, শুধু কালো হওয়ার অপরাধে মেয়রের পুত্র পর্যন্ত পুলিশি হয়রানি অথবা হত্যার শিকার হতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে পাওয়া উপাত্ত অনুসারে আমেরিকাজুড়ে শ্বেতকায়দের তুলনায় কৃষ্ণকায়দের পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার সম্ভাবনা ২১ ভাগ বেশি। ২০১০-১০১২ সালে সংঘটিত পুলিশের গুলিতে নিহত ১৫ থেকে ১৯ বছরের কিশোর-যুবকদের মোট সংখ্যা ১২ হাজার ১৭। এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে প্র-পুবলিকা নামক সংবাদ গবেষণা সংস্থা জানাচ্ছে, প্রতি ১০ লাখে পুলিশি গুলিতে নিহত কালোদের সংখ্যা ৩১ দশমিক ১৭ শতাংশ, শ্বেতকায়দের সংখ্যা ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। গুলি নিক্ষেপকারী এসব পুলিশের ৯০ শতাংশই শ্বেতকায়।
মার্কিন সরকারের তথ্য অনুসারে, আমেরিকার অধিকাংশ শহরের পুলিশ বাহিনীর সদস্যের ৮০ ভাগই শ্বেতকায়। ফার্গুসনে, যেখানে ৬৭ শতাংশ মানুষ কালো, তার পুলিশ বাহিনীতে রয়েছেন ৫৩ জন সাদা পুলিশ কর্মকর্তা। কালো পুলিশ কর্মকর্তার সংখ্যা মাত্র তিন। ফার্গুসনে ২০১৩ সালে পুলিশ সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করেছে এমন শ্বেতকায়ের সংখ্যা ৩৬, কৃষ্ণকায়ের সংখ্যা ৪৮৩।
অধিকাংশ ভাষ্যকারের ধারণা, এ দেশে পুলিশের কালোদের ব্যাপারে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, পুলিশ জানে কালোদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে, তা যদি বেআইনিও হয়, তবু বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। নাগরিক অধিকার নেতা, আল শার্পটন সে কথার ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এ দেশের বিচারব্যবস্থা দুই ধরনের—একটি শ্বেতকায় ও উচ্চবিত্তের জন্য, অন্যটি কালো ও নিম্নবিত্তের জন্য।
এই দুই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় দেশজুড়ে যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, কেউ কেউ তাকে নাগরিক বিদ্রোহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বামপন্থী সাপ্তাহিক নেশন পত্রিকা লিখেছে, এ মুহূর্তে আমেরিকায় যা ঘটছে, তা শুধু প্রতিবাদ ঝড় নয়, এ এক নাগরিক ‘অভ্যুত্থান’। প্রবল শীত ও হাড়কাঁপানো বৃষ্টি উপেক্ষা করে হোয়াইট হাউসের সামনে প্রতিবাদী মানুষ জমায়েত হচ্ছে প্রতিদিন। ‘হান্ডস আপ, ডোন্ট শুট’ এই স্লোগান নিয়ে নিউইয়র্কের ব্রুকলিন ব্রিজের ওপর মিছিল নিয়ে আসছে বিভিন্ন বর্ণ ও ধর্মের মানুষ। দিনের প্রায় সব সময়ই ছোটখাটো প্রতিবাদ সমাবেশ হচ্ছে টাইমস স্কয়ারে। কৃষ্ণ অধিকার আন্দোলন, ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কালারড পিপলের সদস্য ও নাগরিক অধিকারকর্মীরা ফার্গুসন থেকে মিজৌরির রাজধানী জেফারসন সিটি পর্যন্ত পুরো ১২৭ মাইল হেঁটে প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিয়েছেন। অনেকেই বলছেন, ষাটের দশকে মার্টিন লুথার কিংয়ের নেতৃত্বে এ দেশে যে নাগরিক অধিকার আন্দোলন হয়েছিল, আজকের আমেরিকায় সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থেকে শহরের মেয়র, পুলিশপ্রধান, ধর্মীয় নেতা ও সাধারণ নাগরিক—সবাই এ ব্যাপারে একমত যে চলতি বর্ণবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। ফার্গুসনের ঘটনার পর পুলিশ কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে ওবামা বলেন, ‘আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি বলছি, সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ নিরস্ত্র কৃষ্ণকায় যুবকদের ওপর পুলিশের ব্যবহারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, আমেরিকান হিসেবে এই ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয়।
ইতিমধ্যে নিউইয়র্ক শহরে কিছু কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যেমন: ‘রেশিয়াল প্রোফাইলিং’ নিষিদ্ধ হয়েছে, হয়রানি কমাতে পুলিশের বুকে ভিডিও ক্যামেরার ব্যবস্থা হচ্ছে। অ-শ্বেতকায় পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। তবে সবাই এ ব্যাপারে একমত যে শুধু আইন করে অথবা পুলিশ বিভাগে অ-শ্বেতকায়দের সংখ্যা বাড়িয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না। আমেরিকার বর্ণবাদী ব্যবস্থা টিকে আছে ধনী ও দরিদ্রের বিপুল বৈষম্যের ভিত্তিতে। এই ব্যবধান যত দিন না কমছে, প্রকৃত পরিবর্তন অসম্ভব।
No comments