হিন্দুদের গোলপোস্ট হচ্ছে নয়াদিল্লি by কুলদীপ নায়ার
পেশোয়ারে
স্কুলশিশুদের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ভারতকে সত্যিকারের বেদনাপ্লুত করেছে।
পাকিস্তানে যারা প্রাণ হারাল তাদের স্মরণে দুই মিনিটের নীরবতা পালন করার
জন্য ভারতীয় স্কুলশিশুদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র
মোদি। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে তাৎক্ষণিক যে কোনো সহায়তা দেওয়ারও
প্রস্তাব করেছিলেন তিনি। এই মনোভঙ্গি তো সীমান্ত ছাড়িয়ে যাওয়ার আন্তরিকতারই
পরিচায়ক। কামনা করি, দুই দেশের মধ্যে এ অবস্থা অটুট থাকুক।
দুর্ভাগ্যবশত, ভারত ও পাকিস্তানের সুশীল সমাজ দুই দেশের যুবকদের একে অন্যের প্রতি বৈরিতা পোষণে উদ্বিগ্ন বোধ করে না। উপমহাদেশের বাইরে তারা বেশ ভালো বন্ধু। কিন্তু নিজ নিজ দেশে তারা অন্যকে আঘাত হানার জন্য সব সময় মুখিয়ে থাকে; এরকম করতে থাকলে বৈরিতা যে অপরিহার্য হয়ে ওঠে তা তাদের বোধে আসে না। পাকিস্তানিরা প্রায়শ বলে, কাশ্মীর সমস্যার সমাধানটা একবার হলেই হয়, তখন দুইপক্ষ বন্ধু হয়ে যাবে। আমার সন্দেহ রয়েছে। আমি মনে করি, কাশ্মীর হচ্ছে ব্যাধির লক্ষণ, ব্যাধি নয়। ব্যাধিটা হলো পারস্পরিক অবিশ্বাস। কোনো অলৌকিক পন্থায় কাশ্মীর সমস্যার সমাধান যদি হয়েও যায়, সন্দেহ-রোগের কারণে অন্য কোনো সমস্যা জেগে উঠবে।
ভারতীয় ও পাকিস্তানিরা যেখানেই যায় সেখানেই তাদের দুশমনিকে সঙ্গে নিয়ে যায়। দুঃখের বিষয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিও দুশমনি-চিন্তার শিকার হয়। দিল্লি প্রেসক্লাব তো উদার প্রতিষ্ঠান হওয়ারই কথা, কিন্তু পাকিস্তান থেকে আসা কাওয়ালরা সেখানেও গান গাইতে পারলেন না। অন্যদিকে হকি ম্যাচে হারানোর পর পাকিস্তানি খেলোয়াড়রা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে ভারতীয় টিমকে টিটকিরি দিয়েছে।
পাকিস্তানি সংসদের সফররত সদস্যরা লোকসভার স্পিকারের সঙ্গে দেখা করলেন না। ভারতীয় সংসদের সদস্যরা এই সাক্ষাৎকারের আয়োজন করেছিলেন। যখন সাক্ষাৎকারের জন্য অতিথিদের নিয়ে যাওয়া হলো, ওই সময়টায় স্পিকার 'ফ্রি' থাকবেন কিনা তা খতিয়ে দেখেননি। ভারতীয় সংসদ সদস্যদের উচিত ছিল, যে কোনোভাবে বিষয়টি শুধরে নেওয়ার। কিন্তু সৌজন্যের খাতিরেও ওরকম কোনো চেষ্টা করা হয়নি। এ ধরনের ঘটনায় এটাই বোঝা যায়, দেশ বিভাগের ৭০ বছর পরও দেশ দুটি বন্ধুত্ব দূরের কথা, স্বাভাবিক সৌজন্যগুলোও মেনে চলতে অভ্যস্ত হলো না। হিন্দু পরিচিতিকে সামনে নিয়ে আসার প্রবণতা দৃষ্টে মনে হয়, ভবিষ্যতেও উজ্জ্বল কিছু ঘটার নয়।
আগে ছিল হিন্দু ধর্মগ্রন্থের ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে মাতামাতি। এখন উন্মত্ততা ধর্মান্তকরণ নিয়ে। কিছু সংখ্যক মুসলমানকে ধর্মান্তরিত করানো বিশ্বের চোখে, বিশেষ করে পাকিস্তানের কাছে ভারতকে হেয় করে ফেলেছে। 'ধর্মান্তরিত' ব্যক্তিরা যখন বলে, ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পাইয়ে দেওয়ার জন্য রেশন কার্ড ও বিপিএল কার্ড দেবে ওয়াদা করে এবং জোর-জবরদস্তি করে তাদের টেনে আনা হয়েছে তখন বিষয়টি অন্যায়ের কল্পনাতীত পর্যায়ে চলে যায়।
পাকিস্তানে মৌলবাদ যে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে আমি বিস্মিত নই। মারাত্দক ব্লাসফেমি আইন আছে, পাঞ্জাবের উদারনৈতিক একজন গভর্নরকে হত্যা করা যায়, গভর্নরের খুনিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না- এমন দেশে অন্ধকার প্রসারিত হতেই থাকবে। এটা দুঃখজনক। পরিণতি ভয়াবহ হবে বলে উদারপন্থার সমর্থক কণ্ঠগুলো যখন নীরব হয়ে যায় উগ্রপন্থিদের সংখ্যা ও ধৃষ্টতা বাড়বেই।
ভারতে যা ঘটছে তা সত্যিই উদ্বেগজনক। এই দেশ তার রাষ্ট্রস্থিতিতে ধারণ করে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ জন্য সে বিশ্বজুড়ে সম্মানীয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, নয়াদিল্লি এখন দ্রুত হিন্দুত্বের গোলপোস্টে পরিণত হচ্ছে। এতে বিশ্ব হচ্ছে হতাশ আর সংখ্যালঘুরা হচ্ছে ভয়ার্ত।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) প্রধান জাঁকের সঙ্গে বললেন, ৮০০ বছর পর ভারতে আবার হিন্দুরাজ ফিরে এসেছে। এমন আস্ফালনের জন্য তিনি গুরুতর কোনো চ্যালেঞ্জের সামনে পড়লেন না। কিন্তু তার বোলচালে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচিতি প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। কেবল দিল্লিতেই চার লাখ সদস্য সংগ্রহ করেছে আরএসএস। এতে আশ্চর্যান্বিত হইনি। আরএসএসের জজবা আটকে দিতে সক্ষম কংগ্রেস নিজেই বংশানুক্রমিক রাজনীতিতে হাবুডুবু অবস্থায় রয়েছে। জওহর লাল নেহরু গড়ে তুলেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীকে, আবার ইন্দিরা গড়ে তুলেছেন রাজীব গান্ধীকে- এই সত্য সত্ত্বেও অতীতে কংগ্রেসের আদর্শ হিসেবে খুবই গুরুত্ব পেয়েছিল সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা ও বহুত্ববাদের আদর্শ। কিন্তু এখন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীকেও কেন্দ্র হিসেবে দেখা হয় না, তাকে গণ্য করা হয় কেন্দ্রের দক্ষিণ। ভারতের রাজনীতি বাড়াবাড়ি রকমের ব্যক্তিকেন্দ্রিক। বর্তমানে ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে হৈচৈ; তিনি কিসের বা কার জন্য কাজ করছেন তা গুরুত্বহীন। উন্নয়ন কথাটা এতটাই অস্পষ্ট যে, এর কোনো দিক-নির্দেশনা পাওয়া ভার। ভারতের উচিত সামগ্রিকভাবে এ অঞ্চলের উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া। সংকীর্ণতাকে আদর্শের ভিত্তি করতে চাওয়া হলে সেই আদর্শে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকে না; সুযোগের পরিব্যাপ্তিও নয়। এতে সাধারণ মানুষ মনে করে স্বাধীনতার পর থেকে তারা যেমন প্রান্তিক ও অবহেলিত ছিল এখনো তাই আছে।
কেন্দ্রে পরিবর্তন আনতে পারত শাসক দল। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতি সেরকম নয়। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি শাসনতান্ত্রিক হয়েই রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য থেকে অন্যান্য ধারার প্রকাশ ঘটে, যে ধারাটি গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে খাপ খায় না। এ অবস্থার ঘটেনি কোনো তাৎপর্যময় পরিবর্তন। যারা ক্ষমতায় বসে আচার-আচরণে তারা হয়ে যায় একনায়ক। এমনকি তারা যখন প্রচার করে, ক্ষমতা জনগণের হাতে তখনো তারা দেশ শাসন করতে চায় বা শাসন করছে হাতেগোনা এমন কয়েক ব্যক্তির স্বার্থেই কথা বলে।
মোদি এরই মধ্যে নেহরুর জোট নিরপেক্ষতার আইডিয়াকে মাটির গভীরে পুঁতে ফেলেছেন। সত্য বটে আন্দোলনটির মূল সুর কমিউনিস্ট ও গণতান্ত্রিক জোটের আদর্শিক দ্বন্দ্বে হারিয়ে গেছে। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির স্নায়ুযুদ্ধে কমিউনিস্টদের পরাজয় ঘটে। তা সত্ত্বেও জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন একটা চেতনা বহন করে, তা হলো : ছোট ছোট দেশগুলো আকার ও ক্ষমতায় বড় বড় দেশকে ভয় করবে না। মোদি হলেন ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার উৎপাদন। তিনি নেহরু যুগের সমাজতন্ত্রের বাহক নন; নন মহাত্দা গান্ধীর স্বয়ংসম্পূর্ণতার ধ্বজাধারীও। যে উপায়েই হোক আর বিত্তবান নিঃস্বজনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টিকারী অর্থনীতি যত বড়ই হোক, দেশকে উন্নত করতে চাইছেন মোদি।
শেষ করার আগে একটা বিষয়ে বলতে চাই, যা আমায় হতাশ করেছে। আমি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির লেখা বইটির কথা বলছি। জরুরি অবস্থা জারি থাকার সময় তার ভূমিকা বর্ণনা করার পরোক্ষ চেষ্টা বইতে আছে। তিনি জানেন, যে পদে তিনি আছেন সেই পদকে রাজনৈতিক সমালোচনার বিষয়বস্তু করা অনুচিত। তবু, জরুরি অবস্থাকালে তিনি যা যা করেছিলেন তার যথার্থতা তুলে ধরার জন্য রাষ্ট্রপতি তার পদবিগত অবস্থানের সুযোগই নিলেন।
ওই সময়টা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবিচ্ছিন্ন অংশ ছিলেন রাষ্ট্রপতি মুখার্জি। সংবিধান-বহিভর্ূত কর্তৃত্বের অধিকারী সঞ্জয় গান্ধী যিনি দেশকে স্বৈরতন্ত্রের দিকে প্রায় নিয়েই গিয়েছিলেন, সেই সঞ্জয়ের ডানহাত ছিলেন তিনি। উদারনীতিক মনে হলেও এখন বুক ঠুকিয়ে কথা বললেও ওই সময়টায় মুখার্জির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন সবসময়ই উঠবে।
লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।
দুর্ভাগ্যবশত, ভারত ও পাকিস্তানের সুশীল সমাজ দুই দেশের যুবকদের একে অন্যের প্রতি বৈরিতা পোষণে উদ্বিগ্ন বোধ করে না। উপমহাদেশের বাইরে তারা বেশ ভালো বন্ধু। কিন্তু নিজ নিজ দেশে তারা অন্যকে আঘাত হানার জন্য সব সময় মুখিয়ে থাকে; এরকম করতে থাকলে বৈরিতা যে অপরিহার্য হয়ে ওঠে তা তাদের বোধে আসে না। পাকিস্তানিরা প্রায়শ বলে, কাশ্মীর সমস্যার সমাধানটা একবার হলেই হয়, তখন দুইপক্ষ বন্ধু হয়ে যাবে। আমার সন্দেহ রয়েছে। আমি মনে করি, কাশ্মীর হচ্ছে ব্যাধির লক্ষণ, ব্যাধি নয়। ব্যাধিটা হলো পারস্পরিক অবিশ্বাস। কোনো অলৌকিক পন্থায় কাশ্মীর সমস্যার সমাধান যদি হয়েও যায়, সন্দেহ-রোগের কারণে অন্য কোনো সমস্যা জেগে উঠবে।
ভারতীয় ও পাকিস্তানিরা যেখানেই যায় সেখানেই তাদের দুশমনিকে সঙ্গে নিয়ে যায়। দুঃখের বিষয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিও দুশমনি-চিন্তার শিকার হয়। দিল্লি প্রেসক্লাব তো উদার প্রতিষ্ঠান হওয়ারই কথা, কিন্তু পাকিস্তান থেকে আসা কাওয়ালরা সেখানেও গান গাইতে পারলেন না। অন্যদিকে হকি ম্যাচে হারানোর পর পাকিস্তানি খেলোয়াড়রা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে ভারতীয় টিমকে টিটকিরি দিয়েছে।
পাকিস্তানি সংসদের সফররত সদস্যরা লোকসভার স্পিকারের সঙ্গে দেখা করলেন না। ভারতীয় সংসদের সদস্যরা এই সাক্ষাৎকারের আয়োজন করেছিলেন। যখন সাক্ষাৎকারের জন্য অতিথিদের নিয়ে যাওয়া হলো, ওই সময়টায় স্পিকার 'ফ্রি' থাকবেন কিনা তা খতিয়ে দেখেননি। ভারতীয় সংসদ সদস্যদের উচিত ছিল, যে কোনোভাবে বিষয়টি শুধরে নেওয়ার। কিন্তু সৌজন্যের খাতিরেও ওরকম কোনো চেষ্টা করা হয়নি। এ ধরনের ঘটনায় এটাই বোঝা যায়, দেশ বিভাগের ৭০ বছর পরও দেশ দুটি বন্ধুত্ব দূরের কথা, স্বাভাবিক সৌজন্যগুলোও মেনে চলতে অভ্যস্ত হলো না। হিন্দু পরিচিতিকে সামনে নিয়ে আসার প্রবণতা দৃষ্টে মনে হয়, ভবিষ্যতেও উজ্জ্বল কিছু ঘটার নয়।
আগে ছিল হিন্দু ধর্মগ্রন্থের ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে মাতামাতি। এখন উন্মত্ততা ধর্মান্তকরণ নিয়ে। কিছু সংখ্যক মুসলমানকে ধর্মান্তরিত করানো বিশ্বের চোখে, বিশেষ করে পাকিস্তানের কাছে ভারতকে হেয় করে ফেলেছে। 'ধর্মান্তরিত' ব্যক্তিরা যখন বলে, ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পাইয়ে দেওয়ার জন্য রেশন কার্ড ও বিপিএল কার্ড দেবে ওয়াদা করে এবং জোর-জবরদস্তি করে তাদের টেনে আনা হয়েছে তখন বিষয়টি অন্যায়ের কল্পনাতীত পর্যায়ে চলে যায়।
পাকিস্তানে মৌলবাদ যে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে আমি বিস্মিত নই। মারাত্দক ব্লাসফেমি আইন আছে, পাঞ্জাবের উদারনৈতিক একজন গভর্নরকে হত্যা করা যায়, গভর্নরের খুনিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না- এমন দেশে অন্ধকার প্রসারিত হতেই থাকবে। এটা দুঃখজনক। পরিণতি ভয়াবহ হবে বলে উদারপন্থার সমর্থক কণ্ঠগুলো যখন নীরব হয়ে যায় উগ্রপন্থিদের সংখ্যা ও ধৃষ্টতা বাড়বেই।
ভারতে যা ঘটছে তা সত্যিই উদ্বেগজনক। এই দেশ তার রাষ্ট্রস্থিতিতে ধারণ করে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ জন্য সে বিশ্বজুড়ে সম্মানীয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, নয়াদিল্লি এখন দ্রুত হিন্দুত্বের গোলপোস্টে পরিণত হচ্ছে। এতে বিশ্ব হচ্ছে হতাশ আর সংখ্যালঘুরা হচ্ছে ভয়ার্ত।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) প্রধান জাঁকের সঙ্গে বললেন, ৮০০ বছর পর ভারতে আবার হিন্দুরাজ ফিরে এসেছে। এমন আস্ফালনের জন্য তিনি গুরুতর কোনো চ্যালেঞ্জের সামনে পড়লেন না। কিন্তু তার বোলচালে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচিতি প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। কেবল দিল্লিতেই চার লাখ সদস্য সংগ্রহ করেছে আরএসএস। এতে আশ্চর্যান্বিত হইনি। আরএসএসের জজবা আটকে দিতে সক্ষম কংগ্রেস নিজেই বংশানুক্রমিক রাজনীতিতে হাবুডুবু অবস্থায় রয়েছে। জওহর লাল নেহরু গড়ে তুলেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীকে, আবার ইন্দিরা গড়ে তুলেছেন রাজীব গান্ধীকে- এই সত্য সত্ত্বেও অতীতে কংগ্রেসের আদর্শ হিসেবে খুবই গুরুত্ব পেয়েছিল সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা ও বহুত্ববাদের আদর্শ। কিন্তু এখন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীকেও কেন্দ্র হিসেবে দেখা হয় না, তাকে গণ্য করা হয় কেন্দ্রের দক্ষিণ। ভারতের রাজনীতি বাড়াবাড়ি রকমের ব্যক্তিকেন্দ্রিক। বর্তমানে ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে হৈচৈ; তিনি কিসের বা কার জন্য কাজ করছেন তা গুরুত্বহীন। উন্নয়ন কথাটা এতটাই অস্পষ্ট যে, এর কোনো দিক-নির্দেশনা পাওয়া ভার। ভারতের উচিত সামগ্রিকভাবে এ অঞ্চলের উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া। সংকীর্ণতাকে আদর্শের ভিত্তি করতে চাওয়া হলে সেই আদর্শে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকে না; সুযোগের পরিব্যাপ্তিও নয়। এতে সাধারণ মানুষ মনে করে স্বাধীনতার পর থেকে তারা যেমন প্রান্তিক ও অবহেলিত ছিল এখনো তাই আছে।
কেন্দ্রে পরিবর্তন আনতে পারত শাসক দল। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতি সেরকম নয়। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি শাসনতান্ত্রিক হয়েই রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য থেকে অন্যান্য ধারার প্রকাশ ঘটে, যে ধারাটি গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে খাপ খায় না। এ অবস্থার ঘটেনি কোনো তাৎপর্যময় পরিবর্তন। যারা ক্ষমতায় বসে আচার-আচরণে তারা হয়ে যায় একনায়ক। এমনকি তারা যখন প্রচার করে, ক্ষমতা জনগণের হাতে তখনো তারা দেশ শাসন করতে চায় বা শাসন করছে হাতেগোনা এমন কয়েক ব্যক্তির স্বার্থেই কথা বলে।
মোদি এরই মধ্যে নেহরুর জোট নিরপেক্ষতার আইডিয়াকে মাটির গভীরে পুঁতে ফেলেছেন। সত্য বটে আন্দোলনটির মূল সুর কমিউনিস্ট ও গণতান্ত্রিক জোটের আদর্শিক দ্বন্দ্বে হারিয়ে গেছে। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির স্নায়ুযুদ্ধে কমিউনিস্টদের পরাজয় ঘটে। তা সত্ত্বেও জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন একটা চেতনা বহন করে, তা হলো : ছোট ছোট দেশগুলো আকার ও ক্ষমতায় বড় বড় দেশকে ভয় করবে না। মোদি হলেন ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার উৎপাদন। তিনি নেহরু যুগের সমাজতন্ত্রের বাহক নন; নন মহাত্দা গান্ধীর স্বয়ংসম্পূর্ণতার ধ্বজাধারীও। যে উপায়েই হোক আর বিত্তবান নিঃস্বজনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টিকারী অর্থনীতি যত বড়ই হোক, দেশকে উন্নত করতে চাইছেন মোদি।
শেষ করার আগে একটা বিষয়ে বলতে চাই, যা আমায় হতাশ করেছে। আমি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির লেখা বইটির কথা বলছি। জরুরি অবস্থা জারি থাকার সময় তার ভূমিকা বর্ণনা করার পরোক্ষ চেষ্টা বইতে আছে। তিনি জানেন, যে পদে তিনি আছেন সেই পদকে রাজনৈতিক সমালোচনার বিষয়বস্তু করা অনুচিত। তবু, জরুরি অবস্থাকালে তিনি যা যা করেছিলেন তার যথার্থতা তুলে ধরার জন্য রাষ্ট্রপতি তার পদবিগত অবস্থানের সুযোগই নিলেন।
ওই সময়টা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবিচ্ছিন্ন অংশ ছিলেন রাষ্ট্রপতি মুখার্জি। সংবিধান-বহিভর্ূত কর্তৃত্বের অধিকারী সঞ্জয় গান্ধী যিনি দেশকে স্বৈরতন্ত্রের দিকে প্রায় নিয়েই গিয়েছিলেন, সেই সঞ্জয়ের ডানহাত ছিলেন তিনি। উদারনীতিক মনে হলেও এখন বুক ঠুকিয়ে কথা বললেও ওই সময়টায় মুখার্জির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন সবসময়ই উঠবে।
লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।
No comments