বছরজুড়ে আলোচনায় যারা
বছরজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে ছিলেন
তারা। নানা ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে সামনে এসেছে তাদের নাম। কেউ রাষ্ট্র
পরিচালনা করে, কেউ বিরোধী জোটের নেতৃত্ব দিয়ে আবার কেউবা রাজনীতির মাঠে
বক্তৃতা দিয়ে নিজেকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। বিদেশের সম্মাননা আর
নিজের প্রাপ্তিতে কেউবা উজ্জ্বল করেছেন দেশের মুখ। কেউ কুড়িয়েছেন মানুষের
সম্মান। আবার মানুষের ক্ষোভ আর সমালোচনার পাত্র হয়েছেন কেউ। তবে আলোচনার
কেন্দ্রে থাকা মানুষদের বেশির ভাগই ছিলেন রাজনীতি সংশ্লিষ্ট। রাজনৈতিক
কর্মকাণ্ড আর বক্তৃতা- বিবৃতির কারণেই তাদের নিয়ে আলোচনা হয়েছে সর্বত্র।
শেখ হাসিনা: ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনের মাধ্যমে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এ নির্বাচন করার কথা প্রথমে বলা হলেও পরবর্তীতে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার কথা বলা হচ্ছে এখন। দেশ-বিদেশে থাকা বিতর্ক উপেক্ষা করেই রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা করে বছরজুড়েই আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। সরকার গঠনের পর থেকে একের পর এক দৃঢ় নিদ্ধান্ত নিয়ে দল এবং দলের বাইরেও আলোচনায় ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিরোধীদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় একের পর এক কৌশলের কারণে বিরোধী শিবিরেও আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম পরিচালনায় সাহসী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন তিনি। ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ‘সাউথ সাউথ কো-অপারেশন ভিশনারি অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছেন তিনি। দীর্ঘ সময়ে দলের নেতৃত্বে থাকা শেখ হাসিনা দলের ঐক্যও ধরে রেখেছেন নিজ দক্ষতায়।
খালেদা জিয়া: ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে এ বছর সংসদের বাইরে ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তবুও ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার চার্জ গঠন করে বিচারকাজ শুরু হয় এ বছরেই। সরকার বিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করতে ১৮ দলীয় জোটকে ২০দলীয় জোটে পরিণত করেন বেগম জিয়া। তবে প্রায়শই সরকার পতনের আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিলেও মাঠে নামতে পারেনি তার দল বিএনপি। পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু ও মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের পর প্রটোকল হারানো এ নেত্রী নানা কারণে বছরজুড়েই ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে। সরকার পতনের আন্দোলনে ২০ দলের কর্মপরিকল্পনা চলছে তাকে ঘিরেই। এছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রটোকল হারালেও বিদেশী কূটনীতিক, সরকার ও রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তার বৈঠক হচ্ছে নিয়মিত। দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে বিভিন্ন সময়ে তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রভাবশালী বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: শুধু বাংলাদেশেই তিনি আলোচিত নন। গোটা বিশ্বে সমানভাবে আলোচিত ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিদায়ী বছরেও নোবেল বিজয়ী এ অর্থনীতিবিদ অর্জন করেছেন বিভিন্ন সম্মাননা। এ বছর বিশ্বের প্রভাবশালী চিন্তাবিদদের তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছেন তিনি। যার চিন্তার মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছে পৃথিবীর সামগ্রিক চিন্তাধারা। নভেম্বরে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সামাজিক ব্যবসা সম্মেলন মাতিয়েছেন এই শান্তিতে নোবেল বিজয়ী। তার অনুপ্রেরণার কারণে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় মেক্সিকো সিটিকে ‘সামাজিক ব্যবসা নগর’ ঘোষণা করে। ২০১৪ সালের নভেম্বরে সৌদি সরকারের কাছ থেকে গ্লোবাল এন্টারপ্রিনিউরশিপ অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করেন ড. ইউনূস। তার সামাজিক ব্যবসা তত্ত্বের সঙ্গে দুনিয়াজুড়ে উচ্চারিত হয়েছে তার নাম।
তারেক রহমান: বিদেশে সভা-সেমিনারে বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে সারা বছর দেশের রাজনীতির মাঠ গরম রেখেছিলেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন সময়ে লন্ডনে দেয়া বক্তব্য প্রচারের পর বিতর্কের ঝড় উঠে বিভিন্ন স্থান থেকে। সমালোচনার মুখে পড়েন ক্ষমতাসীন দলের। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি বক্তব্যের কারণে তার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের করা হয় দেশজুড়ে। পরোয়ানাও জারি হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। তারেক রহমানের ওই বক্তব্যের জের ধরে ছাত্রলীগ ঘোষণা দিয়েছে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রত্যাহার না হলে সারা দেশের কোথাও খালেদা জিয়াকে সমাবেশ করতে দেবে না। এ কারণে গাজীপুরে সর্বশেষ সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায় একই স্থানে ছাত্রলীগের সমাবেশ আহ্বানের কারণে।
সৈয়দ আশরাফুল হক: খুলনা সার্কিট হাউসে মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ ও বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনাকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ বলে আলোচনায় আসেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তার এ বক্তব্যে কূটনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচিত হয়। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশার ঢাকা সফরের ঠিক পরপর সৈয়দ আশরাফের এ বক্তব্যে তোলপাড় সৃষ্টি হয় কূটনৈতিক দুনিয়ায়। সৈয়দ আশরাফের এ বক্তব্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তার এ বক্তব্য প্রকাশের পর খোদ সরকার প্রধান এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ ঘটনা ছাড়াও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এবং দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হয়েও অনেকটা নিভৃতে থাকা সৈয়দ আশরাফকে নিয়ে ছিল নানা আলোচনা। দলের হাইকমান্ডের আস্থাভাজন হিসেবে যদিও সব সমালোচনা বরাবরই উতরে যান তিনি।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: হজ, মহানবী সাঃ ও তাবলীগ জামাত নিয়ে কটূক্তি করে বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে কারাগারে থাকা সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী হঠাৎই রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার ঝড় তোলেন। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু পিজি হাসপাতালের প্রিজন সেলে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। নিউ ইয়র্কে এক সভায় তিনি বলেন, আমি হজ ও তাবলীগের ঘোর বিরোধী। হজে অনেক ম্যানপাওয়ার নষ্ট হয়। এ বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে তার নামে দেশে একের পর এক মামলা হতে থাকে। ২৩শে নভেম্বর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। পরে তিনি ধানমণ্ডি থানায় আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। এ বক্তব্যের জন্য লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা ও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার ফাঁসির দাবিতে ধর্মভিত্তিক দলগুলো আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
এইচ টি ইমাম: ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে প্রশাসনে দলীয় সমর্থকদের ভূমিকা ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়ে বক্তব্য দিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নওয়াব আলী সিনেট ভবনে আয়োজিত ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে তার দেয়া বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে সুশীল সমাজসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তার এ বক্তব্যে আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ক্ষোভ ও বিরক্তি প্রকাশ করেন। অবশ্য তিনি দাবি করেন তার বক্তব্য বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে।
রওশন এরশাদ: ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বিরোধীদলীয় নেত্রীর মর্যাদা পান জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদ। একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী জোটে অবস্থান নেয়ায় ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয় তার দল জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টির মন্ত্রিসভায় থাকা না থাকা নিয়ে পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে বিরোধ সারা বছর জুড়ে ছিল আলোচনার বিষয়।
সৈয়দ মহসীন আলী: দশম জাতীয় সংসদে সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী সিলেটের একটি স্কুলের অনুষ্ঠানের মঞ্চে বসে ধূমপান করে বছরের শুরুতেই আলোচনায় আসেন। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে তিনি ধূমপান ত্যাগ করার ঘোষণা দেন। দ্বিতীয় দফায় সিলেটেই সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। মঞ্চে বসে ঘুমানো ও জনসভায় গান গেয়ে ব্যাপক হাস্যরসের সৃষ্টি করেন তিনি। তার কর্মকাণ্ডে দলে এবং দলের বাইরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হলেও মন্ত্রী বরাবরই নিজের ভুল স্বীকার করে নিজের অবস্থান ধরে রাখেন।
মুজিবুল হক: ৬৭ বছর বয়সে ২৯ বছরের তরুণী হনুফা বেগমকে বিয়ে করে দেশে-বিদেশে সমালোচিত ছিলেন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। বিয়ের ঘোষণা দিয়ে গণমাধ্যমের চোখেও তিনি ছিলেন আলোচিত মানুষ। বয়সী এ নেতার বিয়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভায় তাকে তরুণ মন্ত্রী বলে আখ্যায়িত করেন।
এ কে খন্দকার: ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ নামক বই লিখে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হন মুক্তিযুদ্ধের উপ-সেনাপতি এ কে খন্দকার। এ কে খন্দকার তার এই বইয়ে লিখেছেন, ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের শেষে ‘জয় পাকিস্তান’ বলেন। তার এই বই প্রকাশের পর তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম থেকে পদত্যাগ করেন। এই বই প্রকাশের পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাকে রাজাকার বলে আক্রমণ করা হয়। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয় তিনি সত্য ইতিহাস তুলে ধরেছেন। ব্যাপক সমালোচনার মুখেও এ কে খন্দকার তার অবস্থানে অনড় রয়েছেন।
ড্যান মজিনা: বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা। তিন বছর বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন শেষে ২১শে ডিসেম্বর দেশে ফিরে যান। এ সংক্ষিপ্ত সময়ে বাংলাদেশের কৃষ্টি-কালচারের সঙ্গে তিনি নিজেকে খাপ খাইয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ ও এদেশের মানুষকে আপন করে নেন। দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা সফর করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও তাকে নিয়ে হয়েছে অনেক আলোচনা-সমালোচনা। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন, সংলাপ, আলোচনার ইস্যুতে বিভিন্ন সময়ে তার সরকারের অবস্থান তুলে ধরে আলোচনায় থাকেন এ কূটনীতিক।
সাকিব আল হাসান: শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ২০১৪ সালের ৭ই জুলাই ছয় মাসের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট ও দেড় বছরের জন্য দেশের বাইরে খেলা নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। নানা নাটকীয়তার পর তার খেলার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে বিসিবি। সফররত জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজে নৈপুণ্য প্রদর্শনের মাধ্যমে আবার আলোচনায় আসেন তিনি।
শেখ হাসিনা: ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনের মাধ্যমে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এ নির্বাচন করার কথা প্রথমে বলা হলেও পরবর্তীতে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার কথা বলা হচ্ছে এখন। দেশ-বিদেশে থাকা বিতর্ক উপেক্ষা করেই রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা করে বছরজুড়েই আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। সরকার গঠনের পর থেকে একের পর এক দৃঢ় নিদ্ধান্ত নিয়ে দল এবং দলের বাইরেও আলোচনায় ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিরোধীদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় একের পর এক কৌশলের কারণে বিরোধী শিবিরেও আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম পরিচালনায় সাহসী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন তিনি। ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ‘সাউথ সাউথ কো-অপারেশন ভিশনারি অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছেন তিনি। দীর্ঘ সময়ে দলের নেতৃত্বে থাকা শেখ হাসিনা দলের ঐক্যও ধরে রেখেছেন নিজ দক্ষতায়।
খালেদা জিয়া: ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে এ বছর সংসদের বাইরে ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তবুও ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার চার্জ গঠন করে বিচারকাজ শুরু হয় এ বছরেই। সরকার বিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করতে ১৮ দলীয় জোটকে ২০দলীয় জোটে পরিণত করেন বেগম জিয়া। তবে প্রায়শই সরকার পতনের আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিলেও মাঠে নামতে পারেনি তার দল বিএনপি। পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু ও মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের পর প্রটোকল হারানো এ নেত্রী নানা কারণে বছরজুড়েই ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে। সরকার পতনের আন্দোলনে ২০ দলের কর্মপরিকল্পনা চলছে তাকে ঘিরেই। এছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রটোকল হারালেও বিদেশী কূটনীতিক, সরকার ও রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তার বৈঠক হচ্ছে নিয়মিত। দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে বিভিন্ন সময়ে তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রভাবশালী বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: শুধু বাংলাদেশেই তিনি আলোচিত নন। গোটা বিশ্বে সমানভাবে আলোচিত ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিদায়ী বছরেও নোবেল বিজয়ী এ অর্থনীতিবিদ অর্জন করেছেন বিভিন্ন সম্মাননা। এ বছর বিশ্বের প্রভাবশালী চিন্তাবিদদের তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছেন তিনি। যার চিন্তার মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছে পৃথিবীর সামগ্রিক চিন্তাধারা। নভেম্বরে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সামাজিক ব্যবসা সম্মেলন মাতিয়েছেন এই শান্তিতে নোবেল বিজয়ী। তার অনুপ্রেরণার কারণে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় মেক্সিকো সিটিকে ‘সামাজিক ব্যবসা নগর’ ঘোষণা করে। ২০১৪ সালের নভেম্বরে সৌদি সরকারের কাছ থেকে গ্লোবাল এন্টারপ্রিনিউরশিপ অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করেন ড. ইউনূস। তার সামাজিক ব্যবসা তত্ত্বের সঙ্গে দুনিয়াজুড়ে উচ্চারিত হয়েছে তার নাম।
তারেক রহমান: বিদেশে সভা-সেমিনারে বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে সারা বছর দেশের রাজনীতির মাঠ গরম রেখেছিলেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন সময়ে লন্ডনে দেয়া বক্তব্য প্রচারের পর বিতর্কের ঝড় উঠে বিভিন্ন স্থান থেকে। সমালোচনার মুখে পড়েন ক্ষমতাসীন দলের। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি বক্তব্যের কারণে তার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের করা হয় দেশজুড়ে। পরোয়ানাও জারি হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। তারেক রহমানের ওই বক্তব্যের জের ধরে ছাত্রলীগ ঘোষণা দিয়েছে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রত্যাহার না হলে সারা দেশের কোথাও খালেদা জিয়াকে সমাবেশ করতে দেবে না। এ কারণে গাজীপুরে সর্বশেষ সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায় একই স্থানে ছাত্রলীগের সমাবেশ আহ্বানের কারণে।
সৈয়দ আশরাফুল হক: খুলনা সার্কিট হাউসে মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ ও বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনাকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ বলে আলোচনায় আসেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তার এ বক্তব্যে কূটনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচিত হয়। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশার ঢাকা সফরের ঠিক পরপর সৈয়দ আশরাফের এ বক্তব্যে তোলপাড় সৃষ্টি হয় কূটনৈতিক দুনিয়ায়। সৈয়দ আশরাফের এ বক্তব্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তার এ বক্তব্য প্রকাশের পর খোদ সরকার প্রধান এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ ঘটনা ছাড়াও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এবং দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হয়েও অনেকটা নিভৃতে থাকা সৈয়দ আশরাফকে নিয়ে ছিল নানা আলোচনা। দলের হাইকমান্ডের আস্থাভাজন হিসেবে যদিও সব সমালোচনা বরাবরই উতরে যান তিনি।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: হজ, মহানবী সাঃ ও তাবলীগ জামাত নিয়ে কটূক্তি করে বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে কারাগারে থাকা সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী হঠাৎই রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার ঝড় তোলেন। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু পিজি হাসপাতালের প্রিজন সেলে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। নিউ ইয়র্কে এক সভায় তিনি বলেন, আমি হজ ও তাবলীগের ঘোর বিরোধী। হজে অনেক ম্যানপাওয়ার নষ্ট হয়। এ বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে তার নামে দেশে একের পর এক মামলা হতে থাকে। ২৩শে নভেম্বর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। পরে তিনি ধানমণ্ডি থানায় আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। এ বক্তব্যের জন্য লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা ও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার ফাঁসির দাবিতে ধর্মভিত্তিক দলগুলো আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
এইচ টি ইমাম: ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে প্রশাসনে দলীয় সমর্থকদের ভূমিকা ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়ে বক্তব্য দিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নওয়াব আলী সিনেট ভবনে আয়োজিত ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে তার দেয়া বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে সুশীল সমাজসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তার এ বক্তব্যে আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ক্ষোভ ও বিরক্তি প্রকাশ করেন। অবশ্য তিনি দাবি করেন তার বক্তব্য বিকৃত করে উপস্থাপন করা হয়েছে।
রওশন এরশাদ: ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বিরোধীদলীয় নেত্রীর মর্যাদা পান জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদ। একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী জোটে অবস্থান নেয়ায় ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয় তার দল জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টির মন্ত্রিসভায় থাকা না থাকা নিয়ে পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে বিরোধ সারা বছর জুড়ে ছিল আলোচনার বিষয়।
সৈয়দ মহসীন আলী: দশম জাতীয় সংসদে সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী সিলেটের একটি স্কুলের অনুষ্ঠানের মঞ্চে বসে ধূমপান করে বছরের শুরুতেই আলোচনায় আসেন। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে তিনি ধূমপান ত্যাগ করার ঘোষণা দেন। দ্বিতীয় দফায় সিলেটেই সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। মঞ্চে বসে ঘুমানো ও জনসভায় গান গেয়ে ব্যাপক হাস্যরসের সৃষ্টি করেন তিনি। তার কর্মকাণ্ডে দলে এবং দলের বাইরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হলেও মন্ত্রী বরাবরই নিজের ভুল স্বীকার করে নিজের অবস্থান ধরে রাখেন।
মুজিবুল হক: ৬৭ বছর বয়সে ২৯ বছরের তরুণী হনুফা বেগমকে বিয়ে করে দেশে-বিদেশে সমালোচিত ছিলেন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। বিয়ের ঘোষণা দিয়ে গণমাধ্যমের চোখেও তিনি ছিলেন আলোচিত মানুষ। বয়সী এ নেতার বিয়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভায় তাকে তরুণ মন্ত্রী বলে আখ্যায়িত করেন।
এ কে খন্দকার: ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ নামক বই লিখে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হন মুক্তিযুদ্ধের উপ-সেনাপতি এ কে খন্দকার। এ কে খন্দকার তার এই বইয়ে লিখেছেন, ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের শেষে ‘জয় পাকিস্তান’ বলেন। তার এই বই প্রকাশের পর তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম থেকে পদত্যাগ করেন। এই বই প্রকাশের পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাকে রাজাকার বলে আক্রমণ করা হয়। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয় তিনি সত্য ইতিহাস তুলে ধরেছেন। ব্যাপক সমালোচনার মুখেও এ কে খন্দকার তার অবস্থানে অনড় রয়েছেন।
ড্যান মজিনা: বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা। তিন বছর বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন শেষে ২১শে ডিসেম্বর দেশে ফিরে যান। এ সংক্ষিপ্ত সময়ে বাংলাদেশের কৃষ্টি-কালচারের সঙ্গে তিনি নিজেকে খাপ খাইয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ ও এদেশের মানুষকে আপন করে নেন। দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা সফর করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও তাকে নিয়ে হয়েছে অনেক আলোচনা-সমালোচনা। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন, সংলাপ, আলোচনার ইস্যুতে বিভিন্ন সময়ে তার সরকারের অবস্থান তুলে ধরে আলোচনায় থাকেন এ কূটনীতিক।
সাকিব আল হাসান: শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ২০১৪ সালের ৭ই জুলাই ছয় মাসের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট ও দেড় বছরের জন্য দেশের বাইরে খেলা নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। নানা নাটকীয়তার পর তার খেলার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে বিসিবি। সফররত জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজে নৈপুণ্য প্রদর্শনের মাধ্যমে আবার আলোচনায় আসেন তিনি।
No comments