আজহারের ফাঁসির আদেশ
রংপুর
অঞ্চলের আল বদর কমান্ডার জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম
আজহারুল ইসলামকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
একাত্তরে গণহত্যা, হত্যা ও ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাকে এ
সাজা দেয়া হয়। মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত মামলার রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি এম
ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল-১।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত এ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য
হলেন- বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক। ট্রাইব্যুনাল
রায় ঘোষণার আগে বলেন, কোনো ধর্মীয় নেতার বিরুদ্ধে রায় দেয়া হচ্ছে না। এখানে
১৯৭১-এর অপরাধীদের বিচার হচ্ছে। আজহারুলের বিরুদ্ধে গঠন করা ছয়টি অভিযোগের
মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়। এর
মধ্যে তিনটি অভিযোগে তাকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়। একটিতে ২৫ বছর এবং অপরটিতে ৫
বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় মানবতাবিরোধী এ জামায়াত নেতাকে। যে অভিযোগের জন্য
তাকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয় সেগুলো হল : ২ নম্বর অভিযোগ ধাপপাড়া গণহত্যা, ৩
নম্বর অভিযোগ হচ্ছে ঝাড়ুয়ারবিল গণহত্যা এবং ৪ নম্বর রংপুর কারমাইকেল কলেজের
চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপক-পত্নীকে হত্যার অভিযোগ। এ ছাড়া ৫ নম্বর
অভিযোগে এক নারীকে ধর্ষণ ও পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণে সহায়তার দায়ে ২৫ বছর ও
৬ নম্বর অভিযোগে নির্যাতনের দায়ে ৫ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে জামায়াতের
এ শীর্ষ নেতাকে। আর প্রমাণিত না হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আনা ১ নম্বর অভিযোগ
থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। রায় ঘোষণা উপলক্ষে সকাল ৯টার আগেই ঢাকা
কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় হাজির করা হয় এটিএম
আজহারুলকে। এ জন্য সকাল থেকেই ট্রাইব্যুনাল ও এর আশপাশের এলাকায় আইনশৃংখলা
রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়। দোয়েল চত্বর থেকে
ট্রাইব্যুনালের দিকের সড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়। ট্রাইব্যুনালের প্রধান ফটকে
অবস্থান নেন আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বাইরে প্রস্তুত রাখা হয়
পুলিশের সাঁজোয়া যান। নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয় পুরো প্রেস ক্লাব এলাকা
পর্যন্ত। এরই মধ্যে রায় ঘোষণার আগে নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখতে যান ঢাকা
মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ। বেলা ১১টার পর ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ
করে সেখানে দু-এক মিনিট থেকেই তিনি আবার বেরিয়ে যান।
সম্পাদকীয় লিখে, বিবৃতি দিয়ে, সহিংসতা করে রায় পরিবর্তন করা যাবে না : বেলা ১১টার কিছু আগে জামায়াতের এ নেতাকে হাজতখানা থেকে ট্রাইব্যুনালে আসামির কাঠগড়ায় তোলা হয়। বেলা ১১টা ১০ মিনিটে বিচারপতিরা এজলাসে ওঠেন। এজলাসে ওঠার পর রায় ঘোষণার আগে ট্রাইব্যুনাল বেশ কিছু মন্তব্য করেন। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, ‘ইদানীং রায় হওয়ার পরে বিভিন্ন রকমের প্রতিক্রিয়া দেখছি। দেশী দু-একটা ও বিদেশী কয়েকটা মিডিয়া এমনভাবে সংবাদ উপস্থাপন করছে যে, এখানে ধর্মীয় নেতাদের রায় দেয়া হচ্ছে। এটা ঠিক নয়। আমরা একাত্তরের অপরাধীদের বিচার করছি। তিনি কোন পর্যায়ের ইসলামিক বা ধর্মীয় নেতা, আজকে তার অবস্থান, সেটা আমাদের বিবেচ্য নয়। সম্পাদকীয় লিখে, বিবৃতি দিয়ে, সহিংসতা করে রায় পরিবর্তন সম্ভব নয়।’
বিচারপতি বলেন, ‘ফৌজদারি মামলায় সব পক্ষকে খুশি করে রায় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা বিচারকরা আইন, সংবিধান, ঘটনা বা সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে রায় দেই। আমাদের সাক্ষ্য বিশ্লেষণে ভুল হলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। আমরা এটা আশা করি, আইনের শাসনে বিশ্বাসী মানুষ রায় পছন্দ না হলে আপিলে যাবেন। রায়ের বিরুদ্ধে সহিংস কর্মসূচি দেবেন না। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা উচিত নয়, যাতে রায় দেয়ার ক্ষেত্রে বিচারকরা চাপ অনুভব করেন।’
রায় প্রদান : বেলা ১১টা ১৭ মিনিট থেকে রায় ঘোষণা শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। ১৫৬ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ আদালতে পড়ে শোনানো হয়। সংক্ষিপ্ত রায়ের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক, এরপর দ্বিতীয় অংশ পড়েন বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন এবং সর্বশেষ আদেশের অংশ পড়েন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। রায় ঘোষণা শেষ হয় ১২টা ৪৫ মিনিটে।
রায়ে এক নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস দেয়া হয় এটিএম আজহারকে। এ অভিযোগটি ছিল একাত্তরের ২৪ মার্চ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ভাসানী (ন্যাপ) নেতা ও রংপুর শহরের বিশিষ্ট আয়কর আইনজীবী এওয়াই মাহফুজ আলীসহ ১১ জনকে অপহরণ, আটক শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যাসংক্রান্ত। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগের প্রতিটিতে দেয়া হয় মৃত্যুদণ্ড।
এর মধ্যে দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, আজহারের নেতৃত্বে একাত্তরের ১৬ এপ্রিল তার নিজ এলাকা রংপুরের বদরগঞ্জ থানার ধাপপাড়ায় ১৫ জন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিকে গুলি করে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে এটিএম আজহারুল ইসলাম নিজেও এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। ওই ঘটনায় শহীদদের মধ্যে ১৪ জনের নাম-পরিচিতি শনাক্ত করা গেছে।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, এটিএম আজহারের নেতৃত্বে ১৭ এপ্রিল তার নিজ এলাকা রংপুরের বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ারবিল এলাকায় এক হাজার ২২৫ জন নিরীহ লোক ধরে নিয়ে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ওই ঘটনায় এক হাজার ২২৫ জন শহীদ হন, যাদের মধ্যে ৩৬৫ জনের নাম-পরিচিতি পাওয়া গেছে। শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধ, কেউ ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাদ যাননি। গণহত্যার শিকারদের মধ্যে ২০০ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন, যা প্রমাণ করে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে ওই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল।
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, এটিএম আজহারের নির্দেশে ১৭ এপ্রিল রংপুর কারমাইকেল কলেজের চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপক-পত্নীকে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে অপহরণ করে দমদম ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। সেদিন কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক কালাচান রায় ও তার স্ত্রী মঞ্জুশ্রী রায়, সুনীল বরণ চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ অধিকারী ও চিত্তরঞ্জন রায়কে হত্যা করা হয়।
পাঁচ নম্বর অভিযোগটি ছিল ধর্ষণসংক্রান্ত। এ অপরাধে আজহার পেয়েছেন ২৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ। পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, এটিএম আজহারুল ইসলামের পরিকল্পনায় ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে রংপুর শহর ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নানা বয়সী নারীদের ধরে এনে রংপুর টাউন হলে আটকে রেখে ধর্ষণসহ শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। সে সময় নারীদের ধরে এনে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর অফিসারদের ভোগের জন্য তুলে দেয়া হতো। রংপুর টাউন হলে তাদের আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হতো। একই সঙ্গে মহিলাসহ নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের অপহরণ, আটক, নির্যাতন, গুরুতর জখম, হত্যা ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর রংপুর টাউন হলের পেছনে ইন্দারায় অনেক মা-বোনের মরদেহ পাওয়া যায়।
ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের নভেম্বরের মাঝামাঝি রংপুর শহরের গুপ্তপাড়ায় একজনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। একই বছরের ১ ডিসেম্বর রংপুর শহরের বেতপট্টি থেকে একজনকে অপহরণ করে রংপুর কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে নিয়ে আটক রেখে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন ও গুরুতর জখম করেন আজহার। নির্যাতনের এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে আরও ৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়। রায়ে বলা হয়, আসামির একটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে অন্য দণ্ডগুলো তার সঙ্গে একীভূত হয়ে যাবে। এ ছাড়া এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামির উচ্চ আদালতে আপিল করারও সুযোগ রয়েছে। রায় ঘোষণার পর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। অন্যদিকে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করার কথা জানিয়েছেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম।
ফরমায়েশি রায় : সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা শেষ হওয়ার আগেই মৃত্যুদণ্ডের রায় শুনে আসামির কাঠগড়ায় এটিএম আজহারুল ইসলাম বলতে থাকেন, ‘ফরমায়েশি রায়, ফরমায়েশি রায়। সম্পূর্ণ মিথ্যা রায়। আমি নির্দোষ। আল্লাহর আদালতের বিচার হবে ইনশাআল্লাহ।’ রায় শেষে বিচারকরা এজলাস ত্যাগের সময় এটিএম আজহার বিচারকদের উদ্দেশে বলতে থকেন, ‘আল্লাহ হু আকবার, আল্লাহ হু আকবার। আল্লাহ আপনাদের বিচার করবে।’
২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল এটিএম আজহারের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু হয়। ওই বছর ২২ আগস্ট মগবাজারের বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তদন্ত শেষে প্রসিকিউশন গতবছর ১৮ জুলাই আজহারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন। একই বছরের ১২ নভেম্বর ছয়টি ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আজহারের বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। মামলাটির বিচার কার্যক্রম শেষে গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। সোমবার ট্রাইব্যুনাল-১ রায় ঘোষণার এ দিন ধার্য করেন। এ রায়টি ছিল ট্রাইব্যুনালের পঞ্চদশ রায়। ট্রাইব্যুনালের এসব রায়ে এ পর্যন্ত ১৬ জন দণ্ডিত হয়েছেন। এর মধ্যে আপিল বিভাগের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একজন আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়।
সম্পাদকীয় লিখে, বিবৃতি দিয়ে, সহিংসতা করে রায় পরিবর্তন করা যাবে না : বেলা ১১টার কিছু আগে জামায়াতের এ নেতাকে হাজতখানা থেকে ট্রাইব্যুনালে আসামির কাঠগড়ায় তোলা হয়। বেলা ১১টা ১০ মিনিটে বিচারপতিরা এজলাসে ওঠেন। এজলাসে ওঠার পর রায় ঘোষণার আগে ট্রাইব্যুনাল বেশ কিছু মন্তব্য করেন। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, ‘ইদানীং রায় হওয়ার পরে বিভিন্ন রকমের প্রতিক্রিয়া দেখছি। দেশী দু-একটা ও বিদেশী কয়েকটা মিডিয়া এমনভাবে সংবাদ উপস্থাপন করছে যে, এখানে ধর্মীয় নেতাদের রায় দেয়া হচ্ছে। এটা ঠিক নয়। আমরা একাত্তরের অপরাধীদের বিচার করছি। তিনি কোন পর্যায়ের ইসলামিক বা ধর্মীয় নেতা, আজকে তার অবস্থান, সেটা আমাদের বিবেচ্য নয়। সম্পাদকীয় লিখে, বিবৃতি দিয়ে, সহিংসতা করে রায় পরিবর্তন সম্ভব নয়।’
বিচারপতি বলেন, ‘ফৌজদারি মামলায় সব পক্ষকে খুশি করে রায় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা বিচারকরা আইন, সংবিধান, ঘটনা বা সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে রায় দেই। আমাদের সাক্ষ্য বিশ্লেষণে ভুল হলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। আমরা এটা আশা করি, আইনের শাসনে বিশ্বাসী মানুষ রায় পছন্দ না হলে আপিলে যাবেন। রায়ের বিরুদ্ধে সহিংস কর্মসূচি দেবেন না। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা উচিত নয়, যাতে রায় দেয়ার ক্ষেত্রে বিচারকরা চাপ অনুভব করেন।’
রায় প্রদান : বেলা ১১টা ১৭ মিনিট থেকে রায় ঘোষণা শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। ১৫৬ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ আদালতে পড়ে শোনানো হয়। সংক্ষিপ্ত রায়ের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক, এরপর দ্বিতীয় অংশ পড়েন বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন এবং সর্বশেষ আদেশের অংশ পড়েন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। রায় ঘোষণা শেষ হয় ১২টা ৪৫ মিনিটে।
রায়ে এক নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস দেয়া হয় এটিএম আজহারকে। এ অভিযোগটি ছিল একাত্তরের ২৪ মার্চ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ভাসানী (ন্যাপ) নেতা ও রংপুর শহরের বিশিষ্ট আয়কর আইনজীবী এওয়াই মাহফুজ আলীসহ ১১ জনকে অপহরণ, আটক শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যাসংক্রান্ত। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগের প্রতিটিতে দেয়া হয় মৃত্যুদণ্ড।
এর মধ্যে দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, আজহারের নেতৃত্বে একাত্তরের ১৬ এপ্রিল তার নিজ এলাকা রংপুরের বদরগঞ্জ থানার ধাপপাড়ায় ১৫ জন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিকে গুলি করে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে এটিএম আজহারুল ইসলাম নিজেও এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। ওই ঘটনায় শহীদদের মধ্যে ১৪ জনের নাম-পরিচিতি শনাক্ত করা গেছে।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, এটিএম আজহারের নেতৃত্বে ১৭ এপ্রিল তার নিজ এলাকা রংপুরের বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ারবিল এলাকায় এক হাজার ২২৫ জন নিরীহ লোক ধরে নিয়ে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ওই ঘটনায় এক হাজার ২২৫ জন শহীদ হন, যাদের মধ্যে ৩৬৫ জনের নাম-পরিচিতি পাওয়া গেছে। শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধ, কেউ ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাদ যাননি। গণহত্যার শিকারদের মধ্যে ২০০ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন, যা প্রমাণ করে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে ওই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল।
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, এটিএম আজহারের নির্দেশে ১৭ এপ্রিল রংপুর কারমাইকেল কলেজের চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপক-পত্নীকে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে অপহরণ করে দমদম ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। সেদিন কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক কালাচান রায় ও তার স্ত্রী মঞ্জুশ্রী রায়, সুনীল বরণ চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ অধিকারী ও চিত্তরঞ্জন রায়কে হত্যা করা হয়।
পাঁচ নম্বর অভিযোগটি ছিল ধর্ষণসংক্রান্ত। এ অপরাধে আজহার পেয়েছেন ২৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ। পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, এটিএম আজহারুল ইসলামের পরিকল্পনায় ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে রংপুর শহর ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নানা বয়সী নারীদের ধরে এনে রংপুর টাউন হলে আটকে রেখে ধর্ষণসহ শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। সে সময় নারীদের ধরে এনে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর অফিসারদের ভোগের জন্য তুলে দেয়া হতো। রংপুর টাউন হলে তাদের আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হতো। একই সঙ্গে মহিলাসহ নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিদের অপহরণ, আটক, নির্যাতন, গুরুতর জখম, হত্যা ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর রংপুর টাউন হলের পেছনে ইন্দারায় অনেক মা-বোনের মরদেহ পাওয়া যায়।
ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের নভেম্বরের মাঝামাঝি রংপুর শহরের গুপ্তপাড়ায় একজনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। একই বছরের ১ ডিসেম্বর রংপুর শহরের বেতপট্টি থেকে একজনকে অপহরণ করে রংপুর কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে নিয়ে আটক রেখে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন ও গুরুতর জখম করেন আজহার। নির্যাতনের এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে আরও ৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়। রায়ে বলা হয়, আসামির একটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে অন্য দণ্ডগুলো তার সঙ্গে একীভূত হয়ে যাবে। এ ছাড়া এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামির উচ্চ আদালতে আপিল করারও সুযোগ রয়েছে। রায় ঘোষণার পর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। অন্যদিকে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করার কথা জানিয়েছেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম।
ফরমায়েশি রায় : সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা শেষ হওয়ার আগেই মৃত্যুদণ্ডের রায় শুনে আসামির কাঠগড়ায় এটিএম আজহারুল ইসলাম বলতে থাকেন, ‘ফরমায়েশি রায়, ফরমায়েশি রায়। সম্পূর্ণ মিথ্যা রায়। আমি নির্দোষ। আল্লাহর আদালতের বিচার হবে ইনশাআল্লাহ।’ রায় শেষে বিচারকরা এজলাস ত্যাগের সময় এটিএম আজহার বিচারকদের উদ্দেশে বলতে থকেন, ‘আল্লাহ হু আকবার, আল্লাহ হু আকবার। আল্লাহ আপনাদের বিচার করবে।’
২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল এটিএম আজহারের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু হয়। ওই বছর ২২ আগস্ট মগবাজারের বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তদন্ত শেষে প্রসিকিউশন গতবছর ১৮ জুলাই আজহারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন। একই বছরের ১২ নভেম্বর ছয়টি ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আজহারের বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। মামলাটির বিচার কার্যক্রম শেষে গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। সোমবার ট্রাইব্যুনাল-১ রায় ঘোষণার এ দিন ধার্য করেন। এ রায়টি ছিল ট্রাইব্যুনালের পঞ্চদশ রায়। ট্রাইব্যুনালের এসব রায়ে এ পর্যন্ত ১৬ জন দণ্ডিত হয়েছেন। এর মধ্যে আপিল বিভাগের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একজন আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়।
No comments