সাক্ষাৎকার- বঙ্গবন্ধুর সচেতন সিদ্ধান্ত ছিল তিনি ভারতে যাবেন না by সাজেদুল হক
বঙ্গবন্ধুর সচেতন সিদ্ধান্ত ছিল তিনি ভারতে যাবেন না। যদি মুক্তিযুদ্ধ ব্যর্থ হতো তাহলে কি হতো? শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হলেন। পাকিস্তানিরা তো তাকে হত্যাও করতে পারতো। এ ঝুঁকিটা তো তিনি নিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন। আবার সংলাপও চালিয়ে গেছেন। কারণ, তার বিশ্বাস ছিল বাংলাদেশ অবশ্যই স্বাধীন হবে।
মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে লেখক, গবেষক, মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন আহমদ এসব কথা বলেছেন। তার লেখা ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থ নিয়ে চারদিকে যখন তুমুল আলোচনা তখন মঙ্গলবার ধানমন্ডির বাসায় দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলেছেন ইতিহাসের বহুল আলোচিত নানা ঘটনা নিয়ে। যে সব ঘটনায় নিজেও যুক্ত ছিলেন তিনি। সম্প্রতি প্রকাশিত কিছু গ্রন্থে দাবি করা হচ্ছে তাজউদ্দীন আহমদ ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু তাতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান। এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, এটা তো খুবই স্বাভাবিক। উনি পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নেতা। তিনি পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের নেতা। উনি কেন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে যাবেন। স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে তিনি কোথায় যেতেন? আমি তো মনে করি এটা ছিল তার রাজনৈতিক কৌশল। জিয়াউর রহমান ২৭শে মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার যে ঘোষণা দেন তা তিনি নিজেই ড্রাফট করেছিলেন। তাতে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রের প্রভিশনাল প্রধান হিসেবে ঘোষণা দেন। পরে অবশ্য আওয়ামী লীগ নেতাদের পরামর্শে তিনি তার ঘোষণা পরিবর্তন করেছিলেন। যাতে তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এটা সত্য, বঙ্গবন্ধু লিখে কোন স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। কিন্তু তার পক্ষে অনেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ইতিহাসের অনেক সত্য আমাদের দেশে গুম হয়ে গেছে। আমি চাই ইতিহাসের সে সত্য পুনরুদ্ধার হোক। প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছি। কর্নেল তাহের বীর উত্তমকে ছোট করার জন্য কিছু লিখিনি। উনি বিপ্লব করার চেষ্টা করেছেন। আজকে যারা তাকে জোর করে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক বানাতে চাইছেন তারা কর্নেল তাহেরকে অপমান করছেন। তারা তাদের বর্তমান রাজনীতিতে তাহেরকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন। এটাই আমার দুঃখ। তিনি বলেন, পার্টির নেতৃত্বের দায়িত্বহীনতার কারণে জাসদের অগণিত কর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে। তাদের নামও সংরক্ষণ করা হয়নি। এটা আমাদের রাজনীতিরই একটি বড় দীনতা যে, রাজনীতি করতে গিয়ে যে সব ছেলে জীবন দেয় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নাম সংরক্ষণের প্রয়োজনও মনে করে না। তাদের পরিবারেরও কোন খোঁজখবর নেয় না। এই যে এতগুলো প্রাণ গেল, জাসদ নেতাদের তার দায় নিতে হবে। সিরাজুল আলম খান থেকে শুরু করে জাসদের কোন নেতাই নেতৃত্বের দায়ভার এড়াতে পারেন না। আওয়ামী লীগ-জাসদের এখনকার ঐক্যকে বলা হচ্ছে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্য। তাহলে ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ছিল? এখন কেন আপনি এ বই লিখলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে লেখক বলেন, তাহলে কখন লিখবো? যারা বলছেন, তারা বলুন কখন লেখার সময় হবে? যখন ইতিহাসের সব চরিত্র হারিয়ে যাবে? তারা একটা মতলব থেকেই এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, আমাদের দেশে নতুন কোন তথ্য উত্থাপন হলে যা পূর্বধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক তখন এক ধরনের হৈচৈ তৈরি হয়। অনেকে হোঁচট খায়। ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে লেখককে যেমন বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে তেমনি পাঠ করার সময় পাঠককেও বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে। বিশেষ কোন পূর্বধারণা নিয়ে ইতিহাস পাঠ করা যাবে না। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান প্রথম কবে উচ্চারিত হয়েছিল, কারা এ স্লোগান দিয়েছিলেন, আজকে যারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছেন তারা হয়তো তা জানেনও না। যেমন একটি কথা প্রচলিত আছে, ১৯৬৯ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেন। কিন্তু তার পেছনে আরও সত্য রয়েছে। ১৯৬৮ সালেই ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া নিয়ে আলোচনা করেন। আর তোফায়েল আহমেদ যে ঘোষণা দেন তা দেন সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে। যদিও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্তর্ভুক্ত ছাত্র ইউনিয়ন শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া নিয়ে তীব্র বিরোধিতা করেছিল। মতিয়া চৌধুরীর অংশের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জোহা তো সেদিন রাগ করে মঞ্চেই ওঠেননি। তিনি বলেন, আমাদের ইতিহাসের অনেক তথ্য এমনিতেই হারিয়ে গেছে। অনেক তথ্য বিকৃত হয়ে গেছে। তথ্য দাতাদের অনেকেই এখন নেই। জীবিত যারা আছেন তাদের অনেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। রাজনীতিবিদরা তাদের বর্তমান লাইন অনুযায়ী কথা বলেন। তিনি হয়তো তার ওই সময়কার পার্ট ঠিকভাবে বলেন না। তবে আমার একটা সুবিধা- মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী জাসদের ঘটনাপ্রবাহে আমি নিজেও যুক্ত ছিলাম। প্রশ্ন উঠতে পারে, আমি নিজে যেহেতু জাসদের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম তাই জাসদকে নিয়ে আমার লেখা কতটা বস্তুনিষ্ঠ হবে। এটা আমি বলতে পারি রাগ, বিরাগ ও অনুরাগের ঊর্ধ্বে উঠে আমি বস্তুনিষ্ঠভাবে লেখার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কন্যা শারমিন আহমদ, মুক্তিযুদ্ধের উপ-সেনা প্রধান একে খন্দকার এবং তার নিজের লেখা বই নিয়ে কেন এই বিতর্ক- এ প্রশ্নের জবাবে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, এতে পজিটিভ অনেক জিনিস আলোচনায় আসছে। শারমিন আহমদ যা লিখেছেন হয়তো তার বাবা-মায়ের কাছে শুনে লিখেছেন। অন্যদিকে, একে খন্দকারের বইটি অনেকটা স্মৃতিকথা ধরনের। তবে তা থেকে ইতিহাসের কিছু কিছু উপাদান নেয়া সম্ভব। যদিও এসব বইয়ের কিছু কিছু তথ্যের সঙ্গে আমি একমত নই। যেমন একে খন্দকার লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ জয় পাকিস্তান বলেছেন। কিন্তু সেদিন আমি রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলাম। আমি এ ধরনের কোন কথা শুনিনি। তিনি বলেন, জাসদকে বুঝতে হলে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়কেও বুঝতে হবে। কারণ, মুক্তিযোদ্ধারাই জাসদ তৈরি করেছিলেন। যে নিউক্লিয়াসের কথা বলা হয় তা চালু হয় ’৭২ সালে। তার আগে এটা কেউ বলতো না। কিন্তু আমি এটার সূত্র নিয়ে এসেছি ১৯৬২ সাল থেকে। ১৯৮৩ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আবদুর রাজ্জাক আমাকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলেছিলেন। মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ৬০-এর দশকে শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। এ অঞ্চলের মানুষ তার মধ্যেই তাদের আশা-আকাঙক্ষার প্রতিফলন দেখতে পেলেন। কারণ প্রতিটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে একটি প্রতীকের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এটা মনে করার কারণ নেই যে তিনি একাই সব করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও কোন নেতা একা সব কিছু করতে পারেননি। আপনার বইয়ে সিরাজুল আলম খানকে বড় করে দেখিয়েছেন এমন মন্তব্যের জবাবে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, না, উনি যা আমি তাই লিখেছি। ’৭১ এর পরবর্তী প্রজন্ম তাকে চেনে না। তারা হয়তো তার নামও শোনেনি। যারা তার সঙ্গী ছিলেন তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, আ স ম রব তাদেরই তার সম্পর্কে বলা উচিত ছিল। তারা তো কিছু বলেন না। ইতিহাসে তার অবদান যেটুকু আমি সেটাই তুলে ধরেছি। উনি তো পরে এরশাদকেও সমর্থন করেছিলেন। তবে ’৭৪ সালের পর থেকে আসলে সিরাজুল আলম খানের তেমন কোন ভূমিকা নেই।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় পাকিস্তানের সঙ্গে খোন্দকার মোশ্তাকের যোগাযোগ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খোন্দকার মোশ্তাক কনফেডারেশন ধরনের কোন কথা বলেননি। বঙ্গবন্ধু অনেকগুলো পথ খোলা রেখেছিলেন। মোশ্তাক যে আলোচনা করছিলেন তা-ও হয়তো বঙ্গবন্ধু জানতেন। না হলে ’৭২ সালে তিনি মন্ত্রিসভায় স্থান পেতেন না, আওয়ামী লীগেও এত গুরুত্ব পেতেন না। মোশ্তাক বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় ষড়যন্ত্র করেছিলেন এসব কথা উঠে আসে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর।
মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে লেখক, গবেষক, মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন আহমদ এসব কথা বলেছেন। তার লেখা ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থ নিয়ে চারদিকে যখন তুমুল আলোচনা তখন মঙ্গলবার ধানমন্ডির বাসায় দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলেছেন ইতিহাসের বহুল আলোচিত নানা ঘটনা নিয়ে। যে সব ঘটনায় নিজেও যুক্ত ছিলেন তিনি। সম্প্রতি প্রকাশিত কিছু গ্রন্থে দাবি করা হচ্ছে তাজউদ্দীন আহমদ ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু তাতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান। এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, এটা তো খুবই স্বাভাবিক। উনি পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নেতা। তিনি পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের নেতা। উনি কেন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে যাবেন। স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে তিনি কোথায় যেতেন? আমি তো মনে করি এটা ছিল তার রাজনৈতিক কৌশল। জিয়াউর রহমান ২৭শে মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার যে ঘোষণা দেন তা তিনি নিজেই ড্রাফট করেছিলেন। তাতে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রের প্রভিশনাল প্রধান হিসেবে ঘোষণা দেন। পরে অবশ্য আওয়ামী লীগ নেতাদের পরামর্শে তিনি তার ঘোষণা পরিবর্তন করেছিলেন। যাতে তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এটা সত্য, বঙ্গবন্ধু লিখে কোন স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। কিন্তু তার পক্ষে অনেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ইতিহাসের অনেক সত্য আমাদের দেশে গুম হয়ে গেছে। আমি চাই ইতিহাসের সে সত্য পুনরুদ্ধার হোক। প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছি। কর্নেল তাহের বীর উত্তমকে ছোট করার জন্য কিছু লিখিনি। উনি বিপ্লব করার চেষ্টা করেছেন। আজকে যারা তাকে জোর করে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক বানাতে চাইছেন তারা কর্নেল তাহেরকে অপমান করছেন। তারা তাদের বর্তমান রাজনীতিতে তাহেরকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন। এটাই আমার দুঃখ। তিনি বলেন, পার্টির নেতৃত্বের দায়িত্বহীনতার কারণে জাসদের অগণিত কর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে। তাদের নামও সংরক্ষণ করা হয়নি। এটা আমাদের রাজনীতিরই একটি বড় দীনতা যে, রাজনীতি করতে গিয়ে যে সব ছেলে জীবন দেয় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নাম সংরক্ষণের প্রয়োজনও মনে করে না। তাদের পরিবারেরও কোন খোঁজখবর নেয় না। এই যে এতগুলো প্রাণ গেল, জাসদ নেতাদের তার দায় নিতে হবে। সিরাজুল আলম খান থেকে শুরু করে জাসদের কোন নেতাই নেতৃত্বের দায়ভার এড়াতে পারেন না। আওয়ামী লীগ-জাসদের এখনকার ঐক্যকে বলা হচ্ছে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্য। তাহলে ১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ছিল? এখন কেন আপনি এ বই লিখলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে লেখক বলেন, তাহলে কখন লিখবো? যারা বলছেন, তারা বলুন কখন লেখার সময় হবে? যখন ইতিহাসের সব চরিত্র হারিয়ে যাবে? তারা একটা মতলব থেকেই এ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, আমাদের দেশে নতুন কোন তথ্য উত্থাপন হলে যা পূর্বধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক তখন এক ধরনের হৈচৈ তৈরি হয়। অনেকে হোঁচট খায়। ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে লেখককে যেমন বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে তেমনি পাঠ করার সময় পাঠককেও বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে। বিশেষ কোন পূর্বধারণা নিয়ে ইতিহাস পাঠ করা যাবে না। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান প্রথম কবে উচ্চারিত হয়েছিল, কারা এ স্লোগান দিয়েছিলেন, আজকে যারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছেন তারা হয়তো তা জানেনও না। যেমন একটি কথা প্রচলিত আছে, ১৯৬৯ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেন। কিন্তু তার পেছনে আরও সত্য রয়েছে। ১৯৬৮ সালেই ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া নিয়ে আলোচনা করেন। আর তোফায়েল আহমেদ যে ঘোষণা দেন তা দেন সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে। যদিও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্তর্ভুক্ত ছাত্র ইউনিয়ন শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া নিয়ে তীব্র বিরোধিতা করেছিল। মতিয়া চৌধুরীর অংশের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জোহা তো সেদিন রাগ করে মঞ্চেই ওঠেননি। তিনি বলেন, আমাদের ইতিহাসের অনেক তথ্য এমনিতেই হারিয়ে গেছে। অনেক তথ্য বিকৃত হয়ে গেছে। তথ্য দাতাদের অনেকেই এখন নেই। জীবিত যারা আছেন তাদের অনেকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। রাজনীতিবিদরা তাদের বর্তমান লাইন অনুযায়ী কথা বলেন। তিনি হয়তো তার ওই সময়কার পার্ট ঠিকভাবে বলেন না। তবে আমার একটা সুবিধা- মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী জাসদের ঘটনাপ্রবাহে আমি নিজেও যুক্ত ছিলাম। প্রশ্ন উঠতে পারে, আমি নিজে যেহেতু জাসদের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম তাই জাসদকে নিয়ে আমার লেখা কতটা বস্তুনিষ্ঠ হবে। এটা আমি বলতে পারি রাগ, বিরাগ ও অনুরাগের ঊর্ধ্বে উঠে আমি বস্তুনিষ্ঠভাবে লেখার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কন্যা শারমিন আহমদ, মুক্তিযুদ্ধের উপ-সেনা প্রধান একে খন্দকার এবং তার নিজের লেখা বই নিয়ে কেন এই বিতর্ক- এ প্রশ্নের জবাবে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, এতে পজিটিভ অনেক জিনিস আলোচনায় আসছে। শারমিন আহমদ যা লিখেছেন হয়তো তার বাবা-মায়ের কাছে শুনে লিখেছেন। অন্যদিকে, একে খন্দকারের বইটি অনেকটা স্মৃতিকথা ধরনের। তবে তা থেকে ইতিহাসের কিছু কিছু উপাদান নেয়া সম্ভব। যদিও এসব বইয়ের কিছু কিছু তথ্যের সঙ্গে আমি একমত নই। যেমন একে খন্দকার লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ জয় পাকিস্তান বলেছেন। কিন্তু সেদিন আমি রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলাম। আমি এ ধরনের কোন কথা শুনিনি। তিনি বলেন, জাসদকে বুঝতে হলে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়কেও বুঝতে হবে। কারণ, মুক্তিযোদ্ধারাই জাসদ তৈরি করেছিলেন। যে নিউক্লিয়াসের কথা বলা হয় তা চালু হয় ’৭২ সালে। তার আগে এটা কেউ বলতো না। কিন্তু আমি এটার সূত্র নিয়ে এসেছি ১৯৬২ সাল থেকে। ১৯৮৩ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আবদুর রাজ্জাক আমাকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলেছিলেন। মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ৬০-এর দশকে শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। এ অঞ্চলের মানুষ তার মধ্যেই তাদের আশা-আকাঙক্ষার প্রতিফলন দেখতে পেলেন। কারণ প্রতিটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে একটি প্রতীকের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এটা মনে করার কারণ নেই যে তিনি একাই সব করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও কোন নেতা একা সব কিছু করতে পারেননি। আপনার বইয়ে সিরাজুল আলম খানকে বড় করে দেখিয়েছেন এমন মন্তব্যের জবাবে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, না, উনি যা আমি তাই লিখেছি। ’৭১ এর পরবর্তী প্রজন্ম তাকে চেনে না। তারা হয়তো তার নামও শোনেনি। যারা তার সঙ্গী ছিলেন তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, আ স ম রব তাদেরই তার সম্পর্কে বলা উচিত ছিল। তারা তো কিছু বলেন না। ইতিহাসে তার অবদান যেটুকু আমি সেটাই তুলে ধরেছি। উনি তো পরে এরশাদকেও সমর্থন করেছিলেন। তবে ’৭৪ সালের পর থেকে আসলে সিরাজুল আলম খানের তেমন কোন ভূমিকা নেই।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় পাকিস্তানের সঙ্গে খোন্দকার মোশ্তাকের যোগাযোগ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খোন্দকার মোশ্তাক কনফেডারেশন ধরনের কোন কথা বলেননি। বঙ্গবন্ধু অনেকগুলো পথ খোলা রেখেছিলেন। মোশ্তাক যে আলোচনা করছিলেন তা-ও হয়তো বঙ্গবন্ধু জানতেন। না হলে ’৭২ সালে তিনি মন্ত্রিসভায় স্থান পেতেন না, আওয়ামী লীগেও এত গুরুত্ব পেতেন না। মোশ্তাক বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় ষড়যন্ত্র করেছিলেন এসব কথা উঠে আসে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর।
No comments