২ হাজার কোটি টাকা নিয়ে উধাও
গ্রাহকদের ২ হাজার কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে এহসান এস সংস্থা নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এতে তৃণমূলের ১২ হাজার গ্রাহক তাদের ১৪ বছরের সঞ্চয় হারিয়ে পথে বসেছেন। প্রতারকরা সটকে পড়ার আগে তাদের সব অফিসে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। যশোরে প্রতিষ্ঠিত এহসান এসসহ তিনটি কোম্পানি বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এই বিপুল অংকের টাকা সংগ্রহ করেছিল।
দুই হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা একটি গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
তদন্ত শেষে গত ৫ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। যুবক ও ডেসটিনির মতো স্থানীয় প্রশাসকের মাধ্যমে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়ার জন্য তারা সুপারিশ করেন। এছাড়া, এহসান সোসাইটি, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লি. এবং এহসান ইসলামী মাল্টি পারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করে সংস্থাটি।
এ প্রসঙ্গে জেলা সমবায় কর্মকর্তা মশিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি সমবায় অধিদফতরের নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান। তাদের আর্থিক হিসাব আমাদের কাছে আছে। তাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটির বাইরে যদি কর্মকর্তারা আর্থিক লেনদেন করে থাকেন সেটির হিসাব আমাদের কাছে নেই।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রাহকদের বিপুল অংকের টাকা আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত এহসান সোসাইটি লি., এহসান রিয়েল এস্টেট কোং লি. ও এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি. নামের এই তিনটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মাওলানা আইয়ুব হোসেন, মুফতি ইউনুস আহমেদ, মাওলানা জুনায়েত আলী, মাওলানা আতাউল্লাহ, মাওলানা মিজানুর রহমান, মাওলানা মো. হালিম, মাওলানা শামছুজ্জামান টিটু ও মনিরুল ইসলাম। গত কয়েক মাস ধরে এদের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না, তারা আত্মগোপন করেছেন। গ্রাহকদের ২ হাজার কোটি টাকা সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মুফতি ইউনুস আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক মাওলানা জুনায়েত আলী ও নির্বাহী সদস্য মাওলানা আতাউল্লাহসহ যশোর শাখার চিফ জোনাল ম্যানেজার খবিরুজ্জামান ভাগাভাগি শেষে আত্মসাৎ করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এহসান সোসাইটির সর্বসাকুল্যে ৫১ কোটির টাকার সম্পদ আছে। এই সম্পদ বিক্রি করেও গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করা সম্ভব নয়। যশোর জেলা সমবায় অফিস সূত্র জানায়, এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড সমবায় অধিদফতরের একটি নিবন্ধিত সমিতি। ২০১৩ সালের অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির ২৯ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে জমি প্রকল্পে ২১ কোটি ২৩ লাখ, ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান ৩১ লাখ টাকা, ধার পাওনা ১ কোটি ৯১ লাখ টাকা। গ্রাহকদের বিনিয়োগকৃত টাকা ২৬ কোটি ৯৩ লাখ ও শেয়ার মূলধন বাবদ ৬৯ লাখ টাকা এবং বাকি টাকা অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই কোম্পানির গ্রাহকের সংখ্যা ১ হাজার ৮৪ জন। এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড একমাত্র প্রতিষ্ঠান যা সমবায় অধিদফতরে নিবন্ধিত। বাকি দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধু এহসান এস জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে নিবন্ধন নেয়া। অপর প্রতিষ্ঠানটির কোনো নিবন্ধন নেই বলে জানা গেছে। সমবায় অধিদফতর শুধু তাদের কাছে নিবন্ধিত সংস্থার দায়িত্ব নেবে, অন্য দুটির নয়। কাজেই ওই দুই প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের টাকা ফেরত পাওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০০১ সালে স্থানীয় এলাকার বাসিন্দা কৃষি ব্যাংকের সাবেক এজিএম কাজী রবিউল ইসলাম এহসান এস সংস্থা নামের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এটি রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ও ফার্মগুলো থেকে নিবন্ধন নেয়া হয়েছে। নিবন্ধন নম্বর হচ্ছে এস-৩২১১ (জে-৭৬) ২০০৩। এই প্রতিষ্ঠানের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলেন এহসান রিয়েল এস্টেট কোম্পানি, ইসলামিক শরিয়া ভিত্তিক এহসান ইসলামী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি।
জানা গেছে, মাওলানা জুনায়েত আলী ও মাওলানা রবিউল ইসলামিক শরিয়া ভিত্তিক এহসান ইসলামী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি পরিচালনা করেন। তারা প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোরআন ও হাদিসের নানা আয়াত তুলে প্রচার চালান। এভাবে কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা দিয়ে তারা টার্গেট গ্র“পকে আয়ত্তে নিয়ে আসেন। তাদের প্রচারণায় বলা হয় দেশের প্রচলিত ব্যাংক ও বীমা সুদের ব্যবসা করে। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে অর্থলগ্নি করে মুনাফা ভোগ করা সুদ খাওয়ার মতোই হারাম। শরিয়া মোতাবেক জীবনযাপন করতে তাদের প্রতিষ্ঠানে অর্থ বিনিয়োগের বিকল্প নেই। এভাবে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এক বছর মেয়াদি প্রতি লাখের জন্য এক মাসে ১৪শ’ টাকা, ২ বছর মেয়াদে প্রতি লাখে মাসে ১৫শ’ টাকা এবং তিন বছর মেয়াদে আমানতকারীকে প্রতি মাসে এক লাখ টাকায় ১৬শ’ টাকা দেয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়ে সঞ্চয় সংগ্রহ করে। গ্রাহকের এই অর্থ দিয়ে ১৫ শতাংশ নগদ ঋণ সহায়তার মাধ্যমে জমি ক্রয়-বিক্রয়সহ লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা হয়।
এহসান সোসাইটির মাধ্যমে ৮ থেকে ১০ বছর মেয়াদি ডিপিএস প্রকল্পের নামে টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতি মাসে একজন গ্রাহকের কাছ থেকে ১ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত কিস্তি সংগ্রহ করা হয়। আবার এই কিস্তির অর্থ দিয়ে গ্রাহকদের কাছে ১৫ শতাংশ সুদে পুনরায় ঋণ দেয়া হয়। এভাবে ১০ হাজার গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। এ ব্যাপারে এহসান সোসাইটি (যশোর জেলা) প্রধান সমন্বয়কারী মাওলানা মো. আয়ুব আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার ব্যবহারের মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
এই কোম্পানির তৃতীয় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি। গ্রাহকদের বইয়ে কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা দেয়া হয়েছে ঢাকার উত্তরার ৯-সেক্টর, বাড়ি ৩৯, রোড-৭/ডি। এই কোম্পানির মাধ্যমে গ্রাহকরা শুধু প্লট, ফ্ল্যাট ও পরিবহন খাতে বিনিয়োগ করেছে। এক বছর মেয়াদি প্রতি লাখের জন্য এক মাসে ১৪শ’ টাকা, ২ বছর মেয়াদে ১৫শ’ টাকা এবং তিন বছর মেয়াদে আমানতকারীকে ১৬শ’ টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সঞ্চয় সংগ্রহ করে। এর গ্রাহক সংখ্যা এ পর্যন্ত ৯শ’ দাঁড়িয়েছে। কোম্পানি গ্রাহকদের বইয়ে তিনটি মোবাইল ফোনের মধ্যে একটি খোলা পাওয়া গেছে। এই ০১৭১১১৪ক্স৭ মোবাইল নম্বরধারী ফোনে নাম প্রকাশ না করে প্রতিষ্ঠানের শাখা নিয়ন্ত্রক ছিলেন বলে নিজেকে দাবি করেন। তিনি জানান, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঝামেলা হওয়ায় দুই বছর আগে রিয়েল এস্টেট ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি একজন শেয়ার সদস্য ছিলেন। বর্তমানে এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন। তিনি আরও বলেন, যশোরে এহসান রিয়েল এস্টেটের ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার সম্পদ আছে। হাজার কোটি টাকার হিসাব সঠিক নয়।
যশোরের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের প্রতিনিধি মফিজুল ইসলাম ইমন বলেন, তার লগ্নিকৃত টাকার পরিমাণ এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে ৫ লাখ টাকা, এহসান রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে ১১ লাখ ৩০ হাজার টাকাসহ মোট ১৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা। তিনি অভিযোগ করে বলেন প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকর্তারা অফিস ও মোবাইল ফোন বন্ধ রেখে গা ঢাকা দিয়েছে। তিনি ঢাকায় গিয়ে কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে তারা ইমনকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
যশোর ব্যুরো : এহসান সোসাইটির প্রতারণায় ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হওয়ার পথে কয়েক হাজার গ্রাহক। তাদের লগ্নি করা টাকা ফেরত দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। গ্রাহকদের দাবি প্রতিষ্ঠানগুলো এ অঞ্চলের অন্তত দশ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে দুই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে গা ঢাকা দিয়েছে। তারা অফিস খুলছে না। আত্মগোপনে থেকে গ্রাহকদের নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। অপরদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এহসান সোসাইটির একাধিক প্রতিষ্ঠানের সর্বসাকুল্যে একান্ন কোটির টাকার সম্পদ আছে। বাকি টাকা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা আত্মসাৎ করেছে। টাকা ফেরতের দাবিতে বুধবার যশোর প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করেছে প্রতারণার শিকার গ্রাহকরা।
খোলাডাঙ্গা এলাকার কোহিনুর বেগম জানান, এলাকার মসজিদের ইমাম আজাহারুলের মাধ্যমে দুই লাখ টাকা দিয়েছি। এখন আর ফেরত দিচ্ছে না। আশ্রম রোডের সেলিনা পারভীন বলেন, আতাউল্লাহসহ কর্মকর্তারা তাবলীগ চিল্লায় গিয়ে মানুষকে নানা কথা বলে টাকা নিয়েছে। এখন আর ফেরত দিচ্ছে না। তিনিও দশ লাখ ত্রিশ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছেন বলে জানান। বারান্দীপাড়ার বাসিন্দা কুলসুম বেগম বলেন, এক লাখ টাকায় মাসে ১৬শ’ টাকা মুনাফা দেয়ার কথা। প্রথম ক’মাস দেয়ার পর কোম্পানির লোকজন টাকা দেয় না। চাইতে গেলে নানা টালবাহানা করে। জমি বিক্রি করে টাকা দিয়ে এখন পথে বসেছি। তারা গ্রাহকের টাকায় ৭০-৮০ হাজার টাকা দরে প্রতি কাঠা জমি ক্রয় করেন। এখন সেই গ্রাহককে তিন থেকে চার লাখ টাকা দরে জমি দেবে বলে জানায়। এতে আপত্তি করলে অফিস থেকে জানানো হয় বেশি বাড়াবাড়ি করলে টাকা জমি কোনোটাই দেয়া হবে না।
দুই হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা একটি গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
তদন্ত শেষে গত ৫ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। যুবক ও ডেসটিনির মতো স্থানীয় প্রশাসকের মাধ্যমে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়ার জন্য তারা সুপারিশ করেন। এছাড়া, এহসান সোসাইটি, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লি. এবং এহসান ইসলামী মাল্টি পারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করে সংস্থাটি।
এ প্রসঙ্গে জেলা সমবায় কর্মকর্তা মশিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি সমবায় অধিদফতরের নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান। তাদের আর্থিক হিসাব আমাদের কাছে আছে। তাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটির বাইরে যদি কর্মকর্তারা আর্থিক লেনদেন করে থাকেন সেটির হিসাব আমাদের কাছে নেই।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রাহকদের বিপুল অংকের টাকা আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত এহসান সোসাইটি লি., এহসান রিয়েল এস্টেট কোং লি. ও এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি. নামের এই তিনটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মাওলানা আইয়ুব হোসেন, মুফতি ইউনুস আহমেদ, মাওলানা জুনায়েত আলী, মাওলানা আতাউল্লাহ, মাওলানা মিজানুর রহমান, মাওলানা মো. হালিম, মাওলানা শামছুজ্জামান টিটু ও মনিরুল ইসলাম। গত কয়েক মাস ধরে এদের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না, তারা আত্মগোপন করেছেন। গ্রাহকদের ২ হাজার কোটি টাকা সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মুফতি ইউনুস আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক মাওলানা জুনায়েত আলী ও নির্বাহী সদস্য মাওলানা আতাউল্লাহসহ যশোর শাখার চিফ জোনাল ম্যানেজার খবিরুজ্জামান ভাগাভাগি শেষে আত্মসাৎ করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এহসান সোসাইটির সর্বসাকুল্যে ৫১ কোটির টাকার সম্পদ আছে। এই সম্পদ বিক্রি করেও গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করা সম্ভব নয়। যশোর জেলা সমবায় অফিস সূত্র জানায়, এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড সমবায় অধিদফতরের একটি নিবন্ধিত সমিতি। ২০১৩ সালের অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির ২৯ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে জমি প্রকল্পে ২১ কোটি ২৩ লাখ, ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান ৩১ লাখ টাকা, ধার পাওনা ১ কোটি ৯১ লাখ টাকা। গ্রাহকদের বিনিয়োগকৃত টাকা ২৬ কোটি ৯৩ লাখ ও শেয়ার মূলধন বাবদ ৬৯ লাখ টাকা এবং বাকি টাকা অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই কোম্পানির গ্রাহকের সংখ্যা ১ হাজার ৮৪ জন। এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড একমাত্র প্রতিষ্ঠান যা সমবায় অধিদফতরে নিবন্ধিত। বাকি দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধু এহসান এস জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে নিবন্ধন নেয়া। অপর প্রতিষ্ঠানটির কোনো নিবন্ধন নেই বলে জানা গেছে। সমবায় অধিদফতর শুধু তাদের কাছে নিবন্ধিত সংস্থার দায়িত্ব নেবে, অন্য দুটির নয়। কাজেই ওই দুই প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের টাকা ফেরত পাওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০০১ সালে স্থানীয় এলাকার বাসিন্দা কৃষি ব্যাংকের সাবেক এজিএম কাজী রবিউল ইসলাম এহসান এস সংস্থা নামের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এটি রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ও ফার্মগুলো থেকে নিবন্ধন নেয়া হয়েছে। নিবন্ধন নম্বর হচ্ছে এস-৩২১১ (জে-৭৬) ২০০৩। এই প্রতিষ্ঠানের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলেন এহসান রিয়েল এস্টেট কোম্পানি, ইসলামিক শরিয়া ভিত্তিক এহসান ইসলামী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি।
জানা গেছে, মাওলানা জুনায়েত আলী ও মাওলানা রবিউল ইসলামিক শরিয়া ভিত্তিক এহসান ইসলামী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি পরিচালনা করেন। তারা প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোরআন ও হাদিসের নানা আয়াত তুলে প্রচার চালান। এভাবে কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা দিয়ে তারা টার্গেট গ্র“পকে আয়ত্তে নিয়ে আসেন। তাদের প্রচারণায় বলা হয় দেশের প্রচলিত ব্যাংক ও বীমা সুদের ব্যবসা করে। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে অর্থলগ্নি করে মুনাফা ভোগ করা সুদ খাওয়ার মতোই হারাম। শরিয়া মোতাবেক জীবনযাপন করতে তাদের প্রতিষ্ঠানে অর্থ বিনিয়োগের বিকল্প নেই। এভাবে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এক বছর মেয়াদি প্রতি লাখের জন্য এক মাসে ১৪শ’ টাকা, ২ বছর মেয়াদে প্রতি লাখে মাসে ১৫শ’ টাকা এবং তিন বছর মেয়াদে আমানতকারীকে প্রতি মাসে এক লাখ টাকায় ১৬শ’ টাকা দেয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়ে সঞ্চয় সংগ্রহ করে। গ্রাহকের এই অর্থ দিয়ে ১৫ শতাংশ নগদ ঋণ সহায়তার মাধ্যমে জমি ক্রয়-বিক্রয়সহ লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা হয়।
এহসান সোসাইটির মাধ্যমে ৮ থেকে ১০ বছর মেয়াদি ডিপিএস প্রকল্পের নামে টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতি মাসে একজন গ্রাহকের কাছ থেকে ১ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত কিস্তি সংগ্রহ করা হয়। আবার এই কিস্তির অর্থ দিয়ে গ্রাহকদের কাছে ১৫ শতাংশ সুদে পুনরায় ঋণ দেয়া হয়। এভাবে ১০ হাজার গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। এ ব্যাপারে এহসান সোসাইটি (যশোর জেলা) প্রধান সমন্বয়কারী মাওলানা মো. আয়ুব আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার ব্যবহারের মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
এই কোম্পানির তৃতীয় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি। গ্রাহকদের বইয়ে কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা দেয়া হয়েছে ঢাকার উত্তরার ৯-সেক্টর, বাড়ি ৩৯, রোড-৭/ডি। এই কোম্পানির মাধ্যমে গ্রাহকরা শুধু প্লট, ফ্ল্যাট ও পরিবহন খাতে বিনিয়োগ করেছে। এক বছর মেয়াদি প্রতি লাখের জন্য এক মাসে ১৪শ’ টাকা, ২ বছর মেয়াদে ১৫শ’ টাকা এবং তিন বছর মেয়াদে আমানতকারীকে ১৬শ’ টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সঞ্চয় সংগ্রহ করে। এর গ্রাহক সংখ্যা এ পর্যন্ত ৯শ’ দাঁড়িয়েছে। কোম্পানি গ্রাহকদের বইয়ে তিনটি মোবাইল ফোনের মধ্যে একটি খোলা পাওয়া গেছে। এই ০১৭১১১৪ক্স৭ মোবাইল নম্বরধারী ফোনে নাম প্রকাশ না করে প্রতিষ্ঠানের শাখা নিয়ন্ত্রক ছিলেন বলে নিজেকে দাবি করেন। তিনি জানান, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঝামেলা হওয়ায় দুই বছর আগে রিয়েল এস্টেট ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি একজন শেয়ার সদস্য ছিলেন। বর্তমানে এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন। তিনি আরও বলেন, যশোরে এহসান রিয়েল এস্টেটের ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার সম্পদ আছে। হাজার কোটি টাকার হিসাব সঠিক নয়।
যশোরের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের প্রতিনিধি মফিজুল ইসলাম ইমন বলেন, তার লগ্নিকৃত টাকার পরিমাণ এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে ৫ লাখ টাকা, এহসান রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে ১১ লাখ ৩০ হাজার টাকাসহ মোট ১৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা। তিনি অভিযোগ করে বলেন প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকর্তারা অফিস ও মোবাইল ফোন বন্ধ রেখে গা ঢাকা দিয়েছে। তিনি ঢাকায় গিয়ে কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে তারা ইমনকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
যশোর ব্যুরো : এহসান সোসাইটির প্রতারণায় ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হওয়ার পথে কয়েক হাজার গ্রাহক। তাদের লগ্নি করা টাকা ফেরত দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। গ্রাহকদের দাবি প্রতিষ্ঠানগুলো এ অঞ্চলের অন্তত দশ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে দুই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে গা ঢাকা দিয়েছে। তারা অফিস খুলছে না। আত্মগোপনে থেকে গ্রাহকদের নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। অপরদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এহসান সোসাইটির একাধিক প্রতিষ্ঠানের সর্বসাকুল্যে একান্ন কোটির টাকার সম্পদ আছে। বাকি টাকা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা আত্মসাৎ করেছে। টাকা ফেরতের দাবিতে বুধবার যশোর প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করেছে প্রতারণার শিকার গ্রাহকরা।
খোলাডাঙ্গা এলাকার কোহিনুর বেগম জানান, এলাকার মসজিদের ইমাম আজাহারুলের মাধ্যমে দুই লাখ টাকা দিয়েছি। এখন আর ফেরত দিচ্ছে না। আশ্রম রোডের সেলিনা পারভীন বলেন, আতাউল্লাহসহ কর্মকর্তারা তাবলীগ চিল্লায় গিয়ে মানুষকে নানা কথা বলে টাকা নিয়েছে। এখন আর ফেরত দিচ্ছে না। তিনিও দশ লাখ ত্রিশ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছেন বলে জানান। বারান্দীপাড়ার বাসিন্দা কুলসুম বেগম বলেন, এক লাখ টাকায় মাসে ১৬শ’ টাকা মুনাফা দেয়ার কথা। প্রথম ক’মাস দেয়ার পর কোম্পানির লোকজন টাকা দেয় না। চাইতে গেলে নানা টালবাহানা করে। জমি বিক্রি করে টাকা দিয়ে এখন পথে বসেছি। তারা গ্রাহকের টাকায় ৭০-৮০ হাজার টাকা দরে প্রতি কাঠা জমি ক্রয় করেন। এখন সেই গ্রাহককে তিন থেকে চার লাখ টাকা দরে জমি দেবে বলে জানায়। এতে আপত্তি করলে অফিস থেকে জানানো হয় বেশি বাড়াবাড়ি করলে টাকা জমি কোনোটাই দেয়া হবে না।
No comments