শিশুমৃত্যু কমাতে সঠিক সময়ে চিকিৎসা জরুরি by ডা. সাদিয়া শবনম ও জায়েদ বিন ইসলাম
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৪ অনুযায়ী পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুমৃত্যু হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে উপনীত হয়েছে। বিশ্বের যে ছয়টি মাত্র দেশ ১৯৯০ সালের তুলনায় বর্তমান শিশুমৃত্যুর হার দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। তবে এখনও পাঁচ বছরের কমবয়সী অনেক শিশু প্রতিরোধযোগ্য ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার কারণে মারা যায়।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিশুমৃত্যু ও অসুস্থতার একটি প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। ইউনিসেফের সাম্প্রতিক নিরীক্ষা অনুযায়ী এখনও বিশ্বব্যাপী শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। যেমন শুধু ২০১২ সালে শিশুমৃত্যুর শতকরা ১৭ ভাগ বা ১১ লাখ মৃত্যুর জন্য নিউমোনিয়াই দায়ী। এসব মৃত্যুর শিকার শিশুদের ৮০ শতাংশের বয়সই দুই বছরের নিচে। নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যুর বেশিরভাগই ঘটে উন্নয়নশীল দেশে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, শতকরা ৭৫ ভাগই ঘটে মাত্র ১৫টি দেশে। বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের মৃত্যুর শতকরা ২৫ ভাগই নিউমোনিয়ার কারণে হয়ে থাকে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিউমোনিয়া প্রতিরোধ ও প্রতিকারযোগ্য। টিকা প্রদান, পুষ্টিকর খাবার এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সাহায্য করে এবং নিউমোনিয়া প্রতিকারে রয়েছে সাশ্রয়ী অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে সঠিক সময়ে চিকিৎসাসেবার আওতায় আনা যায় না। দরিদ্র দেশগুলোয় এ সমস্যাটা আরও বেশি। যেমন নিউমোনিয়া চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্র্ণ নিউমোনিয়া ভ্যাকসিন অনেক সময়ই পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১১-এর তথ্য অনুযায়ী, যেসব শিশুর মধ্যে নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা যায় তার মাত্র ৩৫ শতাংশ মানসম্মত চিকিৎসা কেন্দ্র বা দক্ষ চিকিৎসকের চিকিৎসা পেয়েছে, ৪৬ শতাংশ শিশু অদক্ষ চিকিৎসকের কাছে সেবা নিয়েছে এবং ১৭ শতাংশ শিশু কোনো চিকিৎসাই পায় না। এছাড়া যেসব অভ্যাস নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সাহায্য করে যেমন ছয় মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ পান, ছয় মাস পূরণ হওয়ার পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি বয়স অনুসারে পারিবারিক বাড়তি খাবার খাওয়ানো, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, বায়ুদূষণ কমানো ইত্যাদি দরিদ্র বা উন্নয়নশীল দেশে তেমনভাবে প্রচলিত নয়। ফলে এসব দেশে শিশুমৃত্যুর হার আরও বেশি।
রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নিরাপদ, কার্যকর ও সাশ্রয়ী ব্যবস্থা থাকলেও তা সঠিক সময়ে মানুষের কাছে পৌঁছায় না। নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ দেখা দেয়ার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা প্রদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা বিদ্যমান প্রথাগত চিকিৎসা ব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। তাই রোগাক্রান্ত পরিবারের মধ্যে ফলপ্রসূ চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেয়া আসলেই একটি চ্যালেঞ্জ, যেখানে কমিউনিটিভিত্তিক মডেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের নিউমোনিয়া ঘটিত মৃত্যুহার কমাতে নব্বইয়ের দশক থেকে কাজ করে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে ব্র্যাক বিদ্যমান চিকিৎসা ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে নিউমোনিয়ার চিকিৎসা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তারা কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কার বা স্বাস্থ্যসেবিকাদের এ কাজে অন্তর্ভুক্ত করে প্রশিক্ষণ প্রদান করছে, যার ফলে আরও বেশিসংখ্যক শিশুকে নিউমোনিয়া চিকিৎসাসেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
ব্র্যাক ১৯৯২ সালে নিউমোনিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি শুরু করে এবং ধীরে ধীরে সারা দেশে এর কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেছে। বর্তমানে তাদের ৯৭ হাজার স্বাস্থ্যসেবিকা শহর ও গ্রামাঞ্চলে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিবিধ সেবা দিচ্ছে। এরা নিউমোনিয়া শনাক্তকরণ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রদত্ত গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসাসেবা প্রদানে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। নিজেরা চিকিৎসা প্রদান ছাড়াও তারা মারাত্মক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে শনাক্ত করে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে রেফার করে থাকে।
প্রতিবছর ব্র্যাকের স্বাস্থ্যসেবিকারা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ নিউমোনিয়া রোগী শনাক্ত করে চিকিৎসা প্রদান করে, পাশাপাশি আরও প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার মারাত্মক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে রেফার করে থাকে। এভাবেই তারা বাংলাদেশে শিশুমৃত্যু এবং শিশু রোগের হার কমাতে সরকারের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
ব্র্যাক স্বাস্থ্যসেবিকা মডেল এটাই প্রমাণ করে যে, কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কারদের অন্তর্ভুক্তি ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে নিউমোনিয়া রোগ প্রতিরোধ ও মৃত্যুহার কমানো সম্ভব। তবে এ কাজে সাফল্য অর্জনের জন্য যথাযথ মনিটরিং, তত্ত্বাবধান এবং লজিস্টিক সাপোর্ট অপরিহার্য।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সাফল্য ধরে রাখতে হলে আমাদের অবশ্যই শিশুমৃত্যুর হার আরও কমাতে হবে। এ লক্ষ্যে আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যু প্রতিরোধে কাজ করে যাব- বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস ২০১৪ উপলক্ষে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
ডা. সাদিয়া শবনম ও জায়েদ বিন ইসলাম : সদস্য, ব্র্যাক স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচি
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিশুমৃত্যু ও অসুস্থতার একটি প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। ইউনিসেফের সাম্প্রতিক নিরীক্ষা অনুযায়ী এখনও বিশ্বব্যাপী শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। যেমন শুধু ২০১২ সালে শিশুমৃত্যুর শতকরা ১৭ ভাগ বা ১১ লাখ মৃত্যুর জন্য নিউমোনিয়াই দায়ী। এসব মৃত্যুর শিকার শিশুদের ৮০ শতাংশের বয়সই দুই বছরের নিচে। নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যুর বেশিরভাগই ঘটে উন্নয়নশীল দেশে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, শতকরা ৭৫ ভাগই ঘটে মাত্র ১৫টি দেশে। বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের মৃত্যুর শতকরা ২৫ ভাগই নিউমোনিয়ার কারণে হয়ে থাকে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিউমোনিয়া প্রতিরোধ ও প্রতিকারযোগ্য। টিকা প্রদান, পুষ্টিকর খাবার এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সাহায্য করে এবং নিউমোনিয়া প্রতিকারে রয়েছে সাশ্রয়ী অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে সঠিক সময়ে চিকিৎসাসেবার আওতায় আনা যায় না। দরিদ্র দেশগুলোয় এ সমস্যাটা আরও বেশি। যেমন নিউমোনিয়া চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্র্ণ নিউমোনিয়া ভ্যাকসিন অনেক সময়ই পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১১-এর তথ্য অনুযায়ী, যেসব শিশুর মধ্যে নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা যায় তার মাত্র ৩৫ শতাংশ মানসম্মত চিকিৎসা কেন্দ্র বা দক্ষ চিকিৎসকের চিকিৎসা পেয়েছে, ৪৬ শতাংশ শিশু অদক্ষ চিকিৎসকের কাছে সেবা নিয়েছে এবং ১৭ শতাংশ শিশু কোনো চিকিৎসাই পায় না। এছাড়া যেসব অভ্যাস নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সাহায্য করে যেমন ছয় মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ পান, ছয় মাস পূরণ হওয়ার পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি বয়স অনুসারে পারিবারিক বাড়তি খাবার খাওয়ানো, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, বায়ুদূষণ কমানো ইত্যাদি দরিদ্র বা উন্নয়নশীল দেশে তেমনভাবে প্রচলিত নয়। ফলে এসব দেশে শিশুমৃত্যুর হার আরও বেশি।
রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নিরাপদ, কার্যকর ও সাশ্রয়ী ব্যবস্থা থাকলেও তা সঠিক সময়ে মানুষের কাছে পৌঁছায় না। নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ দেখা দেয়ার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা প্রদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা বিদ্যমান প্রথাগত চিকিৎসা ব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। তাই রোগাক্রান্ত পরিবারের মধ্যে ফলপ্রসূ চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেয়া আসলেই একটি চ্যালেঞ্জ, যেখানে কমিউনিটিভিত্তিক মডেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের নিউমোনিয়া ঘটিত মৃত্যুহার কমাতে নব্বইয়ের দশক থেকে কাজ করে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে ব্র্যাক বিদ্যমান চিকিৎসা ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে নিউমোনিয়ার চিকিৎসা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তারা কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কার বা স্বাস্থ্যসেবিকাদের এ কাজে অন্তর্ভুক্ত করে প্রশিক্ষণ প্রদান করছে, যার ফলে আরও বেশিসংখ্যক শিশুকে নিউমোনিয়া চিকিৎসাসেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
ব্র্যাক ১৯৯২ সালে নিউমোনিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি শুরু করে এবং ধীরে ধীরে সারা দেশে এর কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেছে। বর্তমানে তাদের ৯৭ হাজার স্বাস্থ্যসেবিকা শহর ও গ্রামাঞ্চলে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিবিধ সেবা দিচ্ছে। এরা নিউমোনিয়া শনাক্তকরণ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রদত্ত গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসাসেবা প্রদানে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। নিজেরা চিকিৎসা প্রদান ছাড়াও তারা মারাত্মক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে শনাক্ত করে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে রেফার করে থাকে।
প্রতিবছর ব্র্যাকের স্বাস্থ্যসেবিকারা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ নিউমোনিয়া রোগী শনাক্ত করে চিকিৎসা প্রদান করে, পাশাপাশি আরও প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার মারাত্মক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে রেফার করে থাকে। এভাবেই তারা বাংলাদেশে শিশুমৃত্যু এবং শিশু রোগের হার কমাতে সরকারের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
ব্র্যাক স্বাস্থ্যসেবিকা মডেল এটাই প্রমাণ করে যে, কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কারদের অন্তর্ভুক্তি ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে নিউমোনিয়া রোগ প্রতিরোধ ও মৃত্যুহার কমানো সম্ভব। তবে এ কাজে সাফল্য অর্জনের জন্য যথাযথ মনিটরিং, তত্ত্বাবধান এবং লজিস্টিক সাপোর্ট অপরিহার্য।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সাফল্য ধরে রাখতে হলে আমাদের অবশ্যই শিশুমৃত্যুর হার আরও কমাতে হবে। এ লক্ষ্যে আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যু প্রতিরোধে কাজ করে যাব- বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস ২০১৪ উপলক্ষে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
ডা. সাদিয়া শবনম ও জায়েদ বিন ইসলাম : সদস্য, ব্র্যাক স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচি
No comments