সবাই মুক্তিযোদ্ধা হতে চায়! by মামুন রশীদ
কবি সত্তা নেই যাদের তাদের কবিতা লেখার সাধ দেখে এক বিখ্যাত কবি খেদোক্তি করে লিখেছিলেন, সবাই কবি হতে চায়। আমি নিশ্চিত সেই কবি যদি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতেন, অস্ত্র হাতে লড়াই করতেন, তাহলে ক্রমবর্ধমান মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট জালিয়াতি কিংবা সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা দেখে দুঃখভরা হৃদয়ে লিখতেন, সবাই মুক্তিযোদ্ধা হতে চায়!
প্রায় ৭-৮ বছর আগে ঢাকার বাইরে এক বিচারপতির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করার একটি উদ্যোগ দেখলাম। পরে জেনেছিলাম সেই বিচারপতি যদিও অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, সৎ ও উদ্যোগী বিচারক ছিলেন; কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহণ না থাকায় মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট পাওয়া কিংবা রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার মতো যোগ্য ছিলেন না তিনি। বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের সুবিখ্যাত কবিতা রয়েছে- তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা কিংবা রাজাকার মন্ত্রীর শকটে উড়ছে আমার প্রাণের পতাকা। এসব কবিতার রচয়িতা হওয়া সত্ত্বেও শামসুর রাহমানকে আমরা তার মৃত্যুর পর যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে কারণ দেখানো হয়েছিল, তিনি যা করলে একজন মুক্তিযোদ্ধার সনদ পেতে পারেন এবং একজন সনদপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ভূষিত হতে পারেন, তেমন কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন না। আমরা দুঃখ সত্ত্বেও মেনে নিয়েছিলাম, কারণ এই দেশ সৃষ্টির পেছনে যারা অস্ত্র হাতে লড়াই করেছেন; যারা প্রবাসী সরকার গঠনে, স্বাধীন বাংলা সরকার গঠনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন, যারা ভারতকে সঙ্গে নিয়ে, বিশ্বের অপরাপর অনেক শক্তিশালী দেশকে সঙ্গে নিয়ে, গণতন্ত্রকামী সরকার, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশটি সৃষ্টি করেছিলেন, তারা যে সম্মান পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন, অন্যরা সেই সম্মান পেতে পারেন না। ভাষা মতিন খ্যাত আবদুল মতিন যখন মৃত্যুবরণ করলেন তখন যে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া গেল না, আমরা দুঃখ পেয়েছি; আমরা মনে করেছিলাম তিনিও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত হতে পারতেন। তারপরও আমরা মেনে নিতে পেরেছি, কারণ সেই যে বললাম, যারা অস্ত্র হাতে লড়াই করেছেন, জীবন বাজি রেখে এই বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য কাজ করেছেন, তারা তো একটু ভিন্নধর্মী হবেনই। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, স্বাধীন বাংলাদেশ থাকবে, তাদের এই সম্মানটুকু আমাদের দিতেই হবে এবং আমি নিশ্চিত, যারাই সরকারে থাকুন না কেন, ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ অর্থাৎ বিভিন্ন জাতীয় দিবসে এই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু তাদের দেখানো হবে।
বছর দুয়েক আগে আমি গিয়েছিলাম আমার ভগ্নিপতির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার অন্তিম ইচ্ছা অনুসারে তাকে তার পিতৃভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার একটি গ্রামে সমাহিত করা হয়েছিল। সেখানে দেখেছি তাকে তিন ধরনের সম্মান দেয়া হয়েছিল। প্রথমত, তিনি যে স্কুলে পড়তেন সেই স্কুলের শিক্ষক ও সহপাঠীরা সম্মান দেখিয়েছিলেন; আরেকটি সম্মান দেখানো হয়েছিল রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাকে গার্ড অব অনার দিয়ে, তার শবদেহকে জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল। আর তৃতীয় সম্মানটি ছিল এমন : যারা তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের অনেকে সেখানে উপস্থিত থেকে তাদের কমান্ডারকে বিদায় জানিয়েছিলেন। তখন আমার একটা বিষয় অত্যন্ত ভালো লেগেছিল যে, তার একটা বিশেষ পরিচয় রয়েছে- সেটি হচ্ছে তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাই যেমন আমি মেনে নিয়েছি, ভাষা মতিন এবং বাংলাদেশের প্রধান কবির এত অবদান থাকার পরও তারা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেলেন না; যেমন আমি অনেক দিনের বন্ধুত্বকে ঝুঁকিতে ফেলে সেই বিচারপতির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়াটাকে অযৌক্তিক ও বেমানান মনে করে তার সুযোগ্য সন্তানকে নাস্তানাবুদ করেছিলাম- সেই একই প্রেক্ষাপটে এখন যখন দেখি অনেকেই শুধু সরকারের উচ্চপদে থাকার কারণে, কোনো যুদ্ধ না করে, অস্ত্র হাতে না নিয়ে, প্রবাসী সরকার গঠনে কোনোরকম অবদান না রেখে, আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আদায়ে বিন্দু পরিমাণ উদ্যোগ না নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার খেতাবপ্রাপ্ত, তখন ওই কবির মতো দ্রোহে, ক্ষোভে আমারও লিখতে ইচ্ছে করে, সবাই মুক্তিযোদ্ধা হতে চায়।
আমরা এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমি নিশ্চিত বিশ্বাস করি, যদি বাংলাদেশ নামক দেশটি না হতো তাহলে আমার মতো পূর্ব পাকিস্তানের অত্যন্ত সাধারণ পরিবারে জন্ম নেয়া একটি শিশু কখনও একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হতে পারত না। আজকে আমরা যখন চারপাশে তাকাই, দেখতে পাই অনেক বাংলাদেশী ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অনেক উচ্চপদে পৌঁছেছেন এবং আগামী দিনগুলোয় অনেক বাংলাদেশী এসব পদে যাবেন। এমনকি ভারতীয়দের মতো বাংলাদেশীরাও মাইক্রোসফট, অ্যাপেল কিংবা কোকাকোলা, পেপসি কিংবা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বা সিটি গ্রুপ কিংবা যে কোনো প্রযুক্তি কোম্পানি কিংবা যে কোনো আর্থিক বা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা যে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রধান পদে আসীন হবেন। সে ক্ষেত্রে তার প্রধান পরিচয় কী? তার প্রধান পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন বাংলাদেশী। তিনি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত একজন প্রধান নির্বাহী। এটি কখনোই হতো না যদি একাত্তর সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ না হতো। এত বাংলাদেশী পূর্ব পাকিস্তানের কোটায় পিএইচডি করতে যেতে পারত না, এত বাংলাদেশী কখনও বড় বড় পদে আসীন হতে পারত না, এত বাংলাদেশী মন্ত্রী হতে পারত না, এত বাংলাদেশী সচিব হতে পারত না, এত বাংলাদেশী জেনারেল হতে পারত না সামরিক বাহিনীতে, কারণ আমরা জানি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সর্বোচ্চ পদে আসীন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন একজন কর্নেল পর্যায়ের লোক। সুতরাং ব্রিগেডিয়ার, মেজর জেনারেল, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমাদের হওয়া ছিল স্বপ্নেরও অতীত। মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার ফলে কৃষকের, আধা বেলা খাওয়া শ্রমিকের, গ্রামের মানুষটির কী উপকার হয়েছে আমি জানি না; তবে অনেক বেশি লোক ভিসা নিয়ে বিদেশে পড়তে যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে যাচ্ছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে এক্সপোর্ট করছে, অনেক বেশি লোক উদ্যোক্তা হচ্ছে। সুতরাং আমি মনে করি, অবশ্যই কৃষক-শ্রমিকদের ভাগ্য পরিবর্তনে আমাদের সহায়তা করা প্রয়োজন। তবে স্বাধীনতার সবচেয়ে উপকারভোগী শ্রেণী হচ্ছে আমি, আপনারা, আমার আশপাশের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন। কিন্তু আমায় পীড়া দেয়, যখন দেখি দেশপ্রেমের প্রশ্নে তাদের দায়বদ্ধতা অনেক অনেক কম। এটা ভেবে একদিকে কিছুটা ভালো লাগছে যে, স্বাধীনতার এত বছর পরও উচ্চপদের সরকারি কর্মকর্তারা যে কোনোভাবে জাল সার্টিফিকেট নিয়েও মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার চেষ্টা করছেন। আবার এটা ভেবে দুঃখও পাই, পীড়িত হই, না জানি আরও কত জাল সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন।
মনে আছে, ১৯৮০ সালে কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। ট্রেনে আমাদের সঙ্গে একজন ভদ্রলোকের দেখা হল, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পা হারিয়েছেন। আমাদের তখন যে তারুণ্যের আবেগ, সেই আবেগের বশবর্তী হয়ে তাকে অনেক দেখভাল করেছিলাম, আমরা আমাদের বাসায় তাকে নিয়ে খাইয়েছিলাম। পরবর্তীকালে আবিষ্কার হল, মুক্তিযুদ্ধে সেই লোকটির ভূমিকা ছিল একজন রাজাকারের। তিনি রাজাকার হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পা হারিয়েছেন। তখন এক বন্ধু আরেক বন্ধুর গালে চপেটাঘাত করে কিছুটা হলেও নিজেদের দায়মুক্তির চেষ্টা করেছিলাম। আজকে যখন আমার সিনিয়র ভাই সরকারি কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট জালিয়াতি করেছেন, আর কিছু ভাইয়ের বিচার হচ্ছে, তখন এই চপেটাঘাত কাকে করব? এই চপেটাঘাত কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকে করব? এই চপেটাঘাত কি তাদের সহকর্মী যারা, তাদের করব? এই চপেটাঘাত কি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের গালে করব? এই চপেটাঘাত কি আইনশৃংখলা বাহিনীর গালে করব? নাকি এই চপেটাঘাত সজোরে আমার নিজের গালেই করব?
একটা ভালো দিক হল, মানুষ মনে করছে সচিব হওয়ার পরও কী জানি নেই। মানুষ মনে করছে একজন সম্মানিত বিচারপতি হওয়ার পরও তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তার সন্তানের কাছে যেন কী পাননি। সেটা কী? একজন মুক্তিযোদ্ধার সম্মান। তখন একদিকে ভালো লাগে যে, একজন বাংলাদেশীর জন্য সর্বোচ্চ সম্মান হচ্ছে একাত্তরে লড়াই করে বাংলাদেশ সৃষ্টির সম্মান। এ কারণেই বাংলাদেশ টিকে থাকবে, এ কারণেই বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে।
আমার ভালো লাগছে, এত বছর পরও যারা বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতা করেছে, যারা নিরপরাধ লোকদের নির্বিচারে হত্যা করেছে, যারা মানবতাবিরোধী কাজ করেছে, মা-বোন-শিশুকে যারা অকাতরে হত্যা করেছে, আজ তাদের বিচার হচ্ছে। হোক মৃত্যুদণ্ড, হোক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, হোক মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাভোগের আগেই মৃত্যু। অন্তত আমরা জেনে যাচ্ছি, এ লোকটি মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করার জন্য অভিযুক্ত। আমার আরও ভালো লাগছে, বাংলাদেশের একটি প্রধান দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল অনেক বছর পর জামায়াতে ইসলামী দলের আহূত হরতালকে সমর্থন করছে না। তারা কিন্তু গোলাম আযমের মৃত্যুতে কোনো শোক প্রস্তাব নেননি, তারা এমনকি একসময় তাদের দলে থাকা আবদুল আলিমের মৃত্যুতেও কোনো শোক প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। অনেক দিন পর হলেও আস্তে আস্তে আমরা মনে করতে পারছি, বাংলাদেশে যারাই সরকার গঠন করুন না কেন, তাদের একটি বিষয় মীমাংসা করে আসতে হবে, সেটি হচ্ছে তাদের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হতে হবে, তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি হতে হবে। আমি মনে করি, এই দলটি যাতে ডানপন্থী থেকে কট্টর ডানপন্থী না হতে পারে, তারা যাতে তাদের রাজনৈতিক দলের মধ্যে উদার গণতন্ত্রের চর্চা করতে পারে, সেই দায়িত্বটি আপনার, আমার, আমাদের সবার ওপরেই বর্তায়। আমি মনে করি, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে তাদের মৃত্যুর আগে অন্তত তারা যে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত, এটা চিহ্নিত করা উচিত।
আমি মনে করি, অচিরেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে বৃহত্তর থেকে বৃহত্তম ঐক্য গড়ে উঠবে, শক্তি গড়ে উঠবে। সেখানে সবচেয়ে বেশি রসদ জোগাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী তরুণ প্রজন্ম, যাদের কাছে শিক্ষা রয়েছে, যাদের কাছে প্রযুক্তি রয়েছে। হয়তো তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি; কিন্তু রাজনৈতিক কারণে, অর্থনৈতিক কারণে, সামাজিক কারণে, তাদের নিজস্ব অগ্রগতির কারণে, আন্তর্জাতিক সমাজে তাদের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করার কারণে তারা আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাছে ফিরে যাবে। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় রইলাম, যেদিন আর কখনও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী কোনো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে সরকার পরিচালনা করবে না এবং সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের দলগুলো জাতীয়তাবাদী শক্তিতেও রূপান্তরিত হবে। আমরা সেই দিনের অপেক্ষা করছি যেদিন কোনো মুক্তিযোদ্ধা কবিকে, মুক্তিযোদ্ধা লেখককে ক্ষোভে-দুঃখে লিখতে হবে না, সব শালা মুক্তিযোদ্ধা হতে চায়।
মামুন রশীদ : ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
প্রায় ৭-৮ বছর আগে ঢাকার বাইরে এক বিচারপতির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করার একটি উদ্যোগ দেখলাম। পরে জেনেছিলাম সেই বিচারপতি যদিও অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, সৎ ও উদ্যোগী বিচারক ছিলেন; কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহণ না থাকায় মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট পাওয়া কিংবা রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার মতো যোগ্য ছিলেন না তিনি। বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের সুবিখ্যাত কবিতা রয়েছে- তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা কিংবা রাজাকার মন্ত্রীর শকটে উড়ছে আমার প্রাণের পতাকা। এসব কবিতার রচয়িতা হওয়া সত্ত্বেও শামসুর রাহমানকে আমরা তার মৃত্যুর পর যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে কারণ দেখানো হয়েছিল, তিনি যা করলে একজন মুক্তিযোদ্ধার সনদ পেতে পারেন এবং একজন সনদপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ভূষিত হতে পারেন, তেমন কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন না। আমরা দুঃখ সত্ত্বেও মেনে নিয়েছিলাম, কারণ এই দেশ সৃষ্টির পেছনে যারা অস্ত্র হাতে লড়াই করেছেন; যারা প্রবাসী সরকার গঠনে, স্বাধীন বাংলা সরকার গঠনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন, যারা ভারতকে সঙ্গে নিয়ে, বিশ্বের অপরাপর অনেক শক্তিশালী দেশকে সঙ্গে নিয়ে, গণতন্ত্রকামী সরকার, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশটি সৃষ্টি করেছিলেন, তারা যে সম্মান পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন, অন্যরা সেই সম্মান পেতে পারেন না। ভাষা মতিন খ্যাত আবদুল মতিন যখন মৃত্যুবরণ করলেন তখন যে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া গেল না, আমরা দুঃখ পেয়েছি; আমরা মনে করেছিলাম তিনিও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত হতে পারতেন। তারপরও আমরা মেনে নিতে পেরেছি, কারণ সেই যে বললাম, যারা অস্ত্র হাতে লড়াই করেছেন, জীবন বাজি রেখে এই বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য কাজ করেছেন, তারা তো একটু ভিন্নধর্মী হবেনই। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, স্বাধীন বাংলাদেশ থাকবে, তাদের এই সম্মানটুকু আমাদের দিতেই হবে এবং আমি নিশ্চিত, যারাই সরকারে থাকুন না কেন, ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ অর্থাৎ বিভিন্ন জাতীয় দিবসে এই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু তাদের দেখানো হবে।
বছর দুয়েক আগে আমি গিয়েছিলাম আমার ভগ্নিপতির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার অন্তিম ইচ্ছা অনুসারে তাকে তার পিতৃভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার একটি গ্রামে সমাহিত করা হয়েছিল। সেখানে দেখেছি তাকে তিন ধরনের সম্মান দেয়া হয়েছিল। প্রথমত, তিনি যে স্কুলে পড়তেন সেই স্কুলের শিক্ষক ও সহপাঠীরা সম্মান দেখিয়েছিলেন; আরেকটি সম্মান দেখানো হয়েছিল রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাকে গার্ড অব অনার দিয়ে, তার শবদেহকে জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল। আর তৃতীয় সম্মানটি ছিল এমন : যারা তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের অনেকে সেখানে উপস্থিত থেকে তাদের কমান্ডারকে বিদায় জানিয়েছিলেন। তখন আমার একটা বিষয় অত্যন্ত ভালো লেগেছিল যে, তার একটা বিশেষ পরিচয় রয়েছে- সেটি হচ্ছে তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাই যেমন আমি মেনে নিয়েছি, ভাষা মতিন এবং বাংলাদেশের প্রধান কবির এত অবদান থাকার পরও তারা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেলেন না; যেমন আমি অনেক দিনের বন্ধুত্বকে ঝুঁকিতে ফেলে সেই বিচারপতির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়াটাকে অযৌক্তিক ও বেমানান মনে করে তার সুযোগ্য সন্তানকে নাস্তানাবুদ করেছিলাম- সেই একই প্রেক্ষাপটে এখন যখন দেখি অনেকেই শুধু সরকারের উচ্চপদে থাকার কারণে, কোনো যুদ্ধ না করে, অস্ত্র হাতে না নিয়ে, প্রবাসী সরকার গঠনে কোনোরকম অবদান না রেখে, আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আদায়ে বিন্দু পরিমাণ উদ্যোগ না নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার খেতাবপ্রাপ্ত, তখন ওই কবির মতো দ্রোহে, ক্ষোভে আমারও লিখতে ইচ্ছে করে, সবাই মুক্তিযোদ্ধা হতে চায়।
আমরা এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমি নিশ্চিত বিশ্বাস করি, যদি বাংলাদেশ নামক দেশটি না হতো তাহলে আমার মতো পূর্ব পাকিস্তানের অত্যন্ত সাধারণ পরিবারে জন্ম নেয়া একটি শিশু কখনও একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হতে পারত না। আজকে আমরা যখন চারপাশে তাকাই, দেখতে পাই অনেক বাংলাদেশী ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অনেক উচ্চপদে পৌঁছেছেন এবং আগামী দিনগুলোয় অনেক বাংলাদেশী এসব পদে যাবেন। এমনকি ভারতীয়দের মতো বাংলাদেশীরাও মাইক্রোসফট, অ্যাপেল কিংবা কোকাকোলা, পেপসি কিংবা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বা সিটি গ্রুপ কিংবা যে কোনো প্রযুক্তি কোম্পানি কিংবা যে কোনো আর্থিক বা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা যে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রধান পদে আসীন হবেন। সে ক্ষেত্রে তার প্রধান পরিচয় কী? তার প্রধান পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন বাংলাদেশী। তিনি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত একজন প্রধান নির্বাহী। এটি কখনোই হতো না যদি একাত্তর সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ না হতো। এত বাংলাদেশী পূর্ব পাকিস্তানের কোটায় পিএইচডি করতে যেতে পারত না, এত বাংলাদেশী কখনও বড় বড় পদে আসীন হতে পারত না, এত বাংলাদেশী মন্ত্রী হতে পারত না, এত বাংলাদেশী সচিব হতে পারত না, এত বাংলাদেশী জেনারেল হতে পারত না সামরিক বাহিনীতে, কারণ আমরা জানি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সর্বোচ্চ পদে আসীন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন একজন কর্নেল পর্যায়ের লোক। সুতরাং ব্রিগেডিয়ার, মেজর জেনারেল, লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমাদের হওয়া ছিল স্বপ্নেরও অতীত। মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার ফলে কৃষকের, আধা বেলা খাওয়া শ্রমিকের, গ্রামের মানুষটির কী উপকার হয়েছে আমি জানি না; তবে অনেক বেশি লোক ভিসা নিয়ে বিদেশে পড়তে যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে যাচ্ছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে এক্সপোর্ট করছে, অনেক বেশি লোক উদ্যোক্তা হচ্ছে। সুতরাং আমি মনে করি, অবশ্যই কৃষক-শ্রমিকদের ভাগ্য পরিবর্তনে আমাদের সহায়তা করা প্রয়োজন। তবে স্বাধীনতার সবচেয়ে উপকারভোগী শ্রেণী হচ্ছে আমি, আপনারা, আমার আশপাশের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন। কিন্তু আমায় পীড়া দেয়, যখন দেখি দেশপ্রেমের প্রশ্নে তাদের দায়বদ্ধতা অনেক অনেক কম। এটা ভেবে একদিকে কিছুটা ভালো লাগছে যে, স্বাধীনতার এত বছর পরও উচ্চপদের সরকারি কর্মকর্তারা যে কোনোভাবে জাল সার্টিফিকেট নিয়েও মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার চেষ্টা করছেন। আবার এটা ভেবে দুঃখও পাই, পীড়িত হই, না জানি আরও কত জাল সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন।
মনে আছে, ১৯৮০ সালে কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। ট্রেনে আমাদের সঙ্গে একজন ভদ্রলোকের দেখা হল, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পা হারিয়েছেন। আমাদের তখন যে তারুণ্যের আবেগ, সেই আবেগের বশবর্তী হয়ে তাকে অনেক দেখভাল করেছিলাম, আমরা আমাদের বাসায় তাকে নিয়ে খাইয়েছিলাম। পরবর্তীকালে আবিষ্কার হল, মুক্তিযুদ্ধে সেই লোকটির ভূমিকা ছিল একজন রাজাকারের। তিনি রাজাকার হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিহত করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পা হারিয়েছেন। তখন এক বন্ধু আরেক বন্ধুর গালে চপেটাঘাত করে কিছুটা হলেও নিজেদের দায়মুক্তির চেষ্টা করেছিলাম। আজকে যখন আমার সিনিয়র ভাই সরকারি কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট জালিয়াতি করেছেন, আর কিছু ভাইয়ের বিচার হচ্ছে, তখন এই চপেটাঘাত কাকে করব? এই চপেটাঘাত কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকে করব? এই চপেটাঘাত কি তাদের সহকর্মী যারা, তাদের করব? এই চপেটাঘাত কি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের গালে করব? এই চপেটাঘাত কি আইনশৃংখলা বাহিনীর গালে করব? নাকি এই চপেটাঘাত সজোরে আমার নিজের গালেই করব?
একটা ভালো দিক হল, মানুষ মনে করছে সচিব হওয়ার পরও কী জানি নেই। মানুষ মনে করছে একজন সম্মানিত বিচারপতি হওয়ার পরও তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তার সন্তানের কাছে যেন কী পাননি। সেটা কী? একজন মুক্তিযোদ্ধার সম্মান। তখন একদিকে ভালো লাগে যে, একজন বাংলাদেশীর জন্য সর্বোচ্চ সম্মান হচ্ছে একাত্তরে লড়াই করে বাংলাদেশ সৃষ্টির সম্মান। এ কারণেই বাংলাদেশ টিকে থাকবে, এ কারণেই বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে।
আমার ভালো লাগছে, এত বছর পরও যারা বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতা করেছে, যারা নিরপরাধ লোকদের নির্বিচারে হত্যা করেছে, যারা মানবতাবিরোধী কাজ করেছে, মা-বোন-শিশুকে যারা অকাতরে হত্যা করেছে, আজ তাদের বিচার হচ্ছে। হোক মৃত্যুদণ্ড, হোক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, হোক মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাভোগের আগেই মৃত্যু। অন্তত আমরা জেনে যাচ্ছি, এ লোকটি মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করার জন্য অভিযুক্ত। আমার আরও ভালো লাগছে, বাংলাদেশের একটি প্রধান দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল অনেক বছর পর জামায়াতে ইসলামী দলের আহূত হরতালকে সমর্থন করছে না। তারা কিন্তু গোলাম আযমের মৃত্যুতে কোনো শোক প্রস্তাব নেননি, তারা এমনকি একসময় তাদের দলে থাকা আবদুল আলিমের মৃত্যুতেও কোনো শোক প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। অনেক দিন পর হলেও আস্তে আস্তে আমরা মনে করতে পারছি, বাংলাদেশে যারাই সরকার গঠন করুন না কেন, তাদের একটি বিষয় মীমাংসা করে আসতে হবে, সেটি হচ্ছে তাদের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হতে হবে, তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি হতে হবে। আমি মনে করি, এই দলটি যাতে ডানপন্থী থেকে কট্টর ডানপন্থী না হতে পারে, তারা যাতে তাদের রাজনৈতিক দলের মধ্যে উদার গণতন্ত্রের চর্চা করতে পারে, সেই দায়িত্বটি আপনার, আমার, আমাদের সবার ওপরেই বর্তায়। আমি মনে করি, যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে তাদের মৃত্যুর আগে অন্তত তারা যে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত, এটা চিহ্নিত করা উচিত।
আমি মনে করি, অচিরেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে বৃহত্তর থেকে বৃহত্তম ঐক্য গড়ে উঠবে, শক্তি গড়ে উঠবে। সেখানে সবচেয়ে বেশি রসদ জোগাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী তরুণ প্রজন্ম, যাদের কাছে শিক্ষা রয়েছে, যাদের কাছে প্রযুক্তি রয়েছে। হয়তো তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি; কিন্তু রাজনৈতিক কারণে, অর্থনৈতিক কারণে, সামাজিক কারণে, তাদের নিজস্ব অগ্রগতির কারণে, আন্তর্জাতিক সমাজে তাদের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করার কারণে তারা আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাছে ফিরে যাবে। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় রইলাম, যেদিন আর কখনও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী কোনো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে সরকার পরিচালনা করবে না এবং সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের দলগুলো জাতীয়তাবাদী শক্তিতেও রূপান্তরিত হবে। আমরা সেই দিনের অপেক্ষা করছি যেদিন কোনো মুক্তিযোদ্ধা কবিকে, মুক্তিযোদ্ধা লেখককে ক্ষোভে-দুঃখে লিখতে হবে না, সব শালা মুক্তিযোদ্ধা হতে চায়।
মামুন রশীদ : ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
No comments