এশিয়ার নতুন জ্বালানি সুপারপাওয়ার বাংলাদেশ?
জুলাই মাসে জাতিসংঘের সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক গ্যাস সমৃদ্ধ ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার অধিকার জয় করেছে। নতুন অঞ্চলসহ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাস মজুত এখন আনুমানিক ২০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এশিয়া-প্যাসিফিকে এটা সর্বোচ্চ। বঙ্গোপসাগরে উল্লেখযোগ্য জ্বালানির সন্ধান দেশটির অর্থনীতি সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বড় পার্থক্য গড়ে দেবে। বিদেশি বিনিয়োগের জোয়ার আসবে। প্রগতির চাকা ঘুরতে সহায়তা করবে। দ্য ডিপ্লোম্যাটের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। ‘বাংলাদেশ: এশিয়াস নিউ এনার্জি সুপারপাওয়ার?’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীর কাছে বাংলাদেশ এখনও ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের স্থান। এগুলোর কারণ হলো, রাজনৈতিক উত্তেজনা, ব্যাপক দরিদ্রতা ও চরম ভর্তুকিমূলক অর্থনীতি, যা প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে এবং জ্বালানি অবকাঠামোতে ব্যয় সীমাবদ্ধ করে দেয়। বস্তিতে পূর্ণ ঢাকা ও চট্টগ্রাম, যা রিয়াদ, দোহা আর দুবাইয়ের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শপিংমল থেকে যোজন যোজন দূরে। তারপরও দর্শনধারী ভাল হওয়াটাই সবকিছু নয়। দারিদ্র্য ও সহিংসতা সত্ত্বেও তেলের বাজারে ভাল করেছে নাইজেরিয়া, চাদ ও ভেনেজুয়েলা। কিন্তু বাংলাদেশের সমস্যাগুলো হয়তো বুঝতে সাহায্য করবে বিনিয়োগকারীরা কেন এগিয়ে আসছে না। বস্তুত উল্টাটা ঘটেছে। অস্ট্রেলিয়ার সান্তোস গত বছর অপর্যাপ্ত উৎপাদনকে কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশের একমাত্র অফশোর গ্যাসক্ষেত্রে কার্যক্রম বন্ধ করেছে। সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠান ক্রিস এনার্জির সহায়তায় এ বছরের শেষে অগভীর পানিতে খনন কাজ শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে সান্তোসের। অফশোর খনন অধিকারের জন্য ২০১২ সালে জাতীয় তেল প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার একটি নিলামে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান আকৃষ্ট হয়েছে। একটি ভারতের তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কর্পোরেশন। অপরটি হিউস্টন ভিত্তিক কোনোকো ফিলিপস। গত এপ্রিলে পেট্রোবাংলা বিতর্কমুক্ত অফশোর তেলক্ষেত্রের জন্য নিলাম শুরু করে। কিন্তু সেখানে প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ দেখা গেছে কম। তারা অনশোর ক্ষেত্রগুলোতে প্রবেশগম্যতা অভাবের অভিযোগ তুলেছে। এ বছরের শুরুতে কোনোকো এবং রাশিয়ার স্ট্যাটঅয়েল বাংলাদেশের তিনটি গভীর পানির তেলক্ষেত্রে যৌথভাবে নিলামে অংশ নেয়। তেলক্ষেত্রগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠের ৩০ হাজার ফুট গভীরে। কোনোকো পরবর্তীতে আরও দুটি গভীর পানির ক্ষেত্রে চুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। এ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাংলাদেশে কমসংখ্যক প্রতিষ্ঠানই আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে বাজি ধরার জন্য এটা আদর্শ সময় হতে পারে। সমুদ্রে নতুন এলাকা জয়ের পর দেশটির আনুমানিক প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ এখন ২০০ ট্রিলিয়ন ঘটফুট। বছরের শেষ দিকে পেট্রোবাংলা ১৮টি নতুন তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের নিলাম করবে। সেঞ্চুরি ফাউন্ডেশনের পলিসি এসোসিয়েট নেইল ভাটিয়া বলেন, বাংলাদেশ যদি পুরো এলাকা থেকে জ্বালানি উত্তোলন করতে সক্ষম হয় তাহলে তারা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তবে ভিন্নমত পোষণ করছেন মানার এনার্জির হেড অব কনসাল্টিং রবিন মিলস। তিনি বলছেন, নতুন জলসীমায় কি আছে তা নিশ্চিত হওয়ার কোন উপায় নেই। আমরা এখনও জানি না ১০০ নাকি ২০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট, নাকি আদৌ কোন কিছু সেখানে পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের গ্যাস মজুত সম্ভাব্য, প্রমাণিত নয়। কাজেই আমাদের জানা ভূতাত্ত্বিক ও প্রকৌশল তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী অনুমানের সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি। এ জ্বালানি মজুত জরিপ এবং উত্তোলন করার জন্য বাংলাদেশের সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। কিন্তু গভীর পানিতে খনন করার মৌলিক সামর্থ্যরে অভাব রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের। বাংলাদেশের পেট্রোলিয়াম ও এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি পরীক্ষামূলক গ্যাস খনন করেছে কিন্তু নতুন এলাকায় অনুসন্ধান চালাতে তাদের অর্থ এবং জ্বালানি অবকাঠামোতে ঘাটতি রয়েছে। এসব ঘাটতি, প্রতিবন্ধকতা, দুর্নীতির বেড়াজাল এবং রাজনৈতিক উত্তেজনায় দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে। অধিক অর্থ অধিকতর সমস্যা নিয়ে আসে। তারপরও নতুন এলাকা বাংলাদেশকে সুবিধাজনক অবস্থানেই নিয়ে বসাচ্ছে। বাংলাদেশের অন্যতম দুই দাতারাষ্ট্র চীন ও ভারতের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে নেয়ার সুযোগ রয়েছে। দুটি দেশই জ্বালানির নতুন উৎসের জন্য ক্রমেই মরিয়া হয়ে উঠছে। কক্সবাজারে একটি বিমানবন্দর নির্মাণে চীন ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে। উন্নয়নের অর্থ দিয়ে ভারতকে বেষ্টন করতে চীনের যে কৌশল রয়েছে সেখানে বাংলাদেশ এখনও গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। আর প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোজন সে অবস্থানটা আরও সুদৃঢ় করবে। ভাটিয়া বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার বিশ্বব্যাপী বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গ্যাসের জন্য শক্তিশালী বাজার গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের তেল সম্পদ দারিদ্র্য থেকে উত্থানের সেরা সুযোগ। একই সঙ্গে সরকার ও দেশকে স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। এ সময়টা বাংলাদেশকে অবশ্যই লুফে নিতে হবে।
No comments