ছাগলের জ্ঞান-বুদ্ধি মারাত্মক রকমের কম by মোকাম্মেল হোসেন
গায়ের রঙ কালো- তাই তার নাম কালু। কালুর বুকে অপরিসীম বেদনা। চোখে গভীর বিস্ময়। বিস্ময় ও বেদনার মিলিত স্রোত প্রশ্নের ঢেউ হয়ে কালুর মনের উপকূলে আছড়ে পড়ছে। সে ফিসফিস করে পালের গোদার উদ্দেশে বলল-
: ভাই, চিন্তা কইরা কুনু কূলকিনারা পাইতেছি না!
পালের গোদার শরীরজুড়ে সাদা-কালোর মিশেল। শারীরিক এ বৈশিষ্ট্যের কারণে জুনিয়ররা তাকে চক্কর-বক্কর ভাই বলে ডাকে। কালুর কথা শুনে চক্কর-বক্কর আশ্চর্য হল। এ ধরনের কথা সে আগে কখনও শুনেনি। ছাগলের চিন্তিত হওয়া শোভা পায় না। তার কাজ হল খাওয়া-দাওয়া, পাড়া বেড়ানো, লেদানো আর ঘুমানো। মাতৃকুলের ছাগলরা বাচ্চা জন্ম দেয়। বাচ্চাদের দুধ খাওয়ায়। পাঠাকুলের ছাগলরা গণপিতার কঠিন দায়িত্ব পালন করে। তাদের কেউ যদি এ ধরনের কথা বলত, তবুও শোভা পেত। বিচিকাটা ছাগল এ ধরনের কথা বলবে কেন? তার চিন্তা করার প্রয়োজন কী? চিন্তা করবে মানুষ। আল্লাহপাক মানুষকে চিন্তাশীল জীব হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। কালু খাসিকুলের ছাগল হয়ে মানুষের মতো চিন্তাশীল প্রাণী হয়ে উঠেছে- এর মানে কী? সে কি মানুষ হওয়ার ধান্ধা করছে নাকি? চক্কর-বক্কর কৌতূহলী চোখে কালুকে দেখতে থাকে। কালুর আকার-আকৃতি ছাগলের মতোই আছে। চক্কর-বক্কর কালুর লেজের উপরে-নিচে চোখ বুলাল। সেখানে কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। তাহলে সমস্যা কোথায়? সে হঠাৎ মানুষের মতো চিন্তাশীল প্রাণী হয়ে উঠল কেন? চক্কর-বক্কর কালুর পাছায় শিং দিয়ে গুঁতা মেরে বলল-
: কাইল্যা- তর সমস্যা কী?
গুঁতা খেয়ে কালু মন খারাপ করল না। আচমকা গুঁতায় শরীরের পাদদেশের যন্ত্রণা উৎপাদনকারী গুঁড়াকৃমি নিবৃত্ত হওয়ায় কালুর কিছুটা আরাম হল। পাছায় গুঁতা খাওয়ার আশায় সে পুনরায় একই কথা উচ্চারণ করল। চক্কর-বক্কর এবার অবাক হওয়ার বদলে ভয় পেয়ে গেল। তার কেবলই মনে হতে লাগল-
: ছাগল যদি মানুষ হয়ে যায়, মানুষ তাহলে কী হবে?
অনেকটা সময় কেটে গেল। চক্কর-বক্করের দিক কোনো আঘাত না আসায় কালু আগের কথার সূত্র ধরে বলল-
: ভাই, মানুষ হইল সৃষ্টির সেরা জীব। সৃষ্টির সেরা জীব হইয়া আমরার লগে এই ধরনের আচরণ করা কি ঠিক হইতেছে?
চক্কর-বক্কর হাঁফ ছাড়ল। যাক, সমস্যাটা মানুষকে নিয়ে; কালুর মানুষ হওয়া নিয়ে নয়। সে কালুর গায়ে সহানুভূতির চাদর জড়িয়ে দিয়ে বলল-
: কী হইছে!
- কী না হইছে, সেইটা আমারে কও! সারা দিন ঠনঠনা পাক্কার উফরে আমরারে বাইন্ধা রাখছে। কুনু দানা-পানির ব্যবস্থা নাই। ক্ষিধার চোটে জান কবজ হওয়ার দশা। এরা কোন জাতের মানুষ- বুঝতাম পারতেছি না!
কালুর কথায় চক্কর-বক্কর চারপাশে বিচরণশীল মানুষগুলোর জাত-বেজাত উদঘাটনের চেষ্টা করল। পারল না। এ সময় বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একজন নতুন মানুষ পাশের কক্ষে প্রবেশ করল। চক্কর-বক্কর তার প্রতি মনোযোগী হতেই শুনতে পেল, আগন্তুক চেয়ারে বসে থাকা লোকটির উদ্দেশে বলছে-
: ওসি সাব, কেমন আছেন?
এই লোক তাহলে ওসি? ওসি কী জিনিস- চক্কর-বক্কর বোঝার চেষ্টা করল। ব্যা-ব্যা ভাষায় প্রণীত ছাগল শব্দকোষে এ ধরনের কোনো শব্দ নেই। বোঝা যাচ্ছে না, এ সুজাত, না কুজাত? নতুন কোনো সূত্র পাওয়ার আশায় চক্কর-বক্কর কান পাততেই শুনল, ওসি সাহেব হাসতে হাসতে বলছে-
: আল্লাহ মেহেরবান, অনেকের চাইতে ভালো রাখছেন।
- ভালো থাকলেই ভালো। বারান্দায় অনেক ছাগল বান্ধা দেখলাম! বিষয় কী? আপনেরা কি আইজকাইল ক্যাশ নেওয়ার পাশাপাশি ছাগল-গরুও নেওয়া শুরু করছেন নাকি?
- আরে না!
: তাইলে?
- আর বলবেন না! শালার পুলিশের চাকরি করতে আইসা কত রকম ফ্যাটাংয়ের মধ্যে যে কাল কাটাইতে হইতেছে, ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। ছাগলগুলারে অ্যারেস্ট কইরা থানায় আনা হইছে।
এবার মানুষটা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেল। চক্কর-বক্কর বুঝতে পারল সে পুলিশ। চক্কর-বক্কর সতর্ক হল। ছাগল-শব্দকোষে পুলিশের বর্ণনা দেয়া আছে। সেখানে পুলিশ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করে বলা হয়েছে- ছাগল সম্প্রদায়কে দুইটি অতি ভয়ংকর প্রাণীর ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক থাকিতে হইবে। প্রাণী দুইটি হইল শিয়াল ও পুলিশ। ইহাদের খপ্পরে পড়িলে জীবনসংশয় হইবার সমূহ সম্ভাবনা রহিয়াছে। কাজেই সাবধান। খুব সাবধান।
কার হাতে পড়েছে বুঝতে পেরে চক্কর-বক্করের কলিজা কালোজিরার মতো কালো হয়ে গেল। এখান থেকে মুক্তির জন্য অস্থির হয়ে ডানে-বামে তাকাতেই সে দেখল, ওসি সাহেবের কথা শুনে আগন্তুক চোখ কপালে তুলে বলছে-
: ছাগল!
- অসুবিধা কী? ক্রাইম করলে ছাগল কেন, ইঁদুর-বিড়ালকেও অ্যারেস্ট কইরা থানায় নিয়া আসার মতো শক্তি ও সাহস দেশের পুলিশ বাহিনীর আছে।
: সাবাস! ছাগলগুলা কী ধরনের ক্রাইমের সঙ্গে যুক্ত হইছে- বলা যাবে?
- বলা যাবে না কেন? ছাগল লইয়া গোপনীয়তা বজায় রাখার কিছু নাই; হারামজাদারা আর জায়গা পাইছে না, সরাসরি আমাদের এমপি সাবের বাগানে ঢুইক্যা পড়ছে।
: ঢুইক্যা পড়ার অপরাধেই ধইরা আনলেন?
- শুধু ঢুকলে কি আমাদের এতটা কঠোর হওয়ার প্রয়োজন পড়ত? বজ্জাতগুলা শুধু ঢুকে নাই- মুখও লাগাইছে।
: বলেন কী! কোন জায়গায় মুখ লাগাইছে?
- জায়গায় না, গাছে। টাউটগুলা চাটাচাটি কইরা এমপি সাবের শখের বাগানের মহামূল্যবান গাছের বদ্দিনাশ কইরা ফেলছে।
আগন্তুক এ সময় হা-হা করে হেসে উঠল। ওসি সাহেব বললেন-
: হাসলেন কেন?
- হাসলাম এই জন্য, সবাই ঢুকা পার্টি। সবাই চাটা পার্টি। প্রত্যেকেই তাদের ওজন ও আকার অনুযায়ী জায়গামতো ঢুইক্যা পড়তেছে, পছন্দের বস্তু চাটাচাটি করতেছে। ছাগল বাগানে ঢুকতেছে- বাগানের মালিক উদ্যানে ঢুকতেছে। ছাগল গাছ চাটতেছে- গাছের মালিক পুরা দেশটারেই চাটতেছে।
কিছুক্ষণের জন্য চারপাশে নীরবতা নেমে এলো। এ সময় কালু ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে করুণস্বরে ডেকে উঠতেই আগন্তুক বলল-
: ছাগলগুলারে কি কোর্টে চালান দিবেন?
ওসি সাহেবের মুখে বাঁকা হাসি দেখা গেল। তিনি পকেট থেকে দামি সিগারেটের প্যাকেট বের করে আগন্তুকের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন-
- উহুঁ! এমপি সাহেব বলছিলেন, কোর্টে চালান কইরা দেওয়ার জন্য। আমি তারে পরামর্শ দিছি- স্যার, সামনে নির্বাচন আছে। সেই নির্বাচনে আপনের কোটি কোটি টাকা খরচ হবে। ছাগলের পাল গাছ নষ্ট করায় আপনের যে কয় টাকা ক্ষতি হইছে- সেইটারে নির্বাচনী খরচ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত কইরা ফেলেন। ছাগলের জ্ঞান-বুদ্ধি মারাÍক রকমের কম। কিন্তু ছাগলের মালিক তো আর নির্বোধ না। মামলা খাইয়া সে বেজার হইলে আপনের ভোটের উপর চোট পড়বে। আমার পরামর্শ শুইন্যা এমপি সাহেব অত্যধিক খুশি হইলেন। বললেন-
: তোমার মতো চিকন বুদ্ধির পুলিশও দেশে আছে- এইটা তো জানতাম না! তোমার বাড়ি কই?
আমি তারে বাড়ির ঠিকানা বলতেই তিনি হাসতে লাগলেন। তার সঙ্গে সঙ্গে আমিও হাসতে লাগলাম। হা-হা-হা। তবে আপনেরে বলি, হাসা করি, আর হাসি করি- এর পেছনে আমার সূক্ষ্ম একটা উদ্দেশ্য আছে।
- কী রকম?
: আরে! কোর্টে চালান দিলে ছাগল হারামজাদাদের হিরো বানানোর জন্য মিডিয়া উইঠ্যা-পইড়া লাগবে। পুলিশের বগলের চিপায় থাইক্যা ছাগল হিরো হইয়া যাবে- এইটা মাইন্যা নেওয়া কঠিন।
: তাইলে কী করবেন?
- পাশে একটা খোঁয়াড় আছে। সেইখানে ট্রান্সফার কইরা দিব।
: এত সুন্দর মোটাতাজা নাদুস-নুদুস ছাগল- খোঁয়াড়ে পাঠানোর দরকার কী?
- কী করব?
: হজম কইরা ফেলেন।
- ধুর! বিষয়টা এমপি সাবের নলেজে আছে না?
- তাতে কী হইছে? ছাগলগুলারে থানার পিছনে নিয়া ঠ্যাং-ঠুংয়ে কয়েকটা গুলি মাইরা ঘোষণা দেন- ক্রসফায়ারে সব নিহত হইছে। ক্রসফায়ারের আগে-পরে ‘কেন’ প্রশ্ন নাই, এইটা এমপি, মন্ত্রীরা ভালো কইরাই জানেন। আপনে সরকারি গুলি ধুম-ধাম ফুটাইয়া শুধু এর খোসাগুলা মালখানায় জমা দিবেন। এরপর মিডিয়ার জন্য ক্রসফায়ারে নিহতদের কয়েকটা ছবি তুইল্যা রাইখ্যা হাদিস অনুসারে গলায় ছুরি চালাবেন। ব্যস! কোনো প্রশ্ন ছাড়াই ছাগলের মাংস জায়গামতো এক্সপোর্ট হইয়া যাবে। পাশাপাশি চামড়া বিক্রি কইরাও কিছু পয়সা পাবেন।
: দেশে কি পয়সা খাওয়ার খাত-উপখাতের এতই অভাব যে- চামড়া বেচা পয়সা খাব?
- সমস্যা মনে করলে কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দান কইরা দেন। নেকি হাসিল হবে। গুলি যাবে সরকারের, ছাগল যাবে মালিকের। মাঝখান থেইক্যা নেকির পাল্লা ভারি হবে আপনার। আর দেরি কইরেন না। শ্যুট কইরা দেন।
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
: ভাই, চিন্তা কইরা কুনু কূলকিনারা পাইতেছি না!
পালের গোদার শরীরজুড়ে সাদা-কালোর মিশেল। শারীরিক এ বৈশিষ্ট্যের কারণে জুনিয়ররা তাকে চক্কর-বক্কর ভাই বলে ডাকে। কালুর কথা শুনে চক্কর-বক্কর আশ্চর্য হল। এ ধরনের কথা সে আগে কখনও শুনেনি। ছাগলের চিন্তিত হওয়া শোভা পায় না। তার কাজ হল খাওয়া-দাওয়া, পাড়া বেড়ানো, লেদানো আর ঘুমানো। মাতৃকুলের ছাগলরা বাচ্চা জন্ম দেয়। বাচ্চাদের দুধ খাওয়ায়। পাঠাকুলের ছাগলরা গণপিতার কঠিন দায়িত্ব পালন করে। তাদের কেউ যদি এ ধরনের কথা বলত, তবুও শোভা পেত। বিচিকাটা ছাগল এ ধরনের কথা বলবে কেন? তার চিন্তা করার প্রয়োজন কী? চিন্তা করবে মানুষ। আল্লাহপাক মানুষকে চিন্তাশীল জীব হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। কালু খাসিকুলের ছাগল হয়ে মানুষের মতো চিন্তাশীল প্রাণী হয়ে উঠেছে- এর মানে কী? সে কি মানুষ হওয়ার ধান্ধা করছে নাকি? চক্কর-বক্কর কৌতূহলী চোখে কালুকে দেখতে থাকে। কালুর আকার-আকৃতি ছাগলের মতোই আছে। চক্কর-বক্কর কালুর লেজের উপরে-নিচে চোখ বুলাল। সেখানে কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। তাহলে সমস্যা কোথায়? সে হঠাৎ মানুষের মতো চিন্তাশীল প্রাণী হয়ে উঠল কেন? চক্কর-বক্কর কালুর পাছায় শিং দিয়ে গুঁতা মেরে বলল-
: কাইল্যা- তর সমস্যা কী?
গুঁতা খেয়ে কালু মন খারাপ করল না। আচমকা গুঁতায় শরীরের পাদদেশের যন্ত্রণা উৎপাদনকারী গুঁড়াকৃমি নিবৃত্ত হওয়ায় কালুর কিছুটা আরাম হল। পাছায় গুঁতা খাওয়ার আশায় সে পুনরায় একই কথা উচ্চারণ করল। চক্কর-বক্কর এবার অবাক হওয়ার বদলে ভয় পেয়ে গেল। তার কেবলই মনে হতে লাগল-
: ছাগল যদি মানুষ হয়ে যায়, মানুষ তাহলে কী হবে?
অনেকটা সময় কেটে গেল। চক্কর-বক্করের দিক কোনো আঘাত না আসায় কালু আগের কথার সূত্র ধরে বলল-
: ভাই, মানুষ হইল সৃষ্টির সেরা জীব। সৃষ্টির সেরা জীব হইয়া আমরার লগে এই ধরনের আচরণ করা কি ঠিক হইতেছে?
চক্কর-বক্কর হাঁফ ছাড়ল। যাক, সমস্যাটা মানুষকে নিয়ে; কালুর মানুষ হওয়া নিয়ে নয়। সে কালুর গায়ে সহানুভূতির চাদর জড়িয়ে দিয়ে বলল-
: কী হইছে!
- কী না হইছে, সেইটা আমারে কও! সারা দিন ঠনঠনা পাক্কার উফরে আমরারে বাইন্ধা রাখছে। কুনু দানা-পানির ব্যবস্থা নাই। ক্ষিধার চোটে জান কবজ হওয়ার দশা। এরা কোন জাতের মানুষ- বুঝতাম পারতেছি না!
কালুর কথায় চক্কর-বক্কর চারপাশে বিচরণশীল মানুষগুলোর জাত-বেজাত উদঘাটনের চেষ্টা করল। পারল না। এ সময় বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একজন নতুন মানুষ পাশের কক্ষে প্রবেশ করল। চক্কর-বক্কর তার প্রতি মনোযোগী হতেই শুনতে পেল, আগন্তুক চেয়ারে বসে থাকা লোকটির উদ্দেশে বলছে-
: ওসি সাব, কেমন আছেন?
এই লোক তাহলে ওসি? ওসি কী জিনিস- চক্কর-বক্কর বোঝার চেষ্টা করল। ব্যা-ব্যা ভাষায় প্রণীত ছাগল শব্দকোষে এ ধরনের কোনো শব্দ নেই। বোঝা যাচ্ছে না, এ সুজাত, না কুজাত? নতুন কোনো সূত্র পাওয়ার আশায় চক্কর-বক্কর কান পাততেই শুনল, ওসি সাহেব হাসতে হাসতে বলছে-
: আল্লাহ মেহেরবান, অনেকের চাইতে ভালো রাখছেন।
- ভালো থাকলেই ভালো। বারান্দায় অনেক ছাগল বান্ধা দেখলাম! বিষয় কী? আপনেরা কি আইজকাইল ক্যাশ নেওয়ার পাশাপাশি ছাগল-গরুও নেওয়া শুরু করছেন নাকি?
- আরে না!
: তাইলে?
- আর বলবেন না! শালার পুলিশের চাকরি করতে আইসা কত রকম ফ্যাটাংয়ের মধ্যে যে কাল কাটাইতে হইতেছে, ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। ছাগলগুলারে অ্যারেস্ট কইরা থানায় আনা হইছে।
এবার মানুষটা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেল। চক্কর-বক্কর বুঝতে পারল সে পুলিশ। চক্কর-বক্কর সতর্ক হল। ছাগল-শব্দকোষে পুলিশের বর্ণনা দেয়া আছে। সেখানে পুলিশ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করে বলা হয়েছে- ছাগল সম্প্রদায়কে দুইটি অতি ভয়ংকর প্রাণীর ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক থাকিতে হইবে। প্রাণী দুইটি হইল শিয়াল ও পুলিশ। ইহাদের খপ্পরে পড়িলে জীবনসংশয় হইবার সমূহ সম্ভাবনা রহিয়াছে। কাজেই সাবধান। খুব সাবধান।
কার হাতে পড়েছে বুঝতে পেরে চক্কর-বক্করের কলিজা কালোজিরার মতো কালো হয়ে গেল। এখান থেকে মুক্তির জন্য অস্থির হয়ে ডানে-বামে তাকাতেই সে দেখল, ওসি সাহেবের কথা শুনে আগন্তুক চোখ কপালে তুলে বলছে-
: ছাগল!
- অসুবিধা কী? ক্রাইম করলে ছাগল কেন, ইঁদুর-বিড়ালকেও অ্যারেস্ট কইরা থানায় নিয়া আসার মতো শক্তি ও সাহস দেশের পুলিশ বাহিনীর আছে।
: সাবাস! ছাগলগুলা কী ধরনের ক্রাইমের সঙ্গে যুক্ত হইছে- বলা যাবে?
- বলা যাবে না কেন? ছাগল লইয়া গোপনীয়তা বজায় রাখার কিছু নাই; হারামজাদারা আর জায়গা পাইছে না, সরাসরি আমাদের এমপি সাবের বাগানে ঢুইক্যা পড়ছে।
: ঢুইক্যা পড়ার অপরাধেই ধইরা আনলেন?
- শুধু ঢুকলে কি আমাদের এতটা কঠোর হওয়ার প্রয়োজন পড়ত? বজ্জাতগুলা শুধু ঢুকে নাই- মুখও লাগাইছে।
: বলেন কী! কোন জায়গায় মুখ লাগাইছে?
- জায়গায় না, গাছে। টাউটগুলা চাটাচাটি কইরা এমপি সাবের শখের বাগানের মহামূল্যবান গাছের বদ্দিনাশ কইরা ফেলছে।
আগন্তুক এ সময় হা-হা করে হেসে উঠল। ওসি সাহেব বললেন-
: হাসলেন কেন?
- হাসলাম এই জন্য, সবাই ঢুকা পার্টি। সবাই চাটা পার্টি। প্রত্যেকেই তাদের ওজন ও আকার অনুযায়ী জায়গামতো ঢুইক্যা পড়তেছে, পছন্দের বস্তু চাটাচাটি করতেছে। ছাগল বাগানে ঢুকতেছে- বাগানের মালিক উদ্যানে ঢুকতেছে। ছাগল গাছ চাটতেছে- গাছের মালিক পুরা দেশটারেই চাটতেছে।
কিছুক্ষণের জন্য চারপাশে নীরবতা নেমে এলো। এ সময় কালু ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে করুণস্বরে ডেকে উঠতেই আগন্তুক বলল-
: ছাগলগুলারে কি কোর্টে চালান দিবেন?
ওসি সাহেবের মুখে বাঁকা হাসি দেখা গেল। তিনি পকেট থেকে দামি সিগারেটের প্যাকেট বের করে আগন্তুকের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন-
- উহুঁ! এমপি সাহেব বলছিলেন, কোর্টে চালান কইরা দেওয়ার জন্য। আমি তারে পরামর্শ দিছি- স্যার, সামনে নির্বাচন আছে। সেই নির্বাচনে আপনের কোটি কোটি টাকা খরচ হবে। ছাগলের পাল গাছ নষ্ট করায় আপনের যে কয় টাকা ক্ষতি হইছে- সেইটারে নির্বাচনী খরচ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত কইরা ফেলেন। ছাগলের জ্ঞান-বুদ্ধি মারাÍক রকমের কম। কিন্তু ছাগলের মালিক তো আর নির্বোধ না। মামলা খাইয়া সে বেজার হইলে আপনের ভোটের উপর চোট পড়বে। আমার পরামর্শ শুইন্যা এমপি সাহেব অত্যধিক খুশি হইলেন। বললেন-
: তোমার মতো চিকন বুদ্ধির পুলিশও দেশে আছে- এইটা তো জানতাম না! তোমার বাড়ি কই?
আমি তারে বাড়ির ঠিকানা বলতেই তিনি হাসতে লাগলেন। তার সঙ্গে সঙ্গে আমিও হাসতে লাগলাম। হা-হা-হা। তবে আপনেরে বলি, হাসা করি, আর হাসি করি- এর পেছনে আমার সূক্ষ্ম একটা উদ্দেশ্য আছে।
- কী রকম?
: আরে! কোর্টে চালান দিলে ছাগল হারামজাদাদের হিরো বানানোর জন্য মিডিয়া উইঠ্যা-পইড়া লাগবে। পুলিশের বগলের চিপায় থাইক্যা ছাগল হিরো হইয়া যাবে- এইটা মাইন্যা নেওয়া কঠিন।
: তাইলে কী করবেন?
- পাশে একটা খোঁয়াড় আছে। সেইখানে ট্রান্সফার কইরা দিব।
: এত সুন্দর মোটাতাজা নাদুস-নুদুস ছাগল- খোঁয়াড়ে পাঠানোর দরকার কী?
- কী করব?
: হজম কইরা ফেলেন।
- ধুর! বিষয়টা এমপি সাবের নলেজে আছে না?
- তাতে কী হইছে? ছাগলগুলারে থানার পিছনে নিয়া ঠ্যাং-ঠুংয়ে কয়েকটা গুলি মাইরা ঘোষণা দেন- ক্রসফায়ারে সব নিহত হইছে। ক্রসফায়ারের আগে-পরে ‘কেন’ প্রশ্ন নাই, এইটা এমপি, মন্ত্রীরা ভালো কইরাই জানেন। আপনে সরকারি গুলি ধুম-ধাম ফুটাইয়া শুধু এর খোসাগুলা মালখানায় জমা দিবেন। এরপর মিডিয়ার জন্য ক্রসফায়ারে নিহতদের কয়েকটা ছবি তুইল্যা রাইখ্যা হাদিস অনুসারে গলায় ছুরি চালাবেন। ব্যস! কোনো প্রশ্ন ছাড়াই ছাগলের মাংস জায়গামতো এক্সপোর্ট হইয়া যাবে। পাশাপাশি চামড়া বিক্রি কইরাও কিছু পয়সা পাবেন।
: দেশে কি পয়সা খাওয়ার খাত-উপখাতের এতই অভাব যে- চামড়া বেচা পয়সা খাব?
- সমস্যা মনে করলে কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দান কইরা দেন। নেকি হাসিল হবে। গুলি যাবে সরকারের, ছাগল যাবে মালিকের। মাঝখান থেইক্যা নেকির পাল্লা ভারি হবে আপনার। আর দেরি কইরেন না। শ্যুট কইরা দেন।
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
No comments