কাক এখন কাকের মাংস খায়! by ইকতেদার আহমেদ
পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের পাখি রয়েছে। অধিকাংশ পাখি গাছে বাসা বাঁধে। কিছু পাখিকে শৌখিন মানুষেরা তাদের গৃহে বা গৃহের আঙিনায় পুষে থাকে, এরা পোষা পাখি। এমন কিছু পাখি আছে যেগুলো মানুষের শেখানো বুলি আওড়াতে পারে। চড়ুই ও কবুতর- এ দুটি পাখি গাছের ডালে বাসা না বেঁধে মানুষের গৃহের চালের
কোণে বাসা বাঁধতে সচ্ছন্দবোধ করে। সব ধরনের পাখি নিজের পাড়া ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়।
এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম হল কোকিল।
কোকিল অত্যন্ত কৌশলে কাকের বাসা থেকে কাকের ডিম ফেলে দিয়ে সেখানে ডিম পাড়ে এবং পরবর্তীকালে কোকিলের ডিমে তা দিয়ে কাক কোকিলের জন্ম দেয়।
কাক পাখি হলেও এ পাখিটিকে কেউ পোষা পাখি হিসেবে লালন-পালন করে না। কাকের গায়ের বর্ণ কালো। আমাদের দেশে দু’ধরনের কাক দেখা যায়। এর একটি হল দাঁড়কাক এবং অপরটি পাতি কাক। দাঁড়কাক আকৃতিতে একটু বড়; তবে সংখ্যার বিবেচনায় আমাদের চারপাশে পাতি কাক অধিক পরিলক্ষিত হয়। স্বভাবগতভাবে কাক নোংরা প্রকৃতির। কাক সাধারণত ময়লা-আবর্জনা থেকে তার খাবার সংগ্রহ করে। খাওয়ার ব্যাপারে কাকের তেমন একটা বাছবিচার নেই। তবে কোনো বাছবিচার না থাকলেও কাক নিজের মাংস খায় না। এ ব্যাপারে কাকের নীতিবোধ ও নৈতিকতা প্রবল। কাকের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল, পাখিটি খুব বেশি সমব্যথী। যে কোনো দুর্ঘটনায় একটি কাকের মৃত্যু ঘটলে আশপাশের সব কাক সেটিকে ঘিরে কা কা রবে সমবেদনা জানাতে থাকে। আবার দেখা যায়, একটি কাক অন্য কোনো পাখি বা প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হলে অপরাপর কাক সম্মিলিতভাবে আক্রান্তের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে এসে আক্রান্তকারীকে প্রতিহত করতে সচেষ্ট হয়।
পৃথিবীর যে কোনো দেশে চিকিৎসা পেশায় যারা নিয়োজিত, তারা মানবসেবার মহান ব্রত নিয়ে পেশাটিকে বেছে নেন। চিকিৎসকদের অনেকে সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত, আবার অনেকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা করে থাকেন। সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে রোগী দেখায় বিধি-নিষেধ নেই। চিকিৎসকরা মানুষের রোগ নিরাময়ে বিশেষ ভূমিকা রেখে থাকলেও তারা নিজেরা রোগ থেকে মুক্ত, এ কথা বলা যাবে না। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের রোগ এবং মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসক রয়েছেন। এখন অধিকাংশ মানুষ রোগ নির্ণয়ের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎকদের দ্বারস্থ হয়। সুদূর অতীত থেকে দেখা গেছে, কোনো চিকিৎসক রোগে আক্রান্ত হলে একই পেশায় নিয়োজিত অপর চিকিৎসক তাকে বিনা পারিশ্রমিকে সেবা দিতেন। এ সেবার পরিধি থেকে অনেক সময় দেখা যায় চিকিৎসকদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পিতা-মাতা বাইরে নয়। যে নীতিবোধ ও নৈতিকতা থেকে অতীতে চিকিৎসকরা রোগ
নিরাময়ে সেবার হাত প্রশস্ত করতেন, বর্তমানে নীতিবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে সে সেবার হাত আর প্রশস্ত নয়।
সুদূর অতীতে যারা আইন পেশায় নিয়োজিত হতেন, তাদের প্রায় সবাই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। এমন অনেক নীতিবান ও দৃঢ় চরিত্রের আইনজীবীর কথা শোনা যায়, যারা মক্কেল কর্তৃক নিয়োজিত হওয়ার পর মামলা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত মক্কেল কর্তৃক দেয় টাকা ব্যয় করতে দ্বিধাবোধ করতেন। দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা পরিচালনায় যারা নিষ্ঠাবান ও পারদর্শী হিসেবে খ্যাত, আগে তাদের জিপি বা পিপি অথবা তাদের সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেয়া হতো। একটি জেলার আইনজীবী হিসেবে জিপি বা পিপি পদ যে কোনো আইনজীবীর জন্য সম্মানের হলেও অতীতে অনেক প্রথিতযশা ও ন্যায়নিষ্ঠ আইনজীবী নিজের আইন পেশার ক্ষতি হবে- এ বিবেচনায় জিপি বা পিপি পদের প্রস্তাব বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু অতীতের সেই আÍত্যাগ আজ খুব একটা দেখা যায় না। বিগত চার দশকের বেশি সময় থেকে দেখা যাচ্ছে, জিপি ও পিপি হওয়ার জন্য আইনজীবীদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা হচ্ছে এবং একজন আইনজীবীর পেশাগত সততা ও দক্ষতার চেয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি তার রাজনৈতিক আনুগত্য জিপি বা পিপি নিয়োগের ক্ষেত্রে অধিক বিবেচিত হচ্ছে। একজন জিপি বা পিপি রাষ্ট্র বা সরকারের স্বার্থ সমুন্নত রাখার ব্যাপারে সদাসর্বদা সচেষ্ট থাকবেন, এটি কাক্সিক্ষত হলেও তা যে বর্তমানে প্রতিনিয়ত উপেক্ষিত হচ্ছে, তা বোধকরি আইন পেশায় সংশ্লিষ্ট ও দেশবাসীর বোঝা হয়ে গেছে।
অতীতে একজন আইনজীবী অপর আইনজীবীর ব্যক্তিগত মামলা বিনা পারিশ্রমিকে পরিচালনা করে নীতি ও নৈতিকতার দৃষ্টান্ত সমুজ্জ্বল রাখতেন। বর্তমানে বিভিন্নমুখী অবক্ষয়ের কারণে সে সমুজ্জ্বলতা মলিন। এখন আইনজীবীরা যেসব রাজনৈতিক মামলা পরিচালনা করলে পদ ও ক্ষমতা পাওয়ার জন্য সহায়ক হবে, সেসব মামলা ছাড়া কদাচিৎ বিনা পারিশ্রমিকে অন্য মামলা পরিচালনা করেন। বিভিন্ন জেলায় সরকার প্রদত্ত আইনগত সহায়তা তহবিলে অসহায় মানুষের মামলা পরিচালনার জন্য সরকারের
পক্ষ থেকে সম্ভাব্য অর্থের সংস্থান করা হলেও অধিকাংশ আইনজীবী ওই তহবিলের অর্থ দ্বারা মামলা পরিচালনার
ক্ষেত্রে অনীহা দেখান। এর পেছনের কারণ, মামলা পরিচালনার ব্যয় হিসাবে যে অর্থ দেয়া হয় তা আকর্ষণীয় নয়।
আমাদের দেশে যারা বিচার কার্যে নিয়োজিত, তাদের সবাই আইন বিষয়ে ডিগ্রিধারী। এদের অনেকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ লাভের আগে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। বিচারকরা সমাজেরই অংশ। একজন বিচারকের পারিবারিক, সামাজিক ও জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধে জড়িত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিচারক হিসেবে নিয়োগ লাভের আগে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিচারকরা নিয়োগ লাভের পর যে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে পারছেন এটি আজ কোনো কোনো বিচারকের ক্ষেত্রে সত্য নয়। একজন বিচারকের প্রধান কাজ ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সত্য প্রতিষ্ঠা করা। এ সত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে একজন বিচারকের কোনো ধরনের অন্যায়ের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ নেই। পেশাগত কারণে একজন বিচারকের সৎ হওয়া অত্যাবশ্যক। তাই একজন বিচারক সৎ- এ কথাটি বললে তা অপরাপর বিচারকের জন্য বিব্রতকর হিসেবে দেখা দেয়। আমাদের সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে যে অবক্ষয়ের ছোঁয়া লেগেছে, তা থেকে বিচারকসমাজ অবমুক্ত নন। একজন বিচারক জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধে জড়িয়ে পড়লে তার পৈত্রিক সম্পত্তি রক্ষার জন্য সুবিচার প্রাপ্তির প্রত্যাশায় নীতিবান ও আদর্শ বিচারককে কখনও অনুরোধ করে থাকলে তাকে বিফল হতে হয় না। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয় তখন, যখন একজন বিচারক নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন। এরূপ বিচারক অবৈধ অর্থের মোহে সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্রে আইনকানুনের থোড়াই তোয়াক্কা করেন।
এদের কাছে কোনো সহকর্মী বিচারক সঙ্গত
অনুরোধ করলে তাদের বলতে শোনা যায়, এটি বিচার বিভাগ, এখানে বিচারকদের কোনো ধরনের অনুরোধ করা যায় না।
যে কোনো সমাজের অবক্ষয় হলে তা সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে স্পর্শ করে। মানুষকে আল্লাহপাক যে বুদ্ধি-বিবেক দিয়েছেন তা অন্য কোনো প্রাণীকে দেননি। তাই জন্মগতভাবে একটি প্রাণীর ক্ষেত্রে যা সহজাত, তা মানুষরূপী প্রাণীর ক্ষেত্রে নয়। কাক কাকের মাংস খায় না- এটি জন্মগত সহজাত গুণ হিসেবে চির সত্য। পৃথিবীতে যতদিন কাকের অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন এ সত্যের অন্যথা হবে না। কিন্তু আমাদের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে যারা স্বজাতির ব্যথায় সমব্যথী বা সহমর্মী নন, বরং অন্যায় বা অনৈতিকভাবে প্রাপ্তির যোগ না থাকায় মুখ ফিরিয়ে নেন, ‘কাক কাকের মাংস খায় না’- এ প্রবাদটি তাদের ক্ষেত্রে সত্য নয়, এমনটি বলা যাবে কি? আর বলা না গেলে বলতে বাধা কোথায়- কাক এখন কাকের মাংস খায়!
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
কোণে বাসা বাঁধতে সচ্ছন্দবোধ করে। সব ধরনের পাখি নিজের পাড়া ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়।
এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম হল কোকিল।
কোকিল অত্যন্ত কৌশলে কাকের বাসা থেকে কাকের ডিম ফেলে দিয়ে সেখানে ডিম পাড়ে এবং পরবর্তীকালে কোকিলের ডিমে তা দিয়ে কাক কোকিলের জন্ম দেয়।
কাক পাখি হলেও এ পাখিটিকে কেউ পোষা পাখি হিসেবে লালন-পালন করে না। কাকের গায়ের বর্ণ কালো। আমাদের দেশে দু’ধরনের কাক দেখা যায়। এর একটি হল দাঁড়কাক এবং অপরটি পাতি কাক। দাঁড়কাক আকৃতিতে একটু বড়; তবে সংখ্যার বিবেচনায় আমাদের চারপাশে পাতি কাক অধিক পরিলক্ষিত হয়। স্বভাবগতভাবে কাক নোংরা প্রকৃতির। কাক সাধারণত ময়লা-আবর্জনা থেকে তার খাবার সংগ্রহ করে। খাওয়ার ব্যাপারে কাকের তেমন একটা বাছবিচার নেই। তবে কোনো বাছবিচার না থাকলেও কাক নিজের মাংস খায় না। এ ব্যাপারে কাকের নীতিবোধ ও নৈতিকতা প্রবল। কাকের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল, পাখিটি খুব বেশি সমব্যথী। যে কোনো দুর্ঘটনায় একটি কাকের মৃত্যু ঘটলে আশপাশের সব কাক সেটিকে ঘিরে কা কা রবে সমবেদনা জানাতে থাকে। আবার দেখা যায়, একটি কাক অন্য কোনো পাখি বা প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হলে অপরাপর কাক সম্মিলিতভাবে আক্রান্তের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে এসে আক্রান্তকারীকে প্রতিহত করতে সচেষ্ট হয়।
পৃথিবীর যে কোনো দেশে চিকিৎসা পেশায় যারা নিয়োজিত, তারা মানবসেবার মহান ব্রত নিয়ে পেশাটিকে বেছে নেন। চিকিৎসকদের অনেকে সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত, আবার অনেকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা করে থাকেন। সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে রোগী দেখায় বিধি-নিষেধ নেই। চিকিৎসকরা মানুষের রোগ নিরাময়ে বিশেষ ভূমিকা রেখে থাকলেও তারা নিজেরা রোগ থেকে মুক্ত, এ কথা বলা যাবে না। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের রোগ এবং মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসক রয়েছেন। এখন অধিকাংশ মানুষ রোগ নির্ণয়ের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎকদের দ্বারস্থ হয়। সুদূর অতীত থেকে দেখা গেছে, কোনো চিকিৎসক রোগে আক্রান্ত হলে একই পেশায় নিয়োজিত অপর চিকিৎসক তাকে বিনা পারিশ্রমিকে সেবা দিতেন। এ সেবার পরিধি থেকে অনেক সময় দেখা যায় চিকিৎসকদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পিতা-মাতা বাইরে নয়। যে নীতিবোধ ও নৈতিকতা থেকে অতীতে চিকিৎসকরা রোগ
নিরাময়ে সেবার হাত প্রশস্ত করতেন, বর্তমানে নীতিবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে সে সেবার হাত আর প্রশস্ত নয়।
সুদূর অতীতে যারা আইন পেশায় নিয়োজিত হতেন, তাদের প্রায় সবাই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। এমন অনেক নীতিবান ও দৃঢ় চরিত্রের আইনজীবীর কথা শোনা যায়, যারা মক্কেল কর্তৃক নিয়োজিত হওয়ার পর মামলা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত মক্কেল কর্তৃক দেয় টাকা ব্যয় করতে দ্বিধাবোধ করতেন। দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা পরিচালনায় যারা নিষ্ঠাবান ও পারদর্শী হিসেবে খ্যাত, আগে তাদের জিপি বা পিপি অথবা তাদের সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেয়া হতো। একটি জেলার আইনজীবী হিসেবে জিপি বা পিপি পদ যে কোনো আইনজীবীর জন্য সম্মানের হলেও অতীতে অনেক প্রথিতযশা ও ন্যায়নিষ্ঠ আইনজীবী নিজের আইন পেশার ক্ষতি হবে- এ বিবেচনায় জিপি বা পিপি পদের প্রস্তাব বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু অতীতের সেই আÍত্যাগ আজ খুব একটা দেখা যায় না। বিগত চার দশকের বেশি সময় থেকে দেখা যাচ্ছে, জিপি ও পিপি হওয়ার জন্য আইনজীবীদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা হচ্ছে এবং একজন আইনজীবীর পেশাগত সততা ও দক্ষতার চেয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি তার রাজনৈতিক আনুগত্য জিপি বা পিপি নিয়োগের ক্ষেত্রে অধিক বিবেচিত হচ্ছে। একজন জিপি বা পিপি রাষ্ট্র বা সরকারের স্বার্থ সমুন্নত রাখার ব্যাপারে সদাসর্বদা সচেষ্ট থাকবেন, এটি কাক্সিক্ষত হলেও তা যে বর্তমানে প্রতিনিয়ত উপেক্ষিত হচ্ছে, তা বোধকরি আইন পেশায় সংশ্লিষ্ট ও দেশবাসীর বোঝা হয়ে গেছে।
অতীতে একজন আইনজীবী অপর আইনজীবীর ব্যক্তিগত মামলা বিনা পারিশ্রমিকে পরিচালনা করে নীতি ও নৈতিকতার দৃষ্টান্ত সমুজ্জ্বল রাখতেন। বর্তমানে বিভিন্নমুখী অবক্ষয়ের কারণে সে সমুজ্জ্বলতা মলিন। এখন আইনজীবীরা যেসব রাজনৈতিক মামলা পরিচালনা করলে পদ ও ক্ষমতা পাওয়ার জন্য সহায়ক হবে, সেসব মামলা ছাড়া কদাচিৎ বিনা পারিশ্রমিকে অন্য মামলা পরিচালনা করেন। বিভিন্ন জেলায় সরকার প্রদত্ত আইনগত সহায়তা তহবিলে অসহায় মানুষের মামলা পরিচালনার জন্য সরকারের
পক্ষ থেকে সম্ভাব্য অর্থের সংস্থান করা হলেও অধিকাংশ আইনজীবী ওই তহবিলের অর্থ দ্বারা মামলা পরিচালনার
ক্ষেত্রে অনীহা দেখান। এর পেছনের কারণ, মামলা পরিচালনার ব্যয় হিসাবে যে অর্থ দেয়া হয় তা আকর্ষণীয় নয়।
আমাদের দেশে যারা বিচার কার্যে নিয়োজিত, তাদের সবাই আইন বিষয়ে ডিগ্রিধারী। এদের অনেকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ লাভের আগে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। বিচারকরা সমাজেরই অংশ। একজন বিচারকের পারিবারিক, সামাজিক ও জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধে জড়িত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিচারক হিসেবে নিয়োগ লাভের আগে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিচারকরা নিয়োগ লাভের পর যে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে পারছেন এটি আজ কোনো কোনো বিচারকের ক্ষেত্রে সত্য নয়। একজন বিচারকের প্রধান কাজ ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সত্য প্রতিষ্ঠা করা। এ সত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে একজন বিচারকের কোনো ধরনের অন্যায়ের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ নেই। পেশাগত কারণে একজন বিচারকের সৎ হওয়া অত্যাবশ্যক। তাই একজন বিচারক সৎ- এ কথাটি বললে তা অপরাপর বিচারকের জন্য বিব্রতকর হিসেবে দেখা দেয়। আমাদের সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে যে অবক্ষয়ের ছোঁয়া লেগেছে, তা থেকে বিচারকসমাজ অবমুক্ত নন। একজন বিচারক জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধে জড়িয়ে পড়লে তার পৈত্রিক সম্পত্তি রক্ষার জন্য সুবিচার প্রাপ্তির প্রত্যাশায় নীতিবান ও আদর্শ বিচারককে কখনও অনুরোধ করে থাকলে তাকে বিফল হতে হয় না। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয় তখন, যখন একজন বিচারক নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন। এরূপ বিচারক অবৈধ অর্থের মোহে সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্রে আইনকানুনের থোড়াই তোয়াক্কা করেন।
এদের কাছে কোনো সহকর্মী বিচারক সঙ্গত
অনুরোধ করলে তাদের বলতে শোনা যায়, এটি বিচার বিভাগ, এখানে বিচারকদের কোনো ধরনের অনুরোধ করা যায় না।
যে কোনো সমাজের অবক্ষয় হলে তা সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে স্পর্শ করে। মানুষকে আল্লাহপাক যে বুদ্ধি-বিবেক দিয়েছেন তা অন্য কোনো প্রাণীকে দেননি। তাই জন্মগতভাবে একটি প্রাণীর ক্ষেত্রে যা সহজাত, তা মানুষরূপী প্রাণীর ক্ষেত্রে নয়। কাক কাকের মাংস খায় না- এটি জন্মগত সহজাত গুণ হিসেবে চির সত্য। পৃথিবীতে যতদিন কাকের অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন এ সত্যের অন্যথা হবে না। কিন্তু আমাদের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে যারা স্বজাতির ব্যথায় সমব্যথী বা সহমর্মী নন, বরং অন্যায় বা অনৈতিকভাবে প্রাপ্তির যোগ না থাকায় মুখ ফিরিয়ে নেন, ‘কাক কাকের মাংস খায় না’- এ প্রবাদটি তাদের ক্ষেত্রে সত্য নয়, এমনটি বলা যাবে কি? আর বলা না গেলে বলতে বাধা কোথায়- কাক এখন কাকের মাংস খায়!
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
No comments