থেরাফিল্ম- চোর বটে! by মাহফুজুর রহমান
রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে শুরু করতে যাচ্ছিলাম।
তওবা কেটে অন্য নাম খুঁজলাম। পেয়েও গেলাম- হুমায়ূন আহমেদ। উদাহরণ হিসেবে
টানছি তার নাম। নন্দিত এই কথাসাহিত্যিকের এমন কোনো উপন্যাস কি আছে যার গোটা
একটা অধ্যায় অন্য লেখকের লেখা থেকে মেরে দেয়া? তার এমন কোনো গল্প কি আছে
যার একটা অনুচ্ছেদ অন্য কোনো লেখকের লেখার অনুকরণ? পাঠক বলবেন, অসম্ভব।
হুমায়ূন আহমেদের লেখার প্রভাব আছে এমন লেখক ঢাকায় এখন কতজন? পাঠক বলবেন,
অনেক। তার লেখা হুবহু একটা প্যারা বইয়ের ভেতরে তুলে দিয়েছেন এমন কোনো
জীবিত-মৃত-বিবাহিত-অবিবাহিত কোনো লেখক কি আছেন বাংলা সাহিত্যে? পাঠক বলবেন,
অসম্ভব। আমিও বলি তাই- অসম্ভব। আর অসম্ভবকে সম্ভব করা কার কাজ? হ্যাঁ,
ঠিকই বলেছেন প্রিয় পাঠক, অসম্ভবকে সম্ভব করাই অনন্ত জলিলের কাজ। তিনি এক
অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। এক লেখকের লেখায় অন্য লেখকের লেখা হুবহু তুলে দেয়ার
মতোই এক অসম্ভব কাণ্ড করেছেন। তিনি কাগজের বই লেখেন না বলে পর্দার ‘বই’য়ে
এই কাজটি করতে পেরেছেন। মাত্রাতিরিক্ত রকমের আলোচিত এই নায়ক প্লাস প্রযোজক
প্লাস পরিচালক তার হালের এক ছবিতে অন্য একটি ছবির দৃশ্য জুড়ে দিয়েছেন। না,
না, তিনি ‘নকল’ করেননি। ‘চুরি’ করেননি। ‘অনুকরণ’ করেননি। ‘প্রভাবিত’ও হননি।
ওসব হলে মাইন্ড খেতাম না। ঢাকাই ছবিতে চুরি-ধারি, মারিং-কাটিং ডালভাত। ওসব
আকছার হচ্ছে। টেলিকম কোম্পানির ডায়লগ শোনেন না- ‘নতুন কিছু করো’। নতুন
কিছুই করেছেন অনন্ত। সরাসরি একটি ছবির দৃশ্য নিজের ছবিতে লাগিয়ে দিয়েছেন।
ছবির নাম ‘ মোষ্ট ওয়েলকাম টু’। এ ছবির একাধিক দৃশ্য একটি তামিল ছবি থেকে
নেয়া। ওই ছবির নাম ‘সাত আইয়ুম’, বাংলায় যার মানে হচ্ছে সপ্তম ইন্দ্রিয়।
নিজের সপ্তম ইন্দ্রিয় খাটিয়ে অনন্ত নতুন ধারার এই চুরির রাস্তা বের করেছেন।
তবে এটি চুরি হলেও ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য পরম মঙ্গল বয়ে আনবে। অনন্ত ফিল্মে এসেই যেমনটি বলেছিলেন- ‘বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেছেন আর আমি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে পাল্টে দেবো’- তার সেই কথাই এবার কাজে প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। অনন্ত উদ্ভাবিত এই পদ্ধতিতে আপনি আপনার ছবির শুটিংয়ের খরচ অনেক কমিয়ে আনতে পারবেন। ধরুন, আপনার ছবির এক দৃশ্যে নায়ক পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়বে। আপনার ট্যাকের জোর যা তা। নায়িকার লাঞ্চের পয়সা দিতে দিতেই ফতুর হওয়ার জোগাড়। আপনি কোনো বিদেশী ছবিতে নায়কের লাফিয়ে পড়ার দৃশ্য আপনার ছবিতে জুড়ে দিন। এডিটিংয়ের সময় কারসাজি করে এই কাজটি করুন। একইভাবে নায়কের উঁচু বিল্ডিং থেকে লাফিয়ে পড়ার দৃশ্য, তুষারপাতের মধ্যে নায়ক-নায়িকার গানের দৃশ্য, মরুভুমিতে ভিলেনের দলবল নিয়ে ছোটার দৃশ্যসহ বাংলা ছবির যাবতীয় অসম্ভবকে এডিটিং টেবিলে বসে সম্ভব করুন অনন্ত উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে। দর্শক নিয়ে চিন্তা করবেন না। ওরা বোকার হদ্দ। ব্ল্যাকে টিকিট কেটে আপনার ছবি দেখবে। আর কোন তামিল-তেলেগু-কন্নড় ছবি থেকে আপনি দৃশ্য মারছেন তা ওরা ধরবে কী করে! গোটা ছবি মারলেই ধরতে পারছে না আর কিছু দৃশ্য মারা ধরবে কোন গুপ্ত বিদ্যায়? ‘মোষ্ট ওয়েলকাম’ যে তামিল ‘কন্থসামি’ ছবির নকল সেটা কি দর্শক বের করতে পেরেছিল? সেন্সর বোর্ডের চোখেই ধরা পড়েনি তা আবার দর্শকের চোখে ধরা পড়বে! ‘মোষ্ট ওয়েলকাম’ সেন্সর বোর্ড ছেড়ে দিয়েছে বলেই না অনন্ত অমন যুগান্তকারী একটা চুরির রাস্তা ‘মোষ্ট ওয়েলকাম টু’তে আবিষ্কার করতে পেরেছেন। ‘মোষ্ট ওয়েলকাম’-এ আটকে দিলে তো আজ আর ন্যাড়া দ্বিতীয়বার বেলতলায় যেত না। আর না গেলে অন্য প্রযোজকরা পুকুরচুরি কী জিনিস সেটা জানতেই পারতো না। এবার তারা জেনেছেন, নয়া বিদ্যা কাজে লাগাবেন বটে। বাংলা চলচ্চিত্রের হলুদ আনতে মরিচ ফুরোয় অবস্থা। ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে। কে না জানে টিকে থাকাই চরম সার্থকতা। টিকে থাকতে গেলে একটু-আধটু দুই নম্বুরী করতেই হবে। সিনেমা হলে দর্শকের ঢল নামাতে গেলে খানিক জল ঘোলা করতেই হবে। এজন্যই বাংলা চলচ্চিত্রের ধমনীতে নতুন রক্ত সরবরাহের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন অনন্ত। হোক সে রক্ত এইডস রোগীর, তবু সে রক্ত চলচ্চিত্রের শিরা-উপশিরায় বইবেই। তাতে বাংলা চলচ্চিত্র মরলেও লোকে বলবে ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিয়াছে সূচাগ্রমেদিনী’।
No comments