করাতকল শ্রমিকেরা অসন্তুষ্ট by শুভংকর কর্মকার

নিম্নতম মজুরি নিয়ে করাতকল শ্রমিকদের অসন্তুষ্টিই রয়ে গেল। তাঁদের দাবি করা মাসিক সাড়ে ২৬ হাজার টাকার বিপরীতে ছয় হাজার ৮৫০ টাকা নিম্নতম মজুরি চূড়ান্ত হয়েছে। অবশ্য এই মজুরিই আবার গ্রামাঞ্চলের করাতকলের জন্য বেশি হয়েছে বলে দাবি মালিকপক্ষের। করাতকলের শ্রমিক ও কর্মচারীদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে। সে অনুযায়ী করাতকলের শ্রমিক ও কর্মচারীদের (অদক্ষ, গ্রেড-৪) নিম্নতম মাসিক মজুরি হবে ছয় হাজার ৮৫০ টাকা। দৈনিক হিসাবে এটি দাঁড়াবে ২৬০ টাকা। মাসিক মোট মজুরির মধ্যে মূল মজুরি সাড়ে চার হাজার, বাড়ি ভাড়া (মূল মজুরির ৩০ শতাংশ), যাতায়াত ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা করে। তবে শিক্ষানবিস শ্রমিক-কর্মচারীর মজুরি হবে সব মিলিয়ে সাড়ে চার হাজার টাকা।
‘নিম্নতম মজুরি বোর্ড’-এর সুপারিশ অনুযায়ী এই প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়েছে। তার আগে বোর্ডের চেয়ারম্যান শহীদুল্লাহ বকাউল বোর্ডের বাকি পাঁচ সদস্যকে নিয়ে একাধিক বৈঠক করেন। ঢাকার বাইরে একাধিক জেলায় কমিটির সদস্যরা করাতকল পরিদর্শনও করেন। গত ২৯ এপ্রিল নিম্নতম মজুরি হারের খসড়া সুপারিশ প্রকাশ হয়। সুপারিশে নিম্নতম মজুরি ছিল ছয় হাজার ৪০০ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি চার হাজার টাকা।
জানা যায়, গত মাসের শুরুর দিকে বোর্ডের সর্বশেষ বৈঠকে নতুন মজুরিকাঠামো চূড়ান্ত করা হয়। এতে শেষ পর্যন্ত মালিকপক্ষ সব মিলিয়ে খসড়া সুপারিশের চেয়ে ৪০০ টাকা বৃদ্ধি করতে রাজি হন। তবে তা সন্তোষজনক না হওয়ায় বোর্ডের শ্রমিক প্রতিনিধি ও ঢাকা স মিলস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আলী আকবর হাওলাদার চূড়ান্ত সুপারিশে স্বাক্ষর দানে বিরত থাকেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আলী আকবর অভিযোগ করে বলেন, ‘মালিকপক্ষ একতরফাভাবে এটি করেছেন। আমি একমত না হওয়ায় স্বাক্ষর করি নাই। বর্তমানে করাতকল শ্রমিকেরা এমনিতেই ছয় থেকে সাত হাজার টাকা পান। নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে শ্রমিকদের অবস্থার যদি কোনো উন্নতিই না হয় তবে এর যৌক্তিকতা নাই।’ তিনি প্রথম আলোকে আরও বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত আমরা মূল মজুরি ছয় হাজার টাকা করার দাবি করেছিলাম। কিন্তু মালিকপক্ষ সেটি মানেনি।’
শ্রমিক প্রতিনিধি স্বাক্ষর না করলেও অন্য চার সদস্য প্রস্তাব সমর্থন করায় এটি গৃহীত হয় বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে বোর্ডের মালিকপক্ষের প্রতিনিধি ও ঢাকা উত্তর করাতকল মালিক সমিতির সভাপতি মো. লিয়াকত আলী খান দাবি করে বলেন, বর্তমানে অদক্ষ শ্রমিক পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা মজুরি পান। আর দক্ষ শ্রমিকেরা পান ১০ থেকে ১৩ হাজার। সে হিসেবে শ্রমিকদের উন্নতি হয়নি, এটি সত্য নয়।

>>করাতকল শ্রমিক
অবশ্য মালিকপক্ষের এই প্রতিনিধির বক্তব্য বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, অদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি বাড়লেও দক্ষদের তা কমে গেছে। কারণ নতুন মজুরিকাঠামো অনুযায়ী, মিস্ত্রি ও অপারেটর পদের দক্ষ শ্রমিকদের (গ্রেড-১) মাসিক মোট মজুরি ১১ হাজার ৯৮৫ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি আট হাজার ৪৫০। আর এই শ্রমিকদের মজুরি দৈনিক হিসেবে ৪৬০ টাকা।
এ ছাড়া সহকারী মিস্ত্রি ও অপারেটরদের (গ্রেড-২) দৈনিক মজুরি ৩৬০ টাকা। মাসিক মূল মজুরি ছয় হাজার ৫০০ টাকা। তাঁদের মোট মজুরি হবে নয় হাজার ৪৫০ টাকা। পুলার (টানোয়া) শ্রমিকদের (গ্রেড-৩) মোট মাসিক মজুরি দাঁড়াবে আট হাজার ২০ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি পাঁচ হাজার ৪০০ টাকা। আর দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা।
এ বিষয়ে লিয়াকত আলী বলেন, নতুন মজুরি হার নিয়ে মালিকদের মধ্যে ভিন্নমত আছে। তবে গ্রামাঞ্চলের করাতকলের জন্য নিম্নতম মজুরি বেশি হয়েছে। কারণ শহরের চেয়ে গ্রামে আয় কম।
এই মজুরি দিয়ে করাতকল শ্রমিকেরা জীবন ধারণ করতে পারবেন কি না, জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রশ্নই আসে না। আর করাতকল শ্রমিকেরা অন্য যেকোনো খাতের চেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে কাজ করেন। তবে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণে এটি বিবেচনাতেই আনা হয়নি। এ ছাড়া করাতকলে শ্রমিকেরা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেন। বছরের অনেক সময়ই তাঁদের কাজ থাকে না। ফলে এই নিম্নমত মজুরি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ সুলতান বলেন, জাতীয় নিম্নতম মজুরি মানদণ্ড না থাকায় প্রান্তিক শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ১৯৯৬ সালে সরকার একবার এটি করার উদ্যোগ নিলেও মালিকদের বাধার কারণে হয়নি। আর এটি না হওয়ার কারণে তৈরি পোশাকশিল্পের মজুরি পরোক্ষভাবে মানদণ্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এই শিল্পের নিম্নতম মজুরি পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা।
করাতকল খাতে নতুন মজুরিকাঠামো
পদবিন্যাস মূল মজুরি বাড়িভাড়া চিকিৎসা ও মাসিক মোট
শ্রমিক (মূল মজুরির ৩০%) যাতায়াত ভাতা (টাকায়)
গ্রেড-১ ৮,৪৫০ ২,৫৩৫ ১,০০০ ১১,৯৮৫
গ্রেড-২ ৬,৫০০ ১,৯৫০ ১,০০০ ৯,৪৫০
গ্রেড-৩ ৫,৪০০ ১,৬২০ ১,০০০ ৮,০২০
গ্রেড-৪ ৪,৫০০ ১,৩৫০ ১,০০০ ৬,৮৫০
কর্মচারী
গ্রেড-১ ৬,৫০০ ১,৯৫০ ১,০০০ ৯,৪৫০
গ্রেড-২ ৫,৪০০ ১,৬২০ ১,০০০ ৮,০২০
গ্রেড-৩ ৪,৫০০ ১,৩৫০ ১,০০০ ৬,৮৫০
শিক্ষানবিশ শ্রমিক ও কর্মচারীর মাসিক মজুরি সাকল্যে ৪,৫০০ টাকা
শ্রমিকদের পদবিন্যাস n গ্রেড-১: মিস্ত্রি বা অপারেটর; গ্রেড-২: সহকারী মিস্ত্রি বা সহকারী অপারেটর; গ্রেড-৩: পুলার (টানোয়া); গ্রেড-৪: হেলপার ও অন্যান্য শ্রমিক
কর্মচারীদের পদবিন্যাস n গ্রেড-১: হিসাবরক্ষক, স্টোরকিপার, টাইমকিপার, টাইপিস্ট ও ক্লার্ক; গ্রেড-২: সহকারী হিসাবরক্ষক, স্টোর অ্যাসিস্ট্যান্ট কিপার, টেলিফোন অপারেটর, সেলসম্যান, ড্রাইভার ও ক্যাশিয়ার; গ্রেড-৩: পিয়ন, দারোয়ান, মালি, নাইট গার্ড ও সুইপার

No comments

Powered by Blogger.