পল্লী বিদ্যুতে লুটপাট by মুজিব মাসুদ
লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে পল্লী
বিদ্যুতায়ন বোর্ডের ৭২টি সমিতি (পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-পবিস)। কেনাকাটা,
বিদ্যুৎ চুরি, বৈধ-অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ, লোড বৃদ্ধিসহ নানা কাজে চলছে
লুটপাট। সমিতির জেনারেল ম্যানেজার, ডিজিএম, চার শাখার এজিএম, ইসি
(এনফোর্সমেন্ট কো-অর্ডিনেটর) থেকে শুরু করে প্রায় সব পর্যায়ের অসাধু
কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আর এদের
নানাভাবে সহযোগিতা করছে আরইবির (পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড) কতিপয় শীর্ষ
কর্মকর্তা। অভিযোগ আছে, অবৈধ মাসোয়ারা বাণিজ্যের জন্য আরইবি থেকে
সমিতিগুলোতে মাসিক টার্গেট দেয়া হয়। আর এই টার্গেট পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে
সমিতির সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পবিসের
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম-দুর্নীতি আর লুটপাটের খেসারত দিতে হচ্ছে
গ্রামের সাধারণ গ্রাহকদের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে পবিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অন্তত ৫০ হাজারের বেশি লিখিত অভিযোগ আরইবিতে জমা আছে। কিন্তু আরইবিরই একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের প্রভাবে এসব অভিযোগ হিমঘরে আটকে আছে। লুটপাট আর অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে পবিসের অন্তত ২০ জন জেনারেল ম্যানেজার নামে-বেনামে শতকোটি টাকার মালিক। দুর্নীতির অভিযোগে বেশ কজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বহিষ্কার, ডিমোশন ও বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হলেও অনিয়ম থেমে নেই।
সমিতিগুলোর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, প্রতিটি বৈধ সংযোগ নিতে গ্রাহকদের গড়ে ৫০ থেকে ১ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে। এছাড়া লোড বৃদ্ধির জন্যও মোটা অংকের টাকা ঘুষ লাগে। ঘুষের বিনিময়ে নানা জটিলতা সত্ত্বেও মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সংযোগ দেয়া হয়। জানা গেছে, ঘুষ না দেয়ায় সারা দেশে কমপক্ষে ১ হাজারের বেশি আবেদনকারী আছেন যাদের আবেদন ৬-৭ বছর ধরে সমিতিগুলোতে পড়ে আছে। নানা আইন-কানুনের অজুহাতে এসব আবেদন ফেলে রাখা হচ্ছে। আর কেনাকাটা নিয়ে সমিতিগুলোতে হচ্ছে হরিলুট। অভিযোগ- এ ক্ষেত্রে পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দিয়ে সমিতির দুর্নীতিবাজরা মাসোয়ারা বাণিজ্য করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে আরইবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মঈন উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে আরইবির প্রেস কনসালটেন্ট তালুকদার রুমী যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেয়ার পর আরইবিসহ সমিতিগুলোতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। তিনি শতভাগ সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। কোথাও কোনো অনিয়ম দেখলেই ব্যবস্থা নিচ্ছেন। সমিতিগুলোর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। ইতিমধ্যে দুর্নীতি বন্ধে সমিতির সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সেমিনার ডেকে শপথ করিয়েছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লিফলেট-পোস্টার ছাপিয়ে সেগুলো বণ্টন করছেন।
মালামাল ক্রয়ে দুর্নীতি ও অর্থের অপচয় : নিজস্ব অর্থায়নে প্রতি বছর সমিতিগুলো গড়ে শতকোটি টাকার বেশি বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ক্রয় করে আসছে। এসব ক্রয়ে দরপত্রের কারিগরি, বাণিজ্যিক ও আর্থিক মূল্যায়নে আরইবির নির্দেশনা মানা বাধ্যতামূলক হলেও কেউ মানছে না। নিয়ম অনুযায়ী যে কোনো মালামাল ক্রয়ে আরইবির কোনো প্রকার আর্থিক সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও বাস্তবে আরইবির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সমিতিগুলো আরইবিকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না। আর নিজস্ব অর্থে মালামাল কেনার নামে সমিতিগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল আদায় করছে। এতে গ্রাহকরা একদিকে বিদ্যুৎ পাচ্ছে না, অপরদিকে নানা ভৌতিক বিলে আটকা পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন। নিয়ম হল বিদ্যুৎ গ্রাহকরাই সংশ্লিষ্ট সমিতির মালিক এবং সমিতির সব কার্যক্রমের জন্য সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিদ্যুৎ গ্রাহক তথা মালিকদের কাছে দায়বদ্ধ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে গ্রাহকদের কাছে সমিতি প্রশাসনের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। স্থানীয়দের অভিযোগ তাদের কষ্টার্জিত অর্থে সমিতিগুলো কোটি কোটি টাকা অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করে চলছে। আর এসব কাজে তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই।
বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের এসিআর ও রিক্লোজার ক্রয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি : উপকেন্দ্রের জন্য এসিআর ও রিক্লোজার কেনার ক্ষেত্রে সমিতিগুলোতে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে। এক্ষেত্রে পছন্দের কোম্পানিগুলোকে কাজ দেয়ার জন্য এরা কোনো নিয়মনীতি পর্যন্ত মানছে না। অধিকাংশ কেনাকাটায় কোটি কোটি টাকা আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং হচ্ছে। ২৪ জুন ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি মোট ১৯৬টি রিক্লোজার কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করে। এতে ৪টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এর মধ্যে কোরিয়ান কোম্পানি মেসার্স সিংসাং ইলেকক্ট্রিকের ‘রিক্লোজার’ সর্বনিু হয়। তাদের দর ছিল প্রতিটি ৯.৬৬ লাখ টাকা হিসাবে সর্বমোট ৮ কোটি ৯৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। আরইবি এর আগেও এই কোম্পানির রিক্লোজার কিনে ব্যবহার করে আসছে। অভিযোগ, এবার দরপত্র মূল্যায়নে আরইবির উচ্চ পর্যায়ের একটি সিন্ডিকেট সংশ্লিষ্ট সমিতির মাধ্যমে রহস্যজনকভাবে সিংসাং ইলেকট্রিককে নন-রেসপন্সিভ করে। আর উচ্চ মূল্যে মেসার্স প্রিন্স কর্পোরেশন থেকে মালামাল কেনার সুপারিশ বোর্ডে পাঠায়। জানা গেছে, ওই দরপত্রে মেসার্স প্রিন্স কর্পোরেশন প্রতিটি রিক্লোজারের দাম ১০ লাখ টাকা প্রস্তাব করে। এক্ষেত্রে মেসার্স সিংসাংয়ের তুলনায় প্রতিটি রিক্লোজারের দাম ৩৪ হাজার টাকা বেশি পড়েছে। এই হিসাবে ১৯৬টি রিক্লোজার কেনায় ৬৬ লাখ ৬৪ হাজার টাকা বেশি ব্যয় হবে। কিন্তু সিন্ডিকেট কমিশন বাণিজ্যের জন্য ওই কোম্পানিকে রেসপন্সিভ করে তাদের কার্যাদেশ দেয়ার চক্রান্ত করছে।
আরইবিরই একজন কর্মকর্তা জানান, সংশ্লিষ্ট সমিতি এবার এমন একটি কোম্পানিকে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও রিক্লোজার ক্রয়ের জন্য কার্যাদেশ দিচ্ছে ওই কোম্পানির মালিক জামায়াত-বিএনপির বড় ডোনার। নিয়মিতভাবে জামায়াত ও বিএনপিকে চাঁদা দেয়। অভিযোগ, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়, মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের অর্থায়নে বাংলাদেশে মৌলবাদী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে ওই কোম্পানির মালিককে লিবিয়া থেকে ফেরার পথে বিমানবন্দরেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই কোম্পানি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কতিপয় শীর্ষ মহলের যোগসাজশে দীর্ঘদিন যাবৎ চায়নায় তৈরি নিুমানের রিক্লোজার সরবরাহ করে আসছে। তাদের সরবরাহকৃত রিক্লোজারের মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ মালামাল বর্তমানে নষ্ট হয়ে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে বিভিন্ন সমিতির গোডাউনে। তারপরও সংশ্লিষ্ট পবিস ওই কোম্পানির কাছ থেকে নিুমানের মালামাল ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
সম্প্রতি জাপানি সাহায্য সংস্থা জাইকা ফান্ডের মাধ্যমে প্রকল্পের আওতায় ১৯৭টি রিক্লোজার মেসার্স প্রিন্স কর্পোরেশনের কাছ থেকে ক্রয় করে মাঠ পর্যায়ে বসিয়েও নির্ধারিত মিটার রিডিং পাচ্ছে না। বর্তমানে এগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সম্প্রতি খুলনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ১১৩টি রিক্লোজার ক্রয়ের জন্য ১৪ অক্টোবর দরপত্র আহ্বান করে। ওই দরপত্রেও মেসার্স প্রিন্স করপোরেশন প্রতিটি রিক্লোজারের দাম ৮ লাখ ২৯ হাজার টাকা উল্লেখ করে। এই দাম ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর সুপারিশকৃত মূল্যের চেয়ে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা কম। অর্থাৎ ঢাকা পবিস-১ এর জন্য প্রতিটি রিক্লোজার ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা অতিরিক্ত দাম প্রস্তাব করা হয়। অর্থাৎ ১৭ শতাংশ উচ্চ মূল্যে সর্বমোট ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা বেশিতে চক্রটি ১৯৬টি রিক্লোজার ক্রয়ের সুপারিশ করে।
কিন্তু অভিযোগ, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে ১.৮ মিলিয়ন গ্রাহক সংযোগ প্রকল্পে কোরিয়ান কোম্পানি সিংসাং ইলেকট্রিক ১৪০টি রিক্লোজার সরবরাহের জন্য দরপত্র দাখিল করে। দরপত্রে প্রতিটি রিক্লোজারের মূল্য ৮ লাখ ৪৪ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়। এতে সিংসাং সর্বনিু দরদাতা হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্ত মূল্যায়ন কমিটি প্রতিষ্ঠানকে কারিগরিভাবে নন-রেসপন্সিভ ঘোষণা করে। অভিযোগ রয়েছে, দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় দরদাতার মধ্যে সর্বোচ্চ অবৈধ সুবিধা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে তারা ক্রয়াদেশ প্রদানের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে বলে জানা গেছে। এদিকে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ১.৮ মিলিয়ন গ্রাহক সংযোগ প্রকল্পে কন্ডাক্টর ও ট্রান্সফরমার এবং ফেনী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির তিন-ফেজ মিটারের দরপত্রে উল্লেখিত মূল্য মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ৪ থেকে ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় পুনঃদরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দরপত্রে উদ্ধৃত মূল্য খুলনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দরপত্রে উদ্ধৃত মূল্যের চেয়ে ১৭ শতাংশের বেশি হওয়া সত্ত্বেও তা ক্রয় করছে। এই ক্রয় বাণিজ্যে ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের উচ্চ পর্যায়ের কতিপয় কর্মকর্তা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
১২ লাখ টাকা সরকারি ফি দিয়েও ৩ বছরে সংযোগ মেলেনি : আরইবির সমিতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সমিতি হচ্ছে ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২। কাঁঠালী ভালুকা বাণিজ্যিক এলাকায় সমিতির অবস্থান হওয়ায় এর বেশির ভাগ গ্রাহকই বাণিজ্যিক। এ কারণে এই সমিতির আওতায় প্রতিটি সংযোগ নিতে গ্রাহককে সরকারি ফি ছাড়াও গড়ে ৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হচ্ছে। ঘুষ ছাড়া এই সমিতিতে কোনো সংযোগ হয় না। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সুপারিশ এমনকি মন্ত্রী-এমপি, আরইবি চেয়ারম্যান কিংবা প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার সুপারিশ পর্যন্ত পাত্তা দেয় না সমিতির কর্তাব্যক্তিরা। ঘুষ ছাড়া কোনো আবেদন এলে সেটা ছুড়ে ফেলে দেন। চরম দুর্ব্যবাহার করেন গ্রাহকের সঙ্গে। নানা অজুহাত যেমন ফিডার ওভারলোডেড, ট্রান্সফরমার নষ্ট, লাইন নেই, লাইন টানায় বাধাসহ নানা যুক্তি তুলে ধরে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে ম্যানেজ করে ফেলেন। আর ঘুষ দিলে জেনারেল খোদ ম্যানেজার নিজে সরেজমিন উপস্থিত থেকে সংযোগ দেন। প্রয়োজনে ১০ কিলোমিটার দূর থেকে লাইন টেনে, নতুন ফিডার থেকে সাবস্টেশন বানিয়ে সংযোগ দিচ্ছে। এতে কারও বাধা দেয়ার ক্ষমতা নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু বৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েই এই সমিতি মাসে কোটি টাকার ওপরে উপরি আয় করছে। এ কারণে এই সমিতির পিয়ন থেকে জেনারেল ম্যানেজার পর্যন্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মোটা অংকের টাকা লেনদেন করে পোস্টিং নিতে হয় এখানে। যার কারণে যোগদানের পর থেকে বেপরোয়া হয়ে ওঠে এই সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালের ২৩ জুন আবেদন করেও শেখ মোহাম্মদ আবদুল ওয়াদুদ নামে একজন ব্যবসায়ী এখনও সংযোগ পাননি। এরই মধ্যে তিনি সংযোগ ফি, লাইন নির্মাণ ফিসহ ১২ লাখ টাকার বেশি অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দিয়েছেন। গ্রাহকের নামে ডিমান্ড নোট (চাহিদাপত্র) ইস্যু করা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ, ঘুষ না দেয়ায় সমিতির জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট এখনও ওই ব্যবসায়ীকে বিদ্যুৎ সংযোগ দেননি। বিদ্যুৎ না পেয়ে তিনি এখন প্রতি মাসে মোটা অংকের টাকা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন। বিষয়টি একাধিকবার লিখিতভাবে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মঈন উদ্দিনকে জানিয়েও কোনো ফল পাননি তিনি। আরইবির একটি সূত্রে জানা গেছে, গ্রাহকের চিঠি পেয়ে আরইবি চেয়ারম্যান দ্রুত সংযোগ দেয়ার জন্য জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলমকে নির্দেশ দিলেও ঘুষ না দেয়ায় সে অর্ডারও আমলে নেননি তিনি।
জানা গেছে, এই সংযোগের জন্য এমকাবা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ আবদুল ওয়াদুদ ৫ হাজার টাকা সমীক্ষা ফি জমা দেন ২০১২ সালের ২৪ জুন। গ্রাহকের লোড চাহিদা ছিল ১৫০ কিলোওয়াট। কিন্তু প্রায় দেড় বছর সময় লাগে আবেদনকারীর বিপরীতে ডিমান্ড নোট ইস্যু করতে। চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি গ্রাহক চাহিদাপত্রের বিপরীতে ১১ লাখ ২৪ হাজার ৫৭২ টাকা সরকারি ফি জমা দেন। নিয়ম অনুযায়ী ডিমান্ড নোট ইস্যুর এক সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। কিন্তু সরকারি ফি জমা দেয়ার পরও ঘুষ না দেয়ায় জাহাঙ্গীর আলম নানাভাবে টালবাহানা শুরু করেন। প্রথমে ফিডার ওভারলোডেড হওয়ার মিথ্যা তথ্য দিয়ে ডিমান্ড নোট করা থেকে বিরত থাকেন। অন্য ফিডার থেকে লাইন টেনে সংযোগ দেয়ার কথা বলে আরও ৬০ হাজার টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দিতে বলেন। এরপর গ্রাহক গত ২০ আগস্ট এই টাকা জমা দেন। কিন্তু টাকা জমা দেয়ার পর জাহাঙ্গীর আলম আবার বেঁকে বসেন। বলেন, জনৈক ব্যক্তির বাধার কারণে নতুন লাইন নির্মাণ করা সম্ভব নয়। নিয়ম অনুযায়ী সংযোগকালে কোনো ব্যক্তি যদি বাধা দেয় তাহলে প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে লাইন নির্মাণ করতে হবে। অভিযোগ রয়েছে, মূলত ঘুষ না দেয়ায় এটা জাহাঙ্গীর আলমের এক ধরনের টালবাহানা। এখন তিনি বলছেন, রুট পরিবর্তন করে এই সংযোগ দিতে হবে। এজন্য আবার সরকারি ফি দিতে হবে। স্থানীয় সমিতির একজন কর্মকর্তা বলেন, জিএমকে ঘুষ না দিলে বছরের পর বছর কেটে গেলেও ওই গ্রাহক সংযোগ পাবে না। কারণ ঘুষের এই টাকার ভাগ যাচ্ছে আরইবির সব শীর্ষ টেবিলে।
ভোল্টেজ রেগুলেটর ক্রয়ে দুর্নীতি : পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমে বিদ্যুৎ উপকেন্দ ও বৈদ্যুতিক লাইনে ব্যবহৃত বিভিন্ন আকারের অটোমেটিক ভোল্টেজ রেগুলেটর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সরঞ্জাম। এই সুযোগে নামে-বেনামে সমিতিগুলো প্রতিনিয়ত উচ্চ মূল্যে ভোল্টেজ রেগুলেটর ক্রয় করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ ধরনের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম দেশে উৎপাদন না হওয়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ১শ’ থেকে ২শ’ গুণ বেশি দামেও মালামাল ক্রয় করে গ্রাহকের টাকা লোপাট করছে। সম্প্রতি ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ক্রয় নীতিমালা ও পবিসের সব নিয়ম-কানুন লঙ্ঘন করে সর্বনিু দরদাতার কাছ থেকে ভোল্টেজ রেগুলেটর না নিয়ে তাদের পছন্দের কোম্পানি প্রিন্স কর্পোরেশনের কাছ থেকে ৫৬টি ভোল্টেজ রেগুলেটর কিনতে যাচ্ছে। ভোল্টেজ রেগুলেটরের প্রতিটি ২৩ লাখ ৯৮ হাজার টাকা দামে কেনার সুপারিশ করছে সমিতি। জানা গেছে, এক্ষেত্রেও বড় ধরনের আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং হয়েছে। অভিযোগ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের এই সিন্ডিকেট বাণিজ্যের সঙ্গে এখন সরাসরি সম্পৃক্ত গ্লোবাল মার্কেটিং সার্ভিসেস এবং প্রিন্স কর্পোরেশন। জানা গেছে, ঢাকা পবিস সম্প্রতি গ্লোবাল মার্কেটিং সার্ভিসেস এবং প্রিন্স কর্পোরেশনকে প্রতিটি ভোল্টেজ রেগুলেটর যথাক্রমে ২৩ লাখ ৮৮ হাজার এবং ২৩ লাখ ৯৮ হাজার টাকা করে দেয়ার জন্য সবকিছু চূড়ান্ত করেছে। সিন্ডিকেট এখানে ইচ্ছা করে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০ হাজার টাকা দর পার্থক্য করেছে। যদিও মাত্র দুই মাস আগে ১.৮ মিলিয়ন প্রকল্পের দরপত্রে মেসার্স গ্লোবাল মার্কেটিং এবং প্রিন্স কর্পোরেশন প্রতিটি ভোল্টেজ রেগুলেটর দিয়েছিল ১৬ লাখ ৯৯ হাজার এবং ২২ লাখ ৪০ হাজার টাকায়। কিন্তু এই দরে কার্যাদেশ নিলে সিন্ডিকেট আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবে না বলে পরে সাড়ে আট কোটি টাকা মূল্যে দ্বিতীয় দরদাতা প্রিন্স কর্পোরেশনকে কার্যাদেশ প্রদানের সুপারিশ করে।
মিটার ক্রয়ে দুর্নীতি : গত ৩-৪ বছর ধরে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সিঙ্গেল ফেইজ মিটার কেনা নিয়েও নানা অনিয়ম করে আসছে। জানা গেছে, গোপনে বড় অংকের টাকা মাসোয়ারা নিয়ে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মিটার কেনা হচ্ছে। অভিযোগ, ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরইবির উচ্চ পর্যায়ের সম্পর্ক এতটাই গভীর যে, এই কেনাকাটায় গত ২-৩ বছর ধরে অন্য কোনো কোম্পানি অংশগ্রহণও করে না। সম্প্রতি একটি প্রতিষ্ঠানকে দু’বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরইবি। অথচ এ প্রতিষ্ঠানটি মিটার সরবরাহের বিভিন্ন দরপত্রে সর্বনিু দরদাতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে একাধিকবার। এই প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দেয়া হলে, ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের মনোপলি নষ্ট হবে বলে এ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে পবিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অন্তত ৫০ হাজারের বেশি লিখিত অভিযোগ আরইবিতে জমা আছে। কিন্তু আরইবিরই একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের প্রভাবে এসব অভিযোগ হিমঘরে আটকে আছে। লুটপাট আর অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে পবিসের অন্তত ২০ জন জেনারেল ম্যানেজার নামে-বেনামে শতকোটি টাকার মালিক। দুর্নীতির অভিযোগে বেশ কজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বহিষ্কার, ডিমোশন ও বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হলেও অনিয়ম থেমে নেই।
সমিতিগুলোর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, প্রতিটি বৈধ সংযোগ নিতে গ্রাহকদের গড়ে ৫০ থেকে ১ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে। এছাড়া লোড বৃদ্ধির জন্যও মোটা অংকের টাকা ঘুষ লাগে। ঘুষের বিনিময়ে নানা জটিলতা সত্ত্বেও মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সংযোগ দেয়া হয়। জানা গেছে, ঘুষ না দেয়ায় সারা দেশে কমপক্ষে ১ হাজারের বেশি আবেদনকারী আছেন যাদের আবেদন ৬-৭ বছর ধরে সমিতিগুলোতে পড়ে আছে। নানা আইন-কানুনের অজুহাতে এসব আবেদন ফেলে রাখা হচ্ছে। আর কেনাকাটা নিয়ে সমিতিগুলোতে হচ্ছে হরিলুট। অভিযোগ- এ ক্ষেত্রে পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দিয়ে সমিতির দুর্নীতিবাজরা মাসোয়ারা বাণিজ্য করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে আরইবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মঈন উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে আরইবির প্রেস কনসালটেন্ট তালুকদার রুমী যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেয়ার পর আরইবিসহ সমিতিগুলোতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। তিনি শতভাগ সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। কোথাও কোনো অনিয়ম দেখলেই ব্যবস্থা নিচ্ছেন। সমিতিগুলোর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। ইতিমধ্যে দুর্নীতি বন্ধে সমিতির সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সেমিনার ডেকে শপথ করিয়েছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লিফলেট-পোস্টার ছাপিয়ে সেগুলো বণ্টন করছেন।
মালামাল ক্রয়ে দুর্নীতি ও অর্থের অপচয় : নিজস্ব অর্থায়নে প্রতি বছর সমিতিগুলো গড়ে শতকোটি টাকার বেশি বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি ক্রয় করে আসছে। এসব ক্রয়ে দরপত্রের কারিগরি, বাণিজ্যিক ও আর্থিক মূল্যায়নে আরইবির নির্দেশনা মানা বাধ্যতামূলক হলেও কেউ মানছে না। নিয়ম অনুযায়ী যে কোনো মালামাল ক্রয়ে আরইবির কোনো প্রকার আর্থিক সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও বাস্তবে আরইবির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সমিতিগুলো আরইবিকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না। আর নিজস্ব অর্থে মালামাল কেনার নামে সমিতিগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল আদায় করছে। এতে গ্রাহকরা একদিকে বিদ্যুৎ পাচ্ছে না, অপরদিকে নানা ভৌতিক বিলে আটকা পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন। নিয়ম হল বিদ্যুৎ গ্রাহকরাই সংশ্লিষ্ট সমিতির মালিক এবং সমিতির সব কার্যক্রমের জন্য সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিদ্যুৎ গ্রাহক তথা মালিকদের কাছে দায়বদ্ধ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে গ্রাহকদের কাছে সমিতি প্রশাসনের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। স্থানীয়দের অভিযোগ তাদের কষ্টার্জিত অর্থে সমিতিগুলো কোটি কোটি টাকা অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করে চলছে। আর এসব কাজে তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই।
বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের এসিআর ও রিক্লোজার ক্রয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি : উপকেন্দ্রের জন্য এসিআর ও রিক্লোজার কেনার ক্ষেত্রে সমিতিগুলোতে বেশি দুর্নীতি হচ্ছে। এক্ষেত্রে পছন্দের কোম্পানিগুলোকে কাজ দেয়ার জন্য এরা কোনো নিয়মনীতি পর্যন্ত মানছে না। অধিকাংশ কেনাকাটায় কোটি কোটি টাকা আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং হচ্ছে। ২৪ জুন ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি মোট ১৯৬টি রিক্লোজার কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করে। এতে ৪টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এর মধ্যে কোরিয়ান কোম্পানি মেসার্স সিংসাং ইলেকক্ট্রিকের ‘রিক্লোজার’ সর্বনিু হয়। তাদের দর ছিল প্রতিটি ৯.৬৬ লাখ টাকা হিসাবে সর্বমোট ৮ কোটি ৯৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। আরইবি এর আগেও এই কোম্পানির রিক্লোজার কিনে ব্যবহার করে আসছে। অভিযোগ, এবার দরপত্র মূল্যায়নে আরইবির উচ্চ পর্যায়ের একটি সিন্ডিকেট সংশ্লিষ্ট সমিতির মাধ্যমে রহস্যজনকভাবে সিংসাং ইলেকট্রিককে নন-রেসপন্সিভ করে। আর উচ্চ মূল্যে মেসার্স প্রিন্স কর্পোরেশন থেকে মালামাল কেনার সুপারিশ বোর্ডে পাঠায়। জানা গেছে, ওই দরপত্রে মেসার্স প্রিন্স কর্পোরেশন প্রতিটি রিক্লোজারের দাম ১০ লাখ টাকা প্রস্তাব করে। এক্ষেত্রে মেসার্স সিংসাংয়ের তুলনায় প্রতিটি রিক্লোজারের দাম ৩৪ হাজার টাকা বেশি পড়েছে। এই হিসাবে ১৯৬টি রিক্লোজার কেনায় ৬৬ লাখ ৬৪ হাজার টাকা বেশি ব্যয় হবে। কিন্তু সিন্ডিকেট কমিশন বাণিজ্যের জন্য ওই কোম্পানিকে রেসপন্সিভ করে তাদের কার্যাদেশ দেয়ার চক্রান্ত করছে।
আরইবিরই একজন কর্মকর্তা জানান, সংশ্লিষ্ট সমিতি এবার এমন একটি কোম্পানিকে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও রিক্লোজার ক্রয়ের জন্য কার্যাদেশ দিচ্ছে ওই কোম্পানির মালিক জামায়াত-বিএনপির বড় ডোনার। নিয়মিতভাবে জামায়াত ও বিএনপিকে চাঁদা দেয়। অভিযোগ, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়, মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের অর্থায়নে বাংলাদেশে মৌলবাদী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে ওই কোম্পানির মালিককে লিবিয়া থেকে ফেরার পথে বিমানবন্দরেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই কোম্পানি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কতিপয় শীর্ষ মহলের যোগসাজশে দীর্ঘদিন যাবৎ চায়নায় তৈরি নিুমানের রিক্লোজার সরবরাহ করে আসছে। তাদের সরবরাহকৃত রিক্লোজারের মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ মালামাল বর্তমানে নষ্ট হয়ে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে বিভিন্ন সমিতির গোডাউনে। তারপরও সংশ্লিষ্ট পবিস ওই কোম্পানির কাছ থেকে নিুমানের মালামাল ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
সম্প্রতি জাপানি সাহায্য সংস্থা জাইকা ফান্ডের মাধ্যমে প্রকল্পের আওতায় ১৯৭টি রিক্লোজার মেসার্স প্রিন্স কর্পোরেশনের কাছ থেকে ক্রয় করে মাঠ পর্যায়ে বসিয়েও নির্ধারিত মিটার রিডিং পাচ্ছে না। বর্তমানে এগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সম্প্রতি খুলনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ১১৩টি রিক্লোজার ক্রয়ের জন্য ১৪ অক্টোবর দরপত্র আহ্বান করে। ওই দরপত্রেও মেসার্স প্রিন্স করপোরেশন প্রতিটি রিক্লোজারের দাম ৮ লাখ ২৯ হাজার টাকা উল্লেখ করে। এই দাম ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর সুপারিশকৃত মূল্যের চেয়ে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা কম। অর্থাৎ ঢাকা পবিস-১ এর জন্য প্রতিটি রিক্লোজার ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা অতিরিক্ত দাম প্রস্তাব করা হয়। অর্থাৎ ১৭ শতাংশ উচ্চ মূল্যে সর্বমোট ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা বেশিতে চক্রটি ১৯৬টি রিক্লোজার ক্রয়ের সুপারিশ করে।
কিন্তু অভিযোগ, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে ১.৮ মিলিয়ন গ্রাহক সংযোগ প্রকল্পে কোরিয়ান কোম্পানি সিংসাং ইলেকট্রিক ১৪০টি রিক্লোজার সরবরাহের জন্য দরপত্র দাখিল করে। দরপত্রে প্রতিটি রিক্লোজারের মূল্য ৮ লাখ ৪৪ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়। এতে সিংসাং সর্বনিু দরদাতা হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্ত মূল্যায়ন কমিটি প্রতিষ্ঠানকে কারিগরিভাবে নন-রেসপন্সিভ ঘোষণা করে। অভিযোগ রয়েছে, দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় দরদাতার মধ্যে সর্বোচ্চ অবৈধ সুবিধা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে তারা ক্রয়াদেশ প্রদানের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে বলে জানা গেছে। এদিকে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ১.৮ মিলিয়ন গ্রাহক সংযোগ প্রকল্পে কন্ডাক্টর ও ট্রান্সফরমার এবং ফেনী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির তিন-ফেজ মিটারের দরপত্রে উল্লেখিত মূল্য মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ৪ থেকে ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় পুনঃদরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দরপত্রে উদ্ধৃত মূল্য খুলনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দরপত্রে উদ্ধৃত মূল্যের চেয়ে ১৭ শতাংশের বেশি হওয়া সত্ত্বেও তা ক্রয় করছে। এই ক্রয় বাণিজ্যে ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এবং পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের উচ্চ পর্যায়ের কতিপয় কর্মকর্তা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
১২ লাখ টাকা সরকারি ফি দিয়েও ৩ বছরে সংযোগ মেলেনি : আরইবির সমিতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সমিতি হচ্ছে ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২। কাঁঠালী ভালুকা বাণিজ্যিক এলাকায় সমিতির অবস্থান হওয়ায় এর বেশির ভাগ গ্রাহকই বাণিজ্যিক। এ কারণে এই সমিতির আওতায় প্রতিটি সংযোগ নিতে গ্রাহককে সরকারি ফি ছাড়াও গড়ে ৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হচ্ছে। ঘুষ ছাড়া এই সমিতিতে কোনো সংযোগ হয় না। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সুপারিশ এমনকি মন্ত্রী-এমপি, আরইবি চেয়ারম্যান কিংবা প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার সুপারিশ পর্যন্ত পাত্তা দেয় না সমিতির কর্তাব্যক্তিরা। ঘুষ ছাড়া কোনো আবেদন এলে সেটা ছুড়ে ফেলে দেন। চরম দুর্ব্যবাহার করেন গ্রাহকের সঙ্গে। নানা অজুহাত যেমন ফিডার ওভারলোডেড, ট্রান্সফরমার নষ্ট, লাইন নেই, লাইন টানায় বাধাসহ নানা যুক্তি তুলে ধরে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে ম্যানেজ করে ফেলেন। আর ঘুষ দিলে জেনারেল খোদ ম্যানেজার নিজে সরেজমিন উপস্থিত থেকে সংযোগ দেন। প্রয়োজনে ১০ কিলোমিটার দূর থেকে লাইন টেনে, নতুন ফিডার থেকে সাবস্টেশন বানিয়ে সংযোগ দিচ্ছে। এতে কারও বাধা দেয়ার ক্ষমতা নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু বৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েই এই সমিতি মাসে কোটি টাকার ওপরে উপরি আয় করছে। এ কারণে এই সমিতির পিয়ন থেকে জেনারেল ম্যানেজার পর্যন্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মোটা অংকের টাকা লেনদেন করে পোস্টিং নিতে হয় এখানে। যার কারণে যোগদানের পর থেকে বেপরোয়া হয়ে ওঠে এই সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালের ২৩ জুন আবেদন করেও শেখ মোহাম্মদ আবদুল ওয়াদুদ নামে একজন ব্যবসায়ী এখনও সংযোগ পাননি। এরই মধ্যে তিনি সংযোগ ফি, লাইন নির্মাণ ফিসহ ১২ লাখ টাকার বেশি অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দিয়েছেন। গ্রাহকের নামে ডিমান্ড নোট (চাহিদাপত্র) ইস্যু করা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ, ঘুষ না দেয়ায় সমিতির জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট এখনও ওই ব্যবসায়ীকে বিদ্যুৎ সংযোগ দেননি। বিদ্যুৎ না পেয়ে তিনি এখন প্রতি মাসে মোটা অংকের টাকা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন। বিষয়টি একাধিকবার লিখিতভাবে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মঈন উদ্দিনকে জানিয়েও কোনো ফল পাননি তিনি। আরইবির একটি সূত্রে জানা গেছে, গ্রাহকের চিঠি পেয়ে আরইবি চেয়ারম্যান দ্রুত সংযোগ দেয়ার জন্য জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলমকে নির্দেশ দিলেও ঘুষ না দেয়ায় সে অর্ডারও আমলে নেননি তিনি।
জানা গেছে, এই সংযোগের জন্য এমকাবা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ আবদুল ওয়াদুদ ৫ হাজার টাকা সমীক্ষা ফি জমা দেন ২০১২ সালের ২৪ জুন। গ্রাহকের লোড চাহিদা ছিল ১৫০ কিলোওয়াট। কিন্তু প্রায় দেড় বছর সময় লাগে আবেদনকারীর বিপরীতে ডিমান্ড নোট ইস্যু করতে। চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি গ্রাহক চাহিদাপত্রের বিপরীতে ১১ লাখ ২৪ হাজার ৫৭২ টাকা সরকারি ফি জমা দেন। নিয়ম অনুযায়ী ডিমান্ড নোট ইস্যুর এক সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। কিন্তু সরকারি ফি জমা দেয়ার পরও ঘুষ না দেয়ায় জাহাঙ্গীর আলম নানাভাবে টালবাহানা শুরু করেন। প্রথমে ফিডার ওভারলোডেড হওয়ার মিথ্যা তথ্য দিয়ে ডিমান্ড নোট করা থেকে বিরত থাকেন। অন্য ফিডার থেকে লাইন টেনে সংযোগ দেয়ার কথা বলে আরও ৬০ হাজার টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দিতে বলেন। এরপর গ্রাহক গত ২০ আগস্ট এই টাকা জমা দেন। কিন্তু টাকা জমা দেয়ার পর জাহাঙ্গীর আলম আবার বেঁকে বসেন। বলেন, জনৈক ব্যক্তির বাধার কারণে নতুন লাইন নির্মাণ করা সম্ভব নয়। নিয়ম অনুযায়ী সংযোগকালে কোনো ব্যক্তি যদি বাধা দেয় তাহলে প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে লাইন নির্মাণ করতে হবে। অভিযোগ রয়েছে, মূলত ঘুষ না দেয়ায় এটা জাহাঙ্গীর আলমের এক ধরনের টালবাহানা। এখন তিনি বলছেন, রুট পরিবর্তন করে এই সংযোগ দিতে হবে। এজন্য আবার সরকারি ফি দিতে হবে। স্থানীয় সমিতির একজন কর্মকর্তা বলেন, জিএমকে ঘুষ না দিলে বছরের পর বছর কেটে গেলেও ওই গ্রাহক সংযোগ পাবে না। কারণ ঘুষের এই টাকার ভাগ যাচ্ছে আরইবির সব শীর্ষ টেবিলে।
ভোল্টেজ রেগুলেটর ক্রয়ে দুর্নীতি : পল্লী বিদ্যুতায়ন কার্যক্রমে বিদ্যুৎ উপকেন্দ ও বৈদ্যুতিক লাইনে ব্যবহৃত বিভিন্ন আকারের অটোমেটিক ভোল্টেজ রেগুলেটর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সরঞ্জাম। এই সুযোগে নামে-বেনামে সমিতিগুলো প্রতিনিয়ত উচ্চ মূল্যে ভোল্টেজ রেগুলেটর ক্রয় করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ ধরনের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম দেশে উৎপাদন না হওয়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ১শ’ থেকে ২শ’ গুণ বেশি দামেও মালামাল ক্রয় করে গ্রাহকের টাকা লোপাট করছে। সম্প্রতি ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ক্রয় নীতিমালা ও পবিসের সব নিয়ম-কানুন লঙ্ঘন করে সর্বনিু দরদাতার কাছ থেকে ভোল্টেজ রেগুলেটর না নিয়ে তাদের পছন্দের কোম্পানি প্রিন্স কর্পোরেশনের কাছ থেকে ৫৬টি ভোল্টেজ রেগুলেটর কিনতে যাচ্ছে। ভোল্টেজ রেগুলেটরের প্রতিটি ২৩ লাখ ৯৮ হাজার টাকা দামে কেনার সুপারিশ করছে সমিতি। জানা গেছে, এক্ষেত্রেও বড় ধরনের আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং হয়েছে। অভিযোগ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের এই সিন্ডিকেট বাণিজ্যের সঙ্গে এখন সরাসরি সম্পৃক্ত গ্লোবাল মার্কেটিং সার্ভিসেস এবং প্রিন্স কর্পোরেশন। জানা গেছে, ঢাকা পবিস সম্প্রতি গ্লোবাল মার্কেটিং সার্ভিসেস এবং প্রিন্স কর্পোরেশনকে প্রতিটি ভোল্টেজ রেগুলেটর যথাক্রমে ২৩ লাখ ৮৮ হাজার এবং ২৩ লাখ ৯৮ হাজার টাকা করে দেয়ার জন্য সবকিছু চূড়ান্ত করেছে। সিন্ডিকেট এখানে ইচ্ছা করে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০ হাজার টাকা দর পার্থক্য করেছে। যদিও মাত্র দুই মাস আগে ১.৮ মিলিয়ন প্রকল্পের দরপত্রে মেসার্স গ্লোবাল মার্কেটিং এবং প্রিন্স কর্পোরেশন প্রতিটি ভোল্টেজ রেগুলেটর দিয়েছিল ১৬ লাখ ৯৯ হাজার এবং ২২ লাখ ৪০ হাজার টাকায়। কিন্তু এই দরে কার্যাদেশ নিলে সিন্ডিকেট আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবে না বলে পরে সাড়ে আট কোটি টাকা মূল্যে দ্বিতীয় দরদাতা প্রিন্স কর্পোরেশনকে কার্যাদেশ প্রদানের সুপারিশ করে।
মিটার ক্রয়ে দুর্নীতি : গত ৩-৪ বছর ধরে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সিঙ্গেল ফেইজ মিটার কেনা নিয়েও নানা অনিয়ম করে আসছে। জানা গেছে, গোপনে বড় অংকের টাকা মাসোয়ারা নিয়ে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মিটার কেনা হচ্ছে। অভিযোগ, ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরইবির উচ্চ পর্যায়ের সম্পর্ক এতটাই গভীর যে, এই কেনাকাটায় গত ২-৩ বছর ধরে অন্য কোনো কোম্পানি অংশগ্রহণও করে না। সম্প্রতি একটি প্রতিষ্ঠানকে দু’বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরইবি। অথচ এ প্রতিষ্ঠানটি মিটার সরবরাহের বিভিন্ন দরপত্রে সর্বনিু দরদাতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে একাধিকবার। এই প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দেয়া হলে, ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের মনোপলি নষ্ট হবে বলে এ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
No comments