গাজায় ধ্বংসলীলা ও হত্যাকাণ্ডের হামলা কেন? by আলী রীয়াজ
গাজায় অব্যাহত ইসরায়েলি বিমান হামলায়
সেখানে যে এক মানবিক বিপর্যয়ের সূচনা হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কয়েক
দিন ধরে বিমান হামলার পর ইসরায়েলি প্রশাসন এখন স্থল অভিযানের পরিকল্পনা
করছে। গাজা আবার দখলের আগ্রহ ইসরায়েলের না থাকলেও নিদেনপক্ষে স্বল্প সময়ের
জন্য হলেও সেখানে সেনা পাঠিয়ে ধ্বংসলীলা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটানোর
একধরনের উৎসাহ ইসরায়েলি প্রশাসনের মধ্যে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিমান হামলার
বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীতে সমালোচনা ও ধিক্কার উঠেছে; কিন্তু ইসরায়েলি
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন যে তিনি এতে কোনো চাপ অনুভব
করছেন না। উপরন্তু তাঁদের যুদ্ধংদেহী মনোভাব, অন্য যেকোনো সময়ের মতোই
উগ্রভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।
গাজায় যুদ্ধ নতুন কোনো ঘটনা নয়; এক অর্থে গাজা সব সময়ই যুদ্ধাবস্থার মধ্যে থাকে। গাজা হামাসের নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকে এ অবস্থার পুনরাবৃত্তি হয়েছে কয়েক দফা। প্রতিবারই কোনো না কোনো আশু ঘটনাকে কেন্দ্র করে গাজায় ইসরায়েলিদের আক্রমণের সূচনা হয়। আর সেই আক্রমণের কারণ বা প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমরা দেখতে পাই হামাসের পক্ষ থেকে ইসরায়েলে রকেট নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।যেমন এ বছরের এপ্রিল মাসেও এ ধরনের রকেট নিক্ষেপ এবং ইসরায়েলি বিমান হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনার পেছনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যে ঘটনাপ্রবাহই থাকুক না কেন, তার মাশুল গুনতে হয় সাধারণ মানুষকে। এ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে আমরা জাতিসংঘের আলোচনা, মহাসচিবের অনুরোধ এবং বিভিন্ন ধরনের হুঁশিয়ারি শুনতে পাই। এগুলো যে নেহাতই আনুষ্ঠানিকতা, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন হয় না।
এ দফায় যুদ্ধের ‘কারণ’ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে তিনজন ইসরায়েলি তরুণের অপহরণ এবং হত্যার ঘটনা। তাঁদের হামাস অপহরণ করেছিল বলে ইসরায়েলি অভিযোগ হামাস অস্বীকার করেছে। কিন্তু এটা অস্বীকারের উপায় নেই যে ওই তরুণেরা প্রাণ হারিয়েছেন। এ ঘটনার পর ইসরায়েলিরা গাজায় কয়েক শ হামাস কর্মীকে গ্রেপ্তার করে এ অভিযোগে যে নিহত তিনজন তরুণের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্তদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের ধারণা, ইসরায়েলিরা এ ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে সবাইকে শাস্তি দিচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ইসরায়েলি চরমপন্থীরা পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে একজন ফিলিস্তিনি তরুণকে অপহরণ করে পুড়িয়ে মেরেছে। নিহত তিন ইসরায়েলি তরুণের একজন মার্কিন নাগরিকও বটে; অন্যদিকে যে ফিলিস্তিনি তরুণকে হত্যা করা হয়েছে, তাঁর চাচাতো ভাইকে—সেও একজন মার্কিন নাগরিককে—ইসরায়েলি পুলিশ আটক করার সময় এবং আটক করার পরে নির্যাতন চালিয়েছে বলে প্রমাণসমেত অভিযোগ পাওয়া গেছে। এগুলো হলো এ দফার যুদ্ধাবস্থার আশু প্রেক্ষাপট। ইসরায়েলিরা অবশ্য দাবি করে যে ১১ জুন থেকে হামাস দফায় দফায় রকেট নিক্ষেপ করে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করায় বিমান হামলার সূচনা করেছে তারা।
কিন্তু যেকোনো যুদ্ধ, বিশেষত ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার প্রত্যক্ষ সংঘাত বৃদ্ধি পাওয়া বা তার তীব্রতা বাড়ানোর পেছনে কেবল আশু কারণ কাজ করে না। গত এক দশকে যতবার আমরা যুদ্ধের দামামা বেজে উঠতে শুনেছি, তার পেছনে সাধারণত আশু বিষয়ের চেয়ে অন্যান্য কারণ বেশি কাজ করেছে।
এ কারণগুলো দুই পক্ষের দিক থেকেই সৃষ্ট।ইসরায়েলের এ ধরনের সামরিক অভিযানের পেছনে রয়েছে নেতানিয়াহু সরকারের নিজস্ব দুর্বল অবস্থান। তাঁর সরকারের অংশীদার যে দক্ষিণপন্থী দল—নাফতালি বেনেতের নেতৃত্বাধীন ‘জিউয়িশ হোম’ (বাইয়েত ইয়ুহিদি)—তারা কয়েক মাস ধরেই ফিলিস্তিনি প্রশ্নে তাদের কঠোর অবস্থানের কারণে প্রধানমন্ত্রীর ওপরে চাপ দিয়ে আসছিল। এ বছরের মে মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সফরের সময় তাঁর করা এক মন্তব্য নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে টানাপোড়েন তীব্র হয়। জন কেরি মন্তব্য করেছিলেন যে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত না হলে ইসরায়েল এক বর্ণবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। জন কেরি পরে তাঁর এ বক্তব্য থেকে সামান্য সরে এলেও তাঁর বক্তব্য ইসরায়েলি রাজনীতিতে ঝড় তোলে। একইভাবে এ বছরের গোড়ায় ইসরায়েলি পার্লামেন্টে এ ভাষণ দেওয়ার সময় ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট মার্টিন সুলজ অভিযোগ করেন যে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের চেয়ে বেশি পানি ব্যবহার করছে। তিনি বলেন যে ‘ফিলিস্তিনি তরুণেরা আমাকে প্রশ্ন করেছে যে যেখানে ইসরায়েলিরা দিনে ৭০ লিটার পানি ব্যবহার করে, সেখানে ফিলিস্তিনিরা করে ১৭ লিটার।’ এ বক্তব্যের প্রতিবাদে বেনেতের দলের সদস্যরা ওয়াকআউট করে। মি. বেনেত সরকারের অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রীও। এসব টানাপোড়েনের কারণে নেতানিয়াহুর সরকারকে সব সময়ই ফিলিস্তিন প্রশ্নে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হয়। প্রায় এ ধরনের পরিস্থিতিতেই আমরা ২০১২ সালে গাজায় ইসরায়েলি হামলার ঘটনা ঘটতে দেখেছি। ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যখনই সংকট দেখা দেয়, তখনই গাজায় অভিযান চালিয়ে ক্ষমতাসীনেরা তাদের শক্তি সংহত করার ও জনসমর্থন বাড়ানোর চেষ্টা করে থাকে।
সম্প্রতি নেতানিয়াহু এবং তাঁর দল নিজেরাও একধরনের চাপ অনুভব করছে। হামাস এবং ফাতাহ গোষ্ঠীর মধ্যে মতৈক্যের কারণে যে জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠিত হয়েছে, তা নেতানিয়াহুর সরকারকে বিব্রত করেছে। এ সরকার গঠনের কারণে ফিলিস্তিনিদের শক্তি নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়নি; কিন্তু ইসরায়েলের কোনো কোনো মহলের ধারণা যে ঐক্য তৈরি হয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোর পরোক্ষ প্রচেষ্টায় এবং তাতে করে ফিলিস্তিনিদের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে। গত প্রায় বছর খানেক ধরে ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না থাকায় ইসরায়েলে এ রকম ধারণা আছে যে ফিলিস্তিনিদের এ ঐক্যের পেছনে আছে মার্কিন সমর্থন। নেতানিয়াহু এবং ইসরায়েল সরকারের ধারণা যে এখন তারা এ যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থনে এগিয়ে আসতে বাধ্য হবে। ইতিমধ্যেই তার লক্ষণ আমরা দেখতে পেয়েছি। কূটনৈতিকভাবে খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া নেতানিয়াহু সরকার সম্ভবত মনে করে এ যুদ্ধ থামাতে এগিয়ে আসার মধ্য দিয়ে বিরাজমান দূরত্বের অবসান ঘটবে।
হামাসের পক্ষ থেকেও এ যুদ্ধে কৌশলগতভাবে লাভবান হওয়ার আশা করার কারণ রয়েছে। মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের ক্ষমতাচ্যুতি, তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই হামাস খানিকটা সংকটের মধ্যে আছে। মিসরের সঙ্গে গোপন যেসব সুড়ঙ্গ ছিল সিসি সরকার তার অনেকগুলোই বন্ধ করে দিয়েছে, যা হামাসের অস্ত্র সরবরাহকে বিঘ্নিত করেছে। শুধু তা-ই নয়, এসব পথে আসা বিভিন্ন সামগ্রীর ওপর কর আরোপ করে হামাস তাদের সংগঠন ও প্রশাসন চালাতে সক্ষম হচ্ছিল। হামাসের মধ্যে এ ধারণা রয়েছে যে এ ধরনের হামলার মুখে মিসর সীমান্ত খুলে দিতে বাধ্য হবে এবং সুড়ঙ্গগুলো আবার চালু হবে। শুধু তা-ই নয়, তারা জানে যে শেষ পর্যন্ত কোনো ধরনের যুদ্ধবিরতি করতে হলে ইসরায়েলকে মিসরের মাধ্যমেই তা করতে হবে। মিসরের এ ভূমিকার কারণেই ইতিমধ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন মিসরের প্রেসিডেন্টের
সঙ্গে কথা বলেছেন। এ পদক্ষেপ নিতে হলে সিসি সরকারকে হামাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। হামাসের জন্য সেটা ইতিবাচক হবে বলেই হামাস নেতৃত্বের ধারণা। হামাসের এ ধারণাও ভুল নয় যে এ ধরনের কোনো যুদ্ধবিরতি যদি হয়
তবে তারা ইসরায়েলের আগের প্রতিশ্রুত কিছু বিষয় অর্জন করতে পারবে এবং সম্ভবত আরও নতুন কিছু দাবিও তারা সংযুক্ত করতে পারবে।
এ যুদ্ধের ফলে মিসরের সঙ্গে হামাসের সম্পর্কের উন্নতি হবে, সেটা অবশ্য ইসরায়েলিরা মানতে রাজি নন। ইসরায়েল এ দফায় গাজা হামলার সময় এ আশাই করেছে যে যেহেতু মুসলিম ব্রাদারহুডের শক্তি ধ্বংস করতে চায় মিসর, সেহেতু তারা প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে সমর্থন পাবে। মিসরে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত জেরুজালেম পোস্ট-এর সংবাদদাতাকে সে কথা বলেছেনও। সিসি সরকার যে সে রকম চাইতে পারে, এটা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে না; কিন্তু মিসরের কোনো সরকারের পক্ষেই প্রত্যক্ষভাবে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয়। ফলে শেষ পর্যন্ত মিসরের সরকার একটা যুদ্ধবিরতির চেষ্টায় উদ্যোগী হতে বাধ্য হবে।
গাজায় চলমান যুদ্ধ নতুন নয়। শিশু ও নারীসহ শতাধিক ফিলিস্তিনি নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনা শুক্রবারের খবর; এ সংখ্যা যে আরও বাড়বে তা অনুমান করা যায়। অমানবিক হামলার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ; তাদের প্রাণের বিনিময়ে রাজনীতির দাবাখেলা চলছে। আগেও আমরা তা দেখেছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো এর শেষ কোথায়? প্রতি দুই বছরে একবার করে বড় আকারের যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠবে, শত শত মানুষের প্রাণ সংহার হবে, পৃথিবীজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠবে এবং শেষ পর্যন্ত একটা সাময়িক যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে তার আপাত অবসান ঘটবে। এ বৃত্তচক্র ভাঙার একটিমাত্র উপায়, সেটা সবাই জানেন; একটি বাস্তবোচিত টেকসই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। সেই সমাধানই কেবল ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার, ইসরায়েলের নিরাপত্তা এবং এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এর কোনো বিকল্প নেই। মধ্যপ্রাচ্যের সে দেশগুলো এ কথা বিশ্বাস করে, তারা যতক্ষণ না পর্যন্ত কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এ লক্ষ্যে অগ্রগতি হবে না।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments