ময়লা থাকে সাবানে by আনিসুল হক
পৃথিবীটা কতই সুন্দর হতো, দিনরাতগুলো
কতই না নির্ভার হতো, জীবন কতই না মধুময় হতো, যদি সংবাদমাধ্যম না থাকত!
পৃথিবীতে যত সমস্যার মূল হলো সংবাদ৷ আপনি ততক্ষণ ভালো, যতক্ষণ আপনি
কোনো সংবাদ না জানছেন৷ নো নিউজ ইজ গুড নিউজ৷ আমাদের দেশে যাবতীয় সমস্যার
মূলে আসলে সংবাদমাধ্যমগুলো৷ তারা আমাদের দেয় দুঃসংবাদ, এবং অবশ্যই তা দেয়
ভুলভাবে, বানিয়ে, মিথ্যাকারে, অতিরঞ্জিত করে৷ যদি সংবাদমাধ্যম না থাকত,
তাহলে আমরা অনেক ভুল-খারাপ খবর সম্পর্কে অনবহিতই থেকে যেতাম৷ ফলে, আমাদের
দিবারাত্রিগুলো হতো পরম সুখময়৷ ধরা যাক, ডাক্তার আপনাকে বলল, আপনার
লিভারে ক্যানসার হয়েছে, আপনার লিভার বদলাতে হবে৷ আপনার ঘুম হারাম৷ টাকাপয়সা
লাগবে, লিভার বদলাবেন, তার পরও আপনি বাঁচবেন, আপনি নিশ্চিত নন৷ এই অবস্থায়
আপনি গেলেন আরেকজনের কাছে, তিনি বললেন, কে বলেছে তোমার ক্যানসার, কিছুই
হয়নি৷ যাও, তিন গেলাস পানি খাও, তুমি সেরে যাবে৷ আপনার জন্য ব্যাপারটা কী
রকম স্বস্তির, কী রকম মুক্তির, কী রকম শান্তির বার্তা বয়ে আনবে৷
সংবাদমাধ্যমগুলো সেই সব ভুয়া চিকিৎসকের মতো, যারা আপনাকে সারাক্ষণ বলছে, আপনার অসুখ৷ এই অবস্থায় আপনাকে যেতে হবে তাঁর কাছে, যিনি বলবেন, কিছুই হয়নি৷ কিছুটা ষড়যন্ত্র ছাড়া৷ আপনি ভালো আছেন, ভালো থাকবেন৷ আমাদের পরম সৌভাগ্য যে আমাদের মাথার ওপরে ছায়া হয়ে আছেন এমনই সুসংবাদদাতারা৷ যাঁরা আমাদের পরম হতাশায় জোগান আশার আলো৷ যাঁরা আছেন বলেই আমরা জানতে পারি, আমরা শেষ হয়ে যাইনি, আমাদের আশা আছে, ভবিষ্যৎ আছে, মুক্তি আছে৷
যেমন ধরুন সোনায় ১৫ আনা খাদ মিশিয়ে আমরা দিয়েছি বিদেশি বন্ধুদের, এই ধরনের একটা বাজে খবরে আমাদের মুখটা বিস্বাদ হয়ে গিয়েছিল৷ আমরা খুবই বিব্রত হয়ে পড়েছিলাম৷ সেখান থেকে উদ্ধারের কোনো পথই আমরা খঁুজে পাচ্ছিলাম না৷ ঠিক সেই সময় পাওয়া গেল মধুরতম আশ্বাস, এসে গেল উজ্জ্বল উদ্ধার৷ সোনা কতটুকুন আছে এই নিয়ে কথা না বললেই তো হয়৷ বিদেশি বন্ধুদের তো আমরা অঙ্গীকার করিনি, কত তোলা সোনা আমরা দেব৷ এই নিয়ে খবর প্রকাশ করলেই তো আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়৷ খবর প্রকাশ না করলেই হয়৷
তেমনিভাবে একটি পরিবারের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা নানা অপবাদ দিয়ে আসছিল আমাদের গণমাধ্যমগুলো, আর ওই এলাকার লোকেরাও সেসব কথা বিশ্বাস করে তাঁকে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছিল৷ আমাদের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো এই ব্যাপারটা চেপে বসেছিল, আমাদের গলায় বেঁধা মাছের কাঁটার মতো অস্বস্তি দিচ্ছিল৷ এক দলা সাদা ভাত গিললেই যেমন মাছের কাঁটা নেমে যায়, তেমনিভাবে নেমে গেল অস্বস্তিটা৷ আসলে তো ওই পরিবারটি সম্পর্কে অপপ্রচার করা হয়েছে, ষড়যন্ত্র করা হয়েছে৷ আসলে তো তিনি ফুলের মতো পবিত্র৷ তাঁকে বর্জন নয়, প্রতিরোধ নয়, তাঁকে আমাদের গ্রহণ করতে হবে পরম মমতায়৷ ভালোবাসায়৷ এই রকম একটা চমৎকার সাহসী ব্যবস্থাপত্র পেয়েই মুহূর্তেই আমাদের দিনরাতগুলো মধুময় হয়ে উঠল৷
আসলে সংবাদমাধ্যমে ক্রমাগত মিথ্যাচারে আমাদের মধ্যে একটা ধারণা জন্মায়৷ আমরা সেই ধারণা নিয়ে চলি৷ আমরা কেউই জানি না, মীরজাফর আসলে মীরজাফরি করেছিল কি না৷ কেউই প্রত্যক্ষদর্শী নই৷ কিন্তু আমরা একটা ধারণা দিয়ে চালিত হই৷ এই ধারণা তো ভুলও হতে পারে৷ ভালো-মন্দ বিচারেই তো সমস্যা থাকতে পারে৷ এখন আমরা জানি, আমরা ভুল জানতাম৷ ভুল জানাটা দুঃখজনক, সবচেয়ে দুঃখজনক ভুলটা ভাঙিয়ে দেওয়ার পরেও সংশোধিত না হওয়া৷ আমরা অবশ্যই সংশোধিত হব৷ আমরা আর ওই পরিবারটিকে নিয়ে কোনো রকমের সন্দেহ প্রকাশ করব না৷ টুঁ শব্দটিও করব না৷ আমরা ওই পরিবারের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করব৷ তাদের মঙ্গলের জন্য নিজেদের সর্বস্ব বিসর্জন দেব৷
পণ্ডিতদের কথাও সব সময় শুনতে হয় না৷ এক পণ্ডিত, নাম অমর্ত্য সেন, বলেছেন, যে দেশে গণতন্ত্র আছে, আর যে দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না৷ তিনি বলেছেন, দেশের কোথাও খাদ্যাভাব দেখা দিলে তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হবে, আর সরকারকে যেহেতু ভোটের জন্য আগামীবার জনগণের দুয়ারে হাজিরা দিতে হবে, কাজেই সরকার দ্রুতই অভাবী অঞ্চলে খাদ্যশস্য পৌঁছানোর জন্য ব্যবস্থা নেবে৷ কাজেই দুর্ভিক্ষ হতে পারে না৷ তিনি পণ্ডিত মানুষ৷ সরলহৃদয়৷ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের নিম্নমান সম্পর্কে তিনি ধারণাই রাখেন না৷ বাংলাদেশের কোনো অঞ্চলে কখনোই খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে না৷ যদি কোনো সংবাদমাধ্যম এই জাতীয় খবর প্রচার বা প্রকাশ করে, তার মানে হলো, তারা মিথ্যা বলছে এবং ষড়যন্ত্র করছে৷ তখন দেশপ্রেমিকের কর্তব্য ওই এলাকায় খাদ্যশস্য প্রেরণ করা নয়, এই জাতীয় খবর প্রচারের পেছনের ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটিত করে তাদের কালো হাত গুঁড়িয়ে দেওয়া৷ কে কোন হীনস্বার্থে এই ধরনের মিথ্যা খবর রচনা ও রটনা করতে পারে, তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও সক্রিয় হওয়া৷ আর ভবিষ্যতে ভোটের জন্য এলাকাবাসীর কাছে যাওয়া, আমরা এতটাই স্মার্ট যে সেই কাজ আমাদের করতে হয় না৷ ভোটের জন্য আমাদের কারও দুয়ারে যাওয়ার দরকারই পড়ে না৷
পরিশেষে আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবন থেকে শিক্ষা নেব৷ ঈশ্বরচন্দ্র ছেলেবেলায় কলকাতায় একটা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ সেখানে তাঁর বাবাও থাকতেন, এলাকা থেকে লোকজনও এসে সেখানেই উঠত৷ রান্না করতেন বালক ঈশ্বরচন্দ্র৷ কলকাতার ঘুপচি গলির অন্ধকারের নিচতলায় তাঁদের আশ্রয়৷ দিনের বেলাতেও কিছুই যেন দেখা যায় না৷ একদিন সবাই মিলে খেতে বসেছেন৷ পরিবেশন করছেন বালক বিদ্যাসাগর নিজে৷ হঠাৎ বিদ্যাসাগর দেখলেন, খাবারের হাঁড়িতে একটা তেলাপোকা৷ এখন এই তেলাপোকার জন্য পুরো খাবার ফেলে দিলে সবাই মিলে অভুক্ত থাকতে হবে৷ ঈশ্বরচন্দ্র এক থাবা দিয়ে তেলাপোকাটা তুলে নিয়ে মুখে পুরলেন এবং চিবিয়ে খেয়ে ফেললেন৷ এটাই হওয়া উচিত আমাদের আদর্শ৷ আমরা যদি দেখি কোথাও কোনো তেলাপোকা, তাহলে সেটা রাষ্ট্র করে বেড়াব না৷ সেটা আমরা গিলে খেয়ে ফেলব৷
তাহলেই আমাদের দিনরাত্রিগুলো নিরুপদ্রব, নিষ্কণ্টক, আনন্দময় ও নির্বিঘ্ন হবে৷
আপনি পরিষ্কার হাত নিয়ে বেসিনে যান, আর হাতে সাবান দিন৷ ময়লা বের হবেই৷ কাজেই ময়লা হাতে থাকে না, ময়লা থাকে সাবানে৷
আমরা সাবান বর্জন করব৷
আমরা সুখে থাকব৷
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments