নদীকেন্দ্রিক নিম্নবর্গ মানুষের দুঃখগাথা by বীরেন মুখার্জী
‘তিতাস
একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের
ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে
তাতায়; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না।’ এ
কথাগুলো ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের শুরুতে লিখেছিলেন অদ্বৈত
মল্লবর্মণ। বাংলা সাহিত্যে নদীকেন্দি ক উপন্যাসের মধ্যে নিুবর্গ মানুষের
আখ্যানসমৃদ্ধ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ অমরকীর্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। নদী
অববাহিকায় বসবাসরত মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এ উপন্যাসে।
‘ধীবর’ বা ‘মালো’ সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে অদ্বৈত মল্লবর্মণ গভীর
অন্তর্দৃষ্টিতে দেখেছেন এ সমাজের জীবনসংগ্রামের নিষ্ঠুর চিত্র। বলা যায়,
প্রতিকূল সংঘাতে ক্ষুয়িষ্ণু ‘মালো’ জীবনের সারাৎসার তিনি আঁকতে সক্ষম
হয়েছেন এ উপন্যাসে। বিশ শতকের বাংলা উপন্যাসে যে দুটি ধারা বহমান তারই একটি
হচ্ছে ‘নিুবর্গ মানুষের আখ্যান’। একটু পেছন ফিরলে দেখা যায়, প্রথম
বিশ্বযুদ্ধোত্তর আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘কল্লোল’ (১৯২৩)
গোষ্ঠীর কথাসাহিত্যিকরা তাদের লেখায় নিুবর্গের জীবন তুলে ধরতে সচেষ্ট হন।
নরেশচন্দ সেনগুপ্ত, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত,
প্রেমেন্দ মিত্র প্রমুখের রচনায় নিুবর্গের মানুষের জীবন রূপায়ণে
অভিজ্ঞতাপ্রসূত ধারার সূচনা ঘটে। তবে কথাসাহিত্যে নিুবর্গের জীবনবৈচিত্র্য
রূপায়ণে তিন বন্দ্যোপাধ্যায় তথা মানিক, তারাশঙ্কর ও বিভূতিভূষণের দক্ষতা
অপরিসীম। গবেষক ড. মিল্টন বিশ্বাস বলেন, ‘বিংশ শতাব্দীর পরিবর্তনশীল
আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সাহিত্যকর্ম হয়ে
ওঠে নবতর সমাজভাবনার শিল্পমণ্ডিত রূপ। সামাজিকভাবে নিচু কিংবা যারা
উচ্চবর্গের কাছে অপ্রধান জনগোষ্ঠী, তাদের জীবনের বাস্তবতা, জৈবপ্রবৃত্তি,
নর-নারী সম্পর্কে প্রচলিত নীতিশাসন-বহির্ভূত আচরণ, উচ্চবর্গের শোষণ-শাসন ও
এর প্রতিক্রিয়ায় প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, জীবনাচার, সংস্কার ও জীবনযাপনের
রীতি-পদ্ধতির সম্যক উন্মোচন লক্ষ্য করা যায় এসব উপন্যাসে।’ বলা যায়, অদ্বৈত
মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে নিুবর্গের আখ্যান তুলে ধরা এ
ধারাবাহিকতারই অংশ।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু নির্বাচন, চরিত্র-চিত্রণ এবং প্রকাশভঙ্গিগত কারণে এ উপন্যাসের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনীকার অধ্যাপক শান্তনু কায়সারের মতে- ‘তিতাস জীবনের শেকড় প্রাকৃত জীবনের গভীরে প্রোথিত। এ প্রাকৃত জীবনকে বাইরে থেকে যতই সরল দেখাক, এর ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে, তা বহু ভঙ্গিমা বৈচিত্র্যের অধিকারী। সারল্যের মধ্য দিয়ে এ বৈচিত্র্যের অনুসন্ধান করেছে ঔপন্যাসিক ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে। ফলে নদীকেন্দি ক বাংলা সাহিত্যের উপাদানগুলোর মধ্যে অন্য যে উপন্যাসটি প্রাকৃত জীবনকে ধারণ করেছে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত সেই ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র সঙ্গে তুলনা করলেও ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি অনন্য হয়ে ওঠে।’
অস্বীকার করা যাবে না, নদী অববাহিকায় বসবাসরত ধীবর সম্প্রদায়ের মানুষ মাছ ধরে নৌকা বেয়ে জীবন অতিবাহিত করে। জীবন-জীবিকার জন্য এ শ্রেণীর মানুষ দিনরাত পরিশ্রম করলেও প্রাচুর্যের মুখ কখনও দেখে না। অভাব-অনটন আর তাদের জীবন যেন একই সুতোয় গাঁথা। তবু এ দুঃখ দারিদ্র্যপূর্ণ জীবনে আসে প্রেম-ভালোবাসা। সেখানেও নিরবচ্ছিন্ন সুখ মেলে না। সংসার জীবন কাটে দুঃখ দারিদ্র্যে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ সেই দৈন্যপীড়িত মানুষের মুখ এঁকেছেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে। এ উপন্যাসে ফুটে উঠেছে- মৎস্যজীবীদের জীবন কষ্টের হলেও নির্বিঘ্ন নয়। প্রাকৃতিক নিয়মে এক সময় নদীতে চর পড়ে। নদী তার যৌবন হারায়। সেই সঙ্গে শেষ হয় নদীর মাছ ও জলের তরঙ্গ। নিরুপায় জেলেরা বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের যুগ-যুগান্তরের আবাস ছেড়ে জীবিকা অন্বেষণে অন্যত্র পাড়ি জমায়। আবার কেউ উপায়ান্তর না পেয়ে সেখানেই থেকে যায়। তখন তাদের দুঃখের সীমা আরও দীর্ঘায়িত হয়। এ যেন এক নির্মম বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। অসহায় তিতাসপাড়ের এসব দরিদ্র মানুষের দীর্ঘশ্বাস চিত্রিত হয়েছে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে।
এ উপন্যাসের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে তিতাশ চৌধুরী তার ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- ‘পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে অন্ত্যজ শ্রেণী থেকে উঠে আসা স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত গাল্পিক ও ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণের মতো আর কেউ আছেন বলে আমার জানা নেই। সে জন্যই তার উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। এর সঙ্গে কারও উপন্যাসই মেলানো যায় না। গল্পও। তিনি যাদের মধ্যে থেকে বড় হয়েছেন তাদের কাহিনী নিয়েই উপন্যাসের ঘটনাবলি সাজানো হয়েছে। তিতাস নদীর তীরে জেলেদের গ্রাম। সে গাঁয়ে তারা যুগ যুগ ধরে বসবাস করে। তাদের জীবিকা নির্বাহ হয় তিতাসের বুক থেকে।’ ‘তিতাস’ যে পৃথক একটি সত্তা এবং ‘কঠিন বাস্তব ছাঁচে বানানো অপরূপ শিল্পিত জীবন গাঁথা’ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না এ মূল্যায়নে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ জীবন ঘষে রচনা করেছিলেন এ উপন্যাসটি। যা তাকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গেছে। বাস্তবতা যে, তার জীবদ্দশায় উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশিত হয়নি।
প্রতিটি মানুষ বড় হয়ে ওঠে তার পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে। অর্জিত হয় নানা অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতার সারাৎসার চিরন্তন রূপ দিতে পারেন শুধু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লেখক। অদ্বৈত মল্লবর্মণ মালোপাড়ায় জন্মেছিলেন। সেই মালোদের জীবনের সঙ্গে ছিল তার প্রাণের স্পন্দন। সঙ্গত কারণেই এ স্পন্দনকে তিনি যোগ্যতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন উপন্যাসে। রাইন, সীন বা দানিয়ুবের মতো ক্ষুদ্র নদী তীরে যেমন গড়ে উঠেছে নদীকেন্দি ক ইউরোপীয় সভ্যতা তেমনি তিতাসের তীরেও গড়ে উঠেছিল এক সৃষ্টিশীল জীবন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। উপন্যাসের ভূমিকায় যা তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও লিখেছেন- ‘কত নদীর তীরে একদা নীল-ব্যাপারীদের কুঠি-কেল্লা গড়িয়া উঠিয়াছিল। তাদের ধ্বংসাবশেষ এখনও খুঁজিয়া পাওয়া যায়। কত নদীর তীরে মোগল-পাঠানের তাঁবু পড়িয়া আছে, মগদের ছিপনৌকা রক্ত-লড়াইয়ে মাতিয়াছে- উহাদের তীরে তীরে কত যুদ্ধ হইয়াছে। মানুষের রক্তে হাতিঘোড়ার রক্তে সেসব নদীর জল কত লাল হইয়াছে। আজ হয়তো তারা শুকাইয়া গিয়াছে, কিন্তু পুঁথির পাতায় রেখা কাটিয়া রহিয়াছে। তিতাসের বুকে তেমন কোনো ইতিহাস নাই। সে শুধু একটা নদী।’
লক্ষণীয় যে, বাংলাভাষী ভূ-খণ্ডের আর্থ-সামাজিক সংস্থান, উৎপাদন কাঠামো, শ্রেণীবিন্যাস ও সমাজ বিবর্তনের ক্রমধারায় উপন্যাসে বিষয়বৈচিত্র্য ও চরিত্রচিত্রণে নিুবর্গের প্রাধান্য সুস্পষ্ট। নিুবর্গের বহুমাত্রিক আচরণ, জীবন বাস্তবতা, কৌমসংস্কৃতির সারবত্তা উপস্থাপিত হয়েছে ঔপন্যাসিকদের অনেক আখ্যানে। উপন্যাসের যাত্রালগ্নে সাধারণ মানব-মানবীর জীবন অবলোকন সূত্রে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিুবর্গের মানুষের জীবন উন্মোচিত হয়েছে। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এর ঠকচাচা, ‘কপালকুণ্ডলা’র নির্মম ধর্মসাধনায় নিয়োজিত কাপালিক, ‘ইন্দিরা’, ‘রজনী’, ‘বিষবৃক্ষ’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো নিুবর্গের অন্যতম নিদর্শন। বিষবৃক্ষের হীরা দাসীর চরিত্রটি নারীর নিুবর্গত্বের ব্যতিক্রমী রূপায়ণ হিসেবে স্বীকৃত। রবীন্দ নাথ ঠাকুরের ‘চোখের বালি’র বিনোদিনী নিরাশ্রয় নারীর নিুবর্গত্বকে প্রকাশ করে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে সরাসরি মালো জীবনের দুঃখগাথা অঙ্কন করেছেন। এ সম্প্রদায়ের জীবন যথাযথ রূপায়ণের যে চেষ্টা এ উপন্যাসে দেখা যায় তা অত্যন্ত বাস্তব। তিতাস তীরবর্তী গ্রামগুলোর সবুজের ছড়াছড়ি ও পাকা ধানের মাদকতাময় গন্ধ পাঠককে নিয়ে যায় ভিন্ন এক জগতে। সেই সঙ্গে পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয় সহজ-সরল গ্রাম্য মানুষের মুখচ্ছবি। ছোট-বড় অনেক চরিত্রের সমন্বয়ে এ উপন্যাস রচিত। অদ্বৈত সৃষ্ট কিশোর, সুবল, অনন্ত, বনমালী প্রমুখ অসংখ্য চরিত্র স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল। এ চরিত্রগুলোর মাধ্যমে মালো জীবনের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় তিনি তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন তাদের দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটনে বিপর্যস্ত জীবন। বিভিন্ন মত-পথ, ধর্ম-বর্ণের লোক কীভাবে একত্রে পরম ধৈর্যের সঙ্গে কষ্টগুলো অতিক্রম করে যেতে পারে পারস্পরিক সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে- তা স্পষ্ট হয় এ উপন্যাসে। চরিত্রগুলোর মুখে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ ও যথাযথ পরিবেশ বর্ণনার চেষ্টায় সফল হয়েছেন ঔপন্যাসিক।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ঔপন্যাসিকের সতীর্থ অধ্যাপক সুবোধ চৌধুরী বলেন- ‘আমি তিতাস দেখেছি। আমি সমুদ্র দেখেছি, পাহাড় দেখেছি। অনেক বিচিত্রতর মানুষের সঙ্গে মিশেছি। কিন্তু অদ্বৈত মল্লবর্মণের ছিল মানুষ সম্পর্কে সুগভীর ওহংরমযঃ, এমনটি আমাদের ছিল না। আমরা দেখেছি, দর্শকের মতো, ভালো হয়তো লেগেছে। তবে অদ্বৈত সবটুকু দেখেছেন শিল্পীর চোখে। তার সত্তার সঙ্গে তিতাস ছিল মিশে। এটা পৃথক করতে পারেননি তিনি, চানওনি। তার ওপর ছিল তার উদার দৃষ্টিভঙ্গি। ...প্রথম যখন পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছিলেন, আমি বলেছিলাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, আর কি তোমার বই নেবে? অদ্বৈত বললেন- সুবোধ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বড় Artist, Master artist কিন্তু বাওনের পোলা, রোমান্টিক। আর আমি তো ‘জাউয়ার পোলা’। আর কিছু বলেননি। পরিচয়ের এ প্রত্যক্ষতাই ছিল তার গৌরবের ভিত।’
ফলে এ কথা বলা বোধ করি অত্যুক্তি হয় না, গোকর্র্ণ গ্রামের ধীবর সম্প্রদায়ের জীবনচর্চা যে আন্তরিক মমতায় অদ্বৈত মল্লবর্মণ তুলে এনেছেন তার উপন্যাসে, তার তুলনা বাংলা সাহিত্যে বিরল। লেখক তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে এক উপেক্ষিত সমাজের জীবন সংগ্রামের এ কাহিনীকে দিয়েছেন অবিনশ্বরতা। চার খণ্ড ও দুটি পরিচ্ছদে রচিত এ উপন্যাসে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ পর্বে তিতাস নদীর বৈশিষ্ট্য, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তিতাস পাড়ের মালোদের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের চিত্র বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে আছে গৌরাঙ্গসুন্দর আর নিত্যানন্দ নামে দুই মালোর জীবন সংগ্রামের কাহিনী। এরাই অনন্তের মাকে নিয়ে যায় গোকর্ণঘাটে। গৌরাঙ্গ মালোর জীবন দারিদ্র্যে পিষ্ট এবং তার দিন আর চলে না তার উপস্থাপনা রয়েছে। গৌরাঙ্গের জীবনচিত্র থেকে সহজেই বোঝা যায়, তিতাসের জলের সঙ্গে তাদের জীবন বাঁধা। তিতাসে যখন জল কম থাকে তখন মালোদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। মানুষের জীবন কীভাবে নদীর পানির সঙ্গে জড়িত তারই ইঙ্গিত ফুটে উঠেছে উপন্যাসে। কত রকম পেশায় বাংলাদেশের মানুষ জড়িত সেটিও স্পষ্ট হয়। উপন্যাসের শেষভাগে গোকর্ণ গ্রামকে করে তোলা হয়েছে যেন এক হতাশাগ্রস্ত জনপদ। দেখে চেনার উপায় নেই এখানে একদিন জনবহুল এক মালোপাড়া ছিল। মালোপাড়ায় আর মালোরা নেই আছে শুধু জল। হায়রে তিতাস! মালোদের জীবন ছিল একদিন যার সঙ্গে বাঁধা। মালো সম্প্রদায়ের মানুষ কোনো কিছুর জন্য শপথ করলে তিতাসের জল নিয়েই শপথ করত। তাদের বিশ্বাস ছিল- তিতাস তাদের সঙ্গে ছলনা করবে না। অথচ মালোদের সেই বিশ্বাসকে তিতাস রিক্ত করে দেয়। মালোরা উদ্বাস্তু হয়ে যায় তিতাস থেকে। নদী তাদের আর মায়ের মতো আশ্রয় দেয় না। তিতাসের কোলে জন্মানো তিতাসের সন্তানরা তিতাসেই হারিয়ে যায়। তিতাস পাড়ের মালোদের ঘরবাড়ি সম্পর্কে উপন্যাসের ‘শূন্য ভিটাগুলিতে বর্ণনায় আছে’- ‘গাছ-গাছড়া হইয়াছে। তাতে বাতাস লাগিয়া শোঁ শোঁ শব্দ হয়। এখানে পড়িয়া যারা মরিয়াছে, সেই শব্দে তারাই বুঝি বা নিঃশ্বাস ফেলে।’
অস্বীকারের উপায় নেই যে- ‘তিতাসের গৌরবান্বিত বর্ণনায় উপন্যাসের কাহিনী শুরু হলেও শেষ হয় দীর্ঘ হতাশ্বাসের মধ্য দিয়ে। নদী কীভাবে মানুষের কবিতা হয়ে ওঠে সেটি এ উপন্যাসে ফুটে উঠেছে। প্রায় প্রতিটি চরিত্রই শেষ পর্যন্ত হেরে গেছে তিতাসের রূপ পরিবর্তনের কাছে। তিতাসের বুকে চর জেগে ওঠায় তিতাস তার সন্তানদের মতো নুইয়ে পড়েছে।’ দেখা যায় উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাসন্তী আর পিতা রামকেশব জীবিত থাকে। দুজনেই নিঃস্ব, রিক্ত। রামকেশব তার পুত্রকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিল তা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। কিশোর অনন্তের মাকে বিয়ে করার পর যখন স্ত্রীকে হারিয়ে পাগল হয়ে যায় তারপরও আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে শেষ পর্যন্ত রামকেশব বেঁচে থাকে। চোখের সামনে পুত্রের এ নির্মম পরিণতিতে বিধ্বস্ত হয় পিতা রামকেশবের দেহমন। আর অনন্তের মা শেষ পর্যন্ত ঠাহর করতে পারে কিশোরই ছিল তার স্বামী। কিন্তু যখনই সে কিশোরের সেবা শুরু করে তখনই সমাজ বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত গণপিটুনিতে দুজনই মারা যায়। সব অনুভূতি মিশে যায় তিতাসের জলে।
‘নদীর একটা দার্শনিক রূপ আছে। নদী বহিয়া চলে।... তিতাসও কতকাল ধরিয়া বহিয়া চলিয়াছে’- তিতাসের এ বয়ে চলার সঙ্গে নদীতীরবর্তী হাজারো মানুষের কান্নার রোল অনন্ত প্রবহমান, যা অস্বীকারের সুযোগ নেই। তবে মহাকালের সঙ্গে নিুবর্গ মানুষের জীবনের ইতিহাস নিয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ যে দার্শনিক তত্ত্ব সৃষ্টি করেছেন, তা তাকে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু নির্বাচন, চরিত্র-চিত্রণ এবং প্রকাশভঙ্গিগত কারণে এ উপন্যাসের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনীকার অধ্যাপক শান্তনু কায়সারের মতে- ‘তিতাস জীবনের শেকড় প্রাকৃত জীবনের গভীরে প্রোথিত। এ প্রাকৃত জীবনকে বাইরে থেকে যতই সরল দেখাক, এর ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে, তা বহু ভঙ্গিমা বৈচিত্র্যের অধিকারী। সারল্যের মধ্য দিয়ে এ বৈচিত্র্যের অনুসন্ধান করেছে ঔপন্যাসিক ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে। ফলে নদীকেন্দি ক বাংলা সাহিত্যের উপাদানগুলোর মধ্যে অন্য যে উপন্যাসটি প্রাকৃত জীবনকে ধারণ করেছে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত সেই ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র সঙ্গে তুলনা করলেও ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি অনন্য হয়ে ওঠে।’
অস্বীকার করা যাবে না, নদী অববাহিকায় বসবাসরত ধীবর সম্প্রদায়ের মানুষ মাছ ধরে নৌকা বেয়ে জীবন অতিবাহিত করে। জীবন-জীবিকার জন্য এ শ্রেণীর মানুষ দিনরাত পরিশ্রম করলেও প্রাচুর্যের মুখ কখনও দেখে না। অভাব-অনটন আর তাদের জীবন যেন একই সুতোয় গাঁথা। তবু এ দুঃখ দারিদ্র্যপূর্ণ জীবনে আসে প্রেম-ভালোবাসা। সেখানেও নিরবচ্ছিন্ন সুখ মেলে না। সংসার জীবন কাটে দুঃখ দারিদ্র্যে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ সেই দৈন্যপীড়িত মানুষের মুখ এঁকেছেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে। এ উপন্যাসে ফুটে উঠেছে- মৎস্যজীবীদের জীবন কষ্টের হলেও নির্বিঘ্ন নয়। প্রাকৃতিক নিয়মে এক সময় নদীতে চর পড়ে। নদী তার যৌবন হারায়। সেই সঙ্গে শেষ হয় নদীর মাছ ও জলের তরঙ্গ। নিরুপায় জেলেরা বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের যুগ-যুগান্তরের আবাস ছেড়ে জীবিকা অন্বেষণে অন্যত্র পাড়ি জমায়। আবার কেউ উপায়ান্তর না পেয়ে সেখানেই থেকে যায়। তখন তাদের দুঃখের সীমা আরও দীর্ঘায়িত হয়। এ যেন এক নির্মম বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। অসহায় তিতাসপাড়ের এসব দরিদ্র মানুষের দীর্ঘশ্বাস চিত্রিত হয়েছে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে।
এ উপন্যাসের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে তিতাশ চৌধুরী তার ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- ‘পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে অন্ত্যজ শ্রেণী থেকে উঠে আসা স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত গাল্পিক ও ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণের মতো আর কেউ আছেন বলে আমার জানা নেই। সে জন্যই তার উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। এর সঙ্গে কারও উপন্যাসই মেলানো যায় না। গল্পও। তিনি যাদের মধ্যে থেকে বড় হয়েছেন তাদের কাহিনী নিয়েই উপন্যাসের ঘটনাবলি সাজানো হয়েছে। তিতাস নদীর তীরে জেলেদের গ্রাম। সে গাঁয়ে তারা যুগ যুগ ধরে বসবাস করে। তাদের জীবিকা নির্বাহ হয় তিতাসের বুক থেকে।’ ‘তিতাস’ যে পৃথক একটি সত্তা এবং ‘কঠিন বাস্তব ছাঁচে বানানো অপরূপ শিল্পিত জীবন গাঁথা’ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না এ মূল্যায়নে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ জীবন ঘষে রচনা করেছিলেন এ উপন্যাসটি। যা তাকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গেছে। বাস্তবতা যে, তার জীবদ্দশায় উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশিত হয়নি।
প্রতিটি মানুষ বড় হয়ে ওঠে তার পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে। অর্জিত হয় নানা অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতার সারাৎসার চিরন্তন রূপ দিতে পারেন শুধু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লেখক। অদ্বৈত মল্লবর্মণ মালোপাড়ায় জন্মেছিলেন। সেই মালোদের জীবনের সঙ্গে ছিল তার প্রাণের স্পন্দন। সঙ্গত কারণেই এ স্পন্দনকে তিনি যোগ্যতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন উপন্যাসে। রাইন, সীন বা দানিয়ুবের মতো ক্ষুদ্র নদী তীরে যেমন গড়ে উঠেছে নদীকেন্দি ক ইউরোপীয় সভ্যতা তেমনি তিতাসের তীরেও গড়ে উঠেছিল এক সৃষ্টিশীল জীবন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। উপন্যাসের ভূমিকায় যা তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও লিখেছেন- ‘কত নদীর তীরে একদা নীল-ব্যাপারীদের কুঠি-কেল্লা গড়িয়া উঠিয়াছিল। তাদের ধ্বংসাবশেষ এখনও খুঁজিয়া পাওয়া যায়। কত নদীর তীরে মোগল-পাঠানের তাঁবু পড়িয়া আছে, মগদের ছিপনৌকা রক্ত-লড়াইয়ে মাতিয়াছে- উহাদের তীরে তীরে কত যুদ্ধ হইয়াছে। মানুষের রক্তে হাতিঘোড়ার রক্তে সেসব নদীর জল কত লাল হইয়াছে। আজ হয়তো তারা শুকাইয়া গিয়াছে, কিন্তু পুঁথির পাতায় রেখা কাটিয়া রহিয়াছে। তিতাসের বুকে তেমন কোনো ইতিহাস নাই। সে শুধু একটা নদী।’
লক্ষণীয় যে, বাংলাভাষী ভূ-খণ্ডের আর্থ-সামাজিক সংস্থান, উৎপাদন কাঠামো, শ্রেণীবিন্যাস ও সমাজ বিবর্তনের ক্রমধারায় উপন্যাসে বিষয়বৈচিত্র্য ও চরিত্রচিত্রণে নিুবর্গের প্রাধান্য সুস্পষ্ট। নিুবর্গের বহুমাত্রিক আচরণ, জীবন বাস্তবতা, কৌমসংস্কৃতির সারবত্তা উপস্থাপিত হয়েছে ঔপন্যাসিকদের অনেক আখ্যানে। উপন্যাসের যাত্রালগ্নে সাধারণ মানব-মানবীর জীবন অবলোকন সূত্রে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিুবর্গের মানুষের জীবন উন্মোচিত হয়েছে। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এর ঠকচাচা, ‘কপালকুণ্ডলা’র নির্মম ধর্মসাধনায় নিয়োজিত কাপালিক, ‘ইন্দিরা’, ‘রজনী’, ‘বিষবৃক্ষ’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো নিুবর্গের অন্যতম নিদর্শন। বিষবৃক্ষের হীরা দাসীর চরিত্রটি নারীর নিুবর্গত্বের ব্যতিক্রমী রূপায়ণ হিসেবে স্বীকৃত। রবীন্দ নাথ ঠাকুরের ‘চোখের বালি’র বিনোদিনী নিরাশ্রয় নারীর নিুবর্গত্বকে প্রকাশ করে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে সরাসরি মালো জীবনের দুঃখগাথা অঙ্কন করেছেন। এ সম্প্রদায়ের জীবন যথাযথ রূপায়ণের যে চেষ্টা এ উপন্যাসে দেখা যায় তা অত্যন্ত বাস্তব। তিতাস তীরবর্তী গ্রামগুলোর সবুজের ছড়াছড়ি ও পাকা ধানের মাদকতাময় গন্ধ পাঠককে নিয়ে যায় ভিন্ন এক জগতে। সেই সঙ্গে পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয় সহজ-সরল গ্রাম্য মানুষের মুখচ্ছবি। ছোট-বড় অনেক চরিত্রের সমন্বয়ে এ উপন্যাস রচিত। অদ্বৈত সৃষ্ট কিশোর, সুবল, অনন্ত, বনমালী প্রমুখ অসংখ্য চরিত্র স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল। এ চরিত্রগুলোর মাধ্যমে মালো জীবনের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় তিনি তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন তাদের দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অনটনে বিপর্যস্ত জীবন। বিভিন্ন মত-পথ, ধর্ম-বর্ণের লোক কীভাবে একত্রে পরম ধৈর্যের সঙ্গে কষ্টগুলো অতিক্রম করে যেতে পারে পারস্পরিক সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে- তা স্পষ্ট হয় এ উপন্যাসে। চরিত্রগুলোর মুখে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ ও যথাযথ পরিবেশ বর্ণনার চেষ্টায় সফল হয়েছেন ঔপন্যাসিক।
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ঔপন্যাসিকের সতীর্থ অধ্যাপক সুবোধ চৌধুরী বলেন- ‘আমি তিতাস দেখেছি। আমি সমুদ্র দেখেছি, পাহাড় দেখেছি। অনেক বিচিত্রতর মানুষের সঙ্গে মিশেছি। কিন্তু অদ্বৈত মল্লবর্মণের ছিল মানুষ সম্পর্কে সুগভীর ওহংরমযঃ, এমনটি আমাদের ছিল না। আমরা দেখেছি, দর্শকের মতো, ভালো হয়তো লেগেছে। তবে অদ্বৈত সবটুকু দেখেছেন শিল্পীর চোখে। তার সত্তার সঙ্গে তিতাস ছিল মিশে। এটা পৃথক করতে পারেননি তিনি, চানওনি। তার ওপর ছিল তার উদার দৃষ্টিভঙ্গি। ...প্রথম যখন পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছিলেন, আমি বলেছিলাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, আর কি তোমার বই নেবে? অদ্বৈত বললেন- সুবোধ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বড় Artist, Master artist কিন্তু বাওনের পোলা, রোমান্টিক। আর আমি তো ‘জাউয়ার পোলা’। আর কিছু বলেননি। পরিচয়ের এ প্রত্যক্ষতাই ছিল তার গৌরবের ভিত।’
ফলে এ কথা বলা বোধ করি অত্যুক্তি হয় না, গোকর্র্ণ গ্রামের ধীবর সম্প্রদায়ের জীবনচর্চা যে আন্তরিক মমতায় অদ্বৈত মল্লবর্মণ তুলে এনেছেন তার উপন্যাসে, তার তুলনা বাংলা সাহিত্যে বিরল। লেখক তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে এক উপেক্ষিত সমাজের জীবন সংগ্রামের এ কাহিনীকে দিয়েছেন অবিনশ্বরতা। চার খণ্ড ও দুটি পরিচ্ছদে রচিত এ উপন্যাসে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ পর্বে তিতাস নদীর বৈশিষ্ট্য, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তিতাস পাড়ের মালোদের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের চিত্র বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে আছে গৌরাঙ্গসুন্দর আর নিত্যানন্দ নামে দুই মালোর জীবন সংগ্রামের কাহিনী। এরাই অনন্তের মাকে নিয়ে যায় গোকর্ণঘাটে। গৌরাঙ্গ মালোর জীবন দারিদ্র্যে পিষ্ট এবং তার দিন আর চলে না তার উপস্থাপনা রয়েছে। গৌরাঙ্গের জীবনচিত্র থেকে সহজেই বোঝা যায়, তিতাসের জলের সঙ্গে তাদের জীবন বাঁধা। তিতাসে যখন জল কম থাকে তখন মালোদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। মানুষের জীবন কীভাবে নদীর পানির সঙ্গে জড়িত তারই ইঙ্গিত ফুটে উঠেছে উপন্যাসে। কত রকম পেশায় বাংলাদেশের মানুষ জড়িত সেটিও স্পষ্ট হয়। উপন্যাসের শেষভাগে গোকর্ণ গ্রামকে করে তোলা হয়েছে যেন এক হতাশাগ্রস্ত জনপদ। দেখে চেনার উপায় নেই এখানে একদিন জনবহুল এক মালোপাড়া ছিল। মালোপাড়ায় আর মালোরা নেই আছে শুধু জল। হায়রে তিতাস! মালোদের জীবন ছিল একদিন যার সঙ্গে বাঁধা। মালো সম্প্রদায়ের মানুষ কোনো কিছুর জন্য শপথ করলে তিতাসের জল নিয়েই শপথ করত। তাদের বিশ্বাস ছিল- তিতাস তাদের সঙ্গে ছলনা করবে না। অথচ মালোদের সেই বিশ্বাসকে তিতাস রিক্ত করে দেয়। মালোরা উদ্বাস্তু হয়ে যায় তিতাস থেকে। নদী তাদের আর মায়ের মতো আশ্রয় দেয় না। তিতাসের কোলে জন্মানো তিতাসের সন্তানরা তিতাসেই হারিয়ে যায়। তিতাস পাড়ের মালোদের ঘরবাড়ি সম্পর্কে উপন্যাসের ‘শূন্য ভিটাগুলিতে বর্ণনায় আছে’- ‘গাছ-গাছড়া হইয়াছে। তাতে বাতাস লাগিয়া শোঁ শোঁ শব্দ হয়। এখানে পড়িয়া যারা মরিয়াছে, সেই শব্দে তারাই বুঝি বা নিঃশ্বাস ফেলে।’
অস্বীকারের উপায় নেই যে- ‘তিতাসের গৌরবান্বিত বর্ণনায় উপন্যাসের কাহিনী শুরু হলেও শেষ হয় দীর্ঘ হতাশ্বাসের মধ্য দিয়ে। নদী কীভাবে মানুষের কবিতা হয়ে ওঠে সেটি এ উপন্যাসে ফুটে উঠেছে। প্রায় প্রতিটি চরিত্রই শেষ পর্যন্ত হেরে গেছে তিতাসের রূপ পরিবর্তনের কাছে। তিতাসের বুকে চর জেগে ওঠায় তিতাস তার সন্তানদের মতো নুইয়ে পড়েছে।’ দেখা যায় উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাসন্তী আর পিতা রামকেশব জীবিত থাকে। দুজনেই নিঃস্ব, রিক্ত। রামকেশব তার পুত্রকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিল তা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। কিশোর অনন্তের মাকে বিয়ে করার পর যখন স্ত্রীকে হারিয়ে পাগল হয়ে যায় তারপরও আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে শেষ পর্যন্ত রামকেশব বেঁচে থাকে। চোখের সামনে পুত্রের এ নির্মম পরিণতিতে বিধ্বস্ত হয় পিতা রামকেশবের দেহমন। আর অনন্তের মা শেষ পর্যন্ত ঠাহর করতে পারে কিশোরই ছিল তার স্বামী। কিন্তু যখনই সে কিশোরের সেবা শুরু করে তখনই সমাজ বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত গণপিটুনিতে দুজনই মারা যায়। সব অনুভূতি মিশে যায় তিতাসের জলে।
‘নদীর একটা দার্শনিক রূপ আছে। নদী বহিয়া চলে।... তিতাসও কতকাল ধরিয়া বহিয়া চলিয়াছে’- তিতাসের এ বয়ে চলার সঙ্গে নদীতীরবর্তী হাজারো মানুষের কান্নার রোল অনন্ত প্রবহমান, যা অস্বীকারের সুযোগ নেই। তবে মহাকালের সঙ্গে নিুবর্গ মানুষের জীবনের ইতিহাস নিয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ যে দার্শনিক তত্ত্ব সৃষ্টি করেছেন, তা তাকে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে।
No comments