ফুটবল ও রাজনীতি- ফুটবল, গণতন্ত্র ও বিরোধী দল by এ কে এম জাকারিয়া
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র কী? ভারত,
নাকি ফুটবল? ভারতের নির্বাচন শেষ হয়েছে। মোদির শপথ, নতুন সরকার গঠন—এসব
কাজও সারা। ভারতকে আপাতত আমরা একটু রেহাই দিই। এখন বিশ্বকাপের সময়, মানে
ফুটবলের। সবই এখন ফুটবলময়। ফুটবলই এখন সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। গত বিশ্বকাপের
(২০১০) আগে ফুটবল-বন্দনা করতে গিয়ে টাইম সাময়িকী তাদের সম্পাদকীয় কলামে
ফুটবলকে ‘সবচেয়ে গণতান্ত্রিক খেলা’ হিসেবে উল্লেখ করেছিল। তাদের যুক্তিটা
ছিল অনেকটা এ রকম: ‘এটা যেকোনো জায়গায় প্রায় যেকোনো বস্তু দিয়ে খেলা
সম্ভব। ফুটবল না পাওয়া গেলে একটি টিনের ক্যান, এক টুকরা পাথর বা এক জোড়া
মোড়ানো মোজা—ফুটবল খেলার জন্য সবই সই। এ খেলা খেলতে কোনো সাজসরঞ্জাম
লাগে না, কোনো প্যাড বা হেলমেটেরও দরকার নেই। এমনকি এর জন্য কোনো
খেলোয়াড়ের ছয় ফুট আট ইঞ্চি লম্বা হওয়ারও দরকার নেই। আপনাকে শুধু একটু
ক্ষিপ্রগতির আর তুখোড় হলেই হবে। আর থাকতে হবে প্রচুর প্র্যাকটিস করার
ইচ্ছা। দুনিয়ার যেকোনো দেশ, যেকোনো ধর্ম, যেকোনো গোত্র বা যেকোনো
অর্থনৈতিক অবস্থা থেকেই উঠে আসুক না কেন, ফুটবলে গ্রেট খেলোয়াড় হতে তা
কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
টাইম সাময়িকীর এই মন্তব্যের সূত্র ধরে তখন একটি লেখা লিখেছিলাম (ফুটবল কি ‘সবচেয়ে’ গণতান্ত্রিক খেলা? প্রথম আলো, ১৯ জুন ২০১০)। ফুটবল গণতান্ত্রিক, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। আবার ফুটবলের যে মাহাত্ম্যের কারণে আমরা একে গণতান্ত্রিক বলছি, সেই একই কারণে একে সাম্যবাদী খেলা হিসেবে ব্র্যান্ডিং করলেও ভুল হবে না। সাম্যবাদের দিনকাল এখন খারাপ, তাই গণতন্ত্রের সঙ্গে ফুটবলকে মেলানোই সম্ভবত ভালো। তবে ফুটবল ‘সবচেয়ে’ গণতান্ত্রিক কি না, সেই বিতর্কটাই ছিল এ লেখার বিষয়। কারণ, তখন এর বিরোধিতায় মাঠে (খেলার মাঠ নয়) নেমেছিলেন ম্যারাথন দৌড়বিদ এমবি ব্রুফুট৷
‘ফুটবল সবচেয়ে গণতান্ত্রিক খেলা হতেই পারে না’—টাইম সাময়িকীর সম্পাদকীয় আর লেখাগুলোর বিরোধিতা করেছেন ১৯৬৮ সালে বোস্টন ম্যারাথনে বিজয়ী এই দৌড়বিদ। তাঁর কাছে কোনটি সবচেয়ে গণতান্ত্রিক? খেলাটি অবশ্যই দৌড়। ‘দৌড়ানোর জন্য কোনো সাজসরঞ্জাম লাগে না, একাই দৌড়ানো যায়, অন্য কোনো খেলোয়াড়ের দরকার হয় না। আপনি তৈরি হবেন আর দৌড়ানো শুরু করবেন। এমনকি আপনি যদি চান বোস্টন, নিউইয়র্ক, শিকাগো, লন্ডন বা অন্য কোনো বড় ম্যারাথনেও বিশ্বসেরাদের সঙ্গে দৌড়াতে পারবেন। আরও কিছু দরকার? আপনার চারপাশে দেখবেন দৌড়াচ্ছে অসংখ্য নারী।’—এই ছিল তাঁর যুক্তি।
তবে এখন সময়টা ফুটবলের, সব পক্ষপাত ফুটবলেই থাক। ‘এটাই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। সবখানে ও সব ধরনের মানুষ এই খেলা খেলে, উপভোগ করে এবং তাদের মনোযোগের মধ্যে থাকে।’ ফুটবল লেখক ও বিশেষজ্ঞ জেসি ফিঙ্কের এই বক্তব্যকেই আমরা ফুটবল-পাগলামির এই সময়ে সঠিক মেনে নিই। তবে ফুটবল কি শুধু নিজেই ‘গণতান্ত্রিক’ হয়ে বসে আছে, নাকি রাজনৈতিক দুনিয়ার যে ‘গণতন্ত্র’, তার সঙ্গেও এর সম্পর্ক রয়েছে? গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক আন্দোলন বা গণতন্ত্রের বিকাশ ও সংগ্রামে ফুটবলের কোনো ভূমিকা থাকবে না, তা তো হতে পারে না!
গত বিশ্বকাপের (২০১০) আয়োজক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা দিয়ে শুরু করি। তখন কিউবার ক্রীড়া লেখক অ্যারিয়েল বি কয়া দেশটির রাজনৈতিক অতীত এবং এর সঙ্গে ফুটবলের সম্পর্ক মিলিয়ে একটি লেখা লিখেছিলেন ‘ফুটবলের জাদুকরি শক্তি’ শিরোনামে। লেখাটি তিনি শুরু করেছেন সেই রুবেন দ্বীপ দিয়ে, কেপটাউনের মুখোমুখি যে দ্বীপে একসময় আটকে রাখা হতো সে দেশের বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামীদের। ম্যান্ডেলার সেখানে কেটেছে ১৮ বছর। অ্যারিয়েল লিখেছেন, যাঁরা রুবেন দ্বীপে পা রেখেছেন তাঁরা বলেন, এর দেয়ালঘেরা কারাগার আর তার মধ্যে জমানো স্মৃতির মতোই দ্বীপটির মাটিও যেন ধূসর। এই ধূসরতা যেন এর ইতিহাসেরই রং। ...যাঁরা সেখানে গিয়েছেন, তাঁরা এ–ও বলেন, ফুটবল খেলাকে ঘিরেই বন্দী বিদ্রোহীরা নিজেদের ফিরে পেত। বন্দিত্বের হতাশার মধ্যে সেটাই ছিল একমাত্র মুক্ত জিনিস। শ্বেতাঙ্গ জেলারদের খেলা রাগবি ও ক্রিকেটের বিরুদ্ধে তারা বেছে নিয়েছিল ফুটবল। ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধানের খসড়া তৈরিতে অংশ নেওয়া টোকিও শেক্সওয়েল ছিলেন সেই কারা ফুটবল দলের সদস্য। তাঁর কথায়, ‘সত্যিকারভাবে বললে সেই খেলায় নিয়মকানুনের বালাই ছিল না। তবু সেই ফুটবল খেলাই আমাদের উদ্দীপ্ত ও আশাবাদী রাখত। আমরা যে বেঁচে আছি, তা এভাবেই টের পেতাম এবং ভেঙে পড়তাম না।’
ফুটবল তো শুধু গণতান্ত্রিক খেলাই নয়, প্রতিবাদেরও বড় শক্তি! বিশ্বকাপের এবারের আয়োজক দেশ ব্রাজিল। আধুনিক, গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী এক দেশ। বিশ্বকাপ আয়োজনের শক্তি-সামর্থ্য তো আর সব দেশের থাকে না। আমাদের অনেকের কাছেই ব্রাজিল আর ফুটবল মিলেমিশে একাকার। তবে ‘গণতান্ত্রিক’ খেলা ফুটবল নিয়ে এত মতামাতি যে দেশটিতে, দীর্ঘ ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেই গণতন্ত্রের বাইরেই থাকতে হয়েছে তাদের। ১৯৬৪ সালে চেপে বসা সামরিক শাসন হটেছে ১৯৮৫ সালে। সামরিক শাসকেরা এমনিতে হটে না, তাদের হটাতে হয়। এই আন্দোলনে জোরালোভাবেই শামিল ছিল ফুটবল।
১৯৮৩ সালের ঘটনা। ব্রাজিলের সাও পাওলোর মোরুম্বি স্টেডিয়ামে স্থানীয় চ্যাম্পিয়নশিপে শক্তিশালী সাও পাওলোর বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে করিন্থিয়ানস ক্লাব। দলটির খেলোয়াড়দের হাতে এক বড় ব্যানার: ‘হারি বা জিতি, আমরা সব সময় গণতন্ত্রের পক্ষে’। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ব্রাজিলজুড়ে তখন আন্দোলন জোরালো হতে শুরু করেছে। ফুটবল হয়ে ওঠে গণতন্ত্র উদ্ধারে আন্দোলনের এক বড় শক্তি।এর এক বছরের মাথায় ১৯৮৪ সালে সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দাবিতে ‘ডিরেক্ট (ইলেকশন) নাউ’ এই আন্দোলন চরমে পেঁৗছায়। ফলাফল, ১৯৮৫ সালে সরাসরি নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের পথে যাত্রা।
গণতন্ত্রের আন্দোলনে মাঠে নেমেছিল যে করিন্থিয়ানস ক্লাব, সেটি ১৯৮২ সালে স্পেন বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলের নেতৃত্ব দেওয়া মেডিসিনে ডক্টরেট ‘ডক্টর সক্রেটিস’-এর দল। ফুটবল নিয়ে গণতন্ত্রের আন্দোলনের শুরুটাও করেছিলেন এই ‘অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার’। তবে দেশ নয়, সক্রেটিস শুরুতে নেমেছিলেন ক্লাবের ভেতরের ব্যবস্থাপনা, গণতন্ত্র ও নির্বাচন—এসব নিয়ে৷ দলের সহযোদ্ধাদের নিয়ে আন্দোলনে নেমে তিনি দলে গণতন্ত্র কায়েম করে ছেড়েছিলেন৷ সক্রেটিসের ভাষ্য: ‘দলের সবার ভোট দেওয়ার একই অধিকার ছিল। ক্লাবের নানা সামগ্রীর রক্ষণাবেক্ষণ যে করত, সেই ব্যক্তিটি থেকে দলের প্রেসিডেন্ট, সবার ভোটের মূল্য ছিল এক।’
গণতন্ত্রের জন্য একটি ফুটবল দলের ভেতরকার এই আন্দোলন তখন গণমাধ্যমে পরিচিতি পায় ‘করিন্থিয়ানস ডেমোক্রেসি’ হিসেবে। পরে তা দেশের গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার আন্দোলনের সঙ্গে মিলেমিশে যায়। ফুটবলের শক্তি কাজে লাগে গণতন্ত্রের সংগ্রামে। দলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর গণতন্ত্রের পক্ষে ব্যানার নিয়ে মাঠে নামা শুরু করে করিন্থিয়ানস ক্লাব। এসব নিয়ে ডেমোক্রেসি ইন ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট নামে একটি ছবি তৈরি হয়েছে গত বছর। এর পরিচালক পেদ্রো অ্যাসবেগ বিবিসিতে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত গণতন্ত্রের জন্য করিন্থিয়ানস ক্লাবের এই আন্দোলনের ঘটনা খুবই অনন্য। ফুটবলের ইতিহাসে এ ধরনের উদাহরণ
আর নেই।
‘গণতান্ত্রিক’ খেলা ফুটবল হাজির থেকেছে গণতন্ত্রের সংগ্রামেও। গণতন্ত্র ও ফুটবল নিয়ে ফুটবল লেখক ও বিশেষজ্ঞ জেসি ফিঙ্কের একটি উদ্ধৃতি আগেই উল্লেখ করেছি। ফিফার নির্বাচন নিয়ে তাঁর একটি কলামের শিরোনাম হচ্ছে, ‘ফুটবল মানে গণতন্ত্র আর গণতন্ত্রে দরকার বিরোধী পক্ষ’। বিশ্বকাপ ফুটবল, ফুটবল ও গণতন্ত্র—এসব আলোচনায় আমাদের বাংলাদেশের জায়গা কোথায়? বিশ্বকাপ উত্তেজনায় শামিল থাকলেও বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজনেও নেই, প্রতিযোগিতায়ও নেই। ‘গণতান্ত্রিক’ খেলা ফুটবল বাংলাদেশে খুব সুবিধা করতে পারছে না। কিন্তু দেশের গণতন্ত্র? তার কী অবস্থা? নব্বইয়ের পর নির্বাচন আর গণতন্ত্র—এসব নিয়ে গণতন্ত্রের বিশ্ব আসরে বাংলাদেশ যে জায়গা করে নিতে শুরু করেছিল, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন তার বারোটা বাজিয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য ‘বিরোধী পক্ষ’ একটি দরকারি বিষয় হলেও তা থেকে বাংলাদেশ এখন অনেক অনেক দূরে।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
No comments