গণতন্ত্র মৃত, গণতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক by এ কে এম জাকারিয়া

মালয়েশিয়ার বিমানটি হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে পাইলটের যুক্ত থাকার বিষয়টি শুরু থেকেই আলোচিত হচ্ছিল৷ কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে পাইলটের শেষ কথা ছিল ‘সব ঠিক আছে, শুভরাত্রি’৷ এর পরপরই তা হারিয়ে যাওয়ায় মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সন্দেহ, পাইলট সম্ভবত কিছু লুকাতে চেয়েছেন৷ এ সন্দেহ আরও জোরদার হয়, যখন সেই পাইলট জাহারে আহমদের একটি বিশেষ টি-শার্ট পরা ছবি প্রকাশিত হয়৷

‘ডেমোক্রেসি ইজ ডেড’-টি-শার্টের বুকে এমন লেখা থাকায় অনেকে ধরে নিয়েছেন, এই পাইলট মালয়েশিয়ার কারাবন্দী রাজনৈতিক নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের সমর্থক এবং সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ করতেই তিনি বিমানটি হাইজ্যাক বা এ ধরনের কিছু করেছেন৷ বিমানটি এখনো পাওয়া যায়নি বা এর নিখোঁজের কারণও এখনো অজ্ঞাত৷ কিন্তু ‘ডেমোক্রেসি ইজ ডেড’ বা গণতন্ত্র মৃত—এ বাক্য বা বক্তব্য যে কঠোরভাবে রাজনৈতিক ও সংবেদনশীল, সেটা টের পেলাম৷
মালয়েশিয়ার নিখোঁজ বিমান বা এর পাইলট নন, আমাদের আলোচনার বিষয় গণতন্ত্র৷ পশ্চিমের দুনিয়া, যাকে আমরা গণতন্ত্রের ভূমি বলে জানি, আলো-বাতাস বা সার ইত্যাদি নিশ্চিত করে যেখানে গণতন্ত্রের এ গাছকে পরিচর্যা করা হচ্ছে বলে আমাদের ধারণা, সেখানেই এসব প্রশ্ন উঠছে দীর্ঘদিন ধরে৷ ভোট-নির্বাচন বা এর মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন—এসবই হয়তো হচ্ছে, কিন্তু গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায়, তা িক আসলে কাজ করছে? নাকি নামেই গণতন্ত্র? ‘গণতন্ত্র মারা গেছে’—এমন কথা বলতে শুরু করেছেন অনেকে৷ তবে গণতন্ত্রকে মৃত ঘোষণা করে আবার এর দীর্ঘ জীবনও কামনা করা হচ্ছে৷ বিষয়টি অনেকটা ‘দ্য কিং ইজ ডেড, লং লিভ দ্য কিং’-এর মতো৷ কিন্তু কেন এসব প্রশ্ন উঠছে? যাঁরা এসব প্রশ্ন তুলছেন, তাঁরা বলছেন, গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায় বা এর যা সংজ্ঞা, সে অনুযায়ী এখন আর তা কাজ করছে না৷
গণতন্ত্র মানে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে বানানো সরকারের মাধ্যমে দেশ চালানো অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার অথবা এমন একটি সমাজ, যেখানে সবার অধিকার সমান৷ যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নাকি গণতন্ত্রের এ সংজ্ঞা অনুযায়ী দেশটি খুবই কম পরিচালিত হয়েছে আর সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে গণতন্ত্র একটি তামাশায় পরিণত হয়েছে৷ নিউইয়র্কভিত্তিক কলাম লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট মার্গারেট কিম্বারলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্পর্কে এমনটিই মনে করেন৷ ‘ডেমোক্রেসি ইজ ডেড’ শিরোনামের অতি সাম্প্রতিক (২৬ এপ্রিল ২০১৪, ইউরেশিয়া রিভিউ) এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে তাদের সরকার কী করে, সে ব্যাপারে সাধারণ জনগণের কার্যত কোনোই প্রভাব নেই৷’ একটি দেশে সাধারণ জনগণই তো সংখ্যাগরিষ্ঠ৷ সরকারের কাজে যদি তাঁদের কোনো প্রভাব না থাকে, তবে সেটা গণতন্ত্র হলো কীভাবে? গণতন্ত্র তো সেখানে মৃতই৷
মার্গারেট কিম্বারলে তাঁর যুক্তির সপক্ষে প্রিস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্টিন গিলেন্স ও নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির বেঞ্জামিন পেজের এক গবেষণা সমীক্ষাকে (৯ এপ্রিল ২০১৪) সাক্ষী মেনেছেন৷ মার্কিন রাজনীতিতে এলিট, ইন্টারেস্ট গ্রুপ ও সাধারণ মানুষের অবস্থান নিয়ে এ সমীক্ষার (টেস্টিং থিওরিজ অব আমেরিকান পলিটিকস; এলিটস, ইন্টারেস্টস গ্রুপ অ্যান্ড এভারেজ সিটিজেনস) সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, ‘ব্যবসার স্বার্থ রক্ষা করে, এমন অর্থনৈতিক এলিট ও সংগঠিত গোষ্ঠীর ব্যাপক এবং স্বাধীন প্রভাব রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে৷ অন্যদিকে, জনস্বার্থ রক্ষা করবে, এমন কোনো গ্রুপ ও সাধারণ জনগণের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে খুবই সামান্য বা স্বাধীন কোনো ভূমিকাই নেই৷ আমাদের গবেষণার ফলাফল অর্থনৈতিক এলিট ও পক্ষপাতমূলক বহুত্ববাদের প্রাধান্যের তত্ত্বকেই সমর্থন করছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচনী গণতন্ত্র বা সংখ্যাগরিষ্ঠ বহুত্ববাদের তত্ত্ব মোটেই খাটছে না৷’
তবে এ ধরনের আলোচনা যে খুব সাম্প্রতিক, তা নয়৷ অনেকটা একই ধরনের বিষয় নিয়ে ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জ্যাকব এস হ্যাকার ও পল পিয়ারসনের উইনার-টেক-অল পলিটিকস বইটি সাড়া ফেলে দিয়েছিল৷ সেখানে দেখানো হয়েছিল, ‘কীভাবে ওয়াশিংটন ধনীদের আরও ধনী বানাচ্ছে এবং মধ্যবিত্তদের কাছ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে’৷ তাঁরা দেখিয়েছেন, ১৯৭৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আয়বৈষম্য চরম হারে বাড়ছে৷ মূল্যস্ফীতি দেখা দেওয়ার পর দেশটির সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ জনগোষ্ঠীর আয় বেড়েছে ২৫৬ শতাংশ৷ অন্যদিকে, নিম্ন আয়ের ৮০ ভাগ জনগোষ্ঠীর আয় বেড়েছে মাত্র ২০ শতাংশ৷ এটা স্বাভাবিক বা বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতার কারণে হয়নি, হয়েছে রাজনৈতিক কারণে৷ বইটিতে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, মার্কিন অর্থনীতির এই যে অসাম্য, তা পুরোপুরি রাজনৈতিক৷ সমাজে যাঁরা এমনিতেই নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন ও পাচ্ছেন, তাঁদের আরও সুযোগ দেওয়ার জন্যই নানা কিছু করা হচ্ছে৷ এ জন্য বাজারকে নিজেদের মতো বাগে রাখা জরুরি৷ সেই বিবেচনা থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সব নীতিনির্ধারণ হয়ে থাকে এবং এটা পুরোপুরি উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই করা হয়৷ আর এর শিকার হচ্ছে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অসচেতন জনগণ৷
মার্গারেট কিম্বারলে তাঁর ‘ডেমোক্রেসি ইজ ডেড’ লেখাটি শেষ করেছেন এভাবে: ‘কয়েক বছর পরপর জনগণ ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেন, এটা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র আর কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়৷’ ভোট বা ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের বিষয়টিকেই শুধু গণতন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না৷ ধনী-গিরবের বৈষম্য, অর্থনৈতিক অসাম্য, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামত বা তাঁদের কল্যাণের প্রতিফলন না ঘটা, সবার ক্ষেত্রে আইন সমভাবে কাজ না করা—এসব বিষয়কে গণতন্ত্র থেকে আলাদা করার সুযোগ নেই৷ কোনো দেশে বাস্তবে এর দেখা না পেয়ে গণতন্ত্রকে ‘মৃত’ বলে দেখছেন বা ঘোষণা করছেন অনেকে৷
গণতান্ত্রিক দুনিয়া বলে যাদের জানি, তাদের দেশেই গণতন্ত্রের এ দশা! এর মধ্যে কোথায় আছে বাংলাদেশ? গণতন্ত্রের সঙ্গে যে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা এবং জনকল্যাণ, মানবাধিকার বা আইনের সমান আশ্রয় পাওয়ার অধিকারের মতো বিষয়গুলো রয়েছে, তা সম্ভবত আমরা এখন বিবেচনার বাইরে রাখছি৷ আমাদের সমস্যাটি যে এখন প্রাক্-মৌলিক অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে! যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র নাকি ‘কয়েক বছর পরপর’ ভোটকেন্দ্রে যাওয়া৷ বাংলাদেশের ‘গণতন্ত্র’ বা গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জনগণকে সেই সুযোগও দেয়নি৷ ‘গণতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ রক্ষা, বা ‘বৈধ’ যে নির্বাচনটি দেশে হয়েছে, তাতে অর্ধেকের বেশি আসনের ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়নি৷ এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশে সংসদ হয়েছে, সরকার হয়েছে, ‘বিরোধী দল’ বলেও একটি বিষয় রয়েছে, কিন্তু ‘গণতন্ত্র’ বলতে যা বোঝায় তা টিকল িক? এখানে িক গণতন্ত্র প্রাণ নিয়ে বেঁচে আছে? নাকি মারা গেছে?
‘ডেমোক্রেসি ইজ ডেড’ লেখা টি-শার্ট পরায় মালয়েশিয়ার নিখোঁজ বিমানের পাইলটকে আনোয়ার ইব্রাহিমের সমর্থক হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে৷ বাংলাদেশে গণতন্ত্র আদৌ বেঁচে আছে িক না, এ প্রশ্ন কেউ তুললে বা গণতন্ত্রকে ‘মৃত’ ঘোষণা করলে কে কার সমর্থক হিসেবে বিবেচিত হবেন কে জানে! ‘বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্র নেই, এর মৃত্যু হয়েছে’—সম্প্রতি বিভিন্ন সময় খালেদা জিয়ার মুখ থেকে এ ধরেনর মন্তব্য বের হওয়ায় এ বিপদ আরও বেড়ে গেছে৷ কিন্তু নির্বাচন বর্জন করে তিনিও যে গণতন্ত্র ‘হত্যায়’ শামিল আছেন, সেটা তাঁর বিবেচনায় আছে কিনা কে জানে! সম্ভবত এসব কারণেই আমাদের কারও মুখেই এখন গণতন্ত্রের কী অবস্থা এ প্রশ্ন আর নেই৷ আবার আমরা অনেকেই হয়তো ধরে নিচ্ছি, সবকিছুই ঠিকমতো চলছে, আর সরকারও সবকিছুর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে৷ এ পরিস্থিতি কোনোভাবেই স্বাভাবিক হতে পারে না৷ এমন অবস্থায় আর যা-ই হোক, গণতন্ত্র বেঁচে থাকে না৷
‘কিং ইজ ডেড, লং লিভ দ্য কিং’ বা ‘রাজা মারা গেছেন, রাজা দীর্ঘজীবী হোক’—ফরািস দেশে এ বাগ্ধারা চালু হয়েছিল রাজার মৃত্যুসংবাদ ও একই সঙ্গে নতুন রাজার নাম ঘোষণার জন্য৷ সে যুগ বাসি হয়েছে৷ এখন গণতন্ত্র যেখানে বা যে অবস্থায়ই ‘মারা’ যাক না কেন, সঙ্গে সঙ্গেই নতুন গণতন্ত্র ও এর দীর্ঘ জীবনও কামনা করতে হবে৷ গণতন্ত্র ছাড়া দুনিয়ার সামনেও কোনো পথ নেই! গণতন্ত্রের একমাত্র বিকল্প তো আরও গণতন্ত্র৷ গণতন্ত্র ‘মারা’ গিয়ে থাকলে এখনকার লড়াইটা অবশ্যই আরও গণতন্ত্রের জন্য৷
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.