আল-সিসি বনাম হামদিন সাবাহি by কামাল গাবালা
মিসরীয়দের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে
প্রার্থী হওয়ার সব সুযোগ গত মাসে শেষ হয়ে গেছে৷ চলতি মাসে অনুষ্ঠেয়
নির্বাচনে লড়াই হবে সাবেক সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ও বামপন্থী
রাজনীতিিবদ হামদিন সাবাহির মধ্যে৷ আগামী ২৬ ও ২৭ মের নির্বাচনে সিসিই জয়ী
হবেন বলে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকেরা মনে করছেন৷
একই সঙ্গে সাবাহিও মনে করছেন, তিনি জয়ী হবেন৷ ২০১২ সালের নির্বাচনে তিনি ২০ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন৷ সাবাহি সম্প্রতি একটি পত্রিকাকে বলেছেন, তিনি আসন্ন নির্বাচনে ৫২ শতাংশ ভোটে জয়ী হবেন৷ তিনি জোর দিয়ে বলেন, একটি সফল রাষ্ট্রে দারিদ্র্য দূর করতে হলে সফল ব্যবস্থাপনা দরকার৷ তিনি আরও বলেন, এই রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷ একই সঙ্গে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে এবং সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শেষ করতে হবে৷
দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার প্যাট্রিক কিংসলি বলেছেন, সাবাহির চেয়ে সিসির জনসমর্থন অনেক বেশি৷ তিনি বলেন, সিসির পেছনে সমর্থন জোগাচ্ছে সেনাবািহনী; তাদের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি পক্ষপাতদুষ্ট গণমাধ্যমও সিসিকে সমর্থন করছে৷ কিংসলি বলেছেন, নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে অধিকারকর্মী ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলোর মধ্যে শঙ্কা বিরাজ করছে৷
গত বছর মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচিত প্রেিসডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে উৎখাত করার পর অন্তত ১৬ হাজার ইসলামপন্থী মানুষকে কারাগারে ঢোকানো হয়েছে৷ এই হিসাব সবচেয়ে রক্ষণশীল সূত্রের৷ আর নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, অনেকেই মিসরে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন৷ কারণ, মিসরের একটি আদালত মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে৷ গত তিন বছরে মিসরে তিনটি বিপ্লব ঘটে গেছে৷ ফলে, সেখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিিতশীলতা ফিরিয়ে আনাই এখন মুখ্য ব্যাপার৷ অধিকাংশ মিসরীয় মনে করছেন, সিসিই এ কাজ করতে পারবেন৷
অন্যদিকে, অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, সিসি নির্বাচিত হলেও তঁাকে ঠিক গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের কাতারে ফেলা যাবে না৷ ব্যবসায়ীদের অনেকে হয়তো তঁাকে ভোট দেবেন, তঁারা মনে করেন সিসি মিসরে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে পারবেন৷ ফলে, বিদেিশ বিনিয়োগকারীরা সেখানে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেন৷ কয়েক সপ্তাহ আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি কোম্পানি মিসরে প্রায় ১০ লাখ গৃহ নির্মাণের লক্ষ্যে ৪০ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷ এদিকে কোরিয়ার স্যামসাং কোম্পািন সম্ভবত মিসরে কয়েক শ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে একটি কারখানা স্থাপন করবে৷ কোকো-কোলা কোম্পানিও আরবের সবচেয়ে জনবহুল এই দেশে আধা বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে৷
গত ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক অব আমেরিকার একটি প্রতিবেদনে সিসির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাকে বাজারের জন্য স্বল্প মেয়াদে ভালো হবে বলে উল্লেখ করেছে৷ কারণ, উপসাগরীয় অঞ্চলে আর্থিক সহযোগিতা ছাড়াও কিছু বিনিয়োগের বিষয়য়ে ঐকমত্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকেও মিসরে আর্থিক সহায়তা আসবে৷ প্রতিবেদনে অবশ্য সিসিকে একটি বিষয়ে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে৷ তিনি নাকি হোসনি মোবারকের সমর্থকদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন৷ প্রতিবেদনে মোবারকের সমর্থকদের দুর্নীতিগ্রস্ত ও অক্ষম বলে অভিহিত করা হয়েছে৷ ফরেন পলিসি সাময়িকী মোহাম্মেদ-আল দাহসানকে উদ্ধৃত করে বলেছে, তিনি সিসির অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অস্বচ্ছ বলে বর্ণনা করেছেন৷ তবে তঁার অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রবিষয়ক রাজনৈতিক লক্ষ্য পরিষ্কার৷ দাহসান একজন রাজনৈতিক পণ্ডিত৷ তিনি বলেন, সিসি মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে খুশি করার চেষ্টা করছেন৷ গাজা আগ্রাসনে তঁারও সমর্থন আছে৷
লেখক বলেছেন, সিসি একদল বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরিবেষ্টিত আছেন, তঁারা রাজনৈতিক কর্মসূচি ঠিক করছেন, আগামী সপ্তাহে তা জনসমক্ষে আসবে৷ দাহসান সিসির কিছু বক্তব্য বিশ্লেষণ করেছেন, এগুলোর বেশির ভাগ মূলধারার সংবাদমাধ্যমে ফঁাস হয়েছে৷ এসব বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘কেউ িক তঁার মাসের বেতন গরিবদের দান করার কথা ভেবেছেন? কেউ িক হেঁটে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছেন? এতে তো দেশের কিছু টাকা বঁাচে? মিসরের সমস্য কী আমি তা জানি...কথা দিয়ে মিসরের উন্নতি হবে না, কাজ করতে হবে, নিঃস্বার্থ হতে হবে...মিসরের জন্য একটি বা দুটি প্রজন্ম লাগবে৷’ লেখক মনে করেন, সিসির এসব বক্তব্যে তঁার কঠোর নীতি গ্রহণের পূর্বাভাস আছে৷ যেমন, কর বাড়ানো, গণপরিবহনে ভর্তুকি কমানো ইত্যাদি৷ মুরসির বিদায়ের পর বেবলাভির অন্তর্বর্তী সরকার ঠিক এর উল্টো কাজ করেছিল৷ ২০১৩ সালে তারা ক্ষমতায় বসে এবং কয়েক মাস আগে পদত্যাগ করে৷ বেবলাভি সরকার গালফ এইড গ্রহণ করেছিল৷ ব্যয় বাড়ানো ও ঋণ পরিশোধ ছিল এর মূল্য লক্ষ্য৷ আশা ছিল, ২৫ জানুয়ারির বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর অর্থনীতিতে যে শ্লথগতি এসেছিল, তা দূর করা যাবে৷
এখন ফিরে আসা যাক সিসি ও সাবাহির প্রসঙ্গে৷ সিসির শিকড় নিহিত আছে মনোফেয়া এলাকায়৷ ৮০ বছর আগে তঁার বাবা সেখান থেকে উঠে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন কায়রোর আল গামেয়িলা এলাকায়৷ স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য এই এলাকাটি সুবিধাজনক৷ সিসির বাবা দুটি বিয়ে করেছিলেন, তঁার সন্তান ১১ জন৷ সিসি কৈশোরে ‘আল-শেখ আবদেল ফাত্তাহ আল- সিসি’ নামে পরিচিত ছিলেন৷ কারণ, পবিত্র কোরআন তঁার মুখস্থ ছিল; তিনি পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতও করতে পারতেন৷ সিসির জন্ম হয় ১৯৫৪ সালের ১৯ নভেম্বর৷ আর্মি একাডেমি থেকে ১৯৭৭ সালে স্নাতক করেন৷ তিনি একজন পেশাদার সেনা কর্মকর্তা৷ শেষ পর্যন্ত তিনি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দাপ্রধান হন৷
সিসি বিবাহিত৷ তঁার তিন ছেলে ও এক মেয়ে, তঁার স্ত্রী বোরকা পরেন৷ তঁার পরিবারের কজন সদস্য নাকি চান না যে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন৷ তঁারা ভীত৷ কারণ, কালপরিক্রমায় মিসর সবদিক থেকেই এক কঠিন সময় পার করছে৷ বিশেষত, রাজনৈতিকভাবে৷ মোবারকের বিরুদ্ধে গণ–অভ্যুত্থান ও বিদ্রোহের প্রতি সিসি খুব একটা সমর্থন দেখাননি; যারা তা সমর্থন করেছিল, তাদের প্রতিও নয়৷ এমনকি মুসলিম ব্রাদারহুড, হোসনি মোবারক ও আনোয়ার সাদাতের আমলের সরকারি কর্মকর্তাদেরও তিনি চাকরি থেকে বিতাড়িত করবেন—এমন কোনো লক্ষণ তঁার মধ্যে নেই৷
হামদিন সাবাহির একজন সহপাঠী হিসেবে আমি ভাগ্যবান, ৪২ বছর ধরে আমি তঁার বন্ধু৷ ১৯৭২ সালে কায়রোর মিডিয়া কলেজে আমরা একসঙ্গে পড়েছি৷ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে আমি তঁাকে লড়তে দেখেছি৷ তঁাকে সামাজিক ন্যায়বিচার, মানুষের মর্যাদা ও জাতীয় স্বাধীনতার জন্যও লড়তে দেখেছি৷
মিসরের সাবেক স্বৈরশাসক আনোয়ার সাদাতের সামনে তিনি বুক চিতিয়ে দঁাড়িয়েছিলেন৷ তারপর মোবারকের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সাহসী লড়াই করেছেন৷ গিরব ও কৃষকদের জন্য তিনি লড়াই করেছেন৷ এ কারণে তঁাকে ১৩ বার জেলে যেতে হয়েছে৷ মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যকার যোগসাজশের বিরুদ্ধেও তিনি লড়েছেন৷
সাবাহি সাবেক সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধাচরণ করে বিপ্লব করতে চান না৷ কারণ, সেটা হলে মুসলিম ব্রাদারহুড ও ইহুদি রাষ্ট্রপন্থীরা লাভবান হবেন বলে তিনি মনে করেন৷ মিসরীয় সেনাবাহিনীর প্রতি তঁার সমর্থনের কথা তিনি সর্বদাই বলেন৷
সিসি ও সাবাহি উভয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকেই জাতীয় চরিত্র হিসেবে দেখানো যায়৷ গরমিলটা শুধু তঁাদের অভিজ্ঞতায় ও তঁাদের প্রতি জনগণের সমর্থনের মাত্রায়৷
কামাল গাবালা: মিসরের আল আহরাম পত্রিকা গোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।
No comments