স্যামসন এইচ চৌধুরী :আমাদের আলোকবর্তিকা by জামান সরদার
বাংলাদেশের
কিংবদন্তি উদ্যোক্তা স্যামসন এইচ চৌধুরী দুই বছর আগে এই দিনে শেষ
নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন বটে, তার জীবন ও কীর্তি আমাদের মাঝে দেদীপ্যমান।
প্রচারের আলো এড়িয়ে তিনি যদিও সারাজীবন হাজারো মানুষের জীবন আলোকিত করতে
চেয়েছেন, মৃত্যুর পরও তার জ্বালিয়ে রাখা আলো অবিনাশী বাতিঘরের মতো আমাদের
পথ দেখায়। অন্ধকারে পথ চেনায়, আলোকিত করে। বস্তুত আলো ও অন্ধকারের দ্বন্দ্ব
কেবল প্রকৃতিতে নয়, সমাজেও বিদ্যমান। রাতের অন্ধকার তাড়িয়ে শাশ্বত সূর্য
যেভাবে ধরাধাম আলোকিত করে; সেভাবে সমাজেও কিছু মানুষ থাকেন, যারা আলোর
পথযাত্রী। যারা নিজের মেধা, শ্রম ও ভালোবাসা দিয়ে সমাজের অন্ধকার দূর করেন।
আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। যুগে যুগে যেমন অন্ধকারের প্রতিনিধিরা
আমাদের ঢেকে দিতে চেয়েছে, পেছনে টেনে ধরতে চেয়েছে; তেমনই কিছু মানুষ তাদের
জীবন ও কর্ম দিয়ে আলো জ্বালাতে চেয়েছেন। কখনও কখনও নিজেই হয়ে উঠেছেন
আলোকবর্তিকা। স্যামসন এইচ চৌধুরী তাদেরই একজন। তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে
পুুণ্য স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। নতুন প্রজন্মের কাছে তার জীবনী
রূপকথার মতোই মনে হবে। আমরা জানি, স্যামসন এইচ চৌধুরী ১৯২৬ সালের ২৫
সেপ্টেম্বর এখনকার গোপালগঞ্জ জেলার অরুয়াকান্দিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা
ইয়াকুব হোসাইন চৌধুরী, মায়ের নাম লতিকা চৌধুরী। ১৯৩০ সালে চাঁদপুরের
মিশন স্কুলে তার শিক্ষাজীবন সূচিত হয়। পিতা সেখানে মেডিকেল অফিসার হিসেবে
কর্মরত ছিলেন। ১৯৩২ সালে পিতা বদলি হলে পাবনার আতাইকুলায় একটি গ্রামের
স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। পরে ভালো পড়াশোনার জন্য পিতা তাকে পাঠিয়ে দেন
ময়মনসিংহের ভিক্টোরিয়া মিশন স্কুলে। সেখানে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ার পর
পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুরে শিক্ষা সংঘ হাইস্কুলে গিয়ে ভর্তি হন ১৯৩৫ সালে।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৪২ সালে ফিরে আসেন পাবনায়। সেখানকার
আতাইকুলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন ১৯৪৩ সালে। সে বছরই পরিবারের
কাউকে না জানিয়ে ইন্ডিয়ান রয়েল নেভিতে যোগ দেন। তবে সেখানে বেশি দিন চাকরি
করতে পারেননি। ১৯৪৭ সালে ডাক বিভাগে যোগ দেন এবং ওই বছরই বিয়ে করেন অনিতা
চৌধুরীকে।
এর পরই তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। সরকারি চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন। তবে সেটা শুরু করেছিলেন খুব স্বল্প পরিসরে। ১৯৫২ সালে বাবার প্রতিষ্ঠিত 'হোসেন ফার্মেসী' দেখভাল শুরু করেন প্রথমে। বাবার পেশার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই ওষুধ নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন। বড় হয়ে ওষুধশিল্পে মনোনিবেশ এবং ক্রমে মহীরুহ হয়ে ওঠার বীজ হয়তো সেকালেই বোনা হয়েছিল। কয়েক বছর পর, ১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ধীরেন দত্তের কাছে গেলেন উদ্যমী যুবক স্যামসন এইচ চৌধুরী। ওষুধ কারখানা স্থাপনের একটা লাইসেন্স চাই। পেলেনও। তিন বন্ধুর সঙ্গে যুক্তভাবে প্রত্যেকে ২০ হাজার টাকা করে মোট ৮০ হাজার টাকায় পাবনায় কারখানা স্থাপন করলেন। নাম স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। চারজন অংশীদারের সমান মালিকানা আর প্রচেষ্টায় চলবে এ শিল্প_ এ প্রেরণা থেকেই এমন নাম। স্কয়ারের নামকরণ প্রসঙ্গে স্যামসন এইচ চৌধুরী একবার একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'এটি চার বন্ধুর প্রতিষ্ঠান। তা ছাড়া আমাদের চার হাত সমান। এর লোগোও তাই বর্গাকৃতির।'
এখন সবাই জানে, ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির লোকজনের কাছে তিনি আইকন। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসকে তিনি এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যেখানে স্কয়ার পণ্য শুধু দেশের বাজারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বিদেশে রফতানির তালিকায়ও শীর্ষে উঠে এসেছে। ১৯৫৬ সালের সেই ছোট্ট উদ্যোগ আজ বিশাল একটি গ্রুপে পরিণত হয়েছে। ২৭ হাজার কর্মীর এই বিশাল পরিবারের বার্ষিক আয় ৩০ কোটি ডলার। 'স্কয়ার' শুধু ওষুধেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়েছে প্রসাধন সামগ্রী, টেক্সটাইল, কৃষিপণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা এমনকি মিডিয়াতেও।
শুরুটা ছিল অন্য আট-দশটা শিল্প প্রতিষ্ঠানের মতোই সাধারণ। তবে প্রত্যয় আর দায়বদ্ধতার দিক থেকে স্বতন্ত্র। সে জন্যই পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে শুধু এগিয়ে চলা। ওষুধ থেকে শুরু। তারপর টেক্সটাইল, টয়লেট্রিজ, কনজুমার প্রডাক্টস, স্বাস্থ্যসেবা, মিডিয়া, এমনকি বাড়ির রান্নাঘরেও সগৌরব উপস্থিতি স্কয়ারের। ব্যবসা মানেই মুনাফা_ এ চেনাপথ ধরেই কি এ সাফল্য? নাকি আরও কিছু? 'আমার কাছে কোয়ালিটিই সবার আগে। সব পর্যায়েই আমরা কোয়ালিটি নিশ্চিত করি'_ ওই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন স্যামসন চৌধুরী।
কেবল কোম্পানি বা পণ্যের কোয়ালিটি নয়; বস্তুত উদ্যোক্তাদেরই একটি স্ট্যান্ডার্ড সেট করে গেছেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। অনেকেই তাকে চেনেন 'ব্যবসার জাদুকর' হিসেবে। যে ব্যবসাতেই তিনি হাত দিয়েছেন, সেই ব্যবসাতেই সোনা ফলেছে। তিনি হার মানেননি কোনো চ্যালেঞ্জের কাছেই। সবাই জানেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তা হিসেবে স্যামসন এইচ চৌধুরী হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন; রফতানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করে বিশ্বে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। তার এই সাফল্যও কম নয় যে, তিনি একটি জাতিকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছেন। প্রায় সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর দেশের ওষুধ খাত তার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ তো বটেই, অন্যতম প্রধান রফতানি খাতে পরিণত হয়েছে। গুণগত মান যদি বজায় রাখা যায়, তাহলে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে উৎপন্ন হয়েও যে বিশ্ববাজারে বাঘা বাঘা কোম্পানির সঙ্গে টেক্কা দিয়ে চলতে পারে_ সেই নজির আমাদের সামনে রেখে গেছেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে, তিনি দেখিয়েছেন সাধারণ একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও কীভাবে অসাধারণ হয়ে ওঠা যায়। অসাধারণ এই মানুষের জীবন ও কর্ম আমাদের পথের দিশা হোক। আলো ছড়াতে থাকুক অন্ধকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে।
সাংবাদিক
এর পরই তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। সরকারি চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন। তবে সেটা শুরু করেছিলেন খুব স্বল্প পরিসরে। ১৯৫২ সালে বাবার প্রতিষ্ঠিত 'হোসেন ফার্মেসী' দেখভাল শুরু করেন প্রথমে। বাবার পেশার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই ওষুধ নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন। বড় হয়ে ওষুধশিল্পে মনোনিবেশ এবং ক্রমে মহীরুহ হয়ে ওঠার বীজ হয়তো সেকালেই বোনা হয়েছিল। কয়েক বছর পর, ১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ধীরেন দত্তের কাছে গেলেন উদ্যমী যুবক স্যামসন এইচ চৌধুরী। ওষুধ কারখানা স্থাপনের একটা লাইসেন্স চাই। পেলেনও। তিন বন্ধুর সঙ্গে যুক্তভাবে প্রত্যেকে ২০ হাজার টাকা করে মোট ৮০ হাজার টাকায় পাবনায় কারখানা স্থাপন করলেন। নাম স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। চারজন অংশীদারের সমান মালিকানা আর প্রচেষ্টায় চলবে এ শিল্প_ এ প্রেরণা থেকেই এমন নাম। স্কয়ারের নামকরণ প্রসঙ্গে স্যামসন এইচ চৌধুরী একবার একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'এটি চার বন্ধুর প্রতিষ্ঠান। তা ছাড়া আমাদের চার হাত সমান। এর লোগোও তাই বর্গাকৃতির।'
এখন সবাই জানে, ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির লোকজনের কাছে তিনি আইকন। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসকে তিনি এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যেখানে স্কয়ার পণ্য শুধু দেশের বাজারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বিদেশে রফতানির তালিকায়ও শীর্ষে উঠে এসেছে। ১৯৫৬ সালের সেই ছোট্ট উদ্যোগ আজ বিশাল একটি গ্রুপে পরিণত হয়েছে। ২৭ হাজার কর্মীর এই বিশাল পরিবারের বার্ষিক আয় ৩০ কোটি ডলার। 'স্কয়ার' শুধু ওষুধেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়েছে প্রসাধন সামগ্রী, টেক্সটাইল, কৃষিপণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা এমনকি মিডিয়াতেও।
শুরুটা ছিল অন্য আট-দশটা শিল্প প্রতিষ্ঠানের মতোই সাধারণ। তবে প্রত্যয় আর দায়বদ্ধতার দিক থেকে স্বতন্ত্র। সে জন্যই পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে শুধু এগিয়ে চলা। ওষুধ থেকে শুরু। তারপর টেক্সটাইল, টয়লেট্রিজ, কনজুমার প্রডাক্টস, স্বাস্থ্যসেবা, মিডিয়া, এমনকি বাড়ির রান্নাঘরেও সগৌরব উপস্থিতি স্কয়ারের। ব্যবসা মানেই মুনাফা_ এ চেনাপথ ধরেই কি এ সাফল্য? নাকি আরও কিছু? 'আমার কাছে কোয়ালিটিই সবার আগে। সব পর্যায়েই আমরা কোয়ালিটি নিশ্চিত করি'_ ওই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন স্যামসন চৌধুরী।
কেবল কোম্পানি বা পণ্যের কোয়ালিটি নয়; বস্তুত উদ্যোক্তাদেরই একটি স্ট্যান্ডার্ড সেট করে গেছেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। অনেকেই তাকে চেনেন 'ব্যবসার জাদুকর' হিসেবে। যে ব্যবসাতেই তিনি হাত দিয়েছেন, সেই ব্যবসাতেই সোনা ফলেছে। তিনি হার মানেননি কোনো চ্যালেঞ্জের কাছেই। সবাই জানেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তা হিসেবে স্যামসন এইচ চৌধুরী হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন; রফতানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করে বিশ্বে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। তার এই সাফল্যও কম নয় যে, তিনি একটি জাতিকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছেন। প্রায় সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর দেশের ওষুধ খাত তার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ তো বটেই, অন্যতম প্রধান রফতানি খাতে পরিণত হয়েছে। গুণগত মান যদি বজায় রাখা যায়, তাহলে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে উৎপন্ন হয়েও যে বিশ্ববাজারে বাঘা বাঘা কোম্পানির সঙ্গে টেক্কা দিয়ে চলতে পারে_ সেই নজির আমাদের সামনে রেখে গেছেন স্যামসন এইচ চৌধুরী। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে, তিনি দেখিয়েছেন সাধারণ একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও কীভাবে অসাধারণ হয়ে ওঠা যায়। অসাধারণ এই মানুষের জীবন ও কর্ম আমাদের পথের দিশা হোক। আলো ছড়াতে থাকুক অন্ধকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে।
সাংবাদিক
No comments