ফিলিস্তিনিদের সামনে এবার কী?
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসিতে যোগদানের আবেদন জানিয়ে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের স্বাক্ষরিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের চিঠি এখন জাতিসংঘ সদর দপ্তরে। শুক্রবার জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র চিঠি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, আইসিসিসহ মোট ১৬টি আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্রে ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের স্বাক্ষরসহ কাগজপত্র মহাসচিবের দপ্তর পেয়েছে। তারা সেসব পরীক্ষাও শুরু করেছে। আবেদনের কাগজপত্র আইসিসির ১২২ সদস্যরাষ্ট্রের কাছেও একই সময়ে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বলে নিউইয়র্কে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের কাছে নিশ্চিত করেছেন। রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মনসুর আরও জানিয়েছেন, তাঁরা হেগে আদালতের রেজিস্ট্রারের কাছে পাঠানো এক পত্রে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিগত বছরে গাজা হামলার জন্য ভূতাপেক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণেরও অনুরোধ জানিয়েছেন। এ কথার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, আইসিসি অবিলম্বেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য তদন্ত শুরু করবে। বস্তুত, সে পর্যায়ে যাওয়ার আগে (যদি আদৌ আদালত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণে সম্মত হয়) ফিলিস্তিনকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। প্রথমত, আবেদনপত্র পরীক্ষার জন্য ফিলিস্তিনকে কমপক্ষে ৬০ দিন অপেক্ষা করতে হবে। কাগজপত্রে কোনো গলদ না পাওয়া গেলে কেবল এই সময়ের পরেই হয় সে নিজে বা তার পক্ষে আদালতের কোনো সদস্যরাষ্ট্র ফিলিস্তিন প্রশ্নে তদন্তের অনুরোধ জানাতে পারে। সে অনুরোধ পাওয়ার পর আদালতের প্রথম কাজ হবে এই কথা নিশ্চিত করা যে যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে, ইসরায়েল তার অভ্যন্তরীণ বিচারব্যবস্থায় সে বিষয়ে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। সে কথা প্রমাণিত হওয়ার পরেই কেবল প্রশ্ন উঠবে তদন্তের। একাধিক আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সত্ত্বেও আদালত সম্ভবত এই আবেদন আমলে নেবেন। এযাবৎ এই আদালত মুখ্যত আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সংঘটিত গণহত্যা তদন্তে তার সময় ও অর্থ ব্যয় করেছে। সে কারণে কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, আইসিসি কার্যত আফ্রিকার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদীদের একটি হাতিয়ার মাত্র। মাত্র গত মাসে কেনিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রমাণাভাবে বাতিল হয়েছে। সেটিও আদালতের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এই অবস্থায় নিজের কার্যকারিতা প্রমাণে আফ্রিকার বাইরের বহুল আলোচিত এই সমস্যাটি আদালত আমলে নিতে পারে। বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য উল্লেখ করেছেন, এই পর্যন্ত আইসিসি যে মামলাগুলো আমলে নিয়েছে তার সব কটিতেই ব্যাপক হারে গণহত্যার অভিযোগ ছিল। সেই তুলনায় গত বছর গাজায় মোট মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ২০০। অপরাধের মাত্রা তেমন ব্যাপক নয়, এই যুক্তিতে গত নভেম্বর মাসে আদালত গাজায় তুরস্কের পাঠানো খাদ্যবাহী জাহাজের ওপর ইসরায়েলি গুলিবর্ষণের বিষয়েও অভিযোগ গ্রহণে অস্বীকার করে। আদালতের জন্য অন্য বিবেচ্য হবে ঠিক কোন সীমানা ক্ষেত্রে তারা তদন্ত চালাবে। ফিলিস্তিনের সীমান্ত এখন পর্যন্ত চিহ্নিত নয়। ইসরায়েল এই আদালতের সদস্য নয়। আদালতের তদন্তে সে কোনো সাহায্য করবে এ কথা ভাবারও কোনো কারণ নেই। এ অবস্থায় তদন্ত পদ্ধতি নির্ধারণ ও তারপর সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত প্রদানে কয়েক বছর এমনকি এক দশকের বেশি সময় লেগে যেতে পারে।
ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎস-এর ভাষ্যকার আইয়েল গ্রস অবশ্য ভিন্ন কথা বলেছেন। ফিলিস্তিন যত দিন পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি, তত দিন আদালতের পক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া অসম্ভব ছিল। ২০১২ সালের এপ্রিলে তারা ২০০৮-০৯ সালে গাজায় ইসরায়েলি হামলা বিষয়ে তদন্তের অনুরোধ করেছিল, কিন্তু তা নাকচ করে দেওয়া হয় রাষ্ট্র নয়, এই যুক্তিতে। ২০১২ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনকে ‘নন-মেম্বার স্টেট’ (অর্থাৎ পূর্ণ রাষ্ট্র নয় কিন্তু পূর্ণাঙ্গ সদস্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। হারেৎস লিখেছে, ইসরায়েলের সম্ভাব্য অপরাধ তদন্তে আদালতের এখন আর কোনো বাধা থাকার কথা নয়। মাহমুদ আব্বাস আইসিসিসিতে যোগ দিচ্ছেন সে কথা ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম তীরের অধিকারহারা মানুষের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এক দিন পরে অবশ্য বাস্তবতা ভিন্ন জেনে তাদের উৎসাহ অনেকটা স্তিমিত হয়ে যায়। ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ঘোষণা করেছে। ওয়াশিংটন জানিয়ে দিয়েছে, তার পরামর্শ অগ্রাহ্য করে আইসিসিতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের জন্য ফিলিস্তিনকে কড়া মূল্য দিতে হবে। মুখে সুনির্দিষ্টভাবে না জানালেও ওয়াশিংটন ইঙ্গিত করেছে ফিলিস্তিনের অনুদান বন্ধ বা কাটছাঁট হতে পারে। মার্কিন কংগ্রেস বরাবরই ইসরায়েলের কট্টর সমর্থনের জন্য পরিচিত। ওবামা প্রশাসন নিজে থেকে বিশেষ কোনো উদ্যোগ না নিলে কংগ্রেস যে ফিলিস্তিনকে শাস্তি দিয়ে নানা রকম শর্তারোপ করবে, তা একরকম নিশ্চিত। ফিলিস্তিনের জন্য আশু সমস্যা সৃষ্টি করবে ইসরায়েল। তারা জানিয়ে দিয়েছে, আইসিসিতে যোগদানের শাস্তি হিসেবে তারা ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নেবে। এর মধ্যে থাকবে ফিলিস্তিন থেকে রপ্তানি করা পণ্যের ওপর আহরিত কর স্থানান্তর না করা। আঁধারের পাশাপাশি অবশ্য কিছু আলোও আছে। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক পশ্চিম ইউরোপীয় দেশ ফিলিস্তিনের প্রতি তাদের স্বীকৃতি জানিয়েছে, যা ইসরায়েলকে উদ্বিগ্ন করেছে। অধিকৃত অঞ্চলে তার গৃহীত ব্যবস্থার কারণে নতুন কোনো মানবিক দুর্যোগ সৃষ্টি হলে তা ইসরায়েলকে ইউরোপ বা বিশ্বের অন্যান্য দেশে অধিক জনপ্রিয় করে তুলবে না, সে কথা নিশ্চিত। মুখে যত হম্বিতম্বি করুক না কেন, ইসরায়েল নিজেও সে কথা জানে।
No comments