নির্বাচনী তামাশার গ্র্যান্ড শো আজ by ইনাম আহমেদ চৌধুরী
(দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন)
বাংলাদেশ থেকে সুবচন নির্বাসনে রয়েছে বহুদিন। সাম্প্রতিককালে অবশ্য আমরা
দেখছি সেই অনুপস্থিতির তীক্ষষ্টতম উচ্চারণ। আর আজ বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত
হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচন যাচ্ছে নির্বাসনে। আজকের আয়োজন নিয়ে ক্ষমতাসীন
পক্ষ নানা কথা বলছে বটে, সবই অসার ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। যে দৃষ্টিভঙ্গি
থেকে কিংবা যে অবস্থা থেকে আমরা তাকিয়ে দেখি না কেন, কিছুতেই মনকে প্রবোধ
দিয়ে বলতে পারি না আজ আমার প্রিয় স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশে সাধারণ
নির্বাচন হচ্ছে।
আজকের দিনে বিস্তারিত সংখ্যাতত্ত্বে যেতে চাচ্ছি না। সংবাদপত্রের কলামে, টেলিভিশনের টক শোয় এসব অনেকবারই বলা হয়ে গেছে। সাধারণ নাগরিকরাও এখন এসব জানে। সবাই জানে কীভাবে সংসদের অধিকাংশ আসনে 'অটো এমপিরা' একজন ভোটারের সমর্থন ছাড়াই 'নির্বাচিত' হয়ে গেছেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যে কোনো রাজনৈতিক দল, গণতন্ত্রমনা পক্ষ হতাশ ছাড়া কিছু হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন পক্ষ এ নিয়েও খোঁড়া যুক্তি খাড়া করছে, চোখ-কান বুজে এটাকে 'সাফল্য' হিসেবে প্রচার করছে। কৌতুককর হলেও ইতিমধ্যে 'সরকার' গঠনের মতো 'সংখ্যাগরিষ্ঠতা' নিয়ে নিয়েছে ক্ষমতাসীন জোট। আর বাকি আসনগুলোয় আজ যে অবস্থায় যে পরিস্থিতিতে এবং যে পরিবেশে ভোট প্রদান ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তা সংক্ষেপে দেখতে গেলে নিম্নরূপ_
প্রথমত, কোনো আসনেই সত্যিকার অর্থে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। কেননা, কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী দল অংশগ্রহণ করছে না। বস্তুতপক্ষে সার্বিকভাবে বিরোধী দলগুলো যে এভাবে নির্বাচন বর্জন করবে, তা আগে কখনও ভাবাই যায়নি। যারা অংশগ্রহণ করেছে, তারাও প্রচার-প্রচারণা নিয়ে গা করছে না। বরং অনেক এলাকায় দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী স্বতন্ত্র কিংবা নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রার্থীকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের মনোভাব এমনই যে যদি সম্ভব হয়, ৩০০ আসনেই তারা 'বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়' ওয়াকওভার পেতে যায়। ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার ব্যাপারও নয়; তারা যেন চায় কোনো গোলপোস্টই না থাকুক। এমনকি মাঠের সীমানা না থাকলে আরও ভালো। যেদিকে খুশি বল মারবে!
দ্বিতীয়ত, প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকা সম্পূর্ণভাবে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিরক্ষা বাহিনী কর্তৃক 'নিয়ন্ত্রিত'। আমাদের দেশে নির্বাচন যেখানে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করে, সেখানে এবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আতঙ্কের রাজত্ব। বিরোধীদলীয় জোটের বা জনসাধারণের আন্দোলনের তীব্রতার কারণে না যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি খোদ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ি এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের বাড়াবাড়ি। প্রকাশ্যই তারা বিভিন্ন স্থানে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বাড়িতে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করছে। বিরোধী দল অংশগ্রহণ করছে না, এটা ঠিক; কিন্তু এ ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো গণতান্ত্রিক বিরোধিতা দেখানোর কোনো সুযোগ খোদ সরকারই অবশিষ্ট রাখেনি। এ এক অভূতপূর্ব 'নির্বাচন'।
তৃতীয়ত, কোনো সন্দেহ নেই যে, যদিও দেশের অধিকাংশ ভোটার আজকে ভোট দেওয়ার অবকাশই পাচ্ছেন না, যারা পাচ্ছেন তারাও নিজস্ব কর্তব্য পালনের নৈতিকতা সম্পর্কে সন্দিহান। বিষয়টি নিছক আতঙ্কের নয়। ভোটাররা কেন এ ধরনের একটি নির্বাচনে ভোট দিতে যাবে? নূ্যনতম নৈতিকতা থাকলে কেউ কি এমন তামাশার অংশ হতে পারে?
পঞ্চমত, বিরোধী দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীই কারারুদ্ধ, অবরুদ্ধ বা হুলিয়াপ্রাপ্ত। আর বিরোধীদলীয় নেতা পর্যন্ত গৃহ-অবরুদ্ধ। তার বেরুবার কোনো সুযোগ নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন 'বাংকার সুরক্ষার' যেসব ব্যবস্থা আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখেছি, সে জাতীয় বালুবাহিত ট্রাক, জলকামান এবং বিভিন্ন প্রকারের (যার নাম দুর্ভাগ্যবশত আমার জানা নেই) মারণাস্ত্রসজ্জিত সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চকিত উপস্থিতি আজ তার বাড়ির সামনে। একই অবস্থান প্রধান বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও। দেশের অন্যান্য এলাকাতেও বিরোধীদলীয় কার্যালয়ের একই অবস্থা। তথাকথিত এই সাধারণ নির্বাচনে কোনো বিরোধী দলকেই কোনো সভা-সমিতি করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি সরকারের জোটভুক্ত যে জাতীয় পার্টি ছিল, তাদেরও একটি অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করে দেওয়া হলো!
ষষ্ঠত, সবাই যখন উপলব্ধি করতে পারছে, তথাকথিত নির্বাচনের কোনো যৌক্তিকতা কিংবা স্বীকৃতি থাকছে না, সেখানে এত অর্থ, লোকবলের অপচয় করে একটি সাংঘর্ষিক অবস্থাকে জিইয়ে রাখার মানেটাই বা কি হচ্ছে? এর সদুত্তর কি সরকার দেবে? মাননীয় অর্থমন্ত্রীসহ অনেক মন্ত্রীই তো অত্যাসন্ন আরেকটি নির্বাচনের কথা ভাবছেন। তারা হয়তো বুঝতে পেরেছেন সম্পূর্ণ নিরর্থক হচ্ছে এই প্রাণান্তর চেষ্টা। সেই উপলব্ধির ওপর ভিত্তি করেই কি সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হতো না?
আমার কথা পরিষ্কার। এ ধরনের একটি নিরুত্তাপ, নির্বাক, নিশ্চুপ নির্বাচন অনুষ্ঠানকে কি কোনো সংজ্ঞাতেই গণতান্ত্রিক সাধারণ নির্বাচন আখ্যায়িত করা যেতে পারে? মনে হচ্ছে, দেশে একটি কারফিউ অবস্থান বিদ্যমান। আশ্চর্যের কথা, দেশে যেসব নির্বাচনবিরোধী কাণ্ডকারখানা ঘটছে, তা যে কোনো সুনিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় নির্দেশে হচ্ছে, তা নয়। কোনো নেতার সঙ্গে অন্য নেতাকর্মীর যোগাযোগ নেই, বৈঠক নেই, আলোচনা নেই, সংবাদ সরবরাহ নেই। যা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ স্বতঃপ্রণোদিত। যে যেভাবে চাচ্ছে কিংবা পাচ্ছে, তার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। দুঃখের বিষয়, তা কখনও সাংঘর্ষিক রক্তক্ষয়ী বা সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক পরিবেশ বজায় রাখা হলে এসব নিশ্চয়ই হতো না।
বিশ্বের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং সংবাদমাধ্যমে আজ প্রকাশ পেয়েছে, অবরুদ্ধ বাংলাদেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রচেষ্টা চলছে, যাকে ইকোনমিস্ট আখ্যায়িত করেছে 'ফারসিক্যাল' অর্থাৎ প্রহসনের নির্বাচন হিসেবে। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে, সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা জিম্মি করে, কয়েকশ' প্রাণের বিনিময়ে বর্তমান সরকার যে তামাশার আয়োজন করেছে, আজ তার স্টেজ শো। এর আগে অবশ্য এই বিশ্বখ্যাত পত্রিকা লিখেছিল, মনে হচ্ছে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে আর পরাজয় ঘটবে বাংলাদেশের। আজ বাংলাদেশের সেই পরাজয়ের দিন সমাগত। লক্ষণীয় যে, কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা, জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, চীন এমনকি সরকার কর্তৃক বিশেষভাবে অনুরুদ্ধ রাশিয়াও কোনো পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। তাদের প্রশ্ন, কিসের পর্যবেক্ষক? কোথায় নির্বাচন? কী দেখতে আসব? নিরপেক্ষ দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোরও এই বক্তব্য। জানি না, সদাশয় সরকার এ অবস্থা দেখে এবং পর্যালোচনা করে কী সিদ্ধান্ত নেবে। বা কোনো প্রকারের সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করবে কি-না। তাদের কাছে একটিই অনুরোধ থাকবে। যখন তারা এ সিদ্ধান্ত নেবেন, তখন যেন তারা মনে রাখেন, বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্যের কথা। তাদের জীবন-সংগ্রামের কথা। গণতন্ত্র এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি তাদের আসক্তি ও নিষ্ঠার কথা এবং স্মরণ করেন সেই ৩০ লাখ শহীদের কথা, নিগৃহীত ও সংগ্রামী মানুষের কথা। যারা তাদের সর্বস্ব ত্যাগ করেও একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে ন্যায় বিচার থাকবে, গণতন্ত্র থাকবে, মানুষের বাঁচার অধিকার থাকবে। আর অধিকার থাকবে নিজের ভোট প্রয়োগ করে পছন্দমতো গঠিত সরকার দিয়ে শাসিত হওয়ার।
হায়! স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার দাবিদার একটি দলের নেতৃত্বেই আজ মুক্তিযুদ্ধের মূল যে চেতনা, সেই গণতন্ত্র, সেই মতপ্রকাশের অধিকার, সেই নিজের পছন্দমতো প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে! ক্ষমতাসীন পক্ষ স্বীকার করুক বা না করুক_ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ইতিহাসে আরেকটি কালো দিন যোগ হতে চলছে আজ। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগেরও আত্মহত্যার দিন।
ইনাম আহমেদ চৌধুরী :সাবেক সচিব ও কলাম লেখক; বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অনুলিখন
আজকের দিনে বিস্তারিত সংখ্যাতত্ত্বে যেতে চাচ্ছি না। সংবাদপত্রের কলামে, টেলিভিশনের টক শোয় এসব অনেকবারই বলা হয়ে গেছে। সাধারণ নাগরিকরাও এখন এসব জানে। সবাই জানে কীভাবে সংসদের অধিকাংশ আসনে 'অটো এমপিরা' একজন ভোটারের সমর্থন ছাড়াই 'নির্বাচিত' হয়ে গেছেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যে কোনো রাজনৈতিক দল, গণতন্ত্রমনা পক্ষ হতাশ ছাড়া কিছু হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন পক্ষ এ নিয়েও খোঁড়া যুক্তি খাড়া করছে, চোখ-কান বুজে এটাকে 'সাফল্য' হিসেবে প্রচার করছে। কৌতুককর হলেও ইতিমধ্যে 'সরকার' গঠনের মতো 'সংখ্যাগরিষ্ঠতা' নিয়ে নিয়েছে ক্ষমতাসীন জোট। আর বাকি আসনগুলোয় আজ যে অবস্থায় যে পরিস্থিতিতে এবং যে পরিবেশে ভোট প্রদান ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তা সংক্ষেপে দেখতে গেলে নিম্নরূপ_
প্রথমত, কোনো আসনেই সত্যিকার অর্থে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। কেননা, কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী দল অংশগ্রহণ করছে না। বস্তুতপক্ষে সার্বিকভাবে বিরোধী দলগুলো যে এভাবে নির্বাচন বর্জন করবে, তা আগে কখনও ভাবাই যায়নি। যারা অংশগ্রহণ করেছে, তারাও প্রচার-প্রচারণা নিয়ে গা করছে না। বরং অনেক এলাকায় দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী স্বতন্ত্র কিংবা নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রার্থীকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের মনোভাব এমনই যে যদি সম্ভব হয়, ৩০০ আসনেই তারা 'বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়' ওয়াকওভার পেতে যায়। ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার ব্যাপারও নয়; তারা যেন চায় কোনো গোলপোস্টই না থাকুক। এমনকি মাঠের সীমানা না থাকলে আরও ভালো। যেদিকে খুশি বল মারবে!
দ্বিতীয়ত, প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকা সম্পূর্ণভাবে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিরক্ষা বাহিনী কর্তৃক 'নিয়ন্ত্রিত'। আমাদের দেশে নির্বাচন যেখানে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করে, সেখানে এবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আতঙ্কের রাজত্ব। বিরোধীদলীয় জোটের বা জনসাধারণের আন্দোলনের তীব্রতার কারণে না যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি খোদ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ি এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের বাড়াবাড়ি। প্রকাশ্যই তারা বিভিন্ন স্থানে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বাড়িতে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করছে। বিরোধী দল অংশগ্রহণ করছে না, এটা ঠিক; কিন্তু এ ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো গণতান্ত্রিক বিরোধিতা দেখানোর কোনো সুযোগ খোদ সরকারই অবশিষ্ট রাখেনি। এ এক অভূতপূর্ব 'নির্বাচন'।
তৃতীয়ত, কোনো সন্দেহ নেই যে, যদিও দেশের অধিকাংশ ভোটার আজকে ভোট দেওয়ার অবকাশই পাচ্ছেন না, যারা পাচ্ছেন তারাও নিজস্ব কর্তব্য পালনের নৈতিকতা সম্পর্কে সন্দিহান। বিষয়টি নিছক আতঙ্কের নয়। ভোটাররা কেন এ ধরনের একটি নির্বাচনে ভোট দিতে যাবে? নূ্যনতম নৈতিকতা থাকলে কেউ কি এমন তামাশার অংশ হতে পারে?
পঞ্চমত, বিরোধী দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীই কারারুদ্ধ, অবরুদ্ধ বা হুলিয়াপ্রাপ্ত। আর বিরোধীদলীয় নেতা পর্যন্ত গৃহ-অবরুদ্ধ। তার বেরুবার কোনো সুযোগ নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন 'বাংকার সুরক্ষার' যেসব ব্যবস্থা আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখেছি, সে জাতীয় বালুবাহিত ট্রাক, জলকামান এবং বিভিন্ন প্রকারের (যার নাম দুর্ভাগ্যবশত আমার জানা নেই) মারণাস্ত্রসজ্জিত সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চকিত উপস্থিতি আজ তার বাড়ির সামনে। একই অবস্থান প্রধান বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও। দেশের অন্যান্য এলাকাতেও বিরোধীদলীয় কার্যালয়ের একই অবস্থা। তথাকথিত এই সাধারণ নির্বাচনে কোনো বিরোধী দলকেই কোনো সভা-সমিতি করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি সরকারের জোটভুক্ত যে জাতীয় পার্টি ছিল, তাদেরও একটি অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করে দেওয়া হলো!
ষষ্ঠত, সবাই যখন উপলব্ধি করতে পারছে, তথাকথিত নির্বাচনের কোনো যৌক্তিকতা কিংবা স্বীকৃতি থাকছে না, সেখানে এত অর্থ, লোকবলের অপচয় করে একটি সাংঘর্ষিক অবস্থাকে জিইয়ে রাখার মানেটাই বা কি হচ্ছে? এর সদুত্তর কি সরকার দেবে? মাননীয় অর্থমন্ত্রীসহ অনেক মন্ত্রীই তো অত্যাসন্ন আরেকটি নির্বাচনের কথা ভাবছেন। তারা হয়তো বুঝতে পেরেছেন সম্পূর্ণ নিরর্থক হচ্ছে এই প্রাণান্তর চেষ্টা। সেই উপলব্ধির ওপর ভিত্তি করেই কি সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হতো না?
আমার কথা পরিষ্কার। এ ধরনের একটি নিরুত্তাপ, নির্বাক, নিশ্চুপ নির্বাচন অনুষ্ঠানকে কি কোনো সংজ্ঞাতেই গণতান্ত্রিক সাধারণ নির্বাচন আখ্যায়িত করা যেতে পারে? মনে হচ্ছে, দেশে একটি কারফিউ অবস্থান বিদ্যমান। আশ্চর্যের কথা, দেশে যেসব নির্বাচনবিরোধী কাণ্ডকারখানা ঘটছে, তা যে কোনো সুনিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় নির্দেশে হচ্ছে, তা নয়। কোনো নেতার সঙ্গে অন্য নেতাকর্মীর যোগাযোগ নেই, বৈঠক নেই, আলোচনা নেই, সংবাদ সরবরাহ নেই। যা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ স্বতঃপ্রণোদিত। যে যেভাবে চাচ্ছে কিংবা পাচ্ছে, তার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। দুঃখের বিষয়, তা কখনও সাংঘর্ষিক রক্তক্ষয়ী বা সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে। গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক পরিবেশ বজায় রাখা হলে এসব নিশ্চয়ই হতো না।
বিশ্বের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং সংবাদমাধ্যমে আজ প্রকাশ পেয়েছে, অবরুদ্ধ বাংলাদেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রচেষ্টা চলছে, যাকে ইকোনমিস্ট আখ্যায়িত করেছে 'ফারসিক্যাল' অর্থাৎ প্রহসনের নির্বাচন হিসেবে। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে, সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা জিম্মি করে, কয়েকশ' প্রাণের বিনিময়ে বর্তমান সরকার যে তামাশার আয়োজন করেছে, আজ তার স্টেজ শো। এর আগে অবশ্য এই বিশ্বখ্যাত পত্রিকা লিখেছিল, মনে হচ্ছে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে আর পরাজয় ঘটবে বাংলাদেশের। আজ বাংলাদেশের সেই পরাজয়ের দিন সমাগত। লক্ষণীয় যে, কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা, জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, চীন এমনকি সরকার কর্তৃক বিশেষভাবে অনুরুদ্ধ রাশিয়াও কোনো পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। তাদের প্রশ্ন, কিসের পর্যবেক্ষক? কোথায় নির্বাচন? কী দেখতে আসব? নিরপেক্ষ দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোরও এই বক্তব্য। জানি না, সদাশয় সরকার এ অবস্থা দেখে এবং পর্যালোচনা করে কী সিদ্ধান্ত নেবে। বা কোনো প্রকারের সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করবে কি-না। তাদের কাছে একটিই অনুরোধ থাকবে। যখন তারা এ সিদ্ধান্ত নেবেন, তখন যেন তারা মনে রাখেন, বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্যের কথা। তাদের জীবন-সংগ্রামের কথা। গণতন্ত্র এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি তাদের আসক্তি ও নিষ্ঠার কথা এবং স্মরণ করেন সেই ৩০ লাখ শহীদের কথা, নিগৃহীত ও সংগ্রামী মানুষের কথা। যারা তাদের সর্বস্ব ত্যাগ করেও একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে ন্যায় বিচার থাকবে, গণতন্ত্র থাকবে, মানুষের বাঁচার অধিকার থাকবে। আর অধিকার থাকবে নিজের ভোট প্রয়োগ করে পছন্দমতো গঠিত সরকার দিয়ে শাসিত হওয়ার।
হায়! স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার দাবিদার একটি দলের নেতৃত্বেই আজ মুক্তিযুদ্ধের মূল যে চেতনা, সেই গণতন্ত্র, সেই মতপ্রকাশের অধিকার, সেই নিজের পছন্দমতো প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে! ক্ষমতাসীন পক্ষ স্বীকার করুক বা না করুক_ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ইতিহাসে আরেকটি কালো দিন যোগ হতে চলছে আজ। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগেরও আত্মহত্যার দিন।
ইনাম আহমেদ চৌধুরী :সাবেক সচিব ও কলাম লেখক; বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অনুলিখন
No comments