একজন অভিভাবকের বিদায় by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান
উপদেষ্টা, সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের আকস্মিক প্রয়াণে
আমরা গভীর শোকাহত। তিনি ছিলেন সমকাল পরিবারের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ। যদিও তার
মৃত্যু অকাল নয়; বরং জীবন ও কর্মে সাফল্যের অনেক সোপান পেরিয়েই তিনি
না-ফেরার দেশে চলে গেলেন; তাকে আমাদের আরও অনেক দিন প্রয়োজন ছিল। তার
অনুপস্থিতিতে জাতীয় জীবনে যে শূন্যতা অনুভূত হবে তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতা এবং বিএনপি প্রধানের
শোকবার্তায় জাতীয় বেদনাই প্রতিফলিত হয়েছে। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
কর্মজীবনে রাষ্ট্রীয় দুই শীর্ষস্থানীয় পদে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন
করেছেন তো বটেই; ব্যক্তিজীবনেও আমাদের যে বহুমাত্রিকতা তিনি উপহার দিয়েছেন,
তার নজিরও বিরল। আমরা দেখেছি, নিজের তারুণ্যে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে
অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংগ্রামে তিনি সক্রিয় ছিলেন।
পরবর্তীকালে ১৯৯৬ সালে এক সংকটময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং বিচক্ষণতা ও সাহসের সঙ্গে অবাধ,
সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব করেন। এই
গুরুদায়িত্ব পালন তাকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার আসনে
প্রতিষ্ঠিত করে। সে সময় একটি সামরিক অভ্যুত্থানচেষ্টা তিনি যেভাবে রুখে
দিয়েছিলেন এবং রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলা এড়াতে পেরেছিলেন তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক
ইতিহাসে বিশেষ অধ্যায় হিসেবে যুক্ত থাকবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা
বিশ্বাস করি, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ব্যক্তিজীবনও বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। ইতিহাস গবেষণা ও আইনি ব্যাখ্যার মতো
গুরুগম্ভীর বিষয়ই কেবল নয়, তিনি যেভাবে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে গবেষণা করেছেন,
বিভিন্ন বিষয়ে সুখপাঠ্য গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন, তা অতুলনীয়।
সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় পাতায় রাজনৈতিক কবিতা যুক্ত করে তিনি যেন সাহিত্য ও
সাংবাদিকতার একটি স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টিরও প্রয়াসী হয়েছিলেন। বাংলাদেশের
তারিখ কিংবা যথাশব্দের মতো গ্রন্থ সাংবাদিকতা ও সাহিত্য চর্চায় প্রয়াসীদের
কাছে মহার্ঘ হয়ে আছে। আর ধর্ম চর্চা প্রশ্নে ঐতিহ্যবাদ ও ঔদার্যবাদের যে
মিশ্রণ তিনি ব্যক্তিজীবনে চর্চা করে গেছেন, তাও কম আকর্ষণীয় নয়। তার রচিত
'কোরআনসূত্র' আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। তিনি জীবনের শেষ দিন
পর্যন্ত যেভাবে লেখায়, বক্তৃতায়, গবেষণায় এবং সামাজিক উপস্থিতিতে সক্রিয়
থেকেছেন, তা অনেকের জন্য ঈর্ষার বিষয় হতে পারে। বস্তুত সদা হাসিখুশি ও
আশাবাদী মানুষটি অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন জাতির অভিভাবকের আসনে। কারও মুখের দিকে
না তাকিয়ে তিনি যা সত্য ও সঠিক মনে করেছেন, অকপটে বলেছেন। মুহাম্মদ হাবিবুর
রহমানের গ্রন্থ, প্রবন্ধ, বক্তৃতা, জীবনবোধ, কর্ম আমাদের জাতীয় ও সামাজিক
জীবনে ভাস্বর হয়ে থাকবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। সন্দেহ নেই, শনিবার তার
মৃত্যুতে জাতি একজন পথপ্রদর্শককে হারিয়েছে; কিন্তু এটাও সত্য যে, তার জীবন ও
কীর্তি আগামী দিনগুলোতেও আমাদের পথ দেখিয়ে যেতে থাকবে। আমরা তার স্মৃতি ও
কর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমাদের
সমমর্মিতা।
No comments