মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান :বিচক্ষণ ও দায়িত্ববান একজন বুদ্ধিজীবীর প্রস্থান by ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বিচারপতি
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একজন বহুমাত্রিক মানুষ ছিলেন। নিজের কাজের সব
এলাকাতেই তার সাফল্য ছিল অসামান্য। হাবিবুর রহমানকে প্রথম দেখি ছাত্রনেতা
হিসেবে। ছাত্রনেতা বলতে এখন যা বোঝায়, সে অর্থে নয়। তিনি ছিলেন ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সহ-সভাপতি।
সেকালে ছাত্র সংসদে নির্বাচিত তারাই হতেন, যারা ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত
মেধাবী হতেন। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখনকার দিনের
হলের বার্ষিক নির্বাচন ছিল উৎসবের মতো। আমরা তখন থাকতাম আজিমপুরের সরকারি
আবাসনে। তখনও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে উঠিনি। কিন্তু তাকে আমি
ছাত্রনেতা হিসেবে নির্বাচন করতে ও নির্বাচিত হতে দেখেছি। বায়ান্নর
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা যে ১০ জন ১০
জন করে রাজপথে বের হয়েছিল, তিনি তাদের প্রথম দলেই ছিলেন। বস্তুত তাকে দূর
থেকে দেখলেই চেনা যেত। লম্বায় উঁচু ছিলেন এবং মনে হতো নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যই
যেন এসেছেন।
এরপর হাবিবুর রহমানকে জানবার সুযোগ হয়েছিল আরেকটি ঘটনায়। সেটি বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে এমএ পাস করে তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তখনকার দিনে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ সম্পন্ন করতে পুলিশের ছাড়পত্র দরকার হতো। হাবিবুর রহমান যেহেতু বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে কিছুটা জড়িত ছিলেন, তাই সেই ছাড়পত্র পাননি। ফলে শিক্ষক হিসেবে তার নিয়োগ বাতিল হয়ে যায় এবং এর পরে যে কাজটি তিনি করলেন, সেটি কেবল তার পক্ষেই সম্ভব ছিল। যে সলিমুল্লাহ হলের তিনি সহ-সভাপতি ছিলেন, সেই হলেরই প্রধান ফটকে একটি ট্রেতে পান ও সিগারেট সাজিয়ে একটা দোকানদারি শুরু করেন। ভ্রাম্যমাণ 'দোকান' বা ট্রেটি তার গলায় ঝোলানো ছিল। তাতে লেখা ছিল_ 'শেলী'স ওউন স্টল'। শেলী তার ডাক নাম। পরের দিন তখনকার প্রধান ইংরেজি সংবাদপত্র দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারে তার বন্ধুরা খবরটি ছবিসহ ছেপেছিল। খবরটি কলকাতার পত্রিকাতেও প্রকাশ পায় এবং মন্তব্য করা হয়, পাকিস্তানে বেকারত্ব এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে ইতিহাসে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকারী এক তরুণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পেরে পানের দোকান দিয়েছে। পরে অবশ্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সরকারি চাকরিতে যোগ দেন।
এই ঘটনার মধ্যে যে মৌলিকত্ব, কৌতুকবোধ ও সাহস আমরা দেখেছিলাম, সে গুণগুলো ছিল তার চরিত্রের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। তিনি কমবেশি ৭০টি বই লিখেছেন। প্রত্যেক বছরই নতুন নতুন বই বের হতো। পাঠক সেই বইয়ের জন্য প্রতীক্ষায় থাকত। এসব বইতে যেমন গবেষণা পাওয়া যেত, তেমনই থাকত মৌলিকত্ব। আর তার কথাবার্তায় সবসময়ই আমরা একটি প্রসন্নতা দেখতাম। এই প্রসন্নতার সঙ্গে কৌতুকবোধেরও মিশ্রণ থাকত। এই প্রসন্নতা তার লেখার মধ্যেও আমরা দেখেছি। কঠিন কথা তিনি সরল প্রসন্নতার সঙ্গে লিখতেন। তার বক্তৃতা আমি শুনেছি। যেসব বক্তৃতাতে যেমন গভীর বক্তব্য থাকত, তেমনই থাকত প্রকাশের সাবলীলতা। সংকটের মুহূর্তে দেখেছি যে তিনি সাহসের সঙ্গে সত্য কথা বলেছেন। প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষের অনেক সময় হয়তো তা পছন্দ হয়নি; কিন্তু মানুষ তার বক্তব্যকে সাদরে গ্রহণ করেছে।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ইতিহাস পড়েছেন, আইনও পড়েছেন। বৃত্তি নিয়ে গিয়ে তিনি অক্সফোর্ড থেকে ইতিহাসে এমএ ডিগ্রি লাভ করেছেন। একই সঙ্গে আবার ব্যারিস্টারিও পাস করে এসেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তিনি আইনে ডিগ্রি নিয়েছেন। বোঝা যায়, ইতিহাস ও আইন_ দুই বিষয়েই তার আগ্রহ ছিল। তার রচনাতেও আমরা ইতিহাস অধ্যয়নের পরিচয় যেমন পেতাম, তেমনই একজন আইন বিশেষজ্ঞের যুক্তিবাদিতাও লাভ করতাম।
বিলেত থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ফিরে এসে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু কিছুদিন পরে ঢাকায় চলে এসে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে যোগ দেন উচ্চ আদালতের বিচারপতি হিসেবে। মনে আছে, সেই সময় আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক, তাদের মনে হয়েছিল তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকলেই ভালো হতো। কিন্তু পরে দেখেছি যে, একটা বিস্তৃত ক্ষেত্রে চলে এসে সেখানে যে কাজ করেছেন, সেও খুব প্রয়োজনীয় ছিল। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় ক্রান্তির একটি লগ্নে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে যে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন, সেটা আইন পেশায় না থাকলে তিনি করতে পারতেন না। তার ওই ভূমিকা আমাদের জাতীয় জীবনে খুবই জরুরি ছিল।
বিচারপতি হাবিবুর রহমানের জীবন ছিল কর্মমুখর। আমার ধারণা, তিনি আলস্যকে কখনোই প্রশ্রয় দিতেন না এবং সময়ের অপচয় করতেন না। বিচারপতি হিসেবে অবসর গ্রহণের পর তাকে আমরা লেখক ও গবেষক হিসেবে পেয়েছি। তার লেখার ভেতর একটি স্বাভাবিকতা ও সাবলীলতা থাকত। তিনি শব্দের ব্যবহার করতেন খুব যত্নের সঙ্গে। ভাষার ব্যবহারে তার এই সচেতনতার কারণেই তিনি 'যথাশব্দ' নামে একটি অত্যন্ত উপকারী গ্রন্থ রচনা করে যেতে পেরেছেন। হঠাৎ করে মনে হতে পারে, তার কাছ থেকে এমন বই অপ্রত্যাশিত; কিন্তু শব্দের ব্যবহারে তার যে সতর্কতা, তারই স্বাভাবিক প্রতিফলন এই গ্রন্থ প্রণয়নে ঘটেছে। তিনি আইনের বিষয়েও বই লিখেছেন। তার বিশেষ আগ্রহের ক্ষেত্র ছিল রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এত অল্প সময়ে এত গবেষণা করাটা যে কোনো রবীন্দ্র গবেষকের জন্যই ঈর্ষণীয় বিষয়। এ ক্ষেত্রেও তার মৌলিকত্ব আমরা দেখতে পাই। চীন দেশ সম্পর্কে তিনি গবেষণা করে যে রচনা আমাদের উপহার দিয়েছেন, তাও অসামান্য।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সামাজিক দায়িত্ববোধে অনুপ্রাণিত ছিলেন। সে ব্যাপারটা তার লেখার মধ্যে প্রকাশ পেত। বক্তৃতাতেও থাকত। আমরা দেখেছি যে, তিনি লিখিত বক্তব্য দিতেন এবং সেগুলো মূল্যবান প্রবন্ধ হিসেবে গৃহীত হতো। তাতে বক্তব্য থাকত স্পষ্ট, সাবলীল ও তাৎপর্যপূর্ণ। হেলাফেলা করে কোনো কাজই তিনি করতেন না; যদিও সব কাজই তিনি অত্যন্ত সহজভাবে করছেন বলে মনে হতো।
তার অসুখের খবর আমরা শুনতাম। কিন্তু অসুখ নিয়ে তাকে কখনও বিব্রত হতে দেখিনি। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর সঙ্গে তার গভীর বন্ধুত্ব ছিল। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র সংসদের যে কমিটির সহ-সভাপতি হন, জিল্লুর সেটার সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। বেশ কয়েক বছর আগে তারা দু'জনে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সেখানে হাবিবুর রহমান হোঁচট খেয়ে পড়ে যান এবং তার চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। সেই চিকিৎসা সামান্য ছিল না। পায়ের হাড় ভেঙে যাওয়ায় সেখানে ইস্পাতের পাত বসাতে হয়েছিল। কিন্তু এর পরেও চলাফেরায় তার স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব দেখিনি। বরঞ্চ হাড় জোড়া দেওয়া নিয়েও কৌতুক করতে দেখেছি। মনে আছে তাকে বলতে শুনেছি_ 'আই অ্যাম এ স্টিলম্যান।' তখন এ মন্তব্য শুনে তার যে কৌতুক মিশ্রিত প্রসন্নতা ছিল, সেটার কথাই মনে পড়েছে।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান নানা কারণেই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি গ্রন্থ লিখেছেন, সভা ও সম্মেলনে উল্লেখযোগ্য বক্তব্য রেখেছেন, তার লেখা ও বক্তৃতা দুটিই ছিল অত্যন্ত বিশিষ্ট ধরনের। তাতে ছিল আড়ম্বরহীন স্বাভাবিকত্ব অথচ গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও প্রজ্ঞার পরিচয়। জ্ঞান ও বিচার-বুদ্ধিকে অতি সহজে নিজের সঙ্গে বহন করতেন এবং নিজের মধ্যে ধরে না রেখে অন্যের জন্য প্রকাশ করতেন। একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে তার দায়িত্বপরায়ণতা ও সমাজমনস্কতা ছিল দৃষ্টান্তস্বরূপ। আমাদের সমাজে উজ্জ্বল এবং অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের বড় অভাব। সেই অভাব তিনি তার নিজের মতো করে মিটিয়েছিলেন। তার চলে যাওয়াতে আমরা ওই অভাবটা বিশেষভাবে অনুভব করছি।
জীবনে যেমন ছিলেন মৃত্যুতেও দেখলাম তেমনই স্বাভাবিকতার ব্যত্যয় ঘটালেন না। খুব সহজভাবেই চলে গেলেন। তার রচনা ও আচরণে যে আড়ম্বরহীনতা ছিল, মৃত্যু মুহূর্তেও সেটি তিনি পরিত্যাগ করেননি। এটিও একটি অসাধারণ ঘটনা। তাকে আমরা অনেককাল মনে রাখব, আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই।
এরপর হাবিবুর রহমানকে জানবার সুযোগ হয়েছিল আরেকটি ঘটনায়। সেটি বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে এমএ পাস করে তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তখনকার দিনে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ সম্পন্ন করতে পুলিশের ছাড়পত্র দরকার হতো। হাবিবুর রহমান যেহেতু বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে কিছুটা জড়িত ছিলেন, তাই সেই ছাড়পত্র পাননি। ফলে শিক্ষক হিসেবে তার নিয়োগ বাতিল হয়ে যায় এবং এর পরে যে কাজটি তিনি করলেন, সেটি কেবল তার পক্ষেই সম্ভব ছিল। যে সলিমুল্লাহ হলের তিনি সহ-সভাপতি ছিলেন, সেই হলেরই প্রধান ফটকে একটি ট্রেতে পান ও সিগারেট সাজিয়ে একটা দোকানদারি শুরু করেন। ভ্রাম্যমাণ 'দোকান' বা ট্রেটি তার গলায় ঝোলানো ছিল। তাতে লেখা ছিল_ 'শেলী'স ওউন স্টল'। শেলী তার ডাক নাম। পরের দিন তখনকার প্রধান ইংরেজি সংবাদপত্র দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারে তার বন্ধুরা খবরটি ছবিসহ ছেপেছিল। খবরটি কলকাতার পত্রিকাতেও প্রকাশ পায় এবং মন্তব্য করা হয়, পাকিস্তানে বেকারত্ব এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে ইতিহাসে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকারী এক তরুণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পেরে পানের দোকান দিয়েছে। পরে অবশ্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সরকারি চাকরিতে যোগ দেন।
এই ঘটনার মধ্যে যে মৌলিকত্ব, কৌতুকবোধ ও সাহস আমরা দেখেছিলাম, সে গুণগুলো ছিল তার চরিত্রের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। তিনি কমবেশি ৭০টি বই লিখেছেন। প্রত্যেক বছরই নতুন নতুন বই বের হতো। পাঠক সেই বইয়ের জন্য প্রতীক্ষায় থাকত। এসব বইতে যেমন গবেষণা পাওয়া যেত, তেমনই থাকত মৌলিকত্ব। আর তার কথাবার্তায় সবসময়ই আমরা একটি প্রসন্নতা দেখতাম। এই প্রসন্নতার সঙ্গে কৌতুকবোধেরও মিশ্রণ থাকত। এই প্রসন্নতা তার লেখার মধ্যেও আমরা দেখেছি। কঠিন কথা তিনি সরল প্রসন্নতার সঙ্গে লিখতেন। তার বক্তৃতা আমি শুনেছি। যেসব বক্তৃতাতে যেমন গভীর বক্তব্য থাকত, তেমনই থাকত প্রকাশের সাবলীলতা। সংকটের মুহূর্তে দেখেছি যে তিনি সাহসের সঙ্গে সত্য কথা বলেছেন। প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষের অনেক সময় হয়তো তা পছন্দ হয়নি; কিন্তু মানুষ তার বক্তব্যকে সাদরে গ্রহণ করেছে।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ইতিহাস পড়েছেন, আইনও পড়েছেন। বৃত্তি নিয়ে গিয়ে তিনি অক্সফোর্ড থেকে ইতিহাসে এমএ ডিগ্রি লাভ করেছেন। একই সঙ্গে আবার ব্যারিস্টারিও পাস করে এসেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তিনি আইনে ডিগ্রি নিয়েছেন। বোঝা যায়, ইতিহাস ও আইন_ দুই বিষয়েই তার আগ্রহ ছিল। তার রচনাতেও আমরা ইতিহাস অধ্যয়নের পরিচয় যেমন পেতাম, তেমনই একজন আইন বিশেষজ্ঞের যুক্তিবাদিতাও লাভ করতাম।
বিলেত থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ফিরে এসে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু কিছুদিন পরে ঢাকায় চলে এসে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে যোগ দেন উচ্চ আদালতের বিচারপতি হিসেবে। মনে আছে, সেই সময় আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক, তাদের মনে হয়েছিল তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকলেই ভালো হতো। কিন্তু পরে দেখেছি যে, একটা বিস্তৃত ক্ষেত্রে চলে এসে সেখানে যে কাজ করেছেন, সেও খুব প্রয়োজনীয় ছিল। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় ক্রান্তির একটি লগ্নে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে যে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন, সেটা আইন পেশায় না থাকলে তিনি করতে পারতেন না। তার ওই ভূমিকা আমাদের জাতীয় জীবনে খুবই জরুরি ছিল।
বিচারপতি হাবিবুর রহমানের জীবন ছিল কর্মমুখর। আমার ধারণা, তিনি আলস্যকে কখনোই প্রশ্রয় দিতেন না এবং সময়ের অপচয় করতেন না। বিচারপতি হিসেবে অবসর গ্রহণের পর তাকে আমরা লেখক ও গবেষক হিসেবে পেয়েছি। তার লেখার ভেতর একটি স্বাভাবিকতা ও সাবলীলতা থাকত। তিনি শব্দের ব্যবহার করতেন খুব যত্নের সঙ্গে। ভাষার ব্যবহারে তার এই সচেতনতার কারণেই তিনি 'যথাশব্দ' নামে একটি অত্যন্ত উপকারী গ্রন্থ রচনা করে যেতে পেরেছেন। হঠাৎ করে মনে হতে পারে, তার কাছ থেকে এমন বই অপ্রত্যাশিত; কিন্তু শব্দের ব্যবহারে তার যে সতর্কতা, তারই স্বাভাবিক প্রতিফলন এই গ্রন্থ প্রণয়নে ঘটেছে। তিনি আইনের বিষয়েও বই লিখেছেন। তার বিশেষ আগ্রহের ক্ষেত্র ছিল রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এত অল্প সময়ে এত গবেষণা করাটা যে কোনো রবীন্দ্র গবেষকের জন্যই ঈর্ষণীয় বিষয়। এ ক্ষেত্রেও তার মৌলিকত্ব আমরা দেখতে পাই। চীন দেশ সম্পর্কে তিনি গবেষণা করে যে রচনা আমাদের উপহার দিয়েছেন, তাও অসামান্য।
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সামাজিক দায়িত্ববোধে অনুপ্রাণিত ছিলেন। সে ব্যাপারটা তার লেখার মধ্যে প্রকাশ পেত। বক্তৃতাতেও থাকত। আমরা দেখেছি যে, তিনি লিখিত বক্তব্য দিতেন এবং সেগুলো মূল্যবান প্রবন্ধ হিসেবে গৃহীত হতো। তাতে বক্তব্য থাকত স্পষ্ট, সাবলীল ও তাৎপর্যপূর্ণ। হেলাফেলা করে কোনো কাজই তিনি করতেন না; যদিও সব কাজই তিনি অত্যন্ত সহজভাবে করছেন বলে মনে হতো।
তার অসুখের খবর আমরা শুনতাম। কিন্তু অসুখ নিয়ে তাকে কখনও বিব্রত হতে দেখিনি। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর সঙ্গে তার গভীর বন্ধুত্ব ছিল। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র সংসদের যে কমিটির সহ-সভাপতি হন, জিল্লুর সেটার সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। বেশ কয়েক বছর আগে তারা দু'জনে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সেখানে হাবিবুর রহমান হোঁচট খেয়ে পড়ে যান এবং তার চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। সেই চিকিৎসা সামান্য ছিল না। পায়ের হাড় ভেঙে যাওয়ায় সেখানে ইস্পাতের পাত বসাতে হয়েছিল। কিন্তু এর পরেও চলাফেরায় তার স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব দেখিনি। বরঞ্চ হাড় জোড়া দেওয়া নিয়েও কৌতুক করতে দেখেছি। মনে আছে তাকে বলতে শুনেছি_ 'আই অ্যাম এ স্টিলম্যান।' তখন এ মন্তব্য শুনে তার যে কৌতুক মিশ্রিত প্রসন্নতা ছিল, সেটার কথাই মনে পড়েছে।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান নানা কারণেই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি গ্রন্থ লিখেছেন, সভা ও সম্মেলনে উল্লেখযোগ্য বক্তব্য রেখেছেন, তার লেখা ও বক্তৃতা দুটিই ছিল অত্যন্ত বিশিষ্ট ধরনের। তাতে ছিল আড়ম্বরহীন স্বাভাবিকত্ব অথচ গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও প্রজ্ঞার পরিচয়। জ্ঞান ও বিচার-বুদ্ধিকে অতি সহজে নিজের সঙ্গে বহন করতেন এবং নিজের মধ্যে ধরে না রেখে অন্যের জন্য প্রকাশ করতেন। একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে তার দায়িত্বপরায়ণতা ও সমাজমনস্কতা ছিল দৃষ্টান্তস্বরূপ। আমাদের সমাজে উজ্জ্বল এবং অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের বড় অভাব। সেই অভাব তিনি তার নিজের মতো করে মিটিয়েছিলেন। তার চলে যাওয়াতে আমরা ওই অভাবটা বিশেষভাবে অনুভব করছি।
জীবনে যেমন ছিলেন মৃত্যুতেও দেখলাম তেমনই স্বাভাবিকতার ব্যত্যয় ঘটালেন না। খুব সহজভাবেই চলে গেলেন। তার রচনা ও আচরণে যে আড়ম্বরহীনতা ছিল, মৃত্যু মুহূর্তেও সেটি তিনি পরিত্যাগ করেননি। এটিও একটি অসাধারণ ঘটনা। তাকে আমরা অনেককাল মনে রাখব, আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই।
No comments