বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দ্রুত বিচার চাই
সাম্প্রদায়িক
সন্ত্রাস বন্ধে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন
মানবাধিকারকর্মী, বিশিষ্ট নাগরিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিত্বশীল
ব্যক্তিরা। গতকাল বুধবার রাজধানীতে আয়োজিত পৃথক আলোচনা সভা ও সমাবেশে তারা এ
দাবি জানান। তারা বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে হামলাকারীদের দ্রুত সাজা
দেওয়ার দাবি করেন। একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের
চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাষ্ট্র
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে 'ব্যর্থ' হয়েছে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার
যে বাংলাদেশ, তার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে যেতে পারে। ব্যর্থতার অর্থ হতে
পারে, দেশের ওপর বিরাট একটি জনগোষ্ঠীর আস্থা উঠে যাওয়া। প্রয়োজনে 'শক্তি'
প্রয়োগ করতে হবে। বিভিন্ন আলোচনা সভায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা এবং
হামলার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতার জন্য সরকারের
কঠোর সমালোচনা করা হয়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন :বুধবার রাজধানীর বিচার প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আইন কমিশনের উদ্যোগে আয়োজিত 'বৈষম্য বিলোপ আইন, ২০১৪' খসড়ার ওপর এক মতবিনিময় সভায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, দৃশ্যত সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যথাযথ নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতা প্রলম্বিত হলে এর অর্থ হতে পারে, দেশের ওপর বিরাট একটি জনগোষ্ঠীর আস্থা উঠে যাওয়া। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে বাংলাদেশ, তার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, এভাবে সহিংসতা চলতে পারে না, রাস্তায় আগুনে পুড়ে নিরীহ মানুষ মরতে পারে না। নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের অপরাধে যেভাবে একজন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারকে পুড়িয়ে-পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তা কোনো সভ্য সমাজে মেনে নেওয়া যায় না। প্রয়োজনে সরকারকে শক্তি প্রয়োগ করে হলেও সহিংসতা বন্ধ করে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখেন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক শাহ আলম ও কমিশনের সচিব মো. আশরাফুল ইসলাম। 'বৈষম্য বিলোপবিষয়ক আইন প্রণয়ন' বিষয়ে সুপারিশ তুলে ধরেন কমিশনের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা ফউজুল আজিম।
সাম্প্রদায়িকতা-সহিংসতা রোধে বিক্ষুব্ধ জনতা :বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু থাকার কারণে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক কারণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াত একে অপরকে দোষারোপ করছে। আমরা সাধারণ নাগরিকদের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত হোক, এটা চাই। চাই সংখ্যালঘুদের ওপর সকল হামলার বিচার।
গতকাল বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে 'সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধে বিক্ষুব্ধ জনতা' ব্যানারে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকারকর্মীরা এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন নিজেরা করি'র নির্বাহী নারীনেত্রী খুশী কবির, প্রজন্ম '৭১-এর গবেষক মেঘনা গুহঠাকুরতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা জাহানারা নূরী, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি পারভেজ আলম প্রমুখ। লিখিত বক্তব্য দেন মানবাধিকারকর্মী শিপ্রা বোস।
খুশী কবির বলেন, নির্বাচন-পরবর্তী সাম্প্রদায়িক হামলার ফলে নির্বাচন কমিশন, নিয়োজিত প্রতিরক্ষা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা কী ছিল তা জনগণ জানতে চায়। কারণ, প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে ছিল। গোয়েন্দারা কেন নজর দেয়নি এ ধরনের হামলা হতে পারে_ আমরা তার স্পষ্ট উত্তর চাই।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাংলাদেশে চালু রেখে এবং সাম্প্রদায়িক সংবিধান দিয়ে সংখ্যালঘু হামলার বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, 'রাজনীতিকরা সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। এটাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছেন।'
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম :একাত্তরের সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম আয়োজিত আলোচনা সভায় মুক্তিযুদ্ধে এস ফোর্সের প্রধান কেএম সফিউল্লাহ বীরউত্তম বলেন, একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররাই সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করতে চাচ্ছে। একাত্তরের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ অপশক্তিকে মোকাবেলা করতে হবে। ৮ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী বলেন, সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধে তরুণদের গ্রামে গ্রামে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, একাত্তরের বিজয় অর্জন পরিপূর্ণ হয়নি বলেই পরাজিত ঘাতক চক্র এখনও সাম্প্রদায়িক হামলা চালানোর সাহস পাচ্ছে। তাদের এখনই রুখে দিতে হবে। আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ ও ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসক হাসিনা দৌলা।
সুজন :বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলায় জড়িতদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। গতকাল বিকেলে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে এক মানববন্ধনে এ দাবি জানানো হয়। মানববন্ধনে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা অব্যাহত রয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর, এক বছর আগে রামুর ঘটনা এবং বর্তমান সময়ে হামলায় জড়িতদের বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে। ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী ব্যাপক সহিংসতায় জড়িতদের শাস্তি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। সহিংসতা ও হামলার সঙ্গে জড়িতদের দলে আশ্রয় না দেওয়ার জন্য বিরোধীদলীয় নেতার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
মানববন্ধনে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে।
বিচারপতি কাজী এবাদুল হক বলেন, দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর এতগুলো হামলা হলেও বিরোধীদলীয় নেতা মুখ বন্ধ করে বসে আছেন। আর সরকারকে বলব, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিন, গ্রেফতারের নির্দেশ দিন।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নির্বাহী ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী বলেন, নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চলছে। নাশকতার দায় সরকার এড়াতে পারে না।
লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মী-শিক্ষক-ছাত্র-শ্রমজীবীর প্রতিবাদ :শাহবাগে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে 'লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মী-শিক্ষক-ছাত্র-শ্রমজীবী-পেশাজীবী ও রাজনৈতিক কর্মীবৃন্দে'র ব্যানারে আরেকটি মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। অরূপ রাহীর সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির, সমকালের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবু সাঈদ খান, শিক্ষাবিদ এএন রাশেদা, সাইফুল হক, জোনায়েদ সাকি, কফিল আহমেদ, ফাহমিদুল হক, শিপ্রা বোস প্রমুখ।
সাংবাদিকদের প্রতিবাদ :দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিবাদে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর গণমাধ্যম উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাকে মেনে নিতে নারাজ, তারাই এসব হামলার মদদ দেন।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও এই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রদান করতে পারেনি এ দেশ। এ ব্যর্থতা, এ লজ্জা সবার।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বিএফইউজের মহাসচিব আবদুল জলিল ভুঁইয়া, সহসভাপতি ড. উৎপল সরকার, যুগ্ম মহাসচিব সাইফুল ইসলাম তালুকদার, ডিইউজের একাংশের সভাপতি ওমর ফারুক, সাধারণ সম্পাদক শাবান মাহমুদ, বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব শাহজাহান মিয়া, আলতাফ মাহমুদ, সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মোল্লা জালাল প্রমুখ।
সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সাংবাদিক মঞ্চ : জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে 'মৌলবাদ রুখে দাও-রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ' স্লোগানে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সাংবাদিক মঞ্চ। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে পিটিবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক আশীষ কুমার দের সভাপতিত্বে মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাবেক সভাপতি আলতাফ মাহমুদ, বিএফইউজের (একাংশ) যুগ্ম মহাসচিব সাইফুল ইসলাম তালুকদার, দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক কাজী রফিক, দৈনিক জনতার সম্পাদক আহসানউল্লাহ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মাহমুদুর রহমান খোকন, ডিইউজের সাংগঠনিক সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরীসহ অনেকে। এ ছাড়া কর্মসূূচির প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি শাহেদ চৌধুরী, ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাসানুজ্জামান তরুণ।
বি. চৌধুরীর পাঁচ দফা :বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বুধবার এক বিবৃতিতে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তসহ পাঁচ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি অত্যাচারিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নবগঠিত জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের (এনডিএফ) নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।
এ ছাড়া বিবৃতি দিয়ে ধিক্কার জানানো হয়ে 'আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান'-এর পক্ষ থেকেও। রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল ও শাহবাগে সমাবেশ করেছে 'সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস প্রতিরোধে' প্রগতিশীল সংগঠনগুলো।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) :ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)। বুধবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এ কর্মসূচি পালন করে সংগঠনটি। সংগঠনের সভাপতি ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আ ফ ম রুহুল হকের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. হাসান মাহমুদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণগোপাল দত্ত, স্বাচিপ মহাসচিব অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান প্রমুখ।
বাম মোর্চা : জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বাম মোর্চার বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সাইফুল হক, শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম, মোশরেফা মিশু, মোশাররফ হোসেন নান্নু, হামিদুল হক, মহিনউদ্দিন চৌধুরী লিটন প্রমুখ।
সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ : তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেন রুহুল আমিন গাজী, শওকত মাহমুদ, অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, কামালউদ্দিন সবুজ, সৈয়দ আবদাল আহমদ, চাষী নজরুল ইসলাম, অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভুইয়া প্রমুখ।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন :বুধবার রাজধানীর বিচার প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আইন কমিশনের উদ্যোগে আয়োজিত 'বৈষম্য বিলোপ আইন, ২০১৪' খসড়ার ওপর এক মতবিনিময় সভায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, দৃশ্যত সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যথাযথ নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতা প্রলম্বিত হলে এর অর্থ হতে পারে, দেশের ওপর বিরাট একটি জনগোষ্ঠীর আস্থা উঠে যাওয়া। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে বাংলাদেশ, তার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, এভাবে সহিংসতা চলতে পারে না, রাস্তায় আগুনে পুড়ে নিরীহ মানুষ মরতে পারে না। নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের অপরাধে যেভাবে একজন সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারকে পুড়িয়ে-পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তা কোনো সভ্য সমাজে মেনে নেওয়া যায় না। প্রয়োজনে সরকারকে শক্তি প্রয়োগ করে হলেও সহিংসতা বন্ধ করে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখেন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক শাহ আলম ও কমিশনের সচিব মো. আশরাফুল ইসলাম। 'বৈষম্য বিলোপবিষয়ক আইন প্রণয়ন' বিষয়ে সুপারিশ তুলে ধরেন কমিশনের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা ফউজুল আজিম।
সাম্প্রদায়িকতা-সহিংসতা রোধে বিক্ষুব্ধ জনতা :বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু থাকার কারণে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক কারণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াত একে অপরকে দোষারোপ করছে। আমরা সাধারণ নাগরিকদের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত হোক, এটা চাই। চাই সংখ্যালঘুদের ওপর সকল হামলার বিচার।
গতকাল বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে 'সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধে বিক্ষুব্ধ জনতা' ব্যানারে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকারকর্মীরা এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন নিজেরা করি'র নির্বাহী নারীনেত্রী খুশী কবির, প্রজন্ম '৭১-এর গবেষক মেঘনা গুহঠাকুরতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা জাহানারা নূরী, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি পারভেজ আলম প্রমুখ। লিখিত বক্তব্য দেন মানবাধিকারকর্মী শিপ্রা বোস।
খুশী কবির বলেন, নির্বাচন-পরবর্তী সাম্প্রদায়িক হামলার ফলে নির্বাচন কমিশন, নিয়োজিত প্রতিরক্ষা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা কী ছিল তা জনগণ জানতে চায়। কারণ, প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে ছিল। গোয়েন্দারা কেন নজর দেয়নি এ ধরনের হামলা হতে পারে_ আমরা তার স্পষ্ট উত্তর চাই।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাংলাদেশে চালু রেখে এবং সাম্প্রদায়িক সংবিধান দিয়ে সংখ্যালঘু হামলার বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, 'রাজনীতিকরা সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। এটাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছেন।'
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম :একাত্তরের সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম আয়োজিত আলোচনা সভায় মুক্তিযুদ্ধে এস ফোর্সের প্রধান কেএম সফিউল্লাহ বীরউত্তম বলেন, একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররাই সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করতে চাচ্ছে। একাত্তরের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ অপশক্তিকে মোকাবেলা করতে হবে। ৮ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী বলেন, সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধে তরুণদের গ্রামে গ্রামে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, একাত্তরের বিজয় অর্জন পরিপূর্ণ হয়নি বলেই পরাজিত ঘাতক চক্র এখনও সাম্প্রদায়িক হামলা চালানোর সাহস পাচ্ছে। তাদের এখনই রুখে দিতে হবে। আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ ও ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসক হাসিনা দৌলা।
সুজন :বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলায় জড়িতদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। গতকাল বিকেলে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে এক মানববন্ধনে এ দাবি জানানো হয়। মানববন্ধনে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা অব্যাহত রয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর, এক বছর আগে রামুর ঘটনা এবং বর্তমান সময়ে হামলায় জড়িতদের বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে। ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী ব্যাপক সহিংসতায় জড়িতদের শাস্তি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। সহিংসতা ও হামলার সঙ্গে জড়িতদের দলে আশ্রয় না দেওয়ার জন্য বিরোধীদলীয় নেতার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
মানববন্ধনে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে।
বিচারপতি কাজী এবাদুল হক বলেন, দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর এতগুলো হামলা হলেও বিরোধীদলীয় নেতা মুখ বন্ধ করে বসে আছেন। আর সরকারকে বলব, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিন, গ্রেফতারের নির্দেশ দিন।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নির্বাহী ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী বলেন, নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চলছে। নাশকতার দায় সরকার এড়াতে পারে না।
লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মী-শিক্ষক-ছাত্র-শ্রমজীবীর প্রতিবাদ :শাহবাগে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে 'লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মী-শিক্ষক-ছাত্র-শ্রমজীবী-পেশাজীবী ও রাজনৈতিক কর্মীবৃন্দে'র ব্যানারে আরেকটি মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। অরূপ রাহীর সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির, সমকালের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবু সাঈদ খান, শিক্ষাবিদ এএন রাশেদা, সাইফুল হক, জোনায়েদ সাকি, কফিল আহমেদ, ফাহমিদুল হক, শিপ্রা বোস প্রমুখ।
সাংবাদিকদের প্রতিবাদ :দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিবাদে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর গণমাধ্যম উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাকে মেনে নিতে নারাজ, তারাই এসব হামলার মদদ দেন।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও এই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রদান করতে পারেনি এ দেশ। এ ব্যর্থতা, এ লজ্জা সবার।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বিএফইউজের মহাসচিব আবদুল জলিল ভুঁইয়া, সহসভাপতি ড. উৎপল সরকার, যুগ্ম মহাসচিব সাইফুল ইসলাম তালুকদার, ডিইউজের একাংশের সভাপতি ওমর ফারুক, সাধারণ সম্পাদক শাবান মাহমুদ, বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব শাহজাহান মিয়া, আলতাফ মাহমুদ, সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মোল্লা জালাল প্রমুখ।
সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সাংবাদিক মঞ্চ : জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে 'মৌলবাদ রুখে দাও-রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ' স্লোগানে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সাংবাদিক মঞ্চ। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে পিটিবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক আশীষ কুমার দের সভাপতিত্বে মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাবেক সভাপতি আলতাফ মাহমুদ, বিএফইউজের (একাংশ) যুগ্ম মহাসচিব সাইফুল ইসলাম তালুকদার, দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক কাজী রফিক, দৈনিক জনতার সম্পাদক আহসানউল্লাহ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মাহমুদুর রহমান খোকন, ডিইউজের সাংগঠনিক সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরীসহ অনেকে। এ ছাড়া কর্মসূূচির প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি শাহেদ চৌধুরী, ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাসানুজ্জামান তরুণ।
বি. চৌধুরীর পাঁচ দফা :বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বুধবার এক বিবৃতিতে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তসহ পাঁচ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি অত্যাচারিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নবগঠিত জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের (এনডিএফ) নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।
এ ছাড়া বিবৃতি দিয়ে ধিক্কার জানানো হয়ে 'আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান'-এর পক্ষ থেকেও। রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল ও শাহবাগে সমাবেশ করেছে 'সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস প্রতিরোধে' প্রগতিশীল সংগঠনগুলো।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) :ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)। বুধবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এ কর্মসূচি পালন করে সংগঠনটি। সংগঠনের সভাপতি ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আ ফ ম রুহুল হকের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. হাসান মাহমুদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণগোপাল দত্ত, স্বাচিপ মহাসচিব অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান প্রমুখ।
বাম মোর্চা : জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বাম মোর্চার বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সাইফুল হক, শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম, মোশরেফা মিশু, মোশাররফ হোসেন নান্নু, হামিদুল হক, মহিনউদ্দিন চৌধুরী লিটন প্রমুখ।
সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ : তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেন রুহুল আমিন গাজী, শওকত মাহমুদ, অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, কামালউদ্দিন সবুজ, সৈয়দ আবদাল আহমদ, চাষী নজরুল ইসলাম, অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভুইয়া প্রমুখ।
No comments