'কী জানি বাপু আবার কখন হামলা করে'
'এখনও আমরা ঘুমইতে পারি না রাতে। সারা রাত
জাগে হেরে পাহারা দেই। পুরুষ-নারী কেহয় ঘুমায় না। খালি ঘুমায় ছুয়ালা। কী
জানি বাপু আবার কখন বাড়িত হামলা করে?' ভয়ে আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে এভাবেই
কথাগুলো বললেন সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের গোপালপুর ঝাকুয়া গ্রামের হিন্দু
সম্প্রদায়ের গৃহবধূ নিয়তি রানী। তিনি আরও বলেন, 'হামাক বাড়িত আসে হেনে
হুমকি দিয়া গেইছে বাড়িঘর ভাঙ্গে-চুরে জ্বালায় দিবে। হামাক এক এক করিয়ে বলে
মারে ফেলাবে। এই ভয়ত কেহ বাড়ি থেকে বাহির হয় না।' হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন
ও এলাকাবাসী জানায়, গত রোববার নির্বাচনকালে স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত
নেতাকর্মীরা হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩০টি দোকানে হামলা চালায়। তারা এ সময়
দোকানগুলো ভাংচুর ও লুটপাট করে। এ সময় তারা বেশ কয়েকটি বাড়িতেও ভাংচুর
চালানোর চেষ্টা করে। এ ঘটনার পর থেকেই এ গ্রামের ২ শতাধিক সংখ্যালঘু হিন্দু
পরিবার আতঙ্কিত। তারা সবাই বাড়িঘর ছেড়ে রোববার সন্ধ্যায় আশ্রয় নেন স্থানীয়
ইসকন মন্দিরে। সেখানেই অবস্থান করেন ৩ দিন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তারা
নিজেদের বাড়িঘরে ফিরেছেন। তাদের হামলা আতঙ্ক কাটেনি। এ গ্রামের আরেক গৃহবধূ
মুক্তিরানী জানান, ভয়ে আমরা সব সময় অস্থির থাকি। কয়েকটা বাসার লোক মিলে
একত্রে থাকতে হচ্ছে। আমাদের এলাকার নারী-পুরুষরা লাঠিসোটা নিয়ে বাড়িঘর
পাহারা দিচ্ছে। এ গ্রামের নরেশ চন্দ্র জানান, নাওয়া-খাওয়া আর কাজকর্ম ফেলে
দিনরাত বাড়িঘর পাহারা দেই। আর কাজই বা কী করে করব? দেউনিয়া বাজারে হিন্দু
সম্প্রদায়ের সব দোকানপাট ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। মুসলমানদের একটা
দোকানও ভাঙ্গা হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, দু'দিন ধরে
অনাহারে-অর্ধাহারে পরিবার-পরিজন নিয়ে খুব বিপদে আছি। এখনও কোনো সরকারি
সহায়তা পাইনি আমরা। ঝাকুয়া গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের দোকানি
বিপুুল কুমার রায় জানান, 'আমার দোকানটিতে ৩ লাখ টাকার মাল ছিল। ভাংচুর ও
লুটপাটের পর আমি কিছুই পাইনি। শুধু আমার দোকান নয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের
প্রায় ৩০টি দোকানে ভাংচুর ও লুটপাট করে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন। আমরা তো
রাজনীতি করি না। আমাদের কী দোষ? আমরা হিন্দু এটাই কি আমাদের অপরাধ? একই
অবস্থা দেউনিয়াবাজার, বানিয়াপাড়া ও ঝাড়ডাঙ্গা গ্রামের আরও ২ শতাধিক হিন্দু
সম্প্রদায়ের মানুষের। সোমবার সকালে সদর উপজেলার মধুপুর গ্রামের অতুল চন্দ্র
বর্মণ (৩০) নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীর ওপর হামলা চালায় বিএনপি সমর্থকরা।
হামলাকারীরা তাকে কুপিয়ে জখম করে। এ ঘটনায় ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে
মধুপুর গ্রামের হিন্দুু সম্প্রদায়ের লোকজন ভয়ে ওই এলাকার ইসকন মন্দিরে
আশ্রয় নেন। এর আগে রোববার বিকেলে মিলনপুর ভোটকেন্দ্রে সেখানকার ওয়ার্ড
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিতাই চন্দ্রের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে গুরুতর
আহত করে স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত কর্মীরা। সোমবার বিকেলে হিন্দু সম্প্রদায়ের
ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বাড়িঘর, দোকানপাট পরিদর্শন করেন সাবেক
পানিসম্পদমন্ত্রী ও ঠাকুরগাঁও-১ আসনের নবনির্বাচিত এমপি রমেশ চন্দ্র সেন,
জেলা প্রশাসক মুকেশ চন্দ্র বিশ্বাস, পুলিশ সুপার ফয়সল মাহমুদ ও নির্বাচনী
দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর ৩২ রেজিমেন্টের কমান্ডার লে. কর্নেল শামসুল
আরেফিন। এ সময় তারা নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের
মানুষদের নির্ভয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান। তারপরেও আতঙ্কে অনেক
মানুষ এখনও রাতে ইসকন মন্দিরে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। গতকাল বুধবার দুপুরেও
হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশকিছু মানুষকে ওই মন্দিরে অবস্থান করতে দেখা গেছে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা দিয়ে ওই এলাকায় দুটি অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প
বসানো হয়েছে। একটি ইসকন মন্দিরে, অন্যটি গোপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
ভোটকেন্দ্রে। গড়েয়া ইসকন মন্দিরের অধ্যক্ষ পুষ্পশীলা শ্যাম দাস
ব্র?হ্মচারী জানান, সংখ্যালঘুদের দোকান, বাড়ি ও তাদের ওপর হামলার ঘটনা
নিন্দনীয়। সহিংসতার পরে রোববার বিকেলে ২ সহস্রাধিক মানুষ অবস্থান নেয়। এ
ব্যাপারে গড়েয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সঞ্জয় কুমার জানান, যাদের দোকানপাট ও
বাড়িঘরে হামলা হয়েছে তাদের তালিকা করা হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাদের
সহায়তা দেওয়া হবে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের পুনর্বাসনে উপজেলা ও জেলা
প্রশাসনের সহায়তা চেয়েছি আমরা। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি জসিয়ার রহমান
মাস্টার বলেন, 'আমরা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ
নিচ্ছি।'
No comments