সরকারি চাকরিতে নিয়োগ মেধা নয়, কোটার প্রাধান্য by শরিফুল হাসান
জনপ্রশাসনে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে
কোটা প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। গত আট বছরে পাঁচটি বিসিএসের ফল বিশ্লেষণ করে
দেখা গেছে, মোট এক হাজার ১৮৯ জন প্রার্থীকে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য
সুপারিশ করেছে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি)।
তাঁদের মধ্যে ৫৬০ জনকে মেধায় আর বাকি ৬২৯ জনকে বিভিন্ন কোটা থেকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে।
একই সময়ে পুলিশ ক্যাডারের জন্য ৭৫৩ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছে পিএসসি। এর মধ্যে ৩৫৫ জনকে মেধা আর ৩৯৮ জনকে বিভিন্ন কোটা থেকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। পিএসসির এই সুপারিশ অনুসারেই নিয়োগ দেয় সরকার।
শুধু পুলিশ বা প্রশাসনেই নয়, রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীর ১৫টি সাধারণ ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে গত পাঁচটি বিসিএসে (২০০৫-২০১২) মোট তিন হাজার ১৭৯ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছে পিএসসি। এর মধ্যে এক হাজার ৪৯৩ জনকে মেধায় আর এক হাজার ৬৮৬ জনকে বিভিন্ন কোটা থেকে সুপারিশ করা হয়েছে।
তবে কারিগরি ক্যাডারে বহু চেষ্টা করেও কোটা পূরণ করা যায় না। আবার কাউকে না পেলে কোটার পদগুলো শূন্য রাখতে হয়। ফলে সর্বশেষ চারটি বিসিএসে তিন হাজার ১৬২টি পদ খালি রাখতে হয়েছে পিএসসিকে। এ ছাড়া শুধু কোটার জন্য ৩২তম বিশেষ বিসিএসের ব্যবস্থা করে পিএসসি। প্রার্থী না পাওয়ায় ওই বিসিএসে কোটার এক হাজার ১২৫টি পদও শূন্য রাখতে হয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্যই এবার প্রিলিমিনারি থেকে কোটাপদ্ধতি চালুর চিন্তা করেছিল পিএসসি, যার কারণে সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
প্রশাসনে এমন কোটা থাকলেও দেশের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাপদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। এ ক্ষেত্রে শুধু যোগ্যতাকেই বিবেচনা করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যমান কোটাব্যবস্থার কারণে আমাদের প্রশাসনে মেধাবীদের চেয়ে কোটাধারী কম মেধাবীরা বেশি জায়গা করে নিচ্ছেন। আর শুধু সাধারণ ক্যাডার কেন, কলেজের শিক্ষক, বিচার বিভাগ—সবখানেই তো কোটার কারণে অতি মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। কাজেই কোটাপদ্ধতির অবশ্যই সংস্কার হওয়া উচিত। আর অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা থাকতে পারে। তবে সব মিলিয়ে ২০ শতাংশের বেশি কোটা থাকা উচিত নয়।’
বঞ্চিত মেধাবীরা: বিদ্যমান কোটা অনুযায়ী, কোনো পরীক্ষার মাধ্যমে পিএসসি যদি ১০০ জন লোক নিয়োগ করে, তাহলে মাত্র ৪৫ জন নিয়োগ পাবেন মেধার ভিত্তিতে, ৩০ জন নিয়োগ পাবেন মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের মধ্য থেকে, ১০ জন নারী কোটায়, ১০ জন জেলা কোটায় এবং পাঁচজন নিয়োগ পাবেন উপজাতি কোটায়।
পিএসসির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারে গড়ে ৫০০ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু অংশ নেন দেড় থেকে দুই লাখ পরীক্ষার্থী। কোটাপদ্ধতির কারণে কেউ যদি দুই লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২২৬তম হন, তাহলে তিনি চাকরি না-ও পেতে পারেন। কারণ, ৫০০ পদের মধ্যে মেধা কোটায় ২২৫ জনকে দেওয়া যাবে। কাজেই ২২৬তম হয়ে তিনি চাকরি পাবেন না। আবার কোটা থাকলে কেউ সাত হাজারতম হয়েও চাকরি পেতে পারেন।
কোটার কারণে বঞ্চিত প্রার্থীরা বিসিএসের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন। এমনিতেই বিসিএস পরীক্ষার প্রচলিত পদ্ধতিটি মেধা যাচাইয়ের জন্য কোনো উৎকৃষ্ট পদ্ধতি নয়। পাশাপাশি রয়েছে বাছাই পদ্ধতির দীর্ঘসূত্রতা। একটি বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞাপন প্রচার থেকে শুরু করে নিয়োগ সম্পন্ন হতে দুই-আড়াই বছর লেগে যায়। এসব কারণে অনেক মেধাবী বিসিএসের চিন্তা বাদ দিয়ে ঝুঁকছেন বেসরকারি চাকরির দিকে। কেউ পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে।
সর্বশেষ পাঁচটি বিসিএসের চিত্র: ২০০৫ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের শেষ বছরে ২৭তম বিসিএসের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। নানা জটিলতার পর ২০০৮ সালে ওই বিসিএসের ফল প্রকাশ করে পিএসসি। এতে সাধারণ ক্যাডারে মোট ৫৮০ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়, যার মধ্যে ২৬৯ জনকে মেধায় আর ৩১১ জনকে কোটায় নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।
পিএসসির গত ছয় বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন ও ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২৮তম বিসিএসের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে। দুই বছর পর ২০১০ সালে এর ফল প্রকাশ হয়। সাধারণ ক্যাডারে মোট ৬৫৮ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। এর মধ্যে ৩১০ জনকে মেধায় আর ৩৪৮ জনকে কোটায় নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ২৯তম বিসিএসের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১১ সালে এর ফল প্রকাশ হয়। এতে সাধারণ ক্যাডারে ৪১৫ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে ২০১ জনকে মেধায় আর ২১৪ জনকে কোটায় নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।
৩০তম বিসিএসের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১০ সালে। ২০১১ সালের ২ নভেম্বর এর ফল প্রকাশ হয়। এতে মোট ৭৬৫ জনকে নিয়োগের সুপারিশ ছিল। এর মধ্যে ৩৫৮ জনকে মেধায় আর ৪০৭ জনকে কোটা থেকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।
৩১তম বিসিএসের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১১ সালে। ২০১২ সালের ৮ জুলাই এর ফল প্রকাশ হয়। সাধারণ ক্যাডারে ৭৬১ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। এর মধ্যে ৩৫৫ জনকে মেধায় আর ৪০৬ জনকে কোটায় নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।
পদ শূন্য থাকছে: বিএনপি-জোট সরকারের সময় বলা হতো, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এই পদগুলো মেধা দিয়ে পূরণ করা হোক। কিন্তু এর ফলে দেখা গেল, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা থাকলেও তাঁরা চাকরি পেতেন না। সমস্যা সমাধানে বর্তমান সরকার কোটার পদগুলোতে প্রার্থী না পাওয়া গেলে সেগুলো শূন্য রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফল হয় উল্টো। মেধাবীরা উত্তীর্ণ হয়েও একদিকে চাকরি পাননি, আর অন্যদিকে শত শত পদ শূন্য রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও কৃষি কর্মকর্তাদের মতো কারিগরি ক্যাডারের প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়েছেন।
২৮তম বিসিএসে প্রার্থী না পাওয়ায় প্রাধিকার কোটার বিপরীতে ৮১৩টি পদ শূন্য রাখে পিএসসি। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ৬২৮টি, মহিলা কোটায় ৪৫ ও উপজাতি কোটায় ১৪০টি পদ শূন্য ছিল।
২৯তম বিসিএসে ৫৩৮টি মুক্তিযোদ্ধা, ৮১টি মহিলা ও ১১১টি উপজাতিসহ কোটার ৭৯২টি পদ শূন্য ছিল।
৩০তম বিসিএসে ৬১৩টি মুক্তিযোদ্ধা, ৩২টি মহিলা ও ১৩৯টি উপজাতিসহ কোটার ৭৮৪টি পদ শূন্য ছিল।
৩১তম বিসিএসে ৫৫০টি মুক্তিযোদ্ধা, ৫৪টি মহিলা ও ১২৯টি উপজাতিসহ কোটার ৭৭৩টি পদ শূন্য ছিল।
কোটার শূন্য পদগুলো পূরণ করতে মুক্তিযোদ্ধা, আদিবাসী ও মহিলাদের জন্য ৩২তম বিশেষ বিসিএস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পিএসসি। ওই বিসিএস ও মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৮১৭টি, মহিলা ১০টি ও উপজাতির ২৯৮টিসহ মোট এক হাজার ১২৫টি পদ শূন্য রাখতে হয়। শেষ পর্যন্ত ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে এই পদগুলো পূরণের সিদ্ধান্ত হয়। অথচ ৩২তম বিসিএসে উত্তীর্ণ ৯১২ জনই চাকরির সুযোগ পাননি। কারণ এক কোটা থেকে আরেক কোটায় নিয়োগ দেওয়া যায় না।
এর আগে ২০০৩ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৮৩৩টির মধ্যে ৭৭৮টি, ২০০৫ সালে এক হাজার ৮৫৪টির মধ্যে এক হাজার ৫০৮টি, ২০০৬ সালে ৭৫৪টির মধ্যে ৫৯৮টি এবং ২০০৭ সালে ৭০৯টির মধ্যে ৬৩৭টি পদ খালি রাখতে হয়েছিল এই কোটার কারণেই।
পিএসসির সদস্য লিয়াকত আলী খান ও এমরান কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রার্থী না পাওয়ায় কোটার পদগুলো বছরের পর শূন্য পড়ে থাকে। এ জন্যই এবার প্রিলিমিনারি থেকেই কোটার বিপরীতে প্রার্থী বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এতে কোটার পদগুলো পূরণ করা যেত।
সুপারিশের কী হলো: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান এবং সাবেক সচিব কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ (বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার) বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার ওপর ২০০৮ সালের মার্চে একটি গবেষণা করেছেন। ৬১ পৃষ্ঠার এই গবেষণা প্রতিবেদনটি পিএসসিতে আছে। এই প্রতিবেদনে কোটা কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হলেও সেটি বাস্তবায়িত হয়নি।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭৭ সালে এক বৈঠকে তৎকালীন পে ও সার্ভিস কমিশনের প্রায় সব সদস্য সরকারি নিয়োগে কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে একমাত্র এম এম জামান ছিলেন কোটার পক্ষে। তবে কোটার পক্ষে সেদিন জামানের অবস্থান থাকলেও তিনি শুধু একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যবস্থাটি চালু রাখার পক্ষে ছিলেন। তবে ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী ১০ বছরে কোটার হার ধীরে ধীরে কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার কথা বলেছিলেন তিনি। ওই সুপারিশ অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালের পর দেশের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কোটা থাকার কথা নয়। তবে ওই প্রতিবেদন বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ সরকার নেয়নি।
কোটা পদ্ধতি সংস্কারের কোনো চিন্তা আছে কি না, জানতে চাইলে জনপ্রশাসনসচিব আবদুস সোবহান সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, এখনো সংস্কারের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেই। তবে ভবিষ্যতে হয়তো সংস্কারের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হতে পারে।
একই সময়ে পুলিশ ক্যাডারের জন্য ৭৫৩ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছে পিএসসি। এর মধ্যে ৩৫৫ জনকে মেধা আর ৩৯৮ জনকে বিভিন্ন কোটা থেকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। পিএসসির এই সুপারিশ অনুসারেই নিয়োগ দেয় সরকার।
শুধু পুলিশ বা প্রশাসনেই নয়, রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীর ১৫টি সাধারণ ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে গত পাঁচটি বিসিএসে (২০০৫-২০১২) মোট তিন হাজার ১৭৯ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছে পিএসসি। এর মধ্যে এক হাজার ৪৯৩ জনকে মেধায় আর এক হাজার ৬৮৬ জনকে বিভিন্ন কোটা থেকে সুপারিশ করা হয়েছে।
তবে কারিগরি ক্যাডারে বহু চেষ্টা করেও কোটা পূরণ করা যায় না। আবার কাউকে না পেলে কোটার পদগুলো শূন্য রাখতে হয়। ফলে সর্বশেষ চারটি বিসিএসে তিন হাজার ১৬২টি পদ খালি রাখতে হয়েছে পিএসসিকে। এ ছাড়া শুধু কোটার জন্য ৩২তম বিশেষ বিসিএসের ব্যবস্থা করে পিএসসি। প্রার্থী না পাওয়ায় ওই বিসিএসে কোটার এক হাজার ১২৫টি পদও শূন্য রাখতে হয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্যই এবার প্রিলিমিনারি থেকে কোটাপদ্ধতি চালুর চিন্তা করেছিল পিএসসি, যার কারণে সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
প্রশাসনে এমন কোটা থাকলেও দেশের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাপদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। এ ক্ষেত্রে শুধু যোগ্যতাকেই বিবেচনা করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যমান কোটাব্যবস্থার কারণে আমাদের প্রশাসনে মেধাবীদের চেয়ে কোটাধারী কম মেধাবীরা বেশি জায়গা করে নিচ্ছেন। আর শুধু সাধারণ ক্যাডার কেন, কলেজের শিক্ষক, বিচার বিভাগ—সবখানেই তো কোটার কারণে অতি মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। কাজেই কোটাপদ্ধতির অবশ্যই সংস্কার হওয়া উচিত। আর অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা থাকতে পারে। তবে সব মিলিয়ে ২০ শতাংশের বেশি কোটা থাকা উচিত নয়।’
বঞ্চিত মেধাবীরা: বিদ্যমান কোটা অনুযায়ী, কোনো পরীক্ষার মাধ্যমে পিএসসি যদি ১০০ জন লোক নিয়োগ করে, তাহলে মাত্র ৪৫ জন নিয়োগ পাবেন মেধার ভিত্তিতে, ৩০ জন নিয়োগ পাবেন মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের মধ্য থেকে, ১০ জন নারী কোটায়, ১০ জন জেলা কোটায় এবং পাঁচজন নিয়োগ পাবেন উপজাতি কোটায়।
পিএসসির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারে গড়ে ৫০০ জন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু অংশ নেন দেড় থেকে দুই লাখ পরীক্ষার্থী। কোটাপদ্ধতির কারণে কেউ যদি দুই লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২২৬তম হন, তাহলে তিনি চাকরি না-ও পেতে পারেন। কারণ, ৫০০ পদের মধ্যে মেধা কোটায় ২২৫ জনকে দেওয়া যাবে। কাজেই ২২৬তম হয়ে তিনি চাকরি পাবেন না। আবার কোটা থাকলে কেউ সাত হাজারতম হয়েও চাকরি পেতে পারেন।
কোটার কারণে বঞ্চিত প্রার্থীরা বিসিএসের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন। এমনিতেই বিসিএস পরীক্ষার প্রচলিত পদ্ধতিটি মেধা যাচাইয়ের জন্য কোনো উৎকৃষ্ট পদ্ধতি নয়। পাশাপাশি রয়েছে বাছাই পদ্ধতির দীর্ঘসূত্রতা। একটি বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞাপন প্রচার থেকে শুরু করে নিয়োগ সম্পন্ন হতে দুই-আড়াই বছর লেগে যায়। এসব কারণে অনেক মেধাবী বিসিএসের চিন্তা বাদ দিয়ে ঝুঁকছেন বেসরকারি চাকরির দিকে। কেউ পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে।
সর্বশেষ পাঁচটি বিসিএসের চিত্র: ২০০৫ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের শেষ বছরে ২৭তম বিসিএসের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। নানা জটিলতার পর ২০০৮ সালে ওই বিসিএসের ফল প্রকাশ করে পিএসসি। এতে সাধারণ ক্যাডারে মোট ৫৮০ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়, যার মধ্যে ২৬৯ জনকে মেধায় আর ৩১১ জনকে কোটায় নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।
পিএসসির গত ছয় বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন ও ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২৮তম বিসিএসের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে। দুই বছর পর ২০১০ সালে এর ফল প্রকাশ হয়। সাধারণ ক্যাডারে মোট ৬৫৮ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। এর মধ্যে ৩১০ জনকে মেধায় আর ৩৪৮ জনকে কোটায় নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ২৯তম বিসিএসের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১১ সালে এর ফল প্রকাশ হয়। এতে সাধারণ ক্যাডারে ৪১৫ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে ২০১ জনকে মেধায় আর ২১৪ জনকে কোটায় নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।
৩০তম বিসিএসের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১০ সালে। ২০১১ সালের ২ নভেম্বর এর ফল প্রকাশ হয়। এতে মোট ৭৬৫ জনকে নিয়োগের সুপারিশ ছিল। এর মধ্যে ৩৫৮ জনকে মেধায় আর ৪০৭ জনকে কোটা থেকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।
৩১তম বিসিএসের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১১ সালে। ২০১২ সালের ৮ জুলাই এর ফল প্রকাশ হয়। সাধারণ ক্যাডারে ৭৬১ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। এর মধ্যে ৩৫৫ জনকে মেধায় আর ৪০৬ জনকে কোটায় নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।
পদ শূন্য থাকছে: বিএনপি-জোট সরকারের সময় বলা হতো, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এই পদগুলো মেধা দিয়ে পূরণ করা হোক। কিন্তু এর ফলে দেখা গেল, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা থাকলেও তাঁরা চাকরি পেতেন না। সমস্যা সমাধানে বর্তমান সরকার কোটার পদগুলোতে প্রার্থী না পাওয়া গেলে সেগুলো শূন্য রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফল হয় উল্টো। মেধাবীরা উত্তীর্ণ হয়েও একদিকে চাকরি পাননি, আর অন্যদিকে শত শত পদ শূন্য রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও কৃষি কর্মকর্তাদের মতো কারিগরি ক্যাডারের প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়েছেন।
২৮তম বিসিএসে প্রার্থী না পাওয়ায় প্রাধিকার কোটার বিপরীতে ৮১৩টি পদ শূন্য রাখে পিএসসি। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ৬২৮টি, মহিলা কোটায় ৪৫ ও উপজাতি কোটায় ১৪০টি পদ শূন্য ছিল।
২৯তম বিসিএসে ৫৩৮টি মুক্তিযোদ্ধা, ৮১টি মহিলা ও ১১১টি উপজাতিসহ কোটার ৭৯২টি পদ শূন্য ছিল।
৩০তম বিসিএসে ৬১৩টি মুক্তিযোদ্ধা, ৩২টি মহিলা ও ১৩৯টি উপজাতিসহ কোটার ৭৮৪টি পদ শূন্য ছিল।
৩১তম বিসিএসে ৫৫০টি মুক্তিযোদ্ধা, ৫৪টি মহিলা ও ১২৯টি উপজাতিসহ কোটার ৭৭৩টি পদ শূন্য ছিল।
কোটার শূন্য পদগুলো পূরণ করতে মুক্তিযোদ্ধা, আদিবাসী ও মহিলাদের জন্য ৩২তম বিশেষ বিসিএস নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পিএসসি। ওই বিসিএস ও মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৮১৭টি, মহিলা ১০টি ও উপজাতির ২৯৮টিসহ মোট এক হাজার ১২৫টি পদ শূন্য রাখতে হয়। শেষ পর্যন্ত ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে এই পদগুলো পূরণের সিদ্ধান্ত হয়। অথচ ৩২তম বিসিএসে উত্তীর্ণ ৯১২ জনই চাকরির সুযোগ পাননি। কারণ এক কোটা থেকে আরেক কোটায় নিয়োগ দেওয়া যায় না।
এর আগে ২০০৩ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৮৩৩টির মধ্যে ৭৭৮টি, ২০০৫ সালে এক হাজার ৮৫৪টির মধ্যে এক হাজার ৫০৮টি, ২০০৬ সালে ৭৫৪টির মধ্যে ৫৯৮টি এবং ২০০৭ সালে ৭০৯টির মধ্যে ৬৩৭টি পদ খালি রাখতে হয়েছিল এই কোটার কারণেই।
পিএসসির সদস্য লিয়াকত আলী খান ও এমরান কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রার্থী না পাওয়ায় কোটার পদগুলো বছরের পর শূন্য পড়ে থাকে। এ জন্যই এবার প্রিলিমিনারি থেকেই কোটার বিপরীতে প্রার্থী বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এতে কোটার পদগুলো পূরণ করা যেত।
সুপারিশের কী হলো: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান এবং সাবেক সচিব কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ (বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার) বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার ওপর ২০০৮ সালের মার্চে একটি গবেষণা করেছেন। ৬১ পৃষ্ঠার এই গবেষণা প্রতিবেদনটি পিএসসিতে আছে। এই প্রতিবেদনে কোটা কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হলেও সেটি বাস্তবায়িত হয়নি।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭৭ সালে এক বৈঠকে তৎকালীন পে ও সার্ভিস কমিশনের প্রায় সব সদস্য সরকারি নিয়োগে কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। কমিশনের সদস্যদের মধ্যে একমাত্র এম এম জামান ছিলেন কোটার পক্ষে। তবে কোটার পক্ষে সেদিন জামানের অবস্থান থাকলেও তিনি শুধু একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যবস্থাটি চালু রাখার পক্ষে ছিলেন। তবে ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী ১০ বছরে কোটার হার ধীরে ধীরে কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার কথা বলেছিলেন তিনি। ওই সুপারিশ অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালের পর দেশের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কোটা থাকার কথা নয়। তবে ওই প্রতিবেদন বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ সরকার নেয়নি।
কোটা পদ্ধতি সংস্কারের কোনো চিন্তা আছে কি না, জানতে চাইলে জনপ্রশাসনসচিব আবদুস সোবহান সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, এখনো সংস্কারের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেই। তবে ভবিষ্যতে হয়তো সংস্কারের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হতে পারে।
No comments