নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন জরুরি by শেখ মাহবুবল হক
কালবৈশাখীর
হাওয়া থামলেও রাজনীতির ঝড়ো হাওয়া ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। প্রলয় থামানোর একটি
ক্ষীণ চেষ্টা পরিলক্ষিত হলেও জনগণ আস্থাহীনতায় ভুগছে। নিত্যনতুন প্রস্তাবে
চাওয়ার তালিকা বাড়লেও পাওয়ার তালিকা শূন্যের কোঠায়। কত কিছুই তো চাই-
গণতন্ত্র চাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন চাই,
নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন চাই, সর্বোপরি সৎ মানুষ চাই। আরও কত কিছু।
এসব চাওয়া-পাওয়ার ডামাডোলে নানা মনে নানা প্রশ্ন : নির্বাচন আদৌ হবে কি-না,
হলে কীভাবে হবে, তৃতীয় পক্ষের উদয় হবে কি-না, নির্বাচন হলে কি গণতন্ত্র
পাব, নাকি গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র পাব? এর থেকেও বড় কথা, আমরা কি
গণতন্ত্রের নামে উত্তরাধিকার তন্ত্রের মধ্যেই ঘুরপাক খাব? এমন হাজারও
প্রশ্নে সর্বস্তরের জনগণ আজ দিশেহারা, ভীতসন্ত্রস্ত। কিন্তু উত্তরণের পথ
কই? উত্তরণের লক্ষ্যে বিশিষ্টজনরা কত পথের কথাই না বলেন। কিন্তু নিজ
স্বার্থ বিচারে কোনোটিই কারও মনঃপুত হয় না। সবাই চায় ঘোলা পানিতে মাছ শিকার
করতে। সবার একই কথা- বিচার মানি, কিন্তু তালগাছ আমার। এক দলের দাবি
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে নির্বাচন, অন্য দলের সাফ জবাব, অসম্ভব। জনগণকে
হাইকোর্ট দেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। এক দল
বলছে, নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিয়োগ করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের সাফ জবাব,
দরকার নেই। সাধারণভাবেই নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব, তার ভূরি ভূরি প্রমাণ
আমরা দিয়েছি।
এসব আলোচনায় সকালের নাশতার টেবিলে, রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে, কর্মহীন বেকার যুবককে, স্বঘোষিত বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক দলের গুরুত্বহীন কর্মী হলেও, নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি প্রমাণে তার বক্তব্য রেখে অথবা অযাচিত মন্তব্য করে কখনও কখনও বচসায় লিপ্ত হতে দেখা যায়। একথা অনস্বীকার্য যে, রাজনীতিতে নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কিন্তু আমাদের রাজনীতিকরা জনগণের সেবা/খেদমতের ধোয়া তুলে নির্বাচন করেন। জয়লাভের পর জনগণের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে আÍসেবায় মগ্ন হন। আর পরাজিত পক্ষ পরাজয়ের জ্বালা ভুলতে, বিজয়ী পক্ষের পথে কাঁটা বিছানোর নিমিত্তে, জনগণের দাবি আদায়ের নামে সরকারের মুণ্ডুপাত ও জনগণের পিণ্ডি চটকাতে থাকে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী দীর্ঘ ৪০ বছরেও এদেশের জনগণ এ দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারেনি। বর্তমানে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন তামাশা। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকা এবং যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়ার আশায় কতই না পরিকল্পনা। সেখানে জনগণের স্থান কোথায়, তা গবেষণালব্ধ বিষয়। এমনই দুর্যোগময় সময়ে আগামী নির্বাচন নিয়ে রাজনীতির অন্দরমহলে শুরু হয়েছে নতুন খেলা। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে চলছে ঘরে-বাইরে আলোচনা। বিশিষ্টজনরা দিচ্ছেন নিত্যনতুন ফর্মুলা। কত টক-মিষ্টি আলোচনা, কিন্তু কোনোটাই কোনো দলের মনঃপুত হচ্ছে না। এ প্রেক্ষাপটে একটি সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন পদ্ধতি খুঁজতে গিয়ে আমার মাথায় একটা নতুন ফর্মুলার ভাবনা এসেছে এবং দীর্ঘ চিন্তাভাবনার পর একটা খসড়া পরিকল্পনা দাঁড় করেছি। আমজনতার বিবেচনার জন্য পরিকল্পনাটি উপস্থাপন করছি। বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতি জনগণের নামে জনগণকে শোষণের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। একথা সর্বজনস্বীকৃত যে, বর্তমানে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাই সর্বোত্তম ব্যবসা। বিত্তবান হওয়ার সহজতম উপায়। সেই লক্ষ্যে তথাকথিত নেতা, উপনেতা, পাতিনেতা- সবাই এখন সংসদ সদস্য, মেয়র, কমিশনার, উপজেলা চেয়ারম্যান, মেম্বার ইত্যাদি হওয়ার দৌড়ে মত্ত। এখানে জনগণের কোনো স্থান নেই। শুধু জনগণের কথা বলে, জনগণের ঘাড়ে পা রেখে, জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেয়ে নিজেকে পুষ্ট করাই একমাত্র লক্ষ্য।
এ লক্ষ্যে চিত্তহীন বিত্তবানরা টাকার বস্তা নিয়ে ছুটছে রাজনৈতিক দলের অফিসে, একটা নির্বাচনী মনোনয়নপত্র কেনার আশায়। এভাবেই রাজনীতিতে ঘটছে দুর্বৃত্তায়ন, নীতিহীনতা ও আদর্শহীনতা। ছন্দ মিলিয়ে বলতে হয়-
তোরা যে যা বলিস ভাই,
আমার লজ্জা শরম নাই,
ছলে, বলে, কৌশলে হোক,
আমার টাকার পাহাড় চাই।
রাষ্ট্র আজ ব্যর্থ। রাজনীতি বিপন্ন। শুধু দুর্নীতিরই জয়জয়কার। আর হতভাগ্য জনগণ দিশেহারা। তাই এই দুর্নীতিগ্রস্ত নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন একান্তই কাম্য। অনেক বিশিষ্টজন এই নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের পক্ষে তাদের মতামত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ব্যক্ত করেছেন। এ প্রেক্ষাপটে আমার প্রস্তাব একটা নতুন নির্বাচন পদ্ধতির, যা অবহেলিত জনগণের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হবে। সংবিধান বলে, জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে, কোন দল এ দেশকে ৫ বছরের জন্য পরিচালনা করবে। জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে তাদের নিজ নিজ সংসদীয় আসন থেকে কোন ব্যক্তি সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
দুই স্তরবিশিষ্ট নির্বাচন পদ্ধতির প্রস্তাব : প্রথম পর্বে সব আগ্রহী রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের বিধি মোতাবেক জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। ধরা যাক, ‘ক’ দল জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়। ‘ক’ দল নির্বাচন কমিশনে ৩০০ আসনের জন্য প্রযোজ্য জামানতের টাকা এবং প্রতিটি আসনে নিম্নতম ৭ ও তদূর্ধ্ব সম্ভাব্য প্রার্থীর নামের তালিকা নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত প্রয়োজনীয় তালিকাসহ জমা দেবে। একই সঙ্গে এই প্রার্থী তালিকা সংশ্লিষ্ট আসনের জনগণের অবগতির জন্য এলাকায় প্রকাশ করবে।
নির্বাচন কমিশন তাদের বিধি মোতাবেক যাচাই-বাছাই শেষে ওই প্রার্থীদের নির্বাচন করার উপযুক্ততার ছাড়পত্র প্রদান করবে। প্রতিটি আসনে সর্বনিু ৭ বা তদূর্ধ্ব প্রার্থীর তালিকা নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে দলগুলো প্রতিটি আসনে প্রচারের ব্যবস্থা করবে, যাতে জনগণ তাদের মধ্য থেকে সর্বোত্তম ব্যক্তিকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে বিবচেনা করতে পারে।
কোনো দল যদি কমসংখ্যক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়, তবে সেই দল নির্দিষ্টসংখ্যক আসনের জন্য জামানত জমা ও সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা নির্বাচন কমিশনের বিধি মোতাবেক জমা দেবে।
নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত দিনে প্রথম পর্বের নির্বাচন হবে। সেখানে শুধু রাজনৈতিক দলগুলো জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। তবে যদি কোনো ব্যক্তি কোনো দলের সমর্থন ছাড়া স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে চায়, তবে তিনি বা তারা নির্বাচন কমিশনের বিধি মোতাবেক জামানত প্রদান সাপেক্ষে নির্বাচন করার অনুমতি পাবে।
প্রথম পর্বের নির্বাচনের ব্যালট পেপারে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক অনুমতিপ্রাপ্ত দলগুলোর নির্বাচনী প্রতীক ছাপা হবে। স্বতন্ত্র প্রার্থীকেও একটি প্রতীক প্রদান করা হবে এবং এই প্রতীকটিও প্রথম পর্বের ব্যালট পেপারে ছাপা হবে।
নির্বাচনে যে প্রতীক সর্বোচ্চ ভোট পাবে, প্রতিটি আসনে সেই প্রতীক চিহ্নিত দল জয়লাভ করেছে বলে বিবেচিত হবে। কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী কোনো আসনে সর্বোচ্চ ভোট পেলে সেই প্রার্থী সরাসরি সংসদ সদস্য নির্বাচিত বলে বিবেচিত হবে।
এভাবে ৩০০ সংসদীয় আসনের নির্বাচন ও আসন বণ্টন সম্পন্ন হবে। যেমন ধরা যাক, এই নির্বাচনে ‘ক’ দল ১৪০টি, ‘খ’ দল ১৩০টি, ‘গ’ দল ২০টি, ‘ঘ’ দল ৭টি এবং স্বতন্ত্র ৩টি আসনে জয়লাভ করেছে।
দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচন : প্রথম পর্বের নির্বাচন শেষে নির্বাচন কমিশন যথাসম্ভব দ্রুততম সময়ে ২৯৭টি আসনের নির্বাচন পরিচালনা করবে। প্রথম পর্বের নির্বাচনে যে যে দল যেসব আসনে নির্বাচিত হয়েছে, দ্বিতীয় পর্বে সেই দলের আসনগুলো শুধু সেই দলের পূর্বনির্ধারিত এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক পূর্ব অনুমোদিত সর্বনিম্ন ৭ বা তদূর্ধ্ব প্রার্থীরা ওই আসনের সংসদ সদস্য মনোনীত হওয়ার মানসে ওই আসনের নিবন্ধিত ভোটারদের সামনে প্রার্থী হবে। ওই আসনে সব ভোটার ওই ৭ বা তদূর্ধ্ব প্রার্থীর ভেতর থেকে সর্বোত্তম বিবেচনায় একজন প্রার্থীকে সর্বোচ্চ ভোটের মাধ্যমে ওই আসনের সংসদ সদস্য মনোনীত করবে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিতে দল একজন ব্যক্তিকে একটি আসনের জন্য প্রার্থী ঘোষণা করে। জনগণের বিবেচনায় সেই প্রার্থী উপযুক্ত ও মনঃপুত না হলেও অসহায় ভোটাররা নিরুপায় হয়ে ‘অমুক ভাইয়ের চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র’ জ্ঞানে দলের মার্কায় ভোট প্রদান করে। দল কর্তৃক একজন চিহ্নিত দুর্বৃত্ত মনোনয়ন লাভ করলে অসহায় জনগণ সেই দুর্বৃত্তকে দলের স্বার্থে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্বাচিত করতে বাধ্য হয়। এই নির্বাচন প্রক্রিয়ার ফলে আজ আমাদের রাজনীতির এমন মরণ দশা। অবৈধ অর্থ ও অস্ত্রের হুংকারে সেবাপরায়ণ রাজনীতিকরা আজ আঁস্তাকুড়ে। সৎ মানুষরা আজ রাজনীতিবিমুখ। শিক্ষিত মানুষরা দেশত্যাগে ব্যস্ত। নবপ্রস্তাবিত পদ্ধতিটি জনগণকে এই অচলায়তন ভেঙে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে। এর ফলে-
১. জনগণ অনেক প্রার্থীর ভেতর থেকে তুলনামূলক সৎ প্রার্থীকে নির্বাচিত করার সুযোগ পাবে।
২. একাধিক প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ থাকায় নিবেদিতপ্রাণ সৎ রাজনীতিকরা আবার রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করবে।
৩. সব আগ্রহী প্রার্থীর অংশগ্রহণের সুযোগ থাকায় দলের উচ্চমহলে প্রর্থী মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ হবে। সেই সঙ্গে বন্ধ হবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের লুটপাট বাণিজ্য।
৪. নির্বাচনে অংশগ্রহণের দ্বার উন্মুক্ত থাকায় প্রার্থী নির্বাচনে দলীয় কোন্দল বন্ধ হবে। ফলে দলের অভ্যন্তরীণ শৃংখলা বজায় থাকবে। আর ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ শব্দটা রাজনীতির ময়দান থেকে হারিয়ে যাবে। ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা মাথায় নিয়ে, দুর্নীতিপরায়ণ দেশের তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করে এ দেশের যে অগস্ত যাত্রা, তা রুখতেই হবে। আর সে কাজটা করতে হবে এ দেশের সত্যিকারের মালিক জনগণকে তাদের নিজেদের স্বার্থেই।
রাজনৈতিক পরগাছাদের উপড়ে ফেলে সৎ মানুষের হাতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তুলে দিতে এবং অমিত সম্ভাবনার এই দেশটিকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড় করানোর প্রয়োজনে বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিকে প্রস্তাবিত পদ্ধতি দ্বারা প্রতিস্থাপন জরুরি।
শেখ মাহবুবল হক : বিকল্প জ্বালানি গবেষণা কর্মী
এসব আলোচনায় সকালের নাশতার টেবিলে, রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে, কর্মহীন বেকার যুবককে, স্বঘোষিত বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক দলের গুরুত্বহীন কর্মী হলেও, নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি প্রমাণে তার বক্তব্য রেখে অথবা অযাচিত মন্তব্য করে কখনও কখনও বচসায় লিপ্ত হতে দেখা যায়। একথা অনস্বীকার্য যে, রাজনীতিতে নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কিন্তু আমাদের রাজনীতিকরা জনগণের সেবা/খেদমতের ধোয়া তুলে নির্বাচন করেন। জয়লাভের পর জনগণের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে আÍসেবায় মগ্ন হন। আর পরাজিত পক্ষ পরাজয়ের জ্বালা ভুলতে, বিজয়ী পক্ষের পথে কাঁটা বিছানোর নিমিত্তে, জনগণের দাবি আদায়ের নামে সরকারের মুণ্ডুপাত ও জনগণের পিণ্ডি চটকাতে থাকে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী দীর্ঘ ৪০ বছরেও এদেশের জনগণ এ দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারেনি। বর্তমানে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন তামাশা। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকা এবং যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়ার আশায় কতই না পরিকল্পনা। সেখানে জনগণের স্থান কোথায়, তা গবেষণালব্ধ বিষয়। এমনই দুর্যোগময় সময়ে আগামী নির্বাচন নিয়ে রাজনীতির অন্দরমহলে শুরু হয়েছে নতুন খেলা। নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে চলছে ঘরে-বাইরে আলোচনা। বিশিষ্টজনরা দিচ্ছেন নিত্যনতুন ফর্মুলা। কত টক-মিষ্টি আলোচনা, কিন্তু কোনোটাই কোনো দলের মনঃপুত হচ্ছে না। এ প্রেক্ষাপটে একটি সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন পদ্ধতি খুঁজতে গিয়ে আমার মাথায় একটা নতুন ফর্মুলার ভাবনা এসেছে এবং দীর্ঘ চিন্তাভাবনার পর একটা খসড়া পরিকল্পনা দাঁড় করেছি। আমজনতার বিবেচনার জন্য পরিকল্পনাটি উপস্থাপন করছি। বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতি জনগণের নামে জনগণকে শোষণের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। একথা সর্বজনস্বীকৃত যে, বর্তমানে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাই সর্বোত্তম ব্যবসা। বিত্তবান হওয়ার সহজতম উপায়। সেই লক্ষ্যে তথাকথিত নেতা, উপনেতা, পাতিনেতা- সবাই এখন সংসদ সদস্য, মেয়র, কমিশনার, উপজেলা চেয়ারম্যান, মেম্বার ইত্যাদি হওয়ার দৌড়ে মত্ত। এখানে জনগণের কোনো স্থান নেই। শুধু জনগণের কথা বলে, জনগণের ঘাড়ে পা রেখে, জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেয়ে নিজেকে পুষ্ট করাই একমাত্র লক্ষ্য।
এ লক্ষ্যে চিত্তহীন বিত্তবানরা টাকার বস্তা নিয়ে ছুটছে রাজনৈতিক দলের অফিসে, একটা নির্বাচনী মনোনয়নপত্র কেনার আশায়। এভাবেই রাজনীতিতে ঘটছে দুর্বৃত্তায়ন, নীতিহীনতা ও আদর্শহীনতা। ছন্দ মিলিয়ে বলতে হয়-
তোরা যে যা বলিস ভাই,
আমার লজ্জা শরম নাই,
ছলে, বলে, কৌশলে হোক,
আমার টাকার পাহাড় চাই।
রাষ্ট্র আজ ব্যর্থ। রাজনীতি বিপন্ন। শুধু দুর্নীতিরই জয়জয়কার। আর হতভাগ্য জনগণ দিশেহারা। তাই এই দুর্নীতিগ্রস্ত নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন একান্তই কাম্য। অনেক বিশিষ্টজন এই নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের পক্ষে তাদের মতামত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ব্যক্ত করেছেন। এ প্রেক্ষাপটে আমার প্রস্তাব একটা নতুন নির্বাচন পদ্ধতির, যা অবহেলিত জনগণের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হবে। সংবিধান বলে, জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে, কোন দল এ দেশকে ৫ বছরের জন্য পরিচালনা করবে। জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে তাদের নিজ নিজ সংসদীয় আসন থেকে কোন ব্যক্তি সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
দুই স্তরবিশিষ্ট নির্বাচন পদ্ধতির প্রস্তাব : প্রথম পর্বে সব আগ্রহী রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের বিধি মোতাবেক জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। ধরা যাক, ‘ক’ দল জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়। ‘ক’ দল নির্বাচন কমিশনে ৩০০ আসনের জন্য প্রযোজ্য জামানতের টাকা এবং প্রতিটি আসনে নিম্নতম ৭ ও তদূর্ধ্ব সম্ভাব্য প্রার্থীর নামের তালিকা নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত প্রয়োজনীয় তালিকাসহ জমা দেবে। একই সঙ্গে এই প্রার্থী তালিকা সংশ্লিষ্ট আসনের জনগণের অবগতির জন্য এলাকায় প্রকাশ করবে।
নির্বাচন কমিশন তাদের বিধি মোতাবেক যাচাই-বাছাই শেষে ওই প্রার্থীদের নির্বাচন করার উপযুক্ততার ছাড়পত্র প্রদান করবে। প্রতিটি আসনে সর্বনিু ৭ বা তদূর্ধ্ব প্রার্থীর তালিকা নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে দলগুলো প্রতিটি আসনে প্রচারের ব্যবস্থা করবে, যাতে জনগণ তাদের মধ্য থেকে সর্বোত্তম ব্যক্তিকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে বিবচেনা করতে পারে।
কোনো দল যদি কমসংখ্যক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়, তবে সেই দল নির্দিষ্টসংখ্যক আসনের জন্য জামানত জমা ও সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা নির্বাচন কমিশনের বিধি মোতাবেক জমা দেবে।
নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত দিনে প্রথম পর্বের নির্বাচন হবে। সেখানে শুধু রাজনৈতিক দলগুলো জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। তবে যদি কোনো ব্যক্তি কোনো দলের সমর্থন ছাড়া স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে চায়, তবে তিনি বা তারা নির্বাচন কমিশনের বিধি মোতাবেক জামানত প্রদান সাপেক্ষে নির্বাচন করার অনুমতি পাবে।
প্রথম পর্বের নির্বাচনের ব্যালট পেপারে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক অনুমতিপ্রাপ্ত দলগুলোর নির্বাচনী প্রতীক ছাপা হবে। স্বতন্ত্র প্রার্থীকেও একটি প্রতীক প্রদান করা হবে এবং এই প্রতীকটিও প্রথম পর্বের ব্যালট পেপারে ছাপা হবে।
নির্বাচনে যে প্রতীক সর্বোচ্চ ভোট পাবে, প্রতিটি আসনে সেই প্রতীক চিহ্নিত দল জয়লাভ করেছে বলে বিবেচিত হবে। কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থী কোনো আসনে সর্বোচ্চ ভোট পেলে সেই প্রার্থী সরাসরি সংসদ সদস্য নির্বাচিত বলে বিবেচিত হবে।
এভাবে ৩০০ সংসদীয় আসনের নির্বাচন ও আসন বণ্টন সম্পন্ন হবে। যেমন ধরা যাক, এই নির্বাচনে ‘ক’ দল ১৪০টি, ‘খ’ দল ১৩০টি, ‘গ’ দল ২০টি, ‘ঘ’ দল ৭টি এবং স্বতন্ত্র ৩টি আসনে জয়লাভ করেছে।
দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচন : প্রথম পর্বের নির্বাচন শেষে নির্বাচন কমিশন যথাসম্ভব দ্রুততম সময়ে ২৯৭টি আসনের নির্বাচন পরিচালনা করবে। প্রথম পর্বের নির্বাচনে যে যে দল যেসব আসনে নির্বাচিত হয়েছে, দ্বিতীয় পর্বে সেই দলের আসনগুলো শুধু সেই দলের পূর্বনির্ধারিত এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক পূর্ব অনুমোদিত সর্বনিম্ন ৭ বা তদূর্ধ্ব প্রার্থীরা ওই আসনের সংসদ সদস্য মনোনীত হওয়ার মানসে ওই আসনের নিবন্ধিত ভোটারদের সামনে প্রার্থী হবে। ওই আসনে সব ভোটার ওই ৭ বা তদূর্ধ্ব প্রার্থীর ভেতর থেকে সর্বোত্তম বিবেচনায় একজন প্রার্থীকে সর্বোচ্চ ভোটের মাধ্যমে ওই আসনের সংসদ সদস্য মনোনীত করবে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিতে দল একজন ব্যক্তিকে একটি আসনের জন্য প্রার্থী ঘোষণা করে। জনগণের বিবেচনায় সেই প্রার্থী উপযুক্ত ও মনঃপুত না হলেও অসহায় ভোটাররা নিরুপায় হয়ে ‘অমুক ভাইয়ের চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র’ জ্ঞানে দলের মার্কায় ভোট প্রদান করে। দল কর্তৃক একজন চিহ্নিত দুর্বৃত্ত মনোনয়ন লাভ করলে অসহায় জনগণ সেই দুর্বৃত্তকে দলের স্বার্থে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্বাচিত করতে বাধ্য হয়। এই নির্বাচন প্রক্রিয়ার ফলে আজ আমাদের রাজনীতির এমন মরণ দশা। অবৈধ অর্থ ও অস্ত্রের হুংকারে সেবাপরায়ণ রাজনীতিকরা আজ আঁস্তাকুড়ে। সৎ মানুষরা আজ রাজনীতিবিমুখ। শিক্ষিত মানুষরা দেশত্যাগে ব্যস্ত। নবপ্রস্তাবিত পদ্ধতিটি জনগণকে এই অচলায়তন ভেঙে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে। এর ফলে-
১. জনগণ অনেক প্রার্থীর ভেতর থেকে তুলনামূলক সৎ প্রার্থীকে নির্বাচিত করার সুযোগ পাবে।
২. একাধিক প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ থাকায় নিবেদিতপ্রাণ সৎ রাজনীতিকরা আবার রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করবে।
৩. সব আগ্রহী প্রার্থীর অংশগ্রহণের সুযোগ থাকায় দলের উচ্চমহলে প্রর্থী মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ হবে। সেই সঙ্গে বন্ধ হবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের লুটপাট বাণিজ্য।
৪. নির্বাচনে অংশগ্রহণের দ্বার উন্মুক্ত থাকায় প্রার্থী নির্বাচনে দলীয় কোন্দল বন্ধ হবে। ফলে দলের অভ্যন্তরীণ শৃংখলা বজায় থাকবে। আর ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ শব্দটা রাজনীতির ময়দান থেকে হারিয়ে যাবে। ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা মাথায় নিয়ে, দুর্নীতিপরায়ণ দেশের তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করে এ দেশের যে অগস্ত যাত্রা, তা রুখতেই হবে। আর সে কাজটা করতে হবে এ দেশের সত্যিকারের মালিক জনগণকে তাদের নিজেদের স্বার্থেই।
রাজনৈতিক পরগাছাদের উপড়ে ফেলে সৎ মানুষের হাতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তুলে দিতে এবং অমিত সম্ভাবনার এই দেশটিকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড় করানোর প্রয়োজনে বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিকে প্রস্তাবিত পদ্ধতি দ্বারা প্রতিস্থাপন জরুরি।
শেখ মাহবুবল হক : বিকল্প জ্বালানি গবেষণা কর্মী
No comments