মাননীয় কৃষিমন্ত্রী, বিটিবেগুন চাই না by ফরহাদ মজহার
মাননীয়
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর কাছে আমি একটি দরখাস্ত পেশ করব। কিন্তু তার আগে
নিজের সম্পর্কে দুই-একটি কথা না বলে পারছি না। আমি কৃষকদের সঙ্গে দীর্ঘদিন
ধরে ক্ষেতখামারে কাজ করছি। এটা গ্রাম বা কৃষিব্যবস্থার প্রতি কোনো
রোমান্টিক ধারণার বশবর্তী হয়ে নয়। তবে অনেকের মতোই শহরের চেয়ে গ্রাম আমার
ভালো লাগে। নিজেকে অনেক সময় প্রশ্ন করি, ভালো লাগার ব্যারামটা শহরের
‘গেঞ্জাম’ থেকে দূরে থাকার বাসনা কি-না। কিন্তু সবসময়ই নেতিবাচক উত্তর পাই।
কারণ শহরও আমার ভালো লাগে, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। দিনানুদিনের
লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শহরে সাধারণ মানুষের টিকে থাকার যে অভিজ্ঞতা তার
চরিত্র আলাদা। এই জীবন থেকে শিক্ষা নেয়ার পদ্ধতিও আলাদা। গ্রামের জীবনের
সঙ্গে তার তুলনা অপ্রয়োজনীয়। এই ক্ষেত্রে ভালো লাগা মানসিক কোনো বিনোদন বা
প্রশান্তির সমার্থক নয়, এই দুই পরিস্থিতিতে মানুষের যে পার্থক্য ও
বৈচিত্র্য, তাকে জানার ও বোঝার আগ্রহ থেকেই এই ভালো লাগার উৎপত্তি। শহর
কিভাবে মানুষকে অজান্তে বদলে দেয় সেটা বিস্ময়কর বৈকি। নিজে বড় হয়েছি
নোয়াখালী সদর থানার অধীন লক্ষ্মীনারায়ণপুর নামের গ্রামে। সেটা ছিল আধা বন
আর আধা কৃষির মধ্যবর্তী বিচিত্র এক জায়গা। কৈশোরে খেলার সময় যখন খুশি আমরা
কৃষি ক্ষেত থেকে বনে কিংবা বন থেকে ফসলের মাঠে দাপাদাপি করে বেড়িয়েছি।
কৃষিকে বন থেকে যেমন বিচ্ছিন্ন করা কঠিন ছিল, ঠিক তেমনি বনকেও কৃষি থেকে
আলাদা করা ছিল অসম্ভব। আর উভয়ের মধ্যবর্তী জায়গায় গড়ে উঠছিল শহর। আমি
ম্যাট্রিক পাস করার বয়সে হঠাৎই আবিষ্কার করলাম, চতুর্দিক আমাকে জানান না
দিয়েই বদলে যাচ্ছে। মফস্বল শহরের প্রান্তিক একটি গ্রামেও রূপান্তরের ঠাণ্ডা
হাত স্পর্শ করতে শুরু করেছে। গ্রামের কলেজে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় পড়তে
এসে ফিরে গিয়ে আর লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামকে খুঁজে পাইনি।
যখন বলি, গ্রাম আমার ভালো লাগে, তখন মনের মধ্যে কোনো আকুতি থেকে কথাগুলো উচ্চারিত হয় না। কিন্তু সম্ভবত কৈশোরেই দুটি প্রশ্ন জেগেছিল। এক. গ্রামের বিলয় মানুষের সভ্যতার জন্য অনিবার্য বা অবধারিত কি-না। যদি তাই হয়, তাহলে মানুষ বা প্রকৃতি উভয়ের জন্য এর পরিণতি কী হতে পারে? অর্থাৎ আমরা যদি নিজেদের ‘সভ্য’ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই তাহলে গ্রাম ধ্বংস করে দিয়ে নগর গড়ে তোলাই কি একমাত্র পথ? এটা কেমন কথা? এ কেমন ‘সভ্যতা’? এই সভ্যতার স্থায়িত্বের নিশ্চয়তাই বা কী? এর নিশ্চয়ই কিছু পরিণতি আছে যা সর্বাংশে ইতিবাচক হতে পারে না। দ্বিতীয় প্রশ্ন প্রথম প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত কিন্তু চরিত্রের দিক থেকে ভিন্ন। নগরায়ন বা তথাকথিত আধুনিকতাই মনুষ্য জীবনের প্রধান কিংবা একমাত্র অন্বিষ্ট কি? অর্থাৎ নগর জীবনই কি জীবনযাপনের জন্য মানুষের একমাত্র চাইবার জিনিস, মনুষ্য জীবনের পরমার্থ? বলাবাহুল্য, এ ধরনের প্রশ্নকীটের দংশন ছাড়াও মানুষ বাঁচে। সুখীও হয়। কিন্তু অনেকেই আছে, স্বভাবদোষে জীবদ্দশাতে তাদের যাতনা যায় না। আমার হয়েছে সেই দশা।
যখন অর্থশাস্ত্র পড়েছি, তখন এই প্রশ্নকে দর্শনের জায়গা থেকে বিচার না করে আর্থ-সামাজিক প্রক্রিয়া বিচারের জায়গা থেকে বুঝেছি। বিশেষত পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিস্মৃতি ও গভীরতাই শহর ও গ্রামের দ্বন্দ্ব তৈরি করে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে শিল্পবিপ্লব। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের অধীনে বিস্ফোরিত শিল্পবিপ্লবের যে মহিমা কীর্তন করা হয়, তার সুফল ও কুফল দুটোই আমরা ভোগ করি। কিন্তু এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অন্য কিছু করার দরকার কি নাই? অন্য কোনো কর্তব্য আছে কি মানুষের? থাকলে সেটা কী হতে পারে, অর্থশাস্ত্র তার উত্তর দিতে পারে না। এটা আমরা অনুমান করতে পারি, পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের অবসানের জন্য মানুষের যে সংগ্রাম সেটা একই সঙ্গে শহর ও গ্রামের ব্যবধান মোচনেরও সংগ্রাম। কিন্তু এর মানে কী? গ্রামকে শহর বানানো? সভ্যতার অন্বিষ্ট ও আদর্শ হিসেবে নগরায়ন ও শিল্পায়নের অবস্থানে এতে কি কোনো নড়চড় হয়? আমরা কি বলি যে শহর ভেঙে আবার তাকে গ্রামে রূপান্তর করা উচিত? পুঁজিবাদী হলেও যেমন আমরা শহর চাই, সমাজতন্ত্রী হলেও তো তা-ই চাই। আকাক্সক্ষায় কোনো হেরফের নাই। পুঁজিতন্ত্রে ও সমাজতন্ত্রে এদিক থেকে তো কোনো ফারাক দেখা যায় না। দুইয়ের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ভেদ থাকা সত্ত্বেও এক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য নাই। সমাজতন্ত্রও মনে করে শিল্পায়ন ও নগরায়নই সভ্যতা, ওর মধ্যেই মানুষের অগ্রগতির চাবিকাঠি। সমাজতন্ত্র গ্রাম ও শহরের ব্যবধান মোচন করতে চায় বটে কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মতোই গ্রামকেও শহরে পরিণত করতে চায়। সমাজতন্ত্র নিয়ে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে, সেসব দেশের অভিজ্ঞতা এটাই বলে। সমাজতন্ত্র আদর্শের দিক থেকে ভিন্ন কিছু চেয়েছে কি-না সেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে, তবে তার প্রমাণ পাওয়া মুশকিল।
কৃষকদের সঙ্গে কাজ করতে যাওয়ার পেছনে প্রবলভাবে এসব প্রশ্ন কাজ করেছে। হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা কৃষি সভ্যতাকে প্রগতি ও আধুনিকতার নামে চোখের সামনে আমরা ধ্বংস করে ফেলেছি। কিন্তু কৃষি সম্পর্কে কোনো পূর্বানুমান মাথায় নিয়ে আমি কৃষকদের সঙ্গে কাজ করতে নামিনি। শিল্পসভ্যতা ও নগরায়নের প্রতি প্রশ্ন জারি রেখেও আমার মনে হয়েছে, কৃষি বলতে আসলে আমরা কী বুঝি? কৃষি কাজের মধ্য দিয়ে আমরা প্রকৃতির সঙ্গে যে বিশেষ সম্পর্কে যুক্ত হই, তার চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যটাই বা আসলে কী? যদি কৃষি সভ্যতা ধ্বংস করে নগর ও শিল্পসভ্যতা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প না থাকে তাহলে কী আমরা হারাচ্ছি, কিভাবে আমরা বদলে যাচ্ছি? এই বদলে যাওয়ার পরিণতি কী দাঁড়াতে পারে, সেই দিকগুলো হাতেনাতে কাজ করে বোঝার চেষ্টা করা উচিত। কোনো কেতাবি কায়দায় জানলে হবে না।
সে কারণে হাতে কোদাল নিয়ে মাটির সঙ্গে সম্বন্ধ রচনা করার প্রয়োজনীয়তাবোধ করেছি। অর্থাৎ এই সম্পর্কের অর্থ কী সেটা ইন্দ্রিয়পরায়ণভাবেই বোঝা দরকার মনে হয়েছে। বুদ্ধিকে সামলে রেখেছি, কারণ বুদ্ধির অহমিকা বারবার প্রকৃতির সঙ্গে আমার সম্বন্ধ রচনার ক্ষেত্রে আগাম বাগড়া দিতে থাকে। এমন কিছু প্রশ্ন মাথায় রেখেছি যাতে কৃষকদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ঠিক কী অন্বেষণ করছি, তা নিজের কাছে স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন থাকে। যেমন, বারবার উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি কিভাবে পদ্মা মেঘনা ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার এই মানুষগুলো তাদের এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে কমপক্ষে ১৫ হাজার হাতের ধান ‘আবিষ্কার’ করতে সক্ষম হলেন? কী প্রতিভার গুণে সেটা সম্ভব হল? আবার বিভিন্ন জাতের চাষ পদ্ধতিও আলাদা। ধান চাষ নামক বিমূর্ত কোনো চাষাবাদ পদ্ধতি নাই। প্রতিটি জাতের পরিচর্যা ভিন্ন। অল্প পার্থক্য হলেও কৃষকের কাছ থেকে প্রতিটি জাত ভিন্ন ভিন্ন পরিচর্যার ধরন দাবি করে।
কৃষকের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে প্রাণ, প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্বন্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা আরও গভীর দিকে ধাবিত করে। যেমন, কৃষকের যে জ্ঞানের ওপর পুরো কৃষি ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে থাকে, কিভাবে এ জ্ঞানের উৎপত্তি ঘটে ও চর্চা হয়? শ্রুতিই যে সংস্কৃতিতে ‘প্রমাণ’ বলে গৃহীত, সে সংস্কৃতিতে আবিষ্কারের নিজস্ব জ্ঞানগত প্রক্রিয়া আছে। তার বৈশিষ্ট্য কেমন? কৃষকের কথোপকথনে ও কানে কানে যে লৌকিক জ্ঞানচর্চার ধারা, সেখানে জ্ঞান ধরে রাখা ও বংশানুক্রমে ধরে রাখার বিদ্যাটা কেমন? এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে যখন ১৯৯২ সালে বিখ্যাত ধরিত্রী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করি তখন প্রাণবৈচিত্র্য চুক্তির (Convention on Biological Diversity, CBD) খসড়া প্রণয়নের সময় বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বন্ধুদের সঙ্গে মিলে অনেক রাষ্ট্রপ্রধানকে লোকায়ত জ্ঞানের গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হই। সহজেই প্রমাণ করা গিয়েছিল, লৌকিক বা লোকায়ত জ্ঞান প্রতিটি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। যেভাবে হোক তার সংরক্ষণ ও জীবন্ত চর্চার জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি জরুরি। আর সেটা করতে হলে যাদের জীবনযাপনের সঙ্গে এই জ্ঞানের উৎপত্তি ও চর্চা জড়িত তাদের স্বীকৃতি দিতে হবে এবং তাদের কোনো আবিষ্কার বা সম্পদ ব্যবহার করতে হলে তাদের জ্ঞানের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বত্ব স্বীকার ও তার উপযুক্ত মূল্য দিতে হবে। এটা নিশ্চিত করার জন্য প্রাণবৈচিত্র্য চুক্তির ৮ অনুচ্ছেদের মধ্যে বিখ্যাত লৌকিক জ্ঞান এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত জীবনযাপন ও তার চর্চার সপক্ষে বিশেষ আন্তর্জাতিক বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে। যা চুক্তির 8(j) বিধান হিসেবে খ্যাত।
ভূমিকা হিসেবে এত কথা বলছি এ কারণে যে কৃষি, কৃষকের জ্ঞান ও আবিষ্কার নিয়ে সাম্প্রতিককালে দেশে-বিদেশে যে জিজ্ঞাসা, গবেষণা, আগ্রহ ও বিতর্ক, তার ছিটেফোঁটাও আমাদের দেশে নাই। আমরা ‘আধুনিক’ কৃষির নামে যা করছি সেটা কৃষি নয়, সেটা আসলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফুড প্রডাকশান। তার উৎপাদনের মডেল হচ্ছে কারখানার মতো। জমি যেন আশপাশের প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন একটি বদ্ধ ঘর। সেই জমির সঙ্গে আচরণ কারখানার মেশিনের মতোই। তার মধ্যে বীজ, সার, কীটনাশক আর ডিপটিউবওয়েলের পানি কাঁচামাল হিসেবে ঢুকিয়ে দেয়া হয় আর তা ফসল হয়ে বেরিয়ে আসে। ইনপুট আর আউটপুট। কারখানা বর্জ্য উৎপাদন করে। এই কৃষি-কারখানাও বর্জ্য ত্যাগ করে। সার, বিষ ও মাটির তলা থেকে তুলে আনা আর্সেনিক আশপাশের প্রকৃতিকে দূষিত করে ফেলে। কিন্তু তার দায় এই ‘কারখানা’ নেয় না। এই কারখানা নিজের জমি থেকে কী পরিমাণ ধান পেল তার হিসাব দেখিয়ে বলে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু বিষে বিষাক্ত হয়ে নদী, খালবিল ও পুকুর মাছশূন্য হয়ে গেছে, সেই হিসাব লুকায়। অথচ বাংলাদেশ মাছের দেশ। গ্রামে মুরগি, হাঁস, ছাগল, গরু পালা দুঃসাধ্য। কারণ সর্বত্রই বিষ ছড়িয়ে গিয়েছে। ফলে কৃষি থেকে দুধ, মাংস, ডিমের উৎপাদন ভয়ানক কমেছে। কিন্তু তাকে ‘খাদ্য’ বলা হচ্ছে না। গ্রামের মানুষ কুড়িয়ে যা পেত, তা পাওয়া আরও কঠিন হয়ে গিয়েছে। এই অন্ধ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আসলে কৃষির নামে আমরা কী করছি, তার ভালো-মন্দ বিচার করার কোনো নিরপেক্ষ মানদণ্ড আমরা তৈরি করতে পারিনি। আমরা ধরে নিয়েছি, কৃষিব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়ে কারখানামূলক পরিবেশবিধ্বংসী ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফুড প্রডাকশানই আমাদের খাদ্যের চাহিদা মেটানোর একমাত্র পথ। পরিবেশবান্ধব অন্য কোনো কৃষি পদ্ধতির দরকার নাই। আর এই পথের সুযোগে আমাদের কৃষিব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি এবং দেশীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। কৃষক নয়, কর্পোরেশনই নাকি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে! এই পথ আত্মঘাতী পথ। কিন্তু এ পথেই আমরা ধেয়ে যাচ্ছি।
অথচ বিজ্ঞানীরা নানাভাবে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, পরিবেশসম্মত সত্যিকারের কৃষিই বরং খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পারে। এর পেছনে সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। কারণ পরিবেশবিধ্বংসী ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফুড প্রডাকশনের জায়গায় আন্তর্জাতিকভাবে সে কারণে ‘টেকসই কৃষি ব্যবস্থা’ প্রচার ও প্রবর্তনের কথা বলা হয়। কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানির নানান বাধা, প্রতিবন্ধকতা এবং বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে কৃষক ও গণমানুষের স্বার্থবিরোধী সরকারের কারণে সে চেষ্টা বেগবান হতে পারেনি।
বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থাকে ধ্বংস করে তাকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফুড প্রডাকশনে রূপান্তরের সাম্প্রতিক পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে জিএমও বা বিকৃত জাতের উদ্ভিদ প্রবর্তন। খবরে দেখছি, সম্প্রতি জুনের (২০১৩) মাঝামাঝি সময়ে বিটিবেগুনের বীজ কৃষক পর্যায়ে চাষ করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি)। এ খবর বাংলাদেশের যে কোনো সচেতন নাগরিককে বিস্মিত করবে। বেগুনের মতো অতি পরিচিত এবং প্রচুর ব্যবহৃত একটি সবজির জৈবিক গঠন বিশেষত প্রাণ সংকেত কেন জেনেটিক মডিফিকেশনের মাধ্যমে বিকৃতি ঘটানো বাংলাদেশের কৃষি গবেষণার জন্য জরুরি হয়ে পড়ল? এর কী যুক্তি? এসব নিয়ে এর আগেও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কিন্তু কোনো সদুত্তর দেয়া হয়নি। মাননীয় মন্ত্রীর কাছে আমার দরখাস্ত এই বিটিবেগুন নিয়ে।
বিটিবেগুনকে ‘বিকৃত’ বেগুন বলা হয় কেন? বিটি একটি ব্যাক্টেরিয়ার নাম ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস (Bacillus thuringiensis)। এই ব্যাকটেরিয়ার বিষাক্ত প্রোটিন উদ্ভাবনের জিন রয়েছে। ব্যাকটেরিয়া থেকে সেটা আলাদা করে জেনেটিক কারিগরির মাধ্যমে বেগুনের জিনোম বা প্রাণ-সাংকেতিক গঠনের মধ্যে সেটা প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে বেগুনের মধ্যেই একই ধরনের বিষাক্ত প্রোটিন উৎপাদিত হয়। অথচ স্বাভাবিক বেগুনে এটা হওয়ার কথা নয়। ব্যাকটেরিয়া আর উদ্ভিদ সম্পূর্ণ দুই ভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক সত্তা। এর ফলে বেগুনের মধ্যে সাধারণত আমরা যেসব পোকা সব সময় দেখি, সেই ব্রিঞ্জাল ফ্রুট অ্যান্ড শুটবরার বা লেদাপোকা বেগুনের গায়ে আক্রমণ করলে বা বেগুনের কোনো অংশ খেলে তাদের পুষ্টিনালী ছিদ্র হয়ে যায়। তারা মারা যায়। অর্থাৎ বেগুনগাছ নিজেই তখন বিষ হিসেবে কাজ করে।
বেগুনগাছকে বিষাক্ত বানিয়ে লেদাপোকা মারার প্রতিভাবান কৌশল আবিষ্কারের কারণ হল ইরি ও হাইব্রিডের বিষাক্ত বেগুন চাষ দেখে যারা বিরক্ত ও আতংকিত তাদের ফাঁকি দেয়া। তাদের বলা হবে, এই বেগুন চাষে কোনো বিষ বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয়নি। অথচ পুরো গাছটা নিজেই বিষাক্ত। সেই বিষাক্ত বেগুনগাছের ফল খাওয়ানো হবে ‘বিষমুক্ত’ বলে। ভালোই কোম্পানির বুদ্ধি। যে বিকৃত বিটিবেগুন এতই বিষাক্ত যে পোকা খাওয়ারও উপযোগী নয়, সেই বেগুন কী করে মানুষের খাওয়ার উপযুক্ত হতে পারে? বেগুন ছাড়াও তুলা ও ভুট্টার ক্ষেত্রেও বিটি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এবং কোনো ক্ষেত্রেই সেসবের প্রবর্তনে কৃষিতে কোনো সাফল্য আনেনি। বরং বিটিতুলা চাষ করে লাখ লাখ কৃষকের সর্বস্বান্ত হয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ভারতে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বিটি প্রযুক্তির মাধ্যমে বিষ ব্যবহার না করার কথা স্রেফ মিথ্যা ও প্রতারণা।
সার ও বিষ ছাড়া যেসব কৃষক চাষাবাদ করেন, তারা দীর্ঘদিন ধরেই জানেন বেগুন পোকা নিয়ন্ত্রণ করার সহজ পথ হচ্ছে- ১. স্থান ও পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং সেই পরিবেশে গড়ে ওঠা স্থানীয় বীজের ব্যবহার, ২. জৈব প্রক্রিয়ায় মাটির উর্বরতা রক্ষা করা যাতে কোনো রাসায়নিক সার দিতে না হয়। আর সর্বোপরি বৈচিত্র্যপূর্ণ ফসলের উৎপাদন করা। অর্থাৎ একাট্টা ফসল না করা। কৃষকদের দেখেছি যদি তারা পোকার আক্রমণের আশংকা করেন তবে সব এক জায়গায় না লাগিয়ে আলানে পালানে নানান জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেগুনগাছ লাগান। পোকা কৃষকের জ্ঞান ও বুদ্ধির কাছে পরাজয় মানতে বাধ্য হয়। কৃষকের উদ্ভাবিত এসব জ্ঞান ও তার চর্চাকে উৎসাহিত না করে বিদেশী কোম্পানির মুনাফার বাজার তৈরি করার জন্য এখন বিটিবেগুন প্রবর্তনের চেষ্টা চলছে। যা অবিলম্বে প্রতিরোধ করা জরুরি।
বারি বিটিবেগুন নিয়ে যে গবেষণা করেছে, সেই গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়েই এবং ফলাফল প্রকাশ না করেই এই অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। তার মানে অনুমোদন চাওয়া হচ্ছে গোপনে। অনুমোদন চাওয়ার আগেই বৈজ্ঞানিক মহলে যেমন গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করার কথা, ঠিক তেমনি কৃষক ও ভোক্তা উভয়কেই সেই গবেষণার ফলাফল জানানো দরকার। এ নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহলে যেমন বিতর্ক হওয়া দরকার, তেমনি জিএমও বা বিকৃত বীজ চাষের ফলে পরিবেশ, প্রাণব্যবস্থা ও প্রাণের বৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক হুমকির সম্ভাবনাও সামগ্রিকভাবে বিবেচনার দরকার আছে। জানা দরকার, এই বীজ দ্বারা কৃষকের বেগুনের জাত দূষিত কিংবা ধ্বংস করার সম্ভাবনা কতটুকু।
আরও অনেক কিছু জানার দরকার আছে। যেমন, এই বীজের ‘মালিক’ কে বা কারা, কারণ এর সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির প্রশ্ন জড়িত। মনসান্টো বা ভারতের মাহিকো কোম্পানির কাছে দেশীয় জাতের বীজ বিকৃত করে নতুন নামে, ‘বিটিব্রিঞ্জাল’ নামে প্রচলনের যৌক্তিকতা কী? বাংলাদেশে ৯টি স্থানীয় জাতের বেগুনের জাত বিটিবেগুন উদ্ভাবন কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরা বেগুন, কাজলা বেগুন, খটখটি বেগুন এবং চট্টগ্রামের দোহাজারীর একটি জাতকে বিটিবেগুন হিসেবে বিকৃত করা হয়েছে। এখন সেই বিকৃত বেগুনের বীজ ছাড় করানোর লক্ষ্যে অনুমোদনের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন, কৃষকদের শত শত বছরের উদ্ভাবিত বেগুনের জাতের ওপর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করার জন্য বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার অধিকার বারির মতো প্রতিষ্ঠানকে কে দিয়েছে?
বিটিবেগুন গবেষণার সময় যেন কোনো জৈবদূষণ (biological pollution) না ঘটে, তার জন্য গ্রিনহাউস ব্যবস্থার অধীনে গবেষণা পরিচালনা করার কথা। কিন্তু দেখা গেছে, বাঁশ ও লোহারজালির বেড়া দিয়ে ঘিরে বিটিবেগুনের চাষ করা হচ্ছে। পুরো মাঠেই রয়েছে প্রচুর ঘাস ও বিভিন্ন উদ্ভিদ। খুব কাছেই অন্যান্য শস্যের ক্ষেত। পরিবেশের কোনো প্রকার সুরক্ষা ছাড়াই এভাবেই বিটিবেগুনের গবেষণা চলছে। গবেষণা পর্যায়েই বিটিবেগুন পরিবেশের কোনো ক্ষতি করল কি-না সেটাও এখন জানা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বেগুন বিশেষভাবে বাংলাদেশের সবজি। এর জাতের বৈচিত্র্যের উৎপত্তিস্থলও (Origin of Diversit) এই তিন বৃহৎ নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা অববাহিকা। বাংলাদেশের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে এই সম্পদ রক্ষা করা। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে বেগুন বারো মাস জন্ম এবং সারাদেশে নানা জাতের বেগুন পাওয়া যায়, সেখানে বিদেশী সাহায্য সংস্থা ও বহুজাতিক কোম্পানির তাড়ায় আমাদের দেশের বেগুনের মধ্যে জেনেটিক কারিগরির কী এমন প্রয়োজন দেখা দিল যে সরকার তা অনুমোদন করার উদ্যোগ নিচ্ছে?
বেগুনের বিভিন্ন জাত আমাদের কৃষক, বিশেষত কৃষক নারীর হাজার বছরের আবিষ্কার। বাংলাদেশের জনগণের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি। বিকৃত বেগুন প্রবর্তনের ফলে অন্যসব জাত ভয়াবহ জৈবিক দূষণের (biological pollution) কবলে পড়তে পারে। দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের বিকৃত জাতের বেগুন কৃষক পর্যায়ে গোপনে অনুমোদন চাওয়া শুধু বিতর্কিত বিষয়ই নয়, রীতিমতো একটি বিপজ্জনক প্রস্তাব।
বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই জিএম ফসলের অনুমোদন দিয়ে যাবেন বলে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ২০১১ সালেই বলে রেখেছিলেন। দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের একটি সংবাদ প্রতিবেদনে সেটা জানা যায় (দেখুন, Govt. plans to approve GM crops, এপ্রিল ৩, ২০১১)। কৃষি মন্ত্রণালয় এই বিতর্কিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২০০৫-০৬ সাল থেকে গবেষণা করলেও বিটিবেগুনের কোনো সন্তোষজনক ফলাফল পায়নি। তারপরও বিকৃত বীজের ফসলের অনুমোদন তিনি কেন দেবেন, তার কোনো যুক্তি নাই।
আমরা জানি, বিটিবেগুনের গবেষণার উদ্যোগ বাংলাদেশের কৃষক কিংবা বেগুন পছন্দ করেন এমন ভোক্তাদের কাছ থেকে আসেনি। এসেছে বিটিবেগুন প্রকল্পের অংশীদার বেশির ভাগ বিদেশী সংস্থা ও ব্যবসায়ী কোম্পানির কাছ থেকে, যেমন ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস ফর দি একুইজিশান অব এগ্রোবায়োটেক এপ্লিকেশান (ISAAA), ইউনিভার্সিটি অব ফিলিপাইন্স, লসবেনোস (UPLB), সাউথ ইস্ট এশিয়ান রিজিওনাল সেন্টার ফর গ্রাজুয়েট স্টাডি অ্যান্ড রিসার্চ ইন এগ্রিকালচার (SEARCA) এবং বীজ কোম্পানি যেমন ভারতের MAHYCO, যার সঙ্গে বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্তোর অংশীদারিত্ব রয়েছে- এদের কাছ থেকে। কাজেই এই গবেষণা আসলে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের নয়। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র।
বাংলাদেশে গাজীপুরে অবস্থিত কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (BARI) এই গবেষণা করছে, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের বিশেষ কর্মসূচি ABSP II এর অধীনে। ভারতে এই বেগুন নিয়ে প্রচুর বিরোধিতা ও হৈচৈ হয়েছে এবং ফেব্রুয়ারি ২০১০ সালে ভারতের পরিবেশমন্ত্রী জয়রাম রমেশ ছাড়পত্র দিতে অস্বীকার করেছেন। শুধু তাই নয়, ভারতে বিটিবেগুন গবেষণার ওপর মোরাটরিয়াম জারি রয়েছে। কিন্তু ভারতের উদ্যোক্তা কোম্পানি মাহায়কো ভারতের নিষেধাজ্ঞায় বসে থাকতে রাজি নয়। তাদের উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, এ শিল্পে অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ব্যবসা করতে পারবে কি-না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় থাকতে চায় না। বায়োএগ্রি কোম্পানির অন্যতম প্রতিনিধি Dr Barwale Zehr বলেছেন, ভারতে নিষেধাজ্ঞার কারণে এই পণ্যটি ভারতে ছাড়তে অসুবিধা হলেও তারা ফিল্ড ট্রায়ালের মাধ্যমে অন্য দেশে ছাড়পত্র জোগাড় করতে পারবেন। তিনি জানিয়েছেন, তাদের সঙ্গে সরকারি এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে, তারা এ কাজ করে ফেলার জন্য প্রস্তুত।
`Even though the moratorium has affected the product release in India, we hope to be able to release it in other countries after conducting the mandatory field trials. We are in partnership with both private and public enterprises who are going to commercialize our technology for Bt brinjal and are very close to doing so'.
বিস্ময়কর হল, বাংলাদেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে নীরব। আর কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বিটিবেগুন ও বিটিআলুর ব্যাপারে খুবই উৎসাহী। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের ২০১১ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত এক সভায় তিনি জিএম ফসলকে স্বাগত জানিয়েছেন। তার মতে, জিএম ফসল কীট দমনে ভালো ভূমিকা রাখবে। উৎসাহ প্রকাশের এক পর্যায়ে তিনি জিএম ফসল নিয়ে যারা বিরোধিতা করছেন তাদের ওপর বিরক্ত হয়ে তথ্যপ্রমাণ হাজির করতে বলেছেন। এমনকি তিনি বিরোধিতাকারীদের কথাকে ‘ফতোয়া’ বলে প্রমাণ ছাড়া গ্রহণযোগ্য নয় বলে উড়িয়ে দিয়েছেন (ডেইলি স্টার, মার্চ ৩০, ২০১১)।
কৃষিমন্ত্রীর বিটিবেগুন ও বিটিআলুর প্রতি মহব্বতকে তার ব্যক্তিগত পছন্দ গণ্য করা কঠিন। কারণ তিনি আসলে যাদের ভালোবাসেন তারা হচ্ছে মনসান্তো, ভারতীয় কোম্পানি মাহিকো এবং ইউএসএইড। এটা অবিশ্বাস্য যে, তিনি জানেন না স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া ছাড়াও প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য বিকৃত বেগুন মারাÍক নিরাপত্তা ঝুঁকি। বেগুনের মধ্যে অণুজীবের যে জিন থাকার কথা নয় তা ঢুকিয়ে দেয়ার ফলে বিকৃত বেগুন থেকে সেই জিন বেরিয়ে গিয়ে আশপাশের বেগুনের জাতের কাছাকাছি অন্যান্য জাত ও প্রজাতির বুনো গাছপালা শাকসবজি ঝোপঝাড় লতাপাতায় প্রবিষ্ট হয়ে তাদের দূষিত করে ফেলতে পারে। এ ধরনের পরিবেশ দূষণকে বলা হয় ‘বায়োলজিক্যাল পলিউশান’ বা জীবজীবন দূষিত করে ফেলা। পরিবেশ দূষণের চেয়েও তা ভয়ংকর। এই ভীতিকর সম্ভাবনা থাকার পরও বিটিবেগুন চাষ করার জন্য মতিয়া চৌধুরী ব্যস্ত হয়ে গেছেন।
জৈবদূষণের ভীতিকর সম্ভাবনা নিয়ে এখন দীর্ঘ আলোচনা না করে মাননীয় মন্ত্রীকে সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রিনপিসের একটি প্রতিবেদন দেখতে বলব : Genetically engineered Bt brinjal and the implications for plant biodiversity – revisited. April 2012)। তাকে অনুরোধ করব, তিনি যেন গ্রিনহাউস ব্যবস্থা ছাড়া বিটিবেগুন গবেষণার বর্তমান বিপজ্জনক পদ্ধতি অবিলম্বে বন্ধ এবং কৃষকের ক্ষেতে বিকৃত বেগুন উন্মুক্ত চাষাবাদ করার দায়িত্বজ্ঞানহীন পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেন। তাকে ভেবে দেখতে বলব যে, রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ গণসমর্থন হারিয়েছে, এই সত্য অস্বীকার করার জো নাই। এখন আওয়ামী লিগের কাঁধে বাংলাদেশের জটিল প্রাণব্যবস্থাপনা ও সমৃদ্ধ প্রাণবৈচিত্র্য দূষিত ও ধ্বংস করার বাড়তি দায় মতিয়া চৌধুরী চাপিয়ে দেবেন না, এই বিচক্ষণতা আমরা এখনও আশা করি। পরিবেশবিরোধী নীতি ও প্রযুক্তি প্রবর্তন করে এতকাল কৃষিব্যবস্থা ধ্বংস করার পরও অনেকের আশা মেটেনি। এখন কৃষিব্যবস্থার ভবিষ্যৎ ও কৃষকদের ভাগ্য বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার তৎপরতা নিন্দনীয়।
আমার দরখাস্তের কথা একটাই : মাননীয় কৃষিমন্ত্রী, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার কোনো বিধান না মেনে বিটিবেগুন গবেষণা বন্ধ করুন এবং কৃষকের ক্ষেতে বিটিবেগুন চাষের পরিকল্পনা ত্যাগ করুন। দয়া করে প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থাকে রক্ষা করুন।
যখন বলি, গ্রাম আমার ভালো লাগে, তখন মনের মধ্যে কোনো আকুতি থেকে কথাগুলো উচ্চারিত হয় না। কিন্তু সম্ভবত কৈশোরেই দুটি প্রশ্ন জেগেছিল। এক. গ্রামের বিলয় মানুষের সভ্যতার জন্য অনিবার্য বা অবধারিত কি-না। যদি তাই হয়, তাহলে মানুষ বা প্রকৃতি উভয়ের জন্য এর পরিণতি কী হতে পারে? অর্থাৎ আমরা যদি নিজেদের ‘সভ্য’ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই তাহলে গ্রাম ধ্বংস করে দিয়ে নগর গড়ে তোলাই কি একমাত্র পথ? এটা কেমন কথা? এ কেমন ‘সভ্যতা’? এই সভ্যতার স্থায়িত্বের নিশ্চয়তাই বা কী? এর নিশ্চয়ই কিছু পরিণতি আছে যা সর্বাংশে ইতিবাচক হতে পারে না। দ্বিতীয় প্রশ্ন প্রথম প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত কিন্তু চরিত্রের দিক থেকে ভিন্ন। নগরায়ন বা তথাকথিত আধুনিকতাই মনুষ্য জীবনের প্রধান কিংবা একমাত্র অন্বিষ্ট কি? অর্থাৎ নগর জীবনই কি জীবনযাপনের জন্য মানুষের একমাত্র চাইবার জিনিস, মনুষ্য জীবনের পরমার্থ? বলাবাহুল্য, এ ধরনের প্রশ্নকীটের দংশন ছাড়াও মানুষ বাঁচে। সুখীও হয়। কিন্তু অনেকেই আছে, স্বভাবদোষে জীবদ্দশাতে তাদের যাতনা যায় না। আমার হয়েছে সেই দশা।
যখন অর্থশাস্ত্র পড়েছি, তখন এই প্রশ্নকে দর্শনের জায়গা থেকে বিচার না করে আর্থ-সামাজিক প্রক্রিয়া বিচারের জায়গা থেকে বুঝেছি। বিশেষত পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিস্মৃতি ও গভীরতাই শহর ও গ্রামের দ্বন্দ্ব তৈরি করে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে শিল্পবিপ্লব। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের অধীনে বিস্ফোরিত শিল্পবিপ্লবের যে মহিমা কীর্তন করা হয়, তার সুফল ও কুফল দুটোই আমরা ভোগ করি। কিন্তু এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অন্য কিছু করার দরকার কি নাই? অন্য কোনো কর্তব্য আছে কি মানুষের? থাকলে সেটা কী হতে পারে, অর্থশাস্ত্র তার উত্তর দিতে পারে না। এটা আমরা অনুমান করতে পারি, পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের অবসানের জন্য মানুষের যে সংগ্রাম সেটা একই সঙ্গে শহর ও গ্রামের ব্যবধান মোচনেরও সংগ্রাম। কিন্তু এর মানে কী? গ্রামকে শহর বানানো? সভ্যতার অন্বিষ্ট ও আদর্শ হিসেবে নগরায়ন ও শিল্পায়নের অবস্থানে এতে কি কোনো নড়চড় হয়? আমরা কি বলি যে শহর ভেঙে আবার তাকে গ্রামে রূপান্তর করা উচিত? পুঁজিবাদী হলেও যেমন আমরা শহর চাই, সমাজতন্ত্রী হলেও তো তা-ই চাই। আকাক্সক্ষায় কোনো হেরফের নাই। পুঁজিতন্ত্রে ও সমাজতন্ত্রে এদিক থেকে তো কোনো ফারাক দেখা যায় না। দুইয়ের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ভেদ থাকা সত্ত্বেও এক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য নাই। সমাজতন্ত্রও মনে করে শিল্পায়ন ও নগরায়নই সভ্যতা, ওর মধ্যেই মানুষের অগ্রগতির চাবিকাঠি। সমাজতন্ত্র গ্রাম ও শহরের ব্যবধান মোচন করতে চায় বটে কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মতোই গ্রামকেও শহরে পরিণত করতে চায়। সমাজতন্ত্র নিয়ে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে, সেসব দেশের অভিজ্ঞতা এটাই বলে। সমাজতন্ত্র আদর্শের দিক থেকে ভিন্ন কিছু চেয়েছে কি-না সেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে, তবে তার প্রমাণ পাওয়া মুশকিল।
কৃষকদের সঙ্গে কাজ করতে যাওয়ার পেছনে প্রবলভাবে এসব প্রশ্ন কাজ করেছে। হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা কৃষি সভ্যতাকে প্রগতি ও আধুনিকতার নামে চোখের সামনে আমরা ধ্বংস করে ফেলেছি। কিন্তু কৃষি সম্পর্কে কোনো পূর্বানুমান মাথায় নিয়ে আমি কৃষকদের সঙ্গে কাজ করতে নামিনি। শিল্পসভ্যতা ও নগরায়নের প্রতি প্রশ্ন জারি রেখেও আমার মনে হয়েছে, কৃষি বলতে আসলে আমরা কী বুঝি? কৃষি কাজের মধ্য দিয়ে আমরা প্রকৃতির সঙ্গে যে বিশেষ সম্পর্কে যুক্ত হই, তার চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যটাই বা আসলে কী? যদি কৃষি সভ্যতা ধ্বংস করে নগর ও শিল্পসভ্যতা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প না থাকে তাহলে কী আমরা হারাচ্ছি, কিভাবে আমরা বদলে যাচ্ছি? এই বদলে যাওয়ার পরিণতি কী দাঁড়াতে পারে, সেই দিকগুলো হাতেনাতে কাজ করে বোঝার চেষ্টা করা উচিত। কোনো কেতাবি কায়দায় জানলে হবে না।
সে কারণে হাতে কোদাল নিয়ে মাটির সঙ্গে সম্বন্ধ রচনা করার প্রয়োজনীয়তাবোধ করেছি। অর্থাৎ এই সম্পর্কের অর্থ কী সেটা ইন্দ্রিয়পরায়ণভাবেই বোঝা দরকার মনে হয়েছে। বুদ্ধিকে সামলে রেখেছি, কারণ বুদ্ধির অহমিকা বারবার প্রকৃতির সঙ্গে আমার সম্বন্ধ রচনার ক্ষেত্রে আগাম বাগড়া দিতে থাকে। এমন কিছু প্রশ্ন মাথায় রেখেছি যাতে কৃষকদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ঠিক কী অন্বেষণ করছি, তা নিজের কাছে স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন থাকে। যেমন, বারবার উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি কিভাবে পদ্মা মেঘনা ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার এই মানুষগুলো তাদের এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে কমপক্ষে ১৫ হাজার হাতের ধান ‘আবিষ্কার’ করতে সক্ষম হলেন? কী প্রতিভার গুণে সেটা সম্ভব হল? আবার বিভিন্ন জাতের চাষ পদ্ধতিও আলাদা। ধান চাষ নামক বিমূর্ত কোনো চাষাবাদ পদ্ধতি নাই। প্রতিটি জাতের পরিচর্যা ভিন্ন। অল্প পার্থক্য হলেও কৃষকের কাছ থেকে প্রতিটি জাত ভিন্ন ভিন্ন পরিচর্যার ধরন দাবি করে।
কৃষকের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে প্রাণ, প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্বন্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা আরও গভীর দিকে ধাবিত করে। যেমন, কৃষকের যে জ্ঞানের ওপর পুরো কৃষি ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে থাকে, কিভাবে এ জ্ঞানের উৎপত্তি ঘটে ও চর্চা হয়? শ্রুতিই যে সংস্কৃতিতে ‘প্রমাণ’ বলে গৃহীত, সে সংস্কৃতিতে আবিষ্কারের নিজস্ব জ্ঞানগত প্রক্রিয়া আছে। তার বৈশিষ্ট্য কেমন? কৃষকের কথোপকথনে ও কানে কানে যে লৌকিক জ্ঞানচর্চার ধারা, সেখানে জ্ঞান ধরে রাখা ও বংশানুক্রমে ধরে রাখার বিদ্যাটা কেমন? এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে যখন ১৯৯২ সালে বিখ্যাত ধরিত্রী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করি তখন প্রাণবৈচিত্র্য চুক্তির (Convention on Biological Diversity, CBD) খসড়া প্রণয়নের সময় বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বন্ধুদের সঙ্গে মিলে অনেক রাষ্ট্রপ্রধানকে লোকায়ত জ্ঞানের গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হই। সহজেই প্রমাণ করা গিয়েছিল, লৌকিক বা লোকায়ত জ্ঞান প্রতিটি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। যেভাবে হোক তার সংরক্ষণ ও জীবন্ত চর্চার জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি জরুরি। আর সেটা করতে হলে যাদের জীবনযাপনের সঙ্গে এই জ্ঞানের উৎপত্তি ও চর্চা জড়িত তাদের স্বীকৃতি দিতে হবে এবং তাদের কোনো আবিষ্কার বা সম্পদ ব্যবহার করতে হলে তাদের জ্ঞানের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বত্ব স্বীকার ও তার উপযুক্ত মূল্য দিতে হবে। এটা নিশ্চিত করার জন্য প্রাণবৈচিত্র্য চুক্তির ৮ অনুচ্ছেদের মধ্যে বিখ্যাত লৌকিক জ্ঞান এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত জীবনযাপন ও তার চর্চার সপক্ষে বিশেষ আন্তর্জাতিক বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে। যা চুক্তির 8(j) বিধান হিসেবে খ্যাত।
ভূমিকা হিসেবে এত কথা বলছি এ কারণে যে কৃষি, কৃষকের জ্ঞান ও আবিষ্কার নিয়ে সাম্প্রতিককালে দেশে-বিদেশে যে জিজ্ঞাসা, গবেষণা, আগ্রহ ও বিতর্ক, তার ছিটেফোঁটাও আমাদের দেশে নাই। আমরা ‘আধুনিক’ কৃষির নামে যা করছি সেটা কৃষি নয়, সেটা আসলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফুড প্রডাকশান। তার উৎপাদনের মডেল হচ্ছে কারখানার মতো। জমি যেন আশপাশের প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন একটি বদ্ধ ঘর। সেই জমির সঙ্গে আচরণ কারখানার মেশিনের মতোই। তার মধ্যে বীজ, সার, কীটনাশক আর ডিপটিউবওয়েলের পানি কাঁচামাল হিসেবে ঢুকিয়ে দেয়া হয় আর তা ফসল হয়ে বেরিয়ে আসে। ইনপুট আর আউটপুট। কারখানা বর্জ্য উৎপাদন করে। এই কৃষি-কারখানাও বর্জ্য ত্যাগ করে। সার, বিষ ও মাটির তলা থেকে তুলে আনা আর্সেনিক আশপাশের প্রকৃতিকে দূষিত করে ফেলে। কিন্তু তার দায় এই ‘কারখানা’ নেয় না। এই কারখানা নিজের জমি থেকে কী পরিমাণ ধান পেল তার হিসাব দেখিয়ে বলে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু বিষে বিষাক্ত হয়ে নদী, খালবিল ও পুকুর মাছশূন্য হয়ে গেছে, সেই হিসাব লুকায়। অথচ বাংলাদেশ মাছের দেশ। গ্রামে মুরগি, হাঁস, ছাগল, গরু পালা দুঃসাধ্য। কারণ সর্বত্রই বিষ ছড়িয়ে গিয়েছে। ফলে কৃষি থেকে দুধ, মাংস, ডিমের উৎপাদন ভয়ানক কমেছে। কিন্তু তাকে ‘খাদ্য’ বলা হচ্ছে না। গ্রামের মানুষ কুড়িয়ে যা পেত, তা পাওয়া আরও কঠিন হয়ে গিয়েছে। এই অন্ধ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আসলে কৃষির নামে আমরা কী করছি, তার ভালো-মন্দ বিচার করার কোনো নিরপেক্ষ মানদণ্ড আমরা তৈরি করতে পারিনি। আমরা ধরে নিয়েছি, কৃষিব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়ে কারখানামূলক পরিবেশবিধ্বংসী ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফুড প্রডাকশানই আমাদের খাদ্যের চাহিদা মেটানোর একমাত্র পথ। পরিবেশবান্ধব অন্য কোনো কৃষি পদ্ধতির দরকার নাই। আর এই পথের সুযোগে আমাদের কৃষিব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি এবং দেশীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। কৃষক নয়, কর্পোরেশনই নাকি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে! এই পথ আত্মঘাতী পথ। কিন্তু এ পথেই আমরা ধেয়ে যাচ্ছি।
অথচ বিজ্ঞানীরা নানাভাবে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, পরিবেশসম্মত সত্যিকারের কৃষিই বরং খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পারে। এর পেছনে সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে। কারণ পরিবেশবিধ্বংসী ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফুড প্রডাকশনের জায়গায় আন্তর্জাতিকভাবে সে কারণে ‘টেকসই কৃষি ব্যবস্থা’ প্রচার ও প্রবর্তনের কথা বলা হয়। কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানির নানান বাধা, প্রতিবন্ধকতা এবং বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে কৃষক ও গণমানুষের স্বার্থবিরোধী সরকারের কারণে সে চেষ্টা বেগবান হতে পারেনি।
বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থাকে ধ্বংস করে তাকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফুড প্রডাকশনে রূপান্তরের সাম্প্রতিক পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে জিএমও বা বিকৃত জাতের উদ্ভিদ প্রবর্তন। খবরে দেখছি, সম্প্রতি জুনের (২০১৩) মাঝামাঝি সময়ে বিটিবেগুনের বীজ কৃষক পর্যায়ে চাষ করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি)। এ খবর বাংলাদেশের যে কোনো সচেতন নাগরিককে বিস্মিত করবে। বেগুনের মতো অতি পরিচিত এবং প্রচুর ব্যবহৃত একটি সবজির জৈবিক গঠন বিশেষত প্রাণ সংকেত কেন জেনেটিক মডিফিকেশনের মাধ্যমে বিকৃতি ঘটানো বাংলাদেশের কৃষি গবেষণার জন্য জরুরি হয়ে পড়ল? এর কী যুক্তি? এসব নিয়ে এর আগেও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কিন্তু কোনো সদুত্তর দেয়া হয়নি। মাননীয় মন্ত্রীর কাছে আমার দরখাস্ত এই বিটিবেগুন নিয়ে।
বিটিবেগুনকে ‘বিকৃত’ বেগুন বলা হয় কেন? বিটি একটি ব্যাক্টেরিয়ার নাম ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস (Bacillus thuringiensis)। এই ব্যাকটেরিয়ার বিষাক্ত প্রোটিন উদ্ভাবনের জিন রয়েছে। ব্যাকটেরিয়া থেকে সেটা আলাদা করে জেনেটিক কারিগরির মাধ্যমে বেগুনের জিনোম বা প্রাণ-সাংকেতিক গঠনের মধ্যে সেটা প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে বেগুনের মধ্যেই একই ধরনের বিষাক্ত প্রোটিন উৎপাদিত হয়। অথচ স্বাভাবিক বেগুনে এটা হওয়ার কথা নয়। ব্যাকটেরিয়া আর উদ্ভিদ সম্পূর্ণ দুই ভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক সত্তা। এর ফলে বেগুনের মধ্যে সাধারণত আমরা যেসব পোকা সব সময় দেখি, সেই ব্রিঞ্জাল ফ্রুট অ্যান্ড শুটবরার বা লেদাপোকা বেগুনের গায়ে আক্রমণ করলে বা বেগুনের কোনো অংশ খেলে তাদের পুষ্টিনালী ছিদ্র হয়ে যায়। তারা মারা যায়। অর্থাৎ বেগুনগাছ নিজেই তখন বিষ হিসেবে কাজ করে।
বেগুনগাছকে বিষাক্ত বানিয়ে লেদাপোকা মারার প্রতিভাবান কৌশল আবিষ্কারের কারণ হল ইরি ও হাইব্রিডের বিষাক্ত বেগুন চাষ দেখে যারা বিরক্ত ও আতংকিত তাদের ফাঁকি দেয়া। তাদের বলা হবে, এই বেগুন চাষে কোনো বিষ বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয়নি। অথচ পুরো গাছটা নিজেই বিষাক্ত। সেই বিষাক্ত বেগুনগাছের ফল খাওয়ানো হবে ‘বিষমুক্ত’ বলে। ভালোই কোম্পানির বুদ্ধি। যে বিকৃত বিটিবেগুন এতই বিষাক্ত যে পোকা খাওয়ারও উপযোগী নয়, সেই বেগুন কী করে মানুষের খাওয়ার উপযুক্ত হতে পারে? বেগুন ছাড়াও তুলা ও ভুট্টার ক্ষেত্রেও বিটি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এবং কোনো ক্ষেত্রেই সেসবের প্রবর্তনে কৃষিতে কোনো সাফল্য আনেনি। বরং বিটিতুলা চাষ করে লাখ লাখ কৃষকের সর্বস্বান্ত হয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ভারতে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বিটি প্রযুক্তির মাধ্যমে বিষ ব্যবহার না করার কথা স্রেফ মিথ্যা ও প্রতারণা।
সার ও বিষ ছাড়া যেসব কৃষক চাষাবাদ করেন, তারা দীর্ঘদিন ধরেই জানেন বেগুন পোকা নিয়ন্ত্রণ করার সহজ পথ হচ্ছে- ১. স্থান ও পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং সেই পরিবেশে গড়ে ওঠা স্থানীয় বীজের ব্যবহার, ২. জৈব প্রক্রিয়ায় মাটির উর্বরতা রক্ষা করা যাতে কোনো রাসায়নিক সার দিতে না হয়। আর সর্বোপরি বৈচিত্র্যপূর্ণ ফসলের উৎপাদন করা। অর্থাৎ একাট্টা ফসল না করা। কৃষকদের দেখেছি যদি তারা পোকার আক্রমণের আশংকা করেন তবে সব এক জায়গায় না লাগিয়ে আলানে পালানে নানান জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেগুনগাছ লাগান। পোকা কৃষকের জ্ঞান ও বুদ্ধির কাছে পরাজয় মানতে বাধ্য হয়। কৃষকের উদ্ভাবিত এসব জ্ঞান ও তার চর্চাকে উৎসাহিত না করে বিদেশী কোম্পানির মুনাফার বাজার তৈরি করার জন্য এখন বিটিবেগুন প্রবর্তনের চেষ্টা চলছে। যা অবিলম্বে প্রতিরোধ করা জরুরি।
বারি বিটিবেগুন নিয়ে যে গবেষণা করেছে, সেই গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়েই এবং ফলাফল প্রকাশ না করেই এই অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। তার মানে অনুমোদন চাওয়া হচ্ছে গোপনে। অনুমোদন চাওয়ার আগেই বৈজ্ঞানিক মহলে যেমন গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করার কথা, ঠিক তেমনি কৃষক ও ভোক্তা উভয়কেই সেই গবেষণার ফলাফল জানানো দরকার। এ নিয়ে বৈজ্ঞানিক মহলে যেমন বিতর্ক হওয়া দরকার, তেমনি জিএমও বা বিকৃত বীজ চাষের ফলে পরিবেশ, প্রাণব্যবস্থা ও প্রাণের বৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক হুমকির সম্ভাবনাও সামগ্রিকভাবে বিবেচনার দরকার আছে। জানা দরকার, এই বীজ দ্বারা কৃষকের বেগুনের জাত দূষিত কিংবা ধ্বংস করার সম্ভাবনা কতটুকু।
আরও অনেক কিছু জানার দরকার আছে। যেমন, এই বীজের ‘মালিক’ কে বা কারা, কারণ এর সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির প্রশ্ন জড়িত। মনসান্টো বা ভারতের মাহিকো কোম্পানির কাছে দেশীয় জাতের বীজ বিকৃত করে নতুন নামে, ‘বিটিব্রিঞ্জাল’ নামে প্রচলনের যৌক্তিকতা কী? বাংলাদেশে ৯টি স্থানীয় জাতের বেগুনের জাত বিটিবেগুন উদ্ভাবন কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরা বেগুন, কাজলা বেগুন, খটখটি বেগুন এবং চট্টগ্রামের দোহাজারীর একটি জাতকে বিটিবেগুন হিসেবে বিকৃত করা হয়েছে। এখন সেই বিকৃত বেগুনের বীজ ছাড় করানোর লক্ষ্যে অনুমোদনের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন, কৃষকদের শত শত বছরের উদ্ভাবিত বেগুনের জাতের ওপর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করার জন্য বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার অধিকার বারির মতো প্রতিষ্ঠানকে কে দিয়েছে?
বিটিবেগুন গবেষণার সময় যেন কোনো জৈবদূষণ (biological pollution) না ঘটে, তার জন্য গ্রিনহাউস ব্যবস্থার অধীনে গবেষণা পরিচালনা করার কথা। কিন্তু দেখা গেছে, বাঁশ ও লোহারজালির বেড়া দিয়ে ঘিরে বিটিবেগুনের চাষ করা হচ্ছে। পুরো মাঠেই রয়েছে প্রচুর ঘাস ও বিভিন্ন উদ্ভিদ। খুব কাছেই অন্যান্য শস্যের ক্ষেত। পরিবেশের কোনো প্রকার সুরক্ষা ছাড়াই এভাবেই বিটিবেগুনের গবেষণা চলছে। গবেষণা পর্যায়েই বিটিবেগুন পরিবেশের কোনো ক্ষতি করল কি-না সেটাও এখন জানা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বেগুন বিশেষভাবে বাংলাদেশের সবজি। এর জাতের বৈচিত্র্যের উৎপত্তিস্থলও (Origin of Diversit) এই তিন বৃহৎ নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা অববাহিকা। বাংলাদেশের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে এই সম্পদ রক্ষা করা। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে বেগুন বারো মাস জন্ম এবং সারাদেশে নানা জাতের বেগুন পাওয়া যায়, সেখানে বিদেশী সাহায্য সংস্থা ও বহুজাতিক কোম্পানির তাড়ায় আমাদের দেশের বেগুনের মধ্যে জেনেটিক কারিগরির কী এমন প্রয়োজন দেখা দিল যে সরকার তা অনুমোদন করার উদ্যোগ নিচ্ছে?
বেগুনের বিভিন্ন জাত আমাদের কৃষক, বিশেষত কৃষক নারীর হাজার বছরের আবিষ্কার। বাংলাদেশের জনগণের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি। বিকৃত বেগুন প্রবর্তনের ফলে অন্যসব জাত ভয়াবহ জৈবিক দূষণের (biological pollution) কবলে পড়তে পারে। দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের বিকৃত জাতের বেগুন কৃষক পর্যায়ে গোপনে অনুমোদন চাওয়া শুধু বিতর্কিত বিষয়ই নয়, রীতিমতো একটি বিপজ্জনক প্রস্তাব।
বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই জিএম ফসলের অনুমোদন দিয়ে যাবেন বলে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ২০১১ সালেই বলে রেখেছিলেন। দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের একটি সংবাদ প্রতিবেদনে সেটা জানা যায় (দেখুন, Govt. plans to approve GM crops, এপ্রিল ৩, ২০১১)। কৃষি মন্ত্রণালয় এই বিতর্কিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২০০৫-০৬ সাল থেকে গবেষণা করলেও বিটিবেগুনের কোনো সন্তোষজনক ফলাফল পায়নি। তারপরও বিকৃত বীজের ফসলের অনুমোদন তিনি কেন দেবেন, তার কোনো যুক্তি নাই।
আমরা জানি, বিটিবেগুনের গবেষণার উদ্যোগ বাংলাদেশের কৃষক কিংবা বেগুন পছন্দ করেন এমন ভোক্তাদের কাছ থেকে আসেনি। এসেছে বিটিবেগুন প্রকল্পের অংশীদার বেশির ভাগ বিদেশী সংস্থা ও ব্যবসায়ী কোম্পানির কাছ থেকে, যেমন ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস ফর দি একুইজিশান অব এগ্রোবায়োটেক এপ্লিকেশান (ISAAA), ইউনিভার্সিটি অব ফিলিপাইন্স, লসবেনোস (UPLB), সাউথ ইস্ট এশিয়ান রিজিওনাল সেন্টার ফর গ্রাজুয়েট স্টাডি অ্যান্ড রিসার্চ ইন এগ্রিকালচার (SEARCA) এবং বীজ কোম্পানি যেমন ভারতের MAHYCO, যার সঙ্গে বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্তোর অংশীদারিত্ব রয়েছে- এদের কাছ থেকে। কাজেই এই গবেষণা আসলে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের নয়। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র।
বাংলাদেশে গাজীপুরে অবস্থিত কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (BARI) এই গবেষণা করছে, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের বিশেষ কর্মসূচি ABSP II এর অধীনে। ভারতে এই বেগুন নিয়ে প্রচুর বিরোধিতা ও হৈচৈ হয়েছে এবং ফেব্রুয়ারি ২০১০ সালে ভারতের পরিবেশমন্ত্রী জয়রাম রমেশ ছাড়পত্র দিতে অস্বীকার করেছেন। শুধু তাই নয়, ভারতে বিটিবেগুন গবেষণার ওপর মোরাটরিয়াম জারি রয়েছে। কিন্তু ভারতের উদ্যোক্তা কোম্পানি মাহায়কো ভারতের নিষেধাজ্ঞায় বসে থাকতে রাজি নয়। তাদের উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, এ শিল্পে অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ব্যবসা করতে পারবে কি-না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় থাকতে চায় না। বায়োএগ্রি কোম্পানির অন্যতম প্রতিনিধি Dr Barwale Zehr বলেছেন, ভারতে নিষেধাজ্ঞার কারণে এই পণ্যটি ভারতে ছাড়তে অসুবিধা হলেও তারা ফিল্ড ট্রায়ালের মাধ্যমে অন্য দেশে ছাড়পত্র জোগাড় করতে পারবেন। তিনি জানিয়েছেন, তাদের সঙ্গে সরকারি এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে, তারা এ কাজ করে ফেলার জন্য প্রস্তুত।
`Even though the moratorium has affected the product release in India, we hope to be able to release it in other countries after conducting the mandatory field trials. We are in partnership with both private and public enterprises who are going to commercialize our technology for Bt brinjal and are very close to doing so'.
বিস্ময়কর হল, বাংলাদেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে নীরব। আর কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বিটিবেগুন ও বিটিআলুর ব্যাপারে খুবই উৎসাহী। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের ২০১১ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত এক সভায় তিনি জিএম ফসলকে স্বাগত জানিয়েছেন। তার মতে, জিএম ফসল কীট দমনে ভালো ভূমিকা রাখবে। উৎসাহ প্রকাশের এক পর্যায়ে তিনি জিএম ফসল নিয়ে যারা বিরোধিতা করছেন তাদের ওপর বিরক্ত হয়ে তথ্যপ্রমাণ হাজির করতে বলেছেন। এমনকি তিনি বিরোধিতাকারীদের কথাকে ‘ফতোয়া’ বলে প্রমাণ ছাড়া গ্রহণযোগ্য নয় বলে উড়িয়ে দিয়েছেন (ডেইলি স্টার, মার্চ ৩০, ২০১১)।
কৃষিমন্ত্রীর বিটিবেগুন ও বিটিআলুর প্রতি মহব্বতকে তার ব্যক্তিগত পছন্দ গণ্য করা কঠিন। কারণ তিনি আসলে যাদের ভালোবাসেন তারা হচ্ছে মনসান্তো, ভারতীয় কোম্পানি মাহিকো এবং ইউএসএইড। এটা অবিশ্বাস্য যে, তিনি জানেন না স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া ছাড়াও প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য বিকৃত বেগুন মারাÍক নিরাপত্তা ঝুঁকি। বেগুনের মধ্যে অণুজীবের যে জিন থাকার কথা নয় তা ঢুকিয়ে দেয়ার ফলে বিকৃত বেগুন থেকে সেই জিন বেরিয়ে গিয়ে আশপাশের বেগুনের জাতের কাছাকাছি অন্যান্য জাত ও প্রজাতির বুনো গাছপালা শাকসবজি ঝোপঝাড় লতাপাতায় প্রবিষ্ট হয়ে তাদের দূষিত করে ফেলতে পারে। এ ধরনের পরিবেশ দূষণকে বলা হয় ‘বায়োলজিক্যাল পলিউশান’ বা জীবজীবন দূষিত করে ফেলা। পরিবেশ দূষণের চেয়েও তা ভয়ংকর। এই ভীতিকর সম্ভাবনা থাকার পরও বিটিবেগুন চাষ করার জন্য মতিয়া চৌধুরী ব্যস্ত হয়ে গেছেন।
জৈবদূষণের ভীতিকর সম্ভাবনা নিয়ে এখন দীর্ঘ আলোচনা না করে মাননীয় মন্ত্রীকে সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রিনপিসের একটি প্রতিবেদন দেখতে বলব : Genetically engineered Bt brinjal and the implications for plant biodiversity – revisited. April 2012)। তাকে অনুরোধ করব, তিনি যেন গ্রিনহাউস ব্যবস্থা ছাড়া বিটিবেগুন গবেষণার বর্তমান বিপজ্জনক পদ্ধতি অবিলম্বে বন্ধ এবং কৃষকের ক্ষেতে বিকৃত বেগুন উন্মুক্ত চাষাবাদ করার দায়িত্বজ্ঞানহীন পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেন। তাকে ভেবে দেখতে বলব যে, রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ গণসমর্থন হারিয়েছে, এই সত্য অস্বীকার করার জো নাই। এখন আওয়ামী লিগের কাঁধে বাংলাদেশের জটিল প্রাণব্যবস্থাপনা ও সমৃদ্ধ প্রাণবৈচিত্র্য দূষিত ও ধ্বংস করার বাড়তি দায় মতিয়া চৌধুরী চাপিয়ে দেবেন না, এই বিচক্ষণতা আমরা এখনও আশা করি। পরিবেশবিরোধী নীতি ও প্রযুক্তি প্রবর্তন করে এতকাল কৃষিব্যবস্থা ধ্বংস করার পরও অনেকের আশা মেটেনি। এখন কৃষিব্যবস্থার ভবিষ্যৎ ও কৃষকদের ভাগ্য বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার তৎপরতা নিন্দনীয়।
আমার দরখাস্তের কথা একটাই : মাননীয় কৃষিমন্ত্রী, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার কোনো বিধান না মেনে বিটিবেগুন গবেষণা বন্ধ করুন এবং কৃষকের ক্ষেতে বিটিবেগুন চাষের পরিকল্পনা ত্যাগ করুন। দয়া করে প্রাণবৈচিত্র্যনির্ভর বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থাকে রক্ষা করুন।
No comments