মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার জনমত ও রাজনীতি by ড. ইকবাল হুসাইন
শাহবাগ মোড় এখন তাহ্রির স্কয়ার। তাহ্রির স্কয়ার আন্দোলনের প্রেরণা থেকে অনেকেই স্থানটিকে 'শাহবাগ স্কয়ার' বা শাহবাগ চত্বর বলছেন।
কেউ
বলছেন প্রজন্ম চত্বর। রাতদিন সেখানে হাজারো মানুষের প্রতিবাদী গান,
শ্লোগান। দলমত, শ্রেণী-পেশা, নারী-পুরুষ, শিশু-তরুণ-প্রৌঢ় নির্বিশেষে
সবার দাবি একটাই_ কসাই কাদের মোল্লাসহ সব রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি।
দেশের বড় কোন রাজনৈতিক দল বা নেতার ডাকে তারা এখানে আসেননি। সবাই এসেছেন
প্রাণের আবেগে, তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে। ত্রিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখ বীরাঙ্গনা
মা-বোনের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা আর রাজাকার-আলবদরদের প্রতি তীব্র ঘৃণা
সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের দীপ্ত চেতনায় খুনি, ধর্ষক
যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে সবাই অবিচল। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কেউ ঘরে
ফিরে যাবে না। তরুণ সমাজের স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছেন
দেশের খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, মানবাধিকার ও
সংস্কৃতিকর্মী।
বস্তুত ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ঘোষিত রায় মুক্তচিন্তা ও শুভবুদ্ধির প্রতিটি মানুষকে আশাহত, ক্ষুব্ধ করেছে। অনেকে ব্যথিত এবং লজ্জিত বোধ করেছেন। বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায়ের পর সবার মধ্যেই প্রত্যাশা জেগেছিল, কাদের মোল্লাসহ চিহ্নিত সব রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হবে। প্রধান কেঁৗসুলি গোলাম আরিফ টিপু নিজেই বলেছেন, বাচ্চু রাজাকারের চেয়ে কাদের মোল্লার অভিযোগ বেশি গুরুতর। সুতরাং তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ই কাম্য ছিল সবার। আইনের কোথায় কী ফাঁকফোকর আছে, তদন্ত বা প্রসিকিউশনের কোন দুর্বলতা ছিল কি না তা কেউ বিবেচনায় নিচ্ছেন না। কারণ কসাই কাদের মোল্লাসহ নেতৃস্থানীয় রাজাকার-আলবদরদের অপরাধ ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। বিভিন্ন এলাকায় এখনও শত শত মানুষ তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের সাক্ষী। কাদের মোল্লার লঘুদ-ের পর সেসব মানুষের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি। রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমসহ শীর্ষ অভিযুক্তদের বিচার চলছে। সাঈদীর মামলার রায় যে কোনদিন হতে পারে। এদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- ছাড়া অন্য কোন রায় মুক্তিকামী মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মানুষের বিশেষ করে তরুণ সমাজের এত ঘৃণা এবং ক্ষোভ কেন? আজকের তরুণদের প্রায় কেউই মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। এমনকি এদের একটি বড় অংশ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনও প্রত্যক্ষ করেননি। বরং তারা রাজাকারের গাড়িতে জাতীয় পতাকা দেখেছেন, দেখেছেন তাদের উগ্র আস্ফালন। এদেশে একটা সময় পর্যন্ত 'বঙ্গবন্ধু' 'জয়বাংলা' নিষিদ্ধ ছিল। একইভাবে নিষিদ্ধ ছিল 'রাজাকার' শব্দটি। তরুণদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের আংশিক এবং বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধার পার্থক্যই সঠিকভাবে নিরূপণ করা হতো না। কিন্তু সামগ্রিক অবস্থা কীভাবে পাল্টে গেল? এক্ষেত্রে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। পরবর্তী সময়ে সেক্টরস কমান্ডার ফোরামের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন সময়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমাজ গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। জাহানারা ইমামের আন্দোলনে আওয়ামী লীগও প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে নব্বই পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এই দলটি যখন রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে তখন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা; জামায়াত, রাজাকার, আলবদর বাহিনীর নৃসংশতার প্রকাশসহ বিভিন্ন উদ্যোগ তরুণ প্রজন্মের চিন্তা, আদর্শ ও মূল্যবোধকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। আওয়ামী লীগ যখন বিরোধীদলে তখনো তারা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চর্চার মাধ্যমে রাজাকারবিরোধী জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং রাজাকারদের প্রতি ঘৃণা ও তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করার মতো সুদৃঢ় মনোবল তৈরিতে এককভাবে আওয়ামী লীগের ভূমিকা সবার শীর্ষে বললে অত্যুক্তি হবে না। গত দুই দশকে বাংলাদেশের অনেক বড় বড় অর্জনের মধ্যে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতি হিসেবে আমরা আমাদের আত্মমর্যাদার উৎস খুঁজে পেয়েছি। নাগরিক হিসেবে তরুণ প্রজন্মে মধ্যে দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তৈরি করতে পেরেছি।
অনেকে সংশয় প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে সত্যিই আন্তরিক কি না। তাদের অভিযোগ প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) কেন আওয়ামী লীগ বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করল না। কিন্তু ওই সময়ে আমরা কি এই বিচারের জন্য প্রস্তুত ছিলাম? আমাদের অবকাঠামো, মানসিক প্রস্তুতি, আর্থিক সঙ্গতি, জনমত কি সত্যিই বিচারকাজ পরিচালনার পর্যায়ে ছিল? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে যাবে, ইসলাম থাকবে না, মসজিদ থেকে উলুধ্বনি শোনা যাবে, রাতারাতি কয়েক লাখ মানুষকে হত্যা করা হবে এমন হাজারো অপপ্রচার মোকাবিলা করে দলটি ২১ বছর পর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়। বিচার বিভাগ, সেনাবাহিনী, সিভিল প্রশাসন প্রতিটি স্তরে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তারা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনতে প্রয়াসী হয়। ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে বিচারের উদ্যোগ নিলে তা কতখানি ফলপ্রসূ হতো তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই সংশয় আছে। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার অঙ্গীকার করে। জনগণের প্রাণ উজাড় করা রায় তাদের বিচারের ম্যান্ডেট দেয়। সুতরাং সুষ্ঠুভাবে এই বিচার করার ঐতিহাসিক দায় এখন আওয়ামী লীগের। জনগণের দেয়া দায়িত্ব হিসেবে এ দায় তারা অর্জন করেছে। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। জনগণ তো নয়ই।
রায়ের ব্যাপারে অনেকে 'আন্তজার্তিক মান' রক্ষার কথা বলেন। আমি আইনের মানুষ নই। আইন বিষয়ে কোন ধারণাও নেই। তবুও জানতে ইচ্ছে করে, বিচারের ক্ষেত্রে 'আন্তর্জাতিক মান' বলতে আসলে কী বুঝায়। সৌদি আরবে দোষী প্রমাণিত হলে হত্যার দায়ে শিরশ্ছেদ করা হয়, কানাডায় অপরাধ যত বড়ই হোক দোষীকে মৃত্যুদ- দেয়া যাবে না। এর কোনটি আন্তর্জাতিক মানের? আমরা যা বুঝি তা হচ্ছে প্রতিটি দেশই তার নিজস্ব আইনে চলবে। যে কোন মূল্যে দেশে প্রচলিত আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ১৯৭৩ সালের প্রণীত আইনানুযায়ী গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উত্থাপিত প্রতিটি অভিযোগের দীর্ঘ তদন্ত হয়েছে। শত শত পৃষ্ঠার প্রতিবেদন, তথ্য, প্রমাণ, আলামত যাচাই-বাছাই এবং যুক্তিতর্ক শেষে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীকে আসামিপক্ষ যারপরনাই জেরা করেছেন। আসামিপক্ষ প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সময় নিয়েছেন, কথা বলেছেন, সময় নষ্ট করেছেন, সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ ধরনের আদালতে আসামিপক্ষ যে সুবিধা পেয়েছেন অনুরূপ বিচারকার্যে এত সুবিধা পাওয়ার নজির খুব কমই আছে। তবুও অনেকে বলেন, বিচারকার্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে! বস্তুত এই বিচার প্রক্রিয়ায় যারা 'আন্তর্জাতিক মান' এবং 'স্বচ্ছতা'র কথা বলছেন তাদের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। তারা কি সত্যিই রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি চান? নাকি পরোক্ষভাবে তারা বিচার বন্ধ করার কথা বলছেন?
বিএনপি এখন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। বাচ্চু রাজাকার এবং কাদের মোল্লার রায়ের পরও তারা কোন মন্তব্য করেনি। তবে তারা শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক মান এবং স্বচ্ছতার কথা বলে প্রকারান্তে বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। জামায়াতকে সঙ্গে রেখে তারা কখনো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে অবস্থান নিতে পারবে না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়ায় জামায়াতও প্রথমে আন্তর্জাতিক মান এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু এখন তারা খোলস থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারা এখন ট্রাইব্যুনাল বন্ধের দাবিতে হরতালসহ সহিংস রাজনীতি করছে। তাদের রাজাকার খুনি ধর্ষক নেতাদের শাস্তি হলে দেশে তারা গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়েছে। শাহবাগসহ সারাদেশে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে যে গণজাগরণ তৈরি হয়েছে এটিকে কেবল ফাঁসির দাবিতে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, জামায়াত-শিবিরকে প্রতিহত করার শপথও নিতে হবে। একইসঙ্গে দেশে জামায়াত-শিবিরসহ সব ধরনের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতেও সোচ্চার থাকতে হবে।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে একমাত্র বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক কোন সহযোগিতা না নিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করার সাহস দেখিয়েছে। সরকারের এই সৎসাহসকে সাধুবাদ। জাতি হিসেবে এটি আমাদের গর্ব ও আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক। তবে বিচার প্রক্রিয়ায় বিশ্বমোড়লদের যুক্ত না করায় তাদের একটু অাঁতে ঘা লাগতে পারে। তারই বহির্প্রকাশ ঘটছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায়ের পর ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং দ-িত এই অপরাধীকে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, ইসলামী চিন্তাবিদ ইত্যাদি বিশেষণে উল্লেখ করা হয়। কাদের মোল্লাসহ রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে যে গণআন্দোলন তৈরি হয়েছে তাকেও বিকৃতভাবে ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে অবস্থান বলে উপস্থাপন করা হচ্ছে। জামায়াত অর্থ এবং প্রভাব খাটিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে এহেন প্রচার করাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ ও তৎপর থাকা উচিত।
কাদের মোল্লার রায়ের পর সরকারের সঙ্গে জামায়াতের আপস-সমঝোতার অভিযোগ উঠেছে। যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, যারা যুদ্ধাপরাধের বিচার করার পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সর্বোপরি যারা শীর্ষ রাজাকারদের জেলে পুরে আইনের কাছে সোপর্দ করেছে তাদের বিরুদ্ধে আপস-সমঝোতার অভিযোগ সত্যিই দুঃখজনক। কিন্তু আওয়ামী লীগকেই প্রমাণ করতে হবে যে তারা জামায়াতের সঙ্গে কোন আপস করেনি। প্রয়োজনে আইনের সংশোধন করে চিহ্নিত রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তরুণদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা এবং রাজাকারদের প্রতি যে ঘৃণা তৈরি হয়েছে তাতে জামায়াত-শিবির তো বটেই তাদের প্রতি সামান্যতম সহানুভূতি দেখালেও এদেশে যে কারও রাজনীতি করা কঠিন হয়ে পড়বে। বিএনপি এ সত্যটি উপলব্ধি করছে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তরুণ প্রজন্মের যে ভালোবাসা তৈরি হয়েছে তার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে যদি আওয়ামী লীগও ব্যর্থ হয় তবে মানুষ কোথায় আস্থা রাখবে?
[লেখক: সহকারী অধ্যাপক
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।]
বস্তুত ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ঘোষিত রায় মুক্তচিন্তা ও শুভবুদ্ধির প্রতিটি মানুষকে আশাহত, ক্ষুব্ধ করেছে। অনেকে ব্যথিত এবং লজ্জিত বোধ করেছেন। বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায়ের পর সবার মধ্যেই প্রত্যাশা জেগেছিল, কাদের মোল্লাসহ চিহ্নিত সব রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হবে। প্রধান কেঁৗসুলি গোলাম আরিফ টিপু নিজেই বলেছেন, বাচ্চু রাজাকারের চেয়ে কাদের মোল্লার অভিযোগ বেশি গুরুতর। সুতরাং তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ই কাম্য ছিল সবার। আইনের কোথায় কী ফাঁকফোকর আছে, তদন্ত বা প্রসিকিউশনের কোন দুর্বলতা ছিল কি না তা কেউ বিবেচনায় নিচ্ছেন না। কারণ কসাই কাদের মোল্লাসহ নেতৃস্থানীয় রাজাকার-আলবদরদের অপরাধ ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। বিভিন্ন এলাকায় এখনও শত শত মানুষ তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের সাক্ষী। কাদের মোল্লার লঘুদ-ের পর সেসব মানুষের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি। রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমসহ শীর্ষ অভিযুক্তদের বিচার চলছে। সাঈদীর মামলার রায় যে কোনদিন হতে পারে। এদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- ছাড়া অন্য কোন রায় মুক্তিকামী মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মানুষের বিশেষ করে তরুণ সমাজের এত ঘৃণা এবং ক্ষোভ কেন? আজকের তরুণদের প্রায় কেউই মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। এমনকি এদের একটি বড় অংশ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনও প্রত্যক্ষ করেননি। বরং তারা রাজাকারের গাড়িতে জাতীয় পতাকা দেখেছেন, দেখেছেন তাদের উগ্র আস্ফালন। এদেশে একটা সময় পর্যন্ত 'বঙ্গবন্ধু' 'জয়বাংলা' নিষিদ্ধ ছিল। একইভাবে নিষিদ্ধ ছিল 'রাজাকার' শব্দটি। তরুণদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের আংশিক এবং বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধার পার্থক্যই সঠিকভাবে নিরূপণ করা হতো না। কিন্তু সামগ্রিক অবস্থা কীভাবে পাল্টে গেল? এক্ষেত্রে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। পরবর্তী সময়ে সেক্টরস কমান্ডার ফোরামের ভূমিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন সময়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমাজ গঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। জাহানারা ইমামের আন্দোলনে আওয়ামী লীগও প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে নব্বই পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এই দলটি যখন রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে তখন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা; জামায়াত, রাজাকার, আলবদর বাহিনীর নৃসংশতার প্রকাশসহ বিভিন্ন উদ্যোগ তরুণ প্রজন্মের চিন্তা, আদর্শ ও মূল্যবোধকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। আওয়ামী লীগ যখন বিরোধীদলে তখনো তারা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চর্চার মাধ্যমে রাজাকারবিরোধী জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং রাজাকারদের প্রতি ঘৃণা ও তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করার মতো সুদৃঢ় মনোবল তৈরিতে এককভাবে আওয়ামী লীগের ভূমিকা সবার শীর্ষে বললে অত্যুক্তি হবে না। গত দুই দশকে বাংলাদেশের অনেক বড় বড় অর্জনের মধ্যে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতি হিসেবে আমরা আমাদের আত্মমর্যাদার উৎস খুঁজে পেয়েছি। নাগরিক হিসেবে তরুণ প্রজন্মে মধ্যে দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তৈরি করতে পেরেছি।
অনেকে সংশয় প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে সত্যিই আন্তরিক কি না। তাদের অভিযোগ প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) কেন আওয়ামী লীগ বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করল না। কিন্তু ওই সময়ে আমরা কি এই বিচারের জন্য প্রস্তুত ছিলাম? আমাদের অবকাঠামো, মানসিক প্রস্তুতি, আর্থিক সঙ্গতি, জনমত কি সত্যিই বিচারকাজ পরিচালনার পর্যায়ে ছিল? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে যাবে, ইসলাম থাকবে না, মসজিদ থেকে উলুধ্বনি শোনা যাবে, রাতারাতি কয়েক লাখ মানুষকে হত্যা করা হবে এমন হাজারো অপপ্রচার মোকাবিলা করে দলটি ২১ বছর পর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়। বিচার বিভাগ, সেনাবাহিনী, সিভিল প্রশাসন প্রতিটি স্তরে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তারা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনতে প্রয়াসী হয়। ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে বিচারের উদ্যোগ নিলে তা কতখানি ফলপ্রসূ হতো তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই সংশয় আছে। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার অঙ্গীকার করে। জনগণের প্রাণ উজাড় করা রায় তাদের বিচারের ম্যান্ডেট দেয়। সুতরাং সুষ্ঠুভাবে এই বিচার করার ঐতিহাসিক দায় এখন আওয়ামী লীগের। জনগণের দেয়া দায়িত্ব হিসেবে এ দায় তারা অর্জন করেছে। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। জনগণ তো নয়ই।
রায়ের ব্যাপারে অনেকে 'আন্তজার্তিক মান' রক্ষার কথা বলেন। আমি আইনের মানুষ নই। আইন বিষয়ে কোন ধারণাও নেই। তবুও জানতে ইচ্ছে করে, বিচারের ক্ষেত্রে 'আন্তর্জাতিক মান' বলতে আসলে কী বুঝায়। সৌদি আরবে দোষী প্রমাণিত হলে হত্যার দায়ে শিরশ্ছেদ করা হয়, কানাডায় অপরাধ যত বড়ই হোক দোষীকে মৃত্যুদ- দেয়া যাবে না। এর কোনটি আন্তর্জাতিক মানের? আমরা যা বুঝি তা হচ্ছে প্রতিটি দেশই তার নিজস্ব আইনে চলবে। যে কোন মূল্যে দেশে প্রচলিত আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ১৯৭৩ সালের প্রণীত আইনানুযায়ী গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উত্থাপিত প্রতিটি অভিযোগের দীর্ঘ তদন্ত হয়েছে। শত শত পৃষ্ঠার প্রতিবেদন, তথ্য, প্রমাণ, আলামত যাচাই-বাছাই এবং যুক্তিতর্ক শেষে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীকে আসামিপক্ষ যারপরনাই জেরা করেছেন। আসামিপক্ষ প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সময় নিয়েছেন, কথা বলেছেন, সময় নষ্ট করেছেন, সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ ধরনের আদালতে আসামিপক্ষ যে সুবিধা পেয়েছেন অনুরূপ বিচারকার্যে এত সুবিধা পাওয়ার নজির খুব কমই আছে। তবুও অনেকে বলেন, বিচারকার্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে! বস্তুত এই বিচার প্রক্রিয়ায় যারা 'আন্তর্জাতিক মান' এবং 'স্বচ্ছতা'র কথা বলছেন তাদের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। তারা কি সত্যিই রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি চান? নাকি পরোক্ষভাবে তারা বিচার বন্ধ করার কথা বলছেন?
বিএনপি এখন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। বাচ্চু রাজাকার এবং কাদের মোল্লার রায়ের পরও তারা কোন মন্তব্য করেনি। তবে তারা শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক মান এবং স্বচ্ছতার কথা বলে প্রকারান্তে বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। জামায়াতকে সঙ্গে রেখে তারা কখনো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে অবস্থান নিতে পারবে না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়ায় জামায়াতও প্রথমে আন্তর্জাতিক মান এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু এখন তারা খোলস থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারা এখন ট্রাইব্যুনাল বন্ধের দাবিতে হরতালসহ সহিংস রাজনীতি করছে। তাদের রাজাকার খুনি ধর্ষক নেতাদের শাস্তি হলে দেশে তারা গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়েছে। শাহবাগসহ সারাদেশে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে যে গণজাগরণ তৈরি হয়েছে এটিকে কেবল ফাঁসির দাবিতে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, জামায়াত-শিবিরকে প্রতিহত করার শপথও নিতে হবে। একইসঙ্গে দেশে জামায়াত-শিবিরসহ সব ধরনের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতেও সোচ্চার থাকতে হবে।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে একমাত্র বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক কোন সহযোগিতা না নিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করার সাহস দেখিয়েছে। সরকারের এই সৎসাহসকে সাধুবাদ। জাতি হিসেবে এটি আমাদের গর্ব ও আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক। তবে বিচার প্রক্রিয়ায় বিশ্বমোড়লদের যুক্ত না করায় তাদের একটু অাঁতে ঘা লাগতে পারে। তারই বহির্প্রকাশ ঘটছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায়ের পর ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং দ-িত এই অপরাধীকে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, ইসলামী চিন্তাবিদ ইত্যাদি বিশেষণে উল্লেখ করা হয়। কাদের মোল্লাসহ রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে যে গণআন্দোলন তৈরি হয়েছে তাকেও বিকৃতভাবে ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে অবস্থান বলে উপস্থাপন করা হচ্ছে। জামায়াত অর্থ এবং প্রভাব খাটিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে এহেন প্রচার করাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগ ও তৎপর থাকা উচিত।
কাদের মোল্লার রায়ের পর সরকারের সঙ্গে জামায়াতের আপস-সমঝোতার অভিযোগ উঠেছে। যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, যারা যুদ্ধাপরাধের বিচার করার পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সর্বোপরি যারা শীর্ষ রাজাকারদের জেলে পুরে আইনের কাছে সোপর্দ করেছে তাদের বিরুদ্ধে আপস-সমঝোতার অভিযোগ সত্যিই দুঃখজনক। কিন্তু আওয়ামী লীগকেই প্রমাণ করতে হবে যে তারা জামায়াতের সঙ্গে কোন আপস করেনি। প্রয়োজনে আইনের সংশোধন করে চিহ্নিত রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তরুণদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা এবং রাজাকারদের প্রতি যে ঘৃণা তৈরি হয়েছে তাতে জামায়াত-শিবির তো বটেই তাদের প্রতি সামান্যতম সহানুভূতি দেখালেও এদেশে যে কারও রাজনীতি করা কঠিন হয়ে পড়বে। বিএনপি এ সত্যটি উপলব্ধি করছে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তরুণ প্রজন্মের যে ভালোবাসা তৈরি হয়েছে তার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে যদি আওয়ামী লীগও ব্যর্থ হয় তবে মানুষ কোথায় আস্থা রাখবে?
[লেখক: সহকারী অধ্যাপক
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।]
No comments