শাহবাগের গণজাগরণ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে শিক্ষা নিতে হবে by মোহাম্মদ শাহজাহান
যে রায় লাখ লাখ শহীদ, ৬ লাখ বীরাঙ্গনা, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিব এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী কোটি কোটি মানুষকে অপমান করে,
সেই রায় কি কোন সুস্থ বিবেকবান মানুষ মেনে নিতে পারে?
২১
জানুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ১৪ দিনের ব্যবধান। মাত্র দু'সপ্তাহ আগে পলাতক
যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে মানবতাবিরোধী অপরাধের
দায়ে মৃত্যুদ-ে দ-িত করেন আদালত। ওই রায়ে সারাদেশে বয়ে যায় উল্লাসের বন্যা।
জামায়াত-শিবির এবং বেগম জিয়ার বিএনপি ছাড়া দেশের সব শ্রেণীর মানুষ সন্তোষ
প্রকাশ করেন ওই রায়ে। তবে ৬টি অভিযোগের মধ্যে ৫টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে
প্রমাণিত হওয়ার পরও ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন
দ-ে দ-িত করেন আদালত। 'মিরপুরের কসাই' হিসেবে পরিচিত কাদের মোল্লাকে গুরু
পাপে লঘু দ- দেয়া হয়েছে বলেই মনে করছে সাধারণ মানুষ। আর সবচেয়ে আশ্চর্য
বিষয় হচ্ছে, বাদী-বিবাদী দু'পক্ষই রায়ের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট।
দু'পক্ষ থেকেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
একটা কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, একাত্তরে গোলাম আযম-কাদের মোল্লারা কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ করেননি, তারা অপরাধ করেছেন সমগ্র জাতির বিরুদ্ধে। সে সময় জামায়াত-শিবির-মুসলিম লীগের মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া স্বাধীনতার দাবিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়। বাঙালি জাতি শুধু নয়, কোন জাতির জীবনেই এমন কঠিন ঐক্য আর কখনো দেখা যায়নি।
সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তান সামরিক জান্তা ২৫ মার্চের কালো রাতে বাংলার নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষের ওপর সশস্ত্র যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। শুরু হয় গণহত্যা। কারও কারও মতে, ওই রাতে শুধু ঢাকা শহরেই হাজার হাজার নিরাপরাধ বাঙালি সন্তানকে হত্যা করা হয়। সমগ্র পূর্ব বাংলার থানায় থানায় মোতায়েন করা হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। আর তখন থেকেই গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, সাকা চৌধুরী, কাদের মোল্লারা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহায়ক বাহিনী হিসেবে বাঙালি নিধনে অংশগ্রহণ করেন। গণহত্যা শুরুর কয়েক দিনের মাথায় জামায়াত নেতা গোলাম আযম 'বেলুচিস্তানের কসাই' হিসেবে পরিচিত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জে. টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন। একাত্তরে জামায়াতিরা হত্যা, খুন, ধর্ষণসহ যেসব কুকর্ম ও অপকর্ম করেছে তা আজকে তাদের কর্মকা- থেকেই প্রতীয়মান হয়।
ওই সময় দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী থানায় থানায় অবস্থান নিলেও গ্রামে গ্রামে কোন বাড়ির কারা, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী, কারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ, কোন বাড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধা রণাঙ্গনে গেছেন_ তা তারা জানত না। নিজামী, কাদের মোল্লা, মুজাহিদদের দোসররাই শান্তি কমিটি, আলবদর, আল-শামস ও রাজাকারের নামে পাকিস্তানি দস্যুদের বাড়ি বাড়ি নিয়ে গেছে। জামায়াত-শিবিরের মানুষরূপী জানোয়ারদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্যেই পাকিস্তানি হানাদাররা হাজার হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। ৫ থেকে ৬ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি করেছে এবং লাখো মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে।
সম্প্রতি প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট মুনতাসীর মামুনের 'বীরাঙ্গনা ৭১' শীর্ষক একটি লেখা দৈনিক জনকণ্ঠে ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে। এতে প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি থেকে জানা যায়_ কিশোরী, যুবতী ও নারীদের পাকিস্তান হানাদাররা পালাক্রমে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত থাকেনি, ওই জানোয়ারের বাচ্চারা ধর্ষিতা মেয়েদের স্তন জোরপূর্বক উপরে ফেলা, যৌনাঙ্গে লোহার রড ঢুকিয়ে দেয়াসহ আরও কত ভয়াবহ নির্যাতন করেছে তা পড়লে এখনও গা শিউরে ওঠে। কাদের মোল্লা, সাঈদী এবং তাদের দোসররাই মুক্তিযোদ্ধা ও নারীদের বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে খান সেনাদের হাতে তুলে দিয়েছে।
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ২-৩ দিন পূর্বে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে পাকিস্তানিদের সাহায্যে হত্যা করে। বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে যাদের লাশ পাওয়া যায়, সেখানে দেখা গেছে চোখের ডাক্তারের চোখ উপরে ফেলা হয়েছে, দাঁতের ডাক্তারের দাঁত তুলে ফেলা হয়েছে এবং হৃদরোগের ডাক্তারের কলিজা ছিঁড়ে ফেলেছে। একাত্তরে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী এবং জামায়াত-শিবিরের বাঙালি নিধনের নির্মমতা ও ভয়াবহতা সর্বকালের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বলেই অনেকের বিশ্বাস। জামায়াত-শিবিরের পা-া-গু-ারা সহযোগিতা না করলে পাকিস্তানি জানোয়াররা ৮-৯ মাসে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা এবং ৬ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি করতে পারত না। কারও কারও মতে, একাত্তরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে জামায়াত-শিবির চক্র। আর এ জন্যই ঘাতক কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ-ের শাস্তি মেনে নিতে পারছে না বাংলার মানুষ।
কাদের মোল্লার বিচারের রায় শোনার পর কয়েকজন তরুণের আহ্বানে ৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার রাত থেকেই শাহবাগে সর্বস্তরের মানুষ বিশেষ করে তরুণ সমাজ জমায়েত হয়ে রায় প্রত্যাখ্যান করে ফাঁসির দাবি জানায়। ৮ ফেব্রুয়ারি স্মরণকালের সর্ববৃহৎ শাহবাগের গণজমায়েতে ঘোষণা করা হয়_ "আমরা শপথ করছি_ একাত্তরে যেসব ঘৃণ্য রাজাকার-আলবদর গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- না হওয়া পর্যন্ত এ গণজাগরণের মঞ্চ গণমানুষের নেতৃত্বে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবে।" আমাদের মনে হচ্ছে, একাত্তর আবার ফিরে এসেছে। শাহবাগে গণজাগরণের মঞ্চের পাশেই ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাত্তরের ৭ মার্চ প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। আবার এ ময়দানেই পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ৯ মাস যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করেছিল।
শাহবাগের মঞ্চে আবার সেই একাত্তরের শ্লোগান উচ্চারিত হচ্ছে। শ্লোগানগুলো হচ্ছে_ 'তোমার আমার ঠিকানা_ পদ্মা মেঘনা যমুনা', 'একাত্তরের হাতিয়ার_ গর্জে উঠুক আরেকবার', 'পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা_ পাকিস্তানেই ফিরে যা', 'লাখো শহীদ ডাক পাঠালো সারা বাংলায় খবর দে_ সারা বাংলা ঘেরাও করে জামায়াত-শিবির কবর দে', 'জামায়াত-শিবির রাজাকার_ এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়', 'আর কোনো দাবি নাই_ রাজাকারের ফাঁসি চাই' এবং 'জয় বাংলা'। এসব শ্লোগানে নতুন এক কাব্যের জন্ম দিয়েছে শাহবাগ।
শাহবাগের গণজাগরণের শেষ পরিণতি কি হবে জানি না। এ জাগরণ আমাদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছে_ 'একাত্তরের ঘাতকদের তাদের ক্ষমাহীন অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ে দ-িত এবং সেই রায় কার্যকরও করতে হবে। কাদের মোল্লার ফাঁসির পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদ- হওয়ায় জনমনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। আর এ রায় এবং শাহবাগের গণজাগরণ থেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতকে শিক্ষা নিতে হবে। কেউ কেউ সন্দেহ করছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ও জামায়াত-শিবিরের মধ্যে গোপন অাঁতাত হয়েছে। বলা হচ্ছে, বিএনপি-জামায়াতসহ ১৮দলীয় জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করছে। বিএনপি বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে দলটি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিবে না। আর প্রধান বিরোধীদল বিএনপি সংসদ নির্বাচনে না এলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রশ্ন উঠবে। অনেকের ধারণা, বিএনপি থেকে জামায়াত বেরিয়ে এলে সুষ্ঠু নির্বাচনেও এককভাবে বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। অন্যদিকে জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ অন্য দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি একা হয়ে যাবে। তাছাড়া কাদের মোল্লার রায়ের আগে সন্ত্রাসী জামায়াত-শিবিরকে মিছিল-সমাবেশ করার অনুমতি দিয়ে সন্দেহের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। যে সন্ত্রাসী শিবির বাহিনী গত কয়েক মাস ধরে পুলিশের ওপর একের পর এক হামলা চালিয়ে আসছে সেই শিবির কর্মীরা রাজপথে পুলিশকে রজনীগন্ধা নিয়ে স্বাগত জানায় এবং ওরা শ্লোগান দেয়_ 'পুলিশ-শিবির ভাই ভাই'। আর এসব ঘটনাবলি থেকেই সরকারের সঙ্গে জামায়াতের গোপন অাঁতাতের গুজবটি কোন কোন মহল থেকে উঠে আসছে।
শাহবাগের গণজাগরণের পর প্রধান বিরোধীদল বিএনপি সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে। বাচ্চু রাজাকার ও কাদের মোল্লার রায়ের পর বিএনপি এ পর্যন্ত কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি। এতদিন জামায়াতের ডাকা সন্ত্রাসী হরতালকেও বিএনপি সমর্থন করে আসছিল। কিন্তু কাদের মোল্লার রায়ের পর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, ঘাতকদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল বাতিল সংক্রান্ত দাবির প্রতি তাদের সমর্থন নেই। তাছাড়া জামায়াতের সর্বশেষ ডাকা ৬ ফেব্রুয়ারির হরতালের প্রতিও সমর্থন জানায়নি বিএনপি। এতে বিএনপির প্রতি চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয় জামায়াত। জামায়াত-শিবিরের মান ভাঙানোর লক্ষ্যে ৯ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টনে জামায়াতসহ ১৮ দলের সমাবেশ ডাকা হয়। কিন্তু ৮ তারিখে শাহবাগের বিশাল জনসমুদ্র দেখে ভয় পেয়ে গেছে বিএনপি। পুলিশ অনুমতি দেয়নি_ এ অজুহাতে বিএনপি ৯ তারিখের সমাবেশ স্থগিত করে। বর্তমান সময়ে বিএনপির জন্য জামায়াত-শিবির হচ্ছে গলার কাঁটা। না পারছে ফেলতে_ না পারছে গিলতে। জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের আন্দোলন সমর্থন করলে জনগণের বিপক্ষে যেতে হবে আর সমর্থন না করলে জামায়াত জোট ছেড়ে চলে যাবে।
মনে হচ্ছে, শাহবাগের গণজাগরণে জামায়াত-শিবিরও ভয় পেয়ে গেছে। ৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে ওদের ডাকা হরতাল চট্টলাবাসী ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। ওরাও সাময়িকভাবে হলেও গর্তে ঢুকে গেছে। জামায়াত-শিবিরকে এদেশের রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে ধ্বংসাত্মক অপতৎপরতা বাদ দিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পথে এগুতে হবে। নতুবা জামায়াত-শিবিরের অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন হবে। জামায়াত-শিবির এই সময়ে ছোঁয়াচে ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। যারা ওদের পক্ষ নেবে_ তারাই ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে। আর বিএনপিকে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে টিকে থাকতে হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে থাকা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই।
কাদের মোল্লার লঘু কারাদ-, শাহবাগের গণজাগরণ এবং সারাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে সৃষ্ট জনমত_ জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি চিরতরে নির্মূল করার এক অপার সুযোগ এনে দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট সরকারকে। আওয়ামী লীগ যেন এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। যে কোন মূল্যে শাহবাগের গণজাগরণকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে হবে। শাহবাগের তরুণ প্রজন্মকে অভিবাদন। জয় বাংলা।
[লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]
একটা কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, একাত্তরে গোলাম আযম-কাদের মোল্লারা কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ করেননি, তারা অপরাধ করেছেন সমগ্র জাতির বিরুদ্ধে। সে সময় জামায়াত-শিবির-মুসলিম লীগের মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া স্বাধীনতার দাবিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়। বাঙালি জাতি শুধু নয়, কোন জাতির জীবনেই এমন কঠিন ঐক্য আর কখনো দেখা যায়নি।
সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তান সামরিক জান্তা ২৫ মার্চের কালো রাতে বাংলার নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষের ওপর সশস্ত্র যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। শুরু হয় গণহত্যা। কারও কারও মতে, ওই রাতে শুধু ঢাকা শহরেই হাজার হাজার নিরাপরাধ বাঙালি সন্তানকে হত্যা করা হয়। সমগ্র পূর্ব বাংলার থানায় থানায় মোতায়েন করা হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। আর তখন থেকেই গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, সাকা চৌধুরী, কাদের মোল্লারা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহায়ক বাহিনী হিসেবে বাঙালি নিধনে অংশগ্রহণ করেন। গণহত্যা শুরুর কয়েক দিনের মাথায় জামায়াত নেতা গোলাম আযম 'বেলুচিস্তানের কসাই' হিসেবে পরিচিত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জে. টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন। একাত্তরে জামায়াতিরা হত্যা, খুন, ধর্ষণসহ যেসব কুকর্ম ও অপকর্ম করেছে তা আজকে তাদের কর্মকা- থেকেই প্রতীয়মান হয়।
ওই সময় দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী থানায় থানায় অবস্থান নিলেও গ্রামে গ্রামে কোন বাড়ির কারা, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী, কারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ, কোন বাড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধা রণাঙ্গনে গেছেন_ তা তারা জানত না। নিজামী, কাদের মোল্লা, মুজাহিদদের দোসররাই শান্তি কমিটি, আলবদর, আল-শামস ও রাজাকারের নামে পাকিস্তানি দস্যুদের বাড়ি বাড়ি নিয়ে গেছে। জামায়াত-শিবিরের মানুষরূপী জানোয়ারদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্যেই পাকিস্তানি হানাদাররা হাজার হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। ৫ থেকে ৬ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি করেছে এবং লাখো মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে।
সম্প্রতি প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট মুনতাসীর মামুনের 'বীরাঙ্গনা ৭১' শীর্ষক একটি লেখা দৈনিক জনকণ্ঠে ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে। এতে প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি থেকে জানা যায়_ কিশোরী, যুবতী ও নারীদের পাকিস্তান হানাদাররা পালাক্রমে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত থাকেনি, ওই জানোয়ারের বাচ্চারা ধর্ষিতা মেয়েদের স্তন জোরপূর্বক উপরে ফেলা, যৌনাঙ্গে লোহার রড ঢুকিয়ে দেয়াসহ আরও কত ভয়াবহ নির্যাতন করেছে তা পড়লে এখনও গা শিউরে ওঠে। কাদের মোল্লা, সাঈদী এবং তাদের দোসররাই মুক্তিযোদ্ধা ও নারীদের বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে খান সেনাদের হাতে তুলে দিয়েছে।
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ২-৩ দিন পূর্বে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে পাকিস্তানিদের সাহায্যে হত্যা করে। বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে যাদের লাশ পাওয়া যায়, সেখানে দেখা গেছে চোখের ডাক্তারের চোখ উপরে ফেলা হয়েছে, দাঁতের ডাক্তারের দাঁত তুলে ফেলা হয়েছে এবং হৃদরোগের ডাক্তারের কলিজা ছিঁড়ে ফেলেছে। একাত্তরে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী এবং জামায়াত-শিবিরের বাঙালি নিধনের নির্মমতা ও ভয়াবহতা সর্বকালের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বলেই অনেকের বিশ্বাস। জামায়াত-শিবিরের পা-া-গু-ারা সহযোগিতা না করলে পাকিস্তানি জানোয়াররা ৮-৯ মাসে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা এবং ৬ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি করতে পারত না। কারও কারও মতে, একাত্তরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে জামায়াত-শিবির চক্র। আর এ জন্যই ঘাতক কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ-ের শাস্তি মেনে নিতে পারছে না বাংলার মানুষ।
কাদের মোল্লার বিচারের রায় শোনার পর কয়েকজন তরুণের আহ্বানে ৫ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার রাত থেকেই শাহবাগে সর্বস্তরের মানুষ বিশেষ করে তরুণ সমাজ জমায়েত হয়ে রায় প্রত্যাখ্যান করে ফাঁসির দাবি জানায়। ৮ ফেব্রুয়ারি স্মরণকালের সর্ববৃহৎ শাহবাগের গণজমায়েতে ঘোষণা করা হয়_ "আমরা শপথ করছি_ একাত্তরে যেসব ঘৃণ্য রাজাকার-আলবদর গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- না হওয়া পর্যন্ত এ গণজাগরণের মঞ্চ গণমানুষের নেতৃত্বে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবে।" আমাদের মনে হচ্ছে, একাত্তর আবার ফিরে এসেছে। শাহবাগে গণজাগরণের মঞ্চের পাশেই ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাত্তরের ৭ মার্চ প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। আবার এ ময়দানেই পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ৯ মাস যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করেছিল।
শাহবাগের মঞ্চে আবার সেই একাত্তরের শ্লোগান উচ্চারিত হচ্ছে। শ্লোগানগুলো হচ্ছে_ 'তোমার আমার ঠিকানা_ পদ্মা মেঘনা যমুনা', 'একাত্তরের হাতিয়ার_ গর্জে উঠুক আরেকবার', 'পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা_ পাকিস্তানেই ফিরে যা', 'লাখো শহীদ ডাক পাঠালো সারা বাংলায় খবর দে_ সারা বাংলা ঘেরাও করে জামায়াত-শিবির কবর দে', 'জামায়াত-শিবির রাজাকার_ এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়', 'আর কোনো দাবি নাই_ রাজাকারের ফাঁসি চাই' এবং 'জয় বাংলা'। এসব শ্লোগানে নতুন এক কাব্যের জন্ম দিয়েছে শাহবাগ।
শাহবাগের গণজাগরণের শেষ পরিণতি কি হবে জানি না। এ জাগরণ আমাদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছে_ 'একাত্তরের ঘাতকদের তাদের ক্ষমাহীন অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ে দ-িত এবং সেই রায় কার্যকরও করতে হবে। কাদের মোল্লার ফাঁসির পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদ- হওয়ায় জনমনে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। আর এ রায় এবং শাহবাগের গণজাগরণ থেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতকে শিক্ষা নিতে হবে। কেউ কেউ সন্দেহ করছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ও জামায়াত-শিবিরের মধ্যে গোপন অাঁতাত হয়েছে। বলা হচ্ছে, বিএনপি-জামায়াতসহ ১৮দলীয় জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করছে। বিএনপি বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে দলটি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিবে না। আর প্রধান বিরোধীদল বিএনপি সংসদ নির্বাচনে না এলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রশ্ন উঠবে। অনেকের ধারণা, বিএনপি থেকে জামায়াত বেরিয়ে এলে সুষ্ঠু নির্বাচনেও এককভাবে বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। অন্যদিকে জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ অন্য দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি একা হয়ে যাবে। তাছাড়া কাদের মোল্লার রায়ের আগে সন্ত্রাসী জামায়াত-শিবিরকে মিছিল-সমাবেশ করার অনুমতি দিয়ে সন্দেহের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। যে সন্ত্রাসী শিবির বাহিনী গত কয়েক মাস ধরে পুলিশের ওপর একের পর এক হামলা চালিয়ে আসছে সেই শিবির কর্মীরা রাজপথে পুলিশকে রজনীগন্ধা নিয়ে স্বাগত জানায় এবং ওরা শ্লোগান দেয়_ 'পুলিশ-শিবির ভাই ভাই'। আর এসব ঘটনাবলি থেকেই সরকারের সঙ্গে জামায়াতের গোপন অাঁতাতের গুজবটি কোন কোন মহল থেকে উঠে আসছে।
শাহবাগের গণজাগরণের পর প্রধান বিরোধীদল বিএনপি সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে। বাচ্চু রাজাকার ও কাদের মোল্লার রায়ের পর বিএনপি এ পর্যন্ত কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি। এতদিন জামায়াতের ডাকা সন্ত্রাসী হরতালকেও বিএনপি সমর্থন করে আসছিল। কিন্তু কাদের মোল্লার রায়ের পর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, ঘাতকদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল বাতিল সংক্রান্ত দাবির প্রতি তাদের সমর্থন নেই। তাছাড়া জামায়াতের সর্বশেষ ডাকা ৬ ফেব্রুয়ারির হরতালের প্রতিও সমর্থন জানায়নি বিএনপি। এতে বিএনপির প্রতি চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয় জামায়াত। জামায়াত-শিবিরের মান ভাঙানোর লক্ষ্যে ৯ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টনে জামায়াতসহ ১৮ দলের সমাবেশ ডাকা হয়। কিন্তু ৮ তারিখে শাহবাগের বিশাল জনসমুদ্র দেখে ভয় পেয়ে গেছে বিএনপি। পুলিশ অনুমতি দেয়নি_ এ অজুহাতে বিএনপি ৯ তারিখের সমাবেশ স্থগিত করে। বর্তমান সময়ে বিএনপির জন্য জামায়াত-শিবির হচ্ছে গলার কাঁটা। না পারছে ফেলতে_ না পারছে গিলতে। জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের আন্দোলন সমর্থন করলে জনগণের বিপক্ষে যেতে হবে আর সমর্থন না করলে জামায়াত জোট ছেড়ে চলে যাবে।
মনে হচ্ছে, শাহবাগের গণজাগরণে জামায়াত-শিবিরও ভয় পেয়ে গেছে। ৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে ওদের ডাকা হরতাল চট্টলাবাসী ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। ওরাও সাময়িকভাবে হলেও গর্তে ঢুকে গেছে। জামায়াত-শিবিরকে এদেশের রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে ধ্বংসাত্মক অপতৎপরতা বাদ দিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পথে এগুতে হবে। নতুবা জামায়াত-শিবিরের অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন হবে। জামায়াত-শিবির এই সময়ে ছোঁয়াচে ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। যারা ওদের পক্ষ নেবে_ তারাই ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে। আর বিএনপিকে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে টিকে থাকতে হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে থাকা ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই।
কাদের মোল্লার লঘু কারাদ-, শাহবাগের গণজাগরণ এবং সারাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে সৃষ্ট জনমত_ জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি চিরতরে নির্মূল করার এক অপার সুযোগ এনে দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট সরকারকে। আওয়ামী লীগ যেন এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। যে কোন মূল্যে শাহবাগের গণজাগরণকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে হবে। শাহবাগের তরুণ প্রজন্মকে অভিবাদন। জয় বাংলা।
[লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা]
No comments