জনে জনে জনতাঃ শাহবাগে বাংলাদেশের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ by মোস্তাফা জব্বার
শাহবাগে শুরু হয়েছে বাংলাদেশের দ্বিতীয়
মুক্তিযুদ্ধ। বায়ান্ন, ঊনসত্তর, সত্তর ও একাত্তরের পর দীর্ঘ বিরতিতে ২০১৩
সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিস্থাপন করেছে আমাদের
সন্তানরা তাদের নিজেদের দিয়ে।
ওরা প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের
মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরেই চলবে। সম্ভবত এ বিস্ময়টি অনেকেই
সেদিন বিকেলেও আন্দাজই করতে পারেননি। পোড় খাওয়া, ঘা খাওয়া, হারতে হারতে
হেরে যাওয়ার মতো দশাগ্রস্ত খাদের কিনারায় পা রাখা আমাদের জন্য এ
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বেঁচে থাকার নতুন আশার আলো। তবে অনেকের জন্যই এটি একটি
বিরাট ধাক্কা।
একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির মন্তব্য দিয়েই বোঝা যায় আমরা আমাদের সন্তানদের যে মোটেই চিনি না। এক ছাদের তলায় বাস করি, কোলে করে মানুষ করি কিন্তু তাদের মেধা ও মননে কী আছে সেটি অনুভবই করতে পারি না। এমনকি একটি ডিজিটাল যুগে বাস করেও আমরা ধারণাই করতে পারি না যে, সমাজ বদলানোর সময়টা কেউ থামিয়ে দিতে পারে না। যে সন্তানটিকে তার ঘরে বসে ফেসবুকে বান্ধবীর সঙ্গে ছবি বিনিময় করতে দেখি বা রাত জেগে মোবাইলের বিল তুলতে দেখি তাকে নিয়ে আমরা হতাশ হই।
একজন জনপ্রিয় লেখক, প্রযুক্তিবিদ ও শিক্ষক গত ৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শাহবাগের মহাসমাবেশের মঞ্চে উপস্থিত থেকে লাখো লাখো তরুণকে উদ্দেশ করে বললেন, আমি আজ এখানে কোন বক্তব্য দিতে আসিনি, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আমি লিখেছিলাম, নতুন প্রজন্ম কেবল ফেসবুকে লাইক দেয় আর বস্নগে আড্ডা দেয়। তোমরা আমাকে ভুল প্রমাণ করেছ। আজ এখানে তোমরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছ। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জাফর ইকবাল যদি একথা বলেন তবে রাজনীতিক ওবায়দুল কাদের তো বলতেই পারেন যে, নতুন প্রজন্ম প্রচলিত রাজনীতির ওপর অনাস্থা পেশ করেছে। দুই মেয়ে দুর্বা ও সুধাকে সঙ্গে নিয়ে শাহবাগ চত্বরে আসা বনানীর শাহীনা মমতাজও খুব সঙ্গত কারণেই বলেছেন, ফেসবুক ব্যবহার করার জন্য সন্তানদের অনেক বকেছি। কিন্তু এখন ভুল ভেঙে গেছে। তারা দেশকে অনেক ভালোবাসে। অনেক খবর রাখে। এ আন্দোলন তারই প্রমাণ।
৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে সাধারণ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এমনটাই। বস্তুত আমাদের দেশের আমার প্রজন্ম যারা ৫০ পার করে ৬০ বা সত্তরে পড়েছেন তাদের সিংহভাগই মনে করেন যে, আমাদের সন্তানরা সময় বা দেশ সচেতন নয়। তারা রাজনীতিতে নামে না, মিছিল করে না, শ্লোগান দেয় না বা জাতীয় ইস্যুতে তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে না। কোন কোন ছাত্র সংগঠনের কিছুু দুর্বৃত্তকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাতেই প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় যে, আমাদের তারুণ্য দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, স্বার্থপর এবং প্রতিক্রিয়াশীল। আমরা লক্ষ্য করেছি, তারাও পারতপক্ষে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ বা বড় দলগুলোর ধারেকাছে আসে না। নেতানেত্রীদের আহ্বান তারা কানে ঢুকতেই দেয় না। দেশের সর্বত্র হতাশা, দুর্নীতি, অনিয়ম ও ব্যর্থতা নিয়ে তারা নিজেরা হয়তো কথা বলে কিন্তু রাজপথে সরব হয় না। তেমন সময়েই শাহবাগ চত্বরে বিস্ফোরণটি ঘটে। আমরা এখন সবাই জানি, কাদের মোল্লার ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবনের রায় হওয়ার পর কিছু বস্নগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট শাহবাগের সামনে মানববন্ধন করার উদ্যোগ নেয়। সেই মানববন্ধন এখন বাংলাদেশের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়েছে। আমি নিজে প্রতিদিন ঘুরে ঘুরে বিস্মিত হই যে, ঘরের কোণে কম্পিউটারে কোড লেখার মেয়েটি এখন শাহবাগে গিয়ে জয় বাংলা শ্লোগান দেয়। যে ছেলেটিকে ইন্টারনেট ছেড়ে ওঠতে দেখি না সে যোগ দেয় মশাল মিছিলে। মাকে বলে যায়, মা আজ রাত আমি শাহবাগে কাটাব। ১৮ বছর বয়সের মেয়েটি একসঙ্গে ছবি তুলে আর শ্লোগানে লিড দেয়।
বাস্তবতা হচ্ছে শাহবাগে যারা জমায়েত হয়েছে তারা কোন রাজনৈতিক দলের অনুগত না হলেও 'জয় বাংলা' শ্লোগান প্রদান করে। তারা নিজেদের 'বাঙালি' বলে মনে করে এবং 'তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা' বলে শ্লোগান দেয়। এ শ্লোগানগুলো বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে যুক্ত। '৬৯ থেকে ৭১ সময়কালে সমগ্র জাতি দলমত নির্বিশেষে এ শ্লোগান দিয়েছে। একাত্তরে বাংলাদেশের পরিচয় ছিল জয় বাংলা। আমি যখন বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতে পা রেখেছিলাম তখন ভারতীয়রা বলেছিল, আপনি কি জয় বাংলা থেকে এলেন? জয় বাংলার মানুষ, জয় বাংলার পতাকা, জয় বাংলার টাকা এসবই আমরা শুনতাম। কারও সঙ্গে দেখা হলেই বলতাম জয় বাংলা। খুশির খবর হলে বলতাম জয় বাংলা। বিদায় নিলে বলতাম জয় বাংলা। কিন্তু দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ ছাড়া আর সবাই বাংলাদেশের জন্মের সেসব শ্লোগানের কথা ভুলে যায়। কেবল আওয়ামী লীগ এখনও জয় বাংলা শ্লোগানকে তাদের কণ্ঠে ধারণ করে আসছে। রাজনীতির বিশ্লেষকরা এসব শ্লোগানের হিসাব মিলিয়ে এ আন্দোলনের নেপথ্যে সরকারি দল বা আওয়ামী লীগের মদদ খুঁজে পেয়েছেন। বিএনপির হান্নান শাহ রীতিমতো একে সরকারি দলের নাটক বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার কথাবার্তায় যুদ্ধাপরাধের সহযোগী হওয়ার সব লক্ষণই পরিস্ফুট। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শাহবাগের জনতার বিজয় কামনা করেছেন। বিএনপির সাদেক হোসেন খোকা শাহবাগের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। এ পরিপ্রেক্ষিত বিএনপিকে বাধ্য করেছে ১৮দলীয় জোটের সমাবেশ বাতিল করতে। তবুও বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া শাহবাগের আন্দোলন সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেননি। মন্তব্য করেননি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি শাহবাগের আন্দোলনের নেতারা জাতীয় সংসদে তাদের স্মারকলিপি পাঠায়। জাতীয় সংসদ ও তার সদস্যরা শাহবাগের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং খোদ প্রধানমন্ত্রী শাহবাগের আন্দোলনকারীদের বক্তব্যকে যৌক্তিক বলে বিবেচনা করে তাদের দাবিগুলো পূরণ করার জন্য যা যা করা দরকার তাই করার ঘোষণা দিয়েছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি আরও বলেছেন, তার মন চাইছে শাহবাগে যেতে। অথচ এমন একটি প্রত্যাশা বেগম খালেদা জিয়ার থাকা উচিত ছিল।
আমি ধারণা করি, শাহবাগের আওয়াজ তাদের কানে যেভাবেই পেঁৗছুক, এ আন্দালনের প্রতি জনমানুষের সমর্থন বেগম জিয়ার ঘরানাকে একটু নতুন সুরে কথা বলতে বাধ্য করেছে। যদিও তার দলের হান্নান শাহ ও শওকত মাহমুদের মতো আতেলরা নানাভাবে এ আন্দোলন সম্পর্কে বক্রোক্তি করছেন। তবুও তারা ইচ্ছা করলেই শাহবাগের আন্দোলনকারীদের উপেক্ষা করতে পারছেন না। এমনকি জয়বাংলা শ্লোগানদানকারীদের একটি বিশেষ দলের লোক হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারছেন না। জয় বাংলা এখন জাতীয় শ্লোগানে পরিণত হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া তার মরহুম স্বামী জিয়ার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজাকার ও পাকিস্তানপন্থিদের পুনর্বাসনের যে প্রক্রিয়া সফলতার সঙ্গে এতদিন চালিয়ে চালিয়ে আসছিলেন তাতে এখন সবচেয়ে বড় কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে শাহবাগের নতুন প্রজন্ম। '৭৫ পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দেয়ার মতো চরম দেশদ্রোহ কাজ করে দিনে দিনে রাজাকারদের বাংলাদেশের পতাকাও উপহার দেন। একইভাবে বেগম জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে সরকার গঠন করেন। সেই সূত্র ধরেই মাত্র সেদিন বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়া যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ, ট্রাইব্যুনাল বাতিল; এমনকি কাদের মোল্লার মুক্তি দাবি করেছিলেন। জামায়াতও বিএনপির ছায়ায় থেকেই বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর সব আয়োজন সম্পন্ন করতে থাকে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪২ বছর পর সেই পেছনে ঘুরানো পায়ের পাতাকে উল্টো করার সাহস করেছে আমাদের সন্তানরা।
আমরা একাত্তরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলাম। কিন্তু তখন সেই বিজয় আমরা সম্পূর্ণ করতে পারিনি। একাত্তরে একটি মানচিত্র, একটি পতাকা, একটি জাতীয় সংগীত ও একটি ভূখ- নিয়ে বাংলাদেশ জন্ম নেয়। আমাদের কাছে যুদ্ধে হেরে গিয়ে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিলেও তাদের পূর্ব পাকিস্তানি দোসররা দাপটের সঙ্গে আবার ফিরে আসে। মাত্র সাড়ে তিন বছরেই বাংলাদেশকে তার জন্মের অঙ্গীকার থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা নামধারী জিয়াউর রহমান এ কাজে নেতৃত্ব দেন। কর্নেল তাহের ও জাসদের মতো অনেকে বোকার মতো সেই জিয়াকেই সমর্থন করে সহায়তা করেন। জিয়া জাসদ নেতাদের কারাগারে পুরে ও তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে সেই সহায়তার বদলা নেয়।
যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রকে মূল মন্ত্র হিসেবে নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম ২১ বছরে তাকে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার পাশাপাশি সামরিক শাসনের দেশে পরিণত করা হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বানানো হয় পাকিস্তানি আদলের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। জয় বাংলাকে বানানো হয় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। সংবিধানে প্রবেশ করে বিসমিল্লাহ। ইসলামকে করা হয় রাষ্ট্রধর্ম। জিয়া ও এরশাদের পাশাপাশি বেগম জিয়ার হাতে একাত্তরের পরাজিত শক্তি রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয়। একুশ বছর ধরে সেই প্রক্রিয়া বাধাহীনভাবে চলতে থাকে। জিয়ার পর এরশাদও একই পথে পা চালান। সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে ধূলায় লুণ্ঠিত করে জিয়া এরশাদ ও খালেদা বাংলাদেশকে বস্তুত আরেকটি পাকিস্তানেই পরিণত করে।
'৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর প্রথমবারের মতো মনে হতে থাকে যে দেশটা পাকিস্তান হলেও কিছুটা হয়তো তখনও বাকি রয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সেই সময়ে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে ফিরিয়ে আনতে পুরোপুরি সফল হয়নি। ২০০১ সালে বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গোড়ায় ফিরে যাওয়ার স্বপ্নকে আবার ঠেকিয়ে দেয়। বরং মনে হতে থাকে যে, আমরাই বাংলাদেশের পরাজিত শক্তি এবং বেগম জিয়া ও তার রাজাকার দোসরাই দেশের মূল শক্তি। ৫ ফেব্রুয়ারির আগে তেমনটাই ছিল দেশের সাধারণ মানুষের ধারণা। কিন্তু সেদিন আমাদের সন্তানরা শুরু করে আমাদের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। আমরা একাত্তরে আংশিক বিজয় নিয়ে তুষ্ট হতে বাধ্য হয়েছিলাম। কামনা করি ওরা পরিপূর্ণভাবে বিজয়ী হবে।
[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান, সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার প্রণেতা
একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির মন্তব্য দিয়েই বোঝা যায় আমরা আমাদের সন্তানদের যে মোটেই চিনি না। এক ছাদের তলায় বাস করি, কোলে করে মানুষ করি কিন্তু তাদের মেধা ও মননে কী আছে সেটি অনুভবই করতে পারি না। এমনকি একটি ডিজিটাল যুগে বাস করেও আমরা ধারণাই করতে পারি না যে, সমাজ বদলানোর সময়টা কেউ থামিয়ে দিতে পারে না। যে সন্তানটিকে তার ঘরে বসে ফেসবুকে বান্ধবীর সঙ্গে ছবি বিনিময় করতে দেখি বা রাত জেগে মোবাইলের বিল তুলতে দেখি তাকে নিয়ে আমরা হতাশ হই।
একজন জনপ্রিয় লেখক, প্রযুক্তিবিদ ও শিক্ষক গত ৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শাহবাগের মহাসমাবেশের মঞ্চে উপস্থিত থেকে লাখো লাখো তরুণকে উদ্দেশ করে বললেন, আমি আজ এখানে কোন বক্তব্য দিতে আসিনি, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আমি লিখেছিলাম, নতুন প্রজন্ম কেবল ফেসবুকে লাইক দেয় আর বস্নগে আড্ডা দেয়। তোমরা আমাকে ভুল প্রমাণ করেছ। আজ এখানে তোমরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছ। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জাফর ইকবাল যদি একথা বলেন তবে রাজনীতিক ওবায়দুল কাদের তো বলতেই পারেন যে, নতুন প্রজন্ম প্রচলিত রাজনীতির ওপর অনাস্থা পেশ করেছে। দুই মেয়ে দুর্বা ও সুধাকে সঙ্গে নিয়ে শাহবাগ চত্বরে আসা বনানীর শাহীনা মমতাজও খুব সঙ্গত কারণেই বলেছেন, ফেসবুক ব্যবহার করার জন্য সন্তানদের অনেক বকেছি। কিন্তু এখন ভুল ভেঙে গেছে। তারা দেশকে অনেক ভালোবাসে। অনেক খবর রাখে। এ আন্দোলন তারই প্রমাণ।
৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে সাধারণ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এমনটাই। বস্তুত আমাদের দেশের আমার প্রজন্ম যারা ৫০ পার করে ৬০ বা সত্তরে পড়েছেন তাদের সিংহভাগই মনে করেন যে, আমাদের সন্তানরা সময় বা দেশ সচেতন নয়। তারা রাজনীতিতে নামে না, মিছিল করে না, শ্লোগান দেয় না বা জাতীয় ইস্যুতে তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে না। কোন কোন ছাত্র সংগঠনের কিছুু দুর্বৃত্তকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাতেই প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় যে, আমাদের তারুণ্য দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, স্বার্থপর এবং প্রতিক্রিয়াশীল। আমরা লক্ষ্য করেছি, তারাও পারতপক্ষে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ বা বড় দলগুলোর ধারেকাছে আসে না। নেতানেত্রীদের আহ্বান তারা কানে ঢুকতেই দেয় না। দেশের সর্বত্র হতাশা, দুর্নীতি, অনিয়ম ও ব্যর্থতা নিয়ে তারা নিজেরা হয়তো কথা বলে কিন্তু রাজপথে সরব হয় না। তেমন সময়েই শাহবাগ চত্বরে বিস্ফোরণটি ঘটে। আমরা এখন সবাই জানি, কাদের মোল্লার ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবনের রায় হওয়ার পর কিছু বস্নগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট শাহবাগের সামনে মানববন্ধন করার উদ্যোগ নেয়। সেই মানববন্ধন এখন বাংলাদেশের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়েছে। আমি নিজে প্রতিদিন ঘুরে ঘুরে বিস্মিত হই যে, ঘরের কোণে কম্পিউটারে কোড লেখার মেয়েটি এখন শাহবাগে গিয়ে জয় বাংলা শ্লোগান দেয়। যে ছেলেটিকে ইন্টারনেট ছেড়ে ওঠতে দেখি না সে যোগ দেয় মশাল মিছিলে। মাকে বলে যায়, মা আজ রাত আমি শাহবাগে কাটাব। ১৮ বছর বয়সের মেয়েটি একসঙ্গে ছবি তুলে আর শ্লোগানে লিড দেয়।
বাস্তবতা হচ্ছে শাহবাগে যারা জমায়েত হয়েছে তারা কোন রাজনৈতিক দলের অনুগত না হলেও 'জয় বাংলা' শ্লোগান প্রদান করে। তারা নিজেদের 'বাঙালি' বলে মনে করে এবং 'তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা' বলে শ্লোগান দেয়। এ শ্লোগানগুলো বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে যুক্ত। '৬৯ থেকে ৭১ সময়কালে সমগ্র জাতি দলমত নির্বিশেষে এ শ্লোগান দিয়েছে। একাত্তরে বাংলাদেশের পরিচয় ছিল জয় বাংলা। আমি যখন বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে ভারতে পা রেখেছিলাম তখন ভারতীয়রা বলেছিল, আপনি কি জয় বাংলা থেকে এলেন? জয় বাংলার মানুষ, জয় বাংলার পতাকা, জয় বাংলার টাকা এসবই আমরা শুনতাম। কারও সঙ্গে দেখা হলেই বলতাম জয় বাংলা। খুশির খবর হলে বলতাম জয় বাংলা। বিদায় নিলে বলতাম জয় বাংলা। কিন্তু দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ ছাড়া আর সবাই বাংলাদেশের জন্মের সেসব শ্লোগানের কথা ভুলে যায়। কেবল আওয়ামী লীগ এখনও জয় বাংলা শ্লোগানকে তাদের কণ্ঠে ধারণ করে আসছে। রাজনীতির বিশ্লেষকরা এসব শ্লোগানের হিসাব মিলিয়ে এ আন্দোলনের নেপথ্যে সরকারি দল বা আওয়ামী লীগের মদদ খুঁজে পেয়েছেন। বিএনপির হান্নান শাহ রীতিমতো একে সরকারি দলের নাটক বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার কথাবার্তায় যুদ্ধাপরাধের সহযোগী হওয়ার সব লক্ষণই পরিস্ফুট। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শাহবাগের জনতার বিজয় কামনা করেছেন। বিএনপির সাদেক হোসেন খোকা শাহবাগের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। এ পরিপ্রেক্ষিত বিএনপিকে বাধ্য করেছে ১৮দলীয় জোটের সমাবেশ বাতিল করতে। তবুও বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া শাহবাগের আন্দোলন সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেননি। মন্তব্য করেননি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি শাহবাগের আন্দোলনের নেতারা জাতীয় সংসদে তাদের স্মারকলিপি পাঠায়। জাতীয় সংসদ ও তার সদস্যরা শাহবাগের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং খোদ প্রধানমন্ত্রী শাহবাগের আন্দোলনকারীদের বক্তব্যকে যৌক্তিক বলে বিবেচনা করে তাদের দাবিগুলো পূরণ করার জন্য যা যা করা দরকার তাই করার ঘোষণা দিয়েছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি আরও বলেছেন, তার মন চাইছে শাহবাগে যেতে। অথচ এমন একটি প্রত্যাশা বেগম খালেদা জিয়ার থাকা উচিত ছিল।
আমি ধারণা করি, শাহবাগের আওয়াজ তাদের কানে যেভাবেই পেঁৗছুক, এ আন্দালনের প্রতি জনমানুষের সমর্থন বেগম জিয়ার ঘরানাকে একটু নতুন সুরে কথা বলতে বাধ্য করেছে। যদিও তার দলের হান্নান শাহ ও শওকত মাহমুদের মতো আতেলরা নানাভাবে এ আন্দোলন সম্পর্কে বক্রোক্তি করছেন। তবুও তারা ইচ্ছা করলেই শাহবাগের আন্দোলনকারীদের উপেক্ষা করতে পারছেন না। এমনকি জয়বাংলা শ্লোগানদানকারীদের একটি বিশেষ দলের লোক হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারছেন না। জয় বাংলা এখন জাতীয় শ্লোগানে পরিণত হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া তার মরহুম স্বামী জিয়ার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজাকার ও পাকিস্তানপন্থিদের পুনর্বাসনের যে প্রক্রিয়া সফলতার সঙ্গে এতদিন চালিয়ে চালিয়ে আসছিলেন তাতে এখন সবচেয়ে বড় কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে শাহবাগের নতুন প্রজন্ম। '৭৫ পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দেয়ার মতো চরম দেশদ্রোহ কাজ করে দিনে দিনে রাজাকারদের বাংলাদেশের পতাকাও উপহার দেন। একইভাবে বেগম জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে সরকার গঠন করেন। সেই সূত্র ধরেই মাত্র সেদিন বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়া যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ, ট্রাইব্যুনাল বাতিল; এমনকি কাদের মোল্লার মুক্তি দাবি করেছিলেন। জামায়াতও বিএনপির ছায়ায় থেকেই বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর সব আয়োজন সম্পন্ন করতে থাকে। কিন্তু স্বাধীনতার ৪২ বছর পর সেই পেছনে ঘুরানো পায়ের পাতাকে উল্টো করার সাহস করেছে আমাদের সন্তানরা।
আমরা একাত্তরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলাম। কিন্তু তখন সেই বিজয় আমরা সম্পূর্ণ করতে পারিনি। একাত্তরে একটি মানচিত্র, একটি পতাকা, একটি জাতীয় সংগীত ও একটি ভূখ- নিয়ে বাংলাদেশ জন্ম নেয়। আমাদের কাছে যুদ্ধে হেরে গিয়ে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিলেও তাদের পূর্ব পাকিস্তানি দোসররা দাপটের সঙ্গে আবার ফিরে আসে। মাত্র সাড়ে তিন বছরেই বাংলাদেশকে তার জন্মের অঙ্গীকার থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা নামধারী জিয়াউর রহমান এ কাজে নেতৃত্ব দেন। কর্নেল তাহের ও জাসদের মতো অনেকে বোকার মতো সেই জিয়াকেই সমর্থন করে সহায়তা করেন। জিয়া জাসদ নেতাদের কারাগারে পুরে ও তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে সেই সহায়তার বদলা নেয়।
যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রকে মূল মন্ত্র হিসেবে নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম ২১ বছরে তাকে একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার পাশাপাশি সামরিক শাসনের দেশে পরিণত করা হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বানানো হয় পাকিস্তানি আদলের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। জয় বাংলাকে বানানো হয় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। সংবিধানে প্রবেশ করে বিসমিল্লাহ। ইসলামকে করা হয় রাষ্ট্রধর্ম। জিয়া ও এরশাদের পাশাপাশি বেগম জিয়ার হাতে একাত্তরের পরাজিত শক্তি রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয়। একুশ বছর ধরে সেই প্রক্রিয়া বাধাহীনভাবে চলতে থাকে। জিয়ার পর এরশাদও একই পথে পা চালান। সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে ধূলায় লুণ্ঠিত করে জিয়া এরশাদ ও খালেদা বাংলাদেশকে বস্তুত আরেকটি পাকিস্তানেই পরিণত করে।
'৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর প্রথমবারের মতো মনে হতে থাকে যে দেশটা পাকিস্তান হলেও কিছুটা হয়তো তখনও বাকি রয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সেই সময়ে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে ফিরিয়ে আনতে পুরোপুরি সফল হয়নি। ২০০১ সালে বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গোড়ায় ফিরে যাওয়ার স্বপ্নকে আবার ঠেকিয়ে দেয়। বরং মনে হতে থাকে যে, আমরাই বাংলাদেশের পরাজিত শক্তি এবং বেগম জিয়া ও তার রাজাকার দোসরাই দেশের মূল শক্তি। ৫ ফেব্রুয়ারির আগে তেমনটাই ছিল দেশের সাধারণ মানুষের ধারণা। কিন্তু সেদিন আমাদের সন্তানরা শুরু করে আমাদের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। আমরা একাত্তরে আংশিক বিজয় নিয়ে তুষ্ট হতে বাধ্য হয়েছিলাম। কামনা করি ওরা পরিপূর্ণভাবে বিজয়ী হবে।
[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান, সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার প্রণেতা
No comments