ক্রিকেট-অন্তঃপরিবার- ‘মামা দেখিস, দেখিয়ে দিব’ by আকমল হোসেন
একজনকে জিজ্ঞেস করতেই উৎসাহের সঙ্গে এগিয়ে এলেন। হাত তুলে দেখিয়ে দিলেন, ‘এই তো একটু সামনে এগিয়ে গেলেই রাজুর বাড়ি।’ তাঁর নির্দেশিত পথ ধরে কিছু দূর এগোতেই দেখা গেল একটি বাসার সামনে মোটরসাইকেলের জটলা।
দরজার সামনে জোড়ায় জোড়ায় জুতা। বোঝা গেল, এটাই হবে রাজুর বাড়ি।এই রাজু আর কেউই নন, আবুল হাসান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১০ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে অভিষেকেই সেঞ্চুরি! স্পেশালিস্ট বোলার হিসেবে এই কীর্তি শুধু গাজীপুর গ্রামই নয়, গোটা ক্রিকেট-দুনিয়ায় হইচই ফেলে দিয়েছে। আবুল হাসান মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার গাজীপুর গ্রামেরই সন্তান। রাজু তাঁর ডাকনাম। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী—সবার কাছে তিনি এ নামেই পরিচিত।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে হাসানদের বাড়িতে গিয়েছিলেন এ প্রতিবেদক।
ঘরে ঢুকেই দেখা গেল, মিষ্টিমুখ করানো চলছে। প্রতিবেশী, স্বজন, ক্রিকেটভক্ত—যে-ই আসছেন, তাঁকেই মিষ্টি খাওয়ানো হচ্ছে। জানা গেল, ক্রিকেটপাগল পরিবারটি বুধবার বিকেল থেকেই আনন্দে ভাসছে। শুধু কি তাঁর পরিবার। হাসানের রেকর্ড গড়া সেঞ্চুরির খবর ছড়িয়ে পড়ার পর গাজীপুরের ছোট-বড় সবাই ভাসছে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে। গভীর রাত পর্যন্ত আনন্দ মিছিল হয়েছে কুলাউড়ার ইস্পাহানি গাজীপুর চা-বাগান এলাকায়। বাদ যায়নি জেলা সদরসহ অন্যান্য স্থানও।
হাসানের বড় ভাই আবুল কাশেমও একসময় ক্রিকেট খেলতেন। এখন চাকরি করেন গাজীপুর চা-বাগানে টিলা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে। বাসায় মিষ্টিমুখ করানোর দায়িত্বটা আপাত তাঁর ওপরই পড়েছে। তিনি বললেন, ‘রাজু একেবারে ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট খেলে। পরিবারের সবাই ক্রিকেটভক্ত। টেস্টও আমরা ওয়ানডের মতোই দেখি।’
দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে হাসান সবার ছোট। বাবা আবদুল খালেক গাজীপুর চা-বাগানের কারখানার প্রধান করণিক ছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি মারা যান। মা কামরুন্নাহার গৃহিণী এবং একমাত্র বোন ফাতেমা আক্তার সম্প্রতি অগ্রণী ব্যাংকে যোগ দিয়েছেন।
চা-বাগানেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা হাসানের। গাজীপুর চা-বাগানের প্রাথমিক বিদ্যালয়, আলাউদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং কুলাউড়া নবীনচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে এখানকার সব মাঠই তাঁর আপন জগৎ।
হাসানের বড় ভাই বললেন, ‘রাজুর খবর শুনে কুলাউড়ার যারাই তার সঙ্গে ক্রিকেট খেলে, প্রতিবেশী, মিডিয়ার লোকজন সবাই আসছে, শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। খুব ভালো লাগছে। সবাই আমাদের উৎসাহ দিচ্ছে।’ বোন ফাতেমা আক্তার জানান, হাসানের খেলার প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন ছিল তাঁর বাবার। হাসান যেখানে খেলতে যেতেন, তাঁকে সেখানেই নিয়ে যেতেন বাবা। সারা দিন বসে থাকতেন। খেলা শেষ হলে নিয়ে আসতেন। তিনি জানান, তাঁর সরাসরি খেলা দেখা হয়নি। এ সময় তিনি ব্যাংকে ছিলেন। আর বাসায় ডিশ লাইনে সমস্যা থাকায় তাঁর মাও খেলা দেখতে পারেননি। ভাই আবুল কাশেম কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাগানে খেলা দেখেছেন।
ফাতেমা বলেন, ‘খেলা না দেখে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। খেলা দেখলে খুব টেনশন হয়। ফোনে তার সঙ্গে গতকাল (বুধবার) কথা বলেছিলাম। সে হাসতে হাসতে বলেছে, “একটা অই গেছে, এই আর কি!” সে খুব সিম্পল।’
হাসানের মা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বুধবার বিকেল থেকে অনেকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ক্লান্ত। হাসানের ভাইবোন ও অন্যদের সঙ্গে কথা বলার এক ফাঁকে তিনিও এসে হাজির। কেমন লাগছে? মৃদু হেসে তিনি বললেন, ‘অনুভূতি বলে প্রকাশ করতে পারব না। খুশিতে শুধু কান্না পেয়েছে। ছেলের অর্জন মায়ের কাছে অনেক বড়। আনন্দে চোখের পানি ছাড়া আর কিছুই আসে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘তবে বারবার ওর বাবার কথা মনে পড়ছে। এই সফলতা ওর বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায় হলে তিনিই সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন।’
কামরুন্নাহার বলেন, ‘হাসান প্রতিদিন খেলা থেকে ফিরে আমাকে ফোন দেয়। বুধবারও হোটেলে ফিরে দিয়েছে। হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে, “মা, খেলা দেখেছ?” আমি বললাম, ডিশ ছিল না, বাবা। হেসে বলে, “পৃথিবীর মানুষ দেখল, তুমি দেখো নাই।” আমি বলেছি, সবাই এসে তোমার কথা বলছে। এতেই আমার দেখা হয়ে গেছে।’
হাসানের বন্ধু সুভাষ দাশ। একসঙ্গেই ক্রিকেট খেলেন। হাসানদের বাসায় তাঁকেও পাওয়া গেল। সুভাষ বললেন, ‘ও আমার সার্বক্ষণিক বন্ধু। আমাদের মধ্যে সব সময়ই আত্মবিশ্বাস কাজ করে, আমরা ভালো করব। তাই এই সেঞ্চুরি আমার কাছে স্বাভাবিকই মনে হয়েছে। আমি জানি, সে একজন ভালো ব্যাটসম্যান। সে মজা করে বলত, “মামা দেখিস, যদি কোনো দিন ব্যাট করার সুযোগ পাই, তাইলে দেখিয়ে দিব।”’ তিনি জানান, এ বছর মৌলভীবাজার জেলার পক্ষে সিলেটের বিপক্ষে ৫ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে হাসান খেলেছেন। ৬৫ রান করেছেন। হাসানের ওই রানই জিতিয়েছে দলকে।
প্রতিবেশী জামাল মিয়া (৫০) বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই দেখি খেলতে। ছেলেটা ভালো গানও জানে।’
বাসার পাশেই গাজীপুর চা-বাগানের মাঠ। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, ফুটবল খেলার প্রস্তুতি চলছে। হাসানের কথা উঠতেই আরিফুল ইসলাম নামের একজন বললেন, ‘ও আমাদের গৌরব।’
কুলাউড়া ক্রিকেট প্লেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা ও কুলাউড়া উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সিপার উদ্দিনও হাসানদের বাসায় গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘রাজু সফলতা অর্জন করবে, এটা আমার ধারণাতেই ছিল। সে একজন ন্যাচারাল ট্যালেন্ট।’ তিনি জানান, ২০০২ সালে কুলাউড়ায় এক সপ্তাহের একটি প্রশিক্ষণ হয়েছিল। শ্রীলঙ্কার কোচ ছিলেন। ওই কোচ দুজন খেলোয়াড়ের প্রতি বেশি যত্ন নিয়েছিলেন। তাঁর একজন হাসান।
No comments