এবার প্রাথমিকের প্রশ্নপত্রও ফাঁস
খুদে শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দিয়েই গতকাল বৃহস্পতিবার দেশজুড়ে সমাপনী শিক্ষার্থীদের বাংলা বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে।
পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবক, শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগের ভিত্তিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার বিষয়টি আমলে নেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। অভিযোগের সত্যতা নিরূপণের জন্য মন্ত্রণালয় গতকালই তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তবে গতকালের পরীক্ষা বাতিল করার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বাকি পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্র যাতে ফাঁস না হয় সে জন্য সব জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপার (এসপি) এবং জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে (ডিপিইও) সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। আগামী সোমবার যথারীতি ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়া হবে। ২৬ লাখের বেশি পরীক্ষার্থী এবারের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।এদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটিকে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাথমিক সমাপনীর প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় সন্দেহের তীর বিজি প্রেসের দিকে। গতকাল সন্ধ্যায় তদন্ত কমিটির সদস্যরা বিজি প্রেস পরিদর্শন করেছেন। এ সময় বিজি প্রেসের বেশ কয়েকজন কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তাঁরা।
তদন্ত কমিটির প্রধান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব গিয়াস উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, বিজি প্রেসে কয়েকজন কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদের মধ্য দিয়ে তদন্তকাজ শুরু হয়েছে। আগামী রবিবার প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষক) রুহুল আমিন এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবুল কালাম আজাদ।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফসারুল আমিন এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাংলা বিষয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে প্রশ্নের পুরোটা, নাকি অংশবিশেষ ফাঁস হয়েছে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেলে জানা যাবে। অভিযোগ প্রমাণ হলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরীক্ষা যথারীতি চলবে।'
উল্লেখ্য, গত চার বছর ধরে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ পরীক্ষা আয়োজন করে আসছে। আগামী বছর থেকে এ পরীক্ষা আয়োজন করবে ময়মনসিংহে অবস্থিত জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমী (নেপ)।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর জানলেও সকালে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। পরীক্ষার পর প্রশ্নপত্র মিলিয়ে দেখা গেছে, ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে মূল প্রশ্নের ৪৭ নম্বরের মিল রয়েছে। এর পরই নানা জনের কাছ থেকে জোরালো অভিযোগ আসতে থাকায় মন্ত্রণালয় বিষয়টি আমলে নেয়।
মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে নমুনা পাওয়া গেছে তাতে মূল প্রশ্নের কিছু অংশ মিলেছে। এটা অভিজ্ঞ কোনো শিক্ষকের কাজ হতে পারে। তিনি যে সাজেশন দিয়েছিলেন, ওই সাজেশন অনুযায়ী পরীক্ষার প্রশ্নের কিছু অংশ মিলে গেছে। কিন্তু কিভাবে এই প্রশ্নগুলো মিলল তা খুঁজে বের করার জন্য আমরা গোয়েন্দাদের সাহায্য চেয়েছি। একই সঙ্গে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছি। কমিটিকে আগামী দুই দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া এ ঘটনার পর মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করা হয়েছে।'
সূত্র জানায়, গতকাল দুপুরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয় নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফসারুল আমিন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শ্যামল কান্তি ঘোষকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। ওই বৈঠকেই তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। তদন্ত কমিটি গঠনের পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থারও সাহায্য চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে। এ ছাড়া বাকি পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্র যাতে কোনোভাবে ফাঁস না হয় সে জন্য সব জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে ফ্যাক্সের মাধ্যমে চিঠি পাঠানো হয়।
মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিতে বলা হয়, দেশের কিছু জেলায় চলতি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার বাংলা প্রশ্নের কিছু অংশ ফাঁস হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থায় পরের পরীক্ষাগুলোতে যাতে এ ধরনের কোনো ঘটনা না ঘটে, সে জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে।
এ ছাড়া এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে বিকেলে মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাঠিয়ে এনএসআই, ডিজিএফআই, এসবি, ডিবি ও র্যাবের সাহায্য চাওয়া হয়েছে।
আগামী বছর থেকে নেপের অধীনে পরীক্ষা : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. মোতাহার হোসেন বলেন, 'প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা একটি বৃহৎ পরীক্ষা। প্রতিবছর পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে ময়মনসিংহে অবস্থিত জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমী (নেপ) পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করে দেয়। আর পরীক্ষা গ্রহণ করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। আগামী বছর থেকে পরীক্ষার সব দায়দায়িত্ব নেপের হাতে তুলে দেওয়া হবে। নেপই পরীক্ষার সব আয়োজন করবে। এ জন্য নেপে একটি উইং খোলা হবে। এই উইংয়ে একজন পরিচালকের নেতৃত্বে সাত বিভাগে সাতটি শাখা থাকবে, যারা বিভাগওয়ারি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা পরিচালনা করবে। পর্যায়ক্রমে এটি প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ডে রূপান্তর করা হবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. মোতাহার হোসেন গতকাল গাজীপুরের কয়েকটি পরীক্ষাকেন্দ্র পরিদর্শন করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন ছিলেন।
No comments