সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-মানবিকতার আহ্বানে সাড়া দিন by এমএম আকাশ
সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করেছেন ১৫ জন প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট নাগরিক। এর নেতৃত্বে রয়েছেন আমাদের সবার পরিচিত বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। আগামী ৮ ডিসেম্বর শনিবার গুলিস্তান মহানগর নাট্যমঞ্চে অনুষ্ঠিতব্য এ সম্মেলনে দলমত নির্বিশেষে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদবিরোধী প্রত্যেক ব্যক্তি, শক্তি ও সংগঠনকে সমবেত হওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে গত ১৯ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত কয়েকজন সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল কৌতূহলোদ্দীপক।শুরুতেই একজনের প্রশ্ন_ কেন এ ধরনের উদ্যোগ। ড. আনিসুজ্জামানের পঠিত লিখিত বক্তব্যেই এ প্রশ্নের উত্তর ছিল। এতে বলা হয়, সম্প্রতি কক্সবাজারের রামু ও সনি্নহিত এলাকায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর নিদারুণ সাম্প্রদায়িক নির্যাতন সংঘটিত হয়েছে। এ নির্যাতন অপ্রত্যাশিত, কিন্তু তা ছিল সুপরিকল্পিত। তার আগে ও পরেও বাংলাদেশের নানা স্থানে হিন্দু মন্দির ও প্রতিমা আক্রান্ত হয়েছে। আহমদিয়া সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্ধ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে চক্রান্তকারীরা সুপরিকল্পিতভাবে এসব হামলা চালিয়েছে। এ ধরনের ঘটনা বুদ্ধিজীবীদের মতে খুবই বিপজ্জনক আলামত। ১৫ জনের (জাতীয় অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহ্মদ, জাতীয় অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম, জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক, অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, ড. হামিদা হোসেন, ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, কামাল লোহানী, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার) বিবৃতিতে বলা হয়, 'এসব ঘটনায় তারা মর্মাহত, বিমূঢ় ও বিক্ষুব্ধ।' সংবাদ সম্মেলনের এক পর্যায়ে এ কথাও উঠে আসে যে, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের স্বাভাবিক ঐতিহ্য হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক। ভারতবর্ষ উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসনের সময় ব্রিটিশরাই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অসম বিকাশ ঘটিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে ভাগ কর ও শাসন কর পদ্ধতি অবলম্বন করে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত প্রবণতাকে এ দেশে চালু করেছিল। সুতরাং এ অশুভ প্রবণতার মূল লুকিয়ে আছে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কী সম্পর্ক হবে ওই বিষয়টির মধ্যে। রাজনীতি যদি ধর্মভিত্তিক হয়, রাষ্ট্র যদি বিশেষ কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে থাকে এবং যদি দাবি করা হয় যে, রাষ্ট্রের একটি
ধর্ম আছে, তাহলে সেই রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িকতা থাকবে। সহজে এর নির্মূল করাও কঠিন হবে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে এটাও বলা হয়, সম্প্রতি মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য ধর্মভিত্তিক কতিপয় রাজনৈতিক দল ও শক্তি দেশব্যাপী সংঘবদ্ধ সহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এ থেকে এটাও প্রমাণ হয় যে, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মমিশ্রিত হলে ধর্মের মানবতাবাদী দিকটি চাপা পড়ে যায় এবং সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও জঙ্গিপনার মতো ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে সংবিধানের ৩৮ ধারা থেকে বিস্তৃত উদ্ধৃতি দেন প্রখ্যাত মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল। এ উদ্ধৃতি প্রদানের মাধ্যমে তিনি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, বাংলাদেশের সংবিধানে এত কাটাছেঁড়ার পরও এমন ধারা আছে যা মানতে হলে আমাদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করতেই হবে। সে হিসেবে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে সংবিধানের বিধান অমান্যকারী দলগুলোকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা এবং নিজেদের সংশোধন না করলে রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দেওয়া। বুদ্ধিজীবীদের উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আমরা এ কথাও যোগ করব যে, এটি শুধু শুভবুদ্ধির বিষয় নয়। এর সঙ্গে রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রশ্নও জড়িত। রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না বরং রাষ্ট্র সবার এবং ধর্ম প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার_ রাজনৈতিক দল, শক্তি ও ব্যক্তির মধ্যে এই নীতিতে যারা বিশ্বাসী এবং সেই নীতির প্রশ্নে কৌশলগত কারণে বা ভোটে জয়লাভের জন্য যারা সুবিধাবাদী আপস করতে প্রস্তুত নয় তাদের আজ জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বুদ্ধিজীবীদের আবেদনের এ অংশটি তাৎপর্যপূর্ণ। যদি সত্যি সত্যি দলমত নির্বিশেষে নাগরিকরা নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের ওপর এই নূ্যনতম একটি মাত্র দাবিতে চাপ প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়, তাহলে আমরা একটি বিকল্প জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সক্ষম হবো এবং এর প্রভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করাও সম্ভব হবে।
তবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট নাগরিকদের কেউ কেউ এ কথা বলেছেন যে, তাদের আন্দোলনের লক্ষ্য কোনোভাবেই ধর্ম নয়। ধর্মীয় ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করা, অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি করা বা জাতিধর্ম বা বর্ণভিত্তিক যে কোনো প্রকার বৈষম্য রোধ করার জন্যই এ আন্দোলন। একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দিকে আমরা এগিয়ে যেতে পারব না যতদিন না নাগরিকদের মধ্যে এ মূল্যবোধ সুপ্রতিষ্ঠিত করা যায়। আর যেহেতু রাষ্ট্র নিজেই ধর্মের হাত জড়িয়ে ধরেছে সে কারণে আইন প্রয়োগ কিংবা ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি ইস্যু নানামুখী চাপে অস্পষ্ট কিংবা দিশাহীন হয়ে পড়ে। অনেকের মধ্যে আপসকামী মনোভাবও লক্ষ্য করা যায়। রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে যখন একেক সময় একেক কথা বলা হচ্ছে, শরিয়া আইন প্রয়োগের মৌখিক হুমকি দেওয়া হচ্ছে, তখন বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। অবশ্য এর অন্য ব্যাখ্যাও সম্ভব। বুদ্ধিজীবীদের কারও কারও মতে, এটি কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা অর্থেই বলা হয়েছে।
এ অবস্থায় সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবল থেকে জনগণকে রক্ষার জন্য সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কর্মপ্রয়াস বাড়ানো জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট নাগরিকরা এ দায়িত্বকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, রাষ্ট্রকে সঠিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করার দায়িত্ব রাজনৈতিক সংগঠনের। সে দায়িত্ব বুদ্ধিজীবীরা এককভাবে নিতে পারবেন না এবং সেটা বাস্তবসম্মত তো নয়ই, সঙ্গতও নয়। তবে তারা আশা করছেন যে, আগামী ৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী জাতীয় সম্মেলনে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এবং উপরোক্ত চিন্তাধারায় বিশ্বাসী সব গণসংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা এবং কর্মী-সমর্থকরা দলগত ও ব্যক্তিগতভাবে সমবেত হবেন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত রেখেই সামনে এগিয়ে যাওয়ার শপথ গ্রহণ করবেন। আমরা যদি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারি, তাহলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠা করতে পারব না। আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হলে ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রও হবে না। আমি মনে করি, আমাদের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা অতীতের যেসব সংকটের সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, এবারেও অনুরূপ অবস্থান নেবেন। সংবাদ সম্মেলনে শিল্পকলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক কামাল লোহানী স্মৃতিচারণ করে বলেন, এক সময়ে মহীয়সী নারী সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী সমাবেশ ও মিছিল রাজপথে নেমেছিল। শাসকদের ভ্রূকুটি ও ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়ে তাতে শামিল হয়েছিলেন বুদ্ধিজীবী ও ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে রিকশাচালক, মুচি, কসাই, কুলি-মজুর এবং অন্তঃপুরবাসী নারীরাও। তারা দাঙ্গা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। তাদের ক্ষমতা সীমিত হলেও তাদের ডাকে প্রাথমিকভাবে অনেকেই সাড়া দিয়েছিল এবং সেটাই সেদিন ধাপে ধাপে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব করে তুলেছিল। এখনও আমাদের একই প্রত্যাশা।
ড. এমএম আকাশ : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments