মিয়ানমারের জাতিগত দাঙ্গার শেষ কোথায়? by ড. মাহবুব হাসান
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সহিংস দাঙ্গা আবারও শুরু হয় গত জুন মাস থেকে। আজ পর্যন্ত দাঙ্গায় প্রায় এক লাখেরও বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। মিয়ানমার সরকার বিবিসির কাছে স্বীকার করেছে যে সহিংসতায় ৮৮ জন নিহত হয়। আহত হয় ১২৯ জন, উদ্বাস্তু হয় ২৮ হাজার মানুষ।
কিন্তু জাতিসংঘের হিসাবে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা মুসলমানের সংখ্যা লক্ষাধিক।দাঙ্গাবাজদের হাতে পাঁচটি শহর-জনপদ আক্রান্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের জাতিসংঘ মানবিক সহায়তাবিষয়ক সমন্বয়কারী অশোক নিগাম বলেন, তাঁর সহকর্মীরা 'ব্যাপক আকারের' ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছে। নিগাম জানান, সরকারি হিসাবে চার হাজার ৬০০ বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বাস্তুচ্যুত মানুষদের জন্য জরুরি ত্রাণ প্রয়োজন। এসব ভয়ার্ত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে অস্থায়ী ক্যাম্পে, নৌকায়, দ্বীপে এবং পাহাড়ের চূড়ায়। সরকারি দলের সঙ্গে শরণার্থী এলাকা দেখে এসে জাতিসংঘের প্রতিনিধি বলেছেন, তাদের এখন জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ প্রয়োজন। রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিতওয়াতে নতুন কোনো উদ্বাস্তুকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, সর্বশেষ দাঙ্গায় উপকূলীয় চাওপিউ শহরের রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত একটি এলাকার পুরোটাই আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
লাখখানেক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা মুসলমানের মধ্যে মাত্র চার হাজার আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে আমাদের দেশে এসেছিল।
পাকিস্তানি সামরিক সরকারের নরকযজ্ঞের শিকার হয়ে এক কোটি বাঙালি সেদিন আশ্রয়ের জন্য ভারতে গিয়েছিল। ভারত আমাদের ফেরত পাঠায়নি। আমাদের অধিকাংশই মুসলমান হওয়ার পরও কেবল মানুষের নিরুপায় অবস্থা বিবেচনা করে আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। শুধু তা-ই নয়, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে তারা অস্ত্র দিয়ে, ট্রেনিং দিয়ে সাহায্য করেছিল বলেই আমরা মাত্র ৯ মাসে বিজয় অর্জন করতে পেরেছি।
রোহিঙ্গা মুসলমানরা তাদের রাজ্যটিকে স্বাধীন করতে চায় না। তার পরও তাদেরই প্রতিবেশী রাখাইন বৌদ্ধরা বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়ে তাদের বাস্তুচ্যুত করে চলেছে দশকের পর দশক ধরে। সত্তরের দশকে যখন রোহিঙ্গারা দলে দলে আসতে থাকে নাফ নদী পেরিয়ে এবং অন্যান্য পথে, তখনই আমরা জানতে পারি, রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সে দেশের বৌদ্ধরা চড়াও হয়েছে। তারা বিতাড়িত করছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের। দখল করে নিচ্ছে তাদের সহায়-সম্পত্তি, নয়তো ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে বাস্তুচ্যুত করে দিয়ে বাধ্য করছে দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি জমাতে। সেই সময় আসা কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানের সন্তান-সন্তুতি নিয়ে বেড়ে আজ পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষে পরিণত হয়েছে। কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। তাদের দেশে ফেরত নিতে রাজিই হয়নি মিয়ানমার সরকার। কূটনৈতিকভাবে আলোচনা করে এই সমস্যার সমাধান বের করা হলেও সে দেশের সরকার তাদের ফেরত নেয়নি যেমন, এখনো নিচ্ছে না। বরং বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার জন্যই যেন এই জাতিগত নির্মম দাঙ্গা বাধানো হয়েছে। এ দেশে আশ্রিত শরণার্থী রোহিঙ্গারাও আর ফেরত যেতে চাইছে না দেশে। তার একটি বড় কারণ, সেখানে ফিরে গেলে আগের জমি-জিরেতসহ সহায়-সম্পদ কিছুই ফিরে পাবে না।
কিন্তু আমাদের দেশে তো এমন জায়গা নেই যে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা মুসলমানদের আদর করে, যত্ন করে আশ্রয় দেব এবং লালন-পালন করব। এর মধ্যেই কক্সবাজারের সামাজিক জীবনে রোহিঙ্গারা ভয়াবহ পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। গত ৩০-৩৩ বছরে তাদের নতুন প্রজন্ম, যাদের জন্ম এ দেশে, তারা যুবক হয়ে উঠেছে। তারা দাবি করছে, তারা বাংলাদেশের নাগরিক। অনেকেই পরিচয় গোপন রেখে পাসপোর্ট নিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের কারণে অনেক রোহিঙ্গাকেই ভোটার তালিকায় নাম তুলিয়ে নিয়েছে। অনেকেই পেয়ে গেছে জাতীয় পরিচয়পত্র। যেমনটা আগে থেকেই পেয়ে আসছে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ছেলেমেয়েরা। আটকে পড়া পাকিস্তানিরা আগে বেশ সরগরম করত দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য; কিন্তু এখন আর সেই সরব-উত্তেজনা তাদের মধ্যে নেই। রোহিঙ্গারাও আর দেশে ফিরে যেতে চায় না। তারা এখানেই থাকার জন্য নানা কায়দা-কৌশল করছে। সেটা তাদের দিক থেকে স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের জন্য তা বিষফোড়ার মতো। আমাদের মানবিকতা আছে, মহানুভবতা আছে, অতিথিদের সেবা করার মনোভাব ও ঐতিহ্যও আছে- কিন্তু আমাদের সেই পর্যাপ্ত সামর্থ্য নেই। সেটা আমরা সবাই জানি। সরকার সেটা মুখে না বললেও তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকেই তা বোঝা যায়।
কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের আটক করে যখন পুশব্যাক করেছে, তখনই পরিষ্কার হয়েছে সরকারের সিদ্ধান্ত। আর কোনো রোহিঙ্গাকে দেশে জায়গা দেওয়া হবে না। আমরাও একবার কোটি মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা ও মানবিকতা আমাদের থাকা সত্ত্বেও আজ আমরা নারাজ।
দিন কয়েক আগে আল জাজিরার একটি সচিত্র নিউজ ক্লিপ দেখলাম মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নিয়ে। একটি ব্লগেও ইনডিটেলস রিপোর্ট পড়েছি রোহিঙ্গা মুসলমান নিধনে বৌদ্ধ রোহিঙ্গাদের দাঙ্গার বিষয়ে। ফেসবুকে প্রায় প্রতিদিনই রোহিঙ্গা নিয়ে কমেন্টস, সচিত্র রিপোর্ট, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট পড়েছি। সেসব রিপোর্ট ও মন্তব্যগুলো পড়লে আমাদের সরকারের ওপর রাগ জমতে থাকে। কারণ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে জাতিগত দাঙ্গায় অব্যাহতভাবে মুসলমান রোহিঙ্গারা হতাহতের শিকার হতে থাকলেও সীমান্ত প্রতিবেশী হিসেবে এবং গরিষ্ঠ মুসলমানের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়েও কোনো রকম প্রতিবাদ করেনি বাংলাদেশ সরকার। অতি সম্প্রতি সরকার মিনমিনে গলায় বলেছে, রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের লক্ষ্য বাংলাদেশ হতে পারে না। এ ধরনের পরোক্ষ কথায় সামরিক স্বভাবের মিয়ানমারের প্রশাসনের মনে কোনো রকম ভয় বা শঙ্কা, বিগর্হিত কাজের জন্য অনুতাপ, এমন কিছুই জন্মাবে না। আমরা লক্ষ করেছি বিশ্বের দেড় শ কোটি মুসলমানের কোনো প্রতিবাদ নেই রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ ও বিতাড়নের বিরুদ্ধে। অথচ মুসলমান বলে একই জাতিগত মানুষদের মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিক বলেও স্বীকার করে না। রাষ্ট্রের এই অস্বীকারের নীতিই অসহিঞ্চু বৌদ্ধদের উগ্র-ধর্মান্ধ করে তুলেছে বলে মনে হয়। তারাই ভেতরে ভেতরে উসকে দিচ্ছে দাঙ্গাবাজদের। দুর্গত রোহিঙ্গারা অভিযোগ করেছে নাসাকা বাহিনী ও সামরিক সদস্যরা জেরিকেনভর্তি পেট্রল সরবরাহ করেছে দাঙ্গাবাজদের। দাঙ্গাবাজদের অপকর্মে এই সহযোগিতাই প্রমাণ করে সরকারও এই রোহিঙ্গা মুসলমান নিধন ও বিতাড়নে জড়িত। ঠিক এ রকম ঘটনাই ঘটেছিল ভারতে বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার বেলায়ও। সেখানকার নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে থাকা হিন্দু পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীর লোকেরা ধর্মান্ধদের সহযোগিতা দিয়েছিল। এমনকি তৎকালীন নরসিমা রাওয়ের সরকারও ভেতরে ভেতরে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার পক্ষে ছিল। প্রশাসনের ঢিলা নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ ও আদভানি এবং বালঠাকরেকে আটক করেনি। ফলে উগ্র হিন্দুরা আরো সাহস পেয়েছিল বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে। ইে ঘটনারই পুনরাবৃত্তি আমরা দেখছি মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গা সম্প্রসারণে সে দেশের নিরাপত্তারক্ষীরা দুষ্কৃতকারীদের সহায়তার কাজে।
গত জুন মাস থেকে পর্যায়ক্রমে দাঙ্গা চলতে থাকলেও তা থামানো, দাঙ্গাবাজ বৌদ্ধ রাখাইনদের আটক ও দুর্গত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা বিধানে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি মিয়ানমার সরকার। মুসলিম বিশ্বের নেতারাও রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত দাঙ্গা প্রতিরোধে মিয়ানমার সরকারের নাজুক পদক্ষেপের কোনো সমালোচনা করেনি বা করলেও তাকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি সে দেশের সরকার। আজকে তারা পরিস্থিতি স্বাভাবিক দাবি করলেও রোহিঙ্গা মুসলমানদের কেন তাহলে পাহাড়ের চূড়ায়, নৌকায়, দ্বীপে বা আশ্রয়কেন্দ্রে বাস করতে হচ্ছে? কেন প্রতি সপ্তাহেই মুসলমানদের নিধন ও বাস্তুচ্যুত করার নারকীয় ঘটনা ঘটছে? যাদের বাড়িঘর পোড়ানো হয়নি; কিন্তু হত্যার ভয়ে যারা পালিয়ে গেছে কোথাও, কেন তাদের বাড়িঘরে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে না? যারা ওই নারকীয় যজ্ঞের জন্য দায়ী, সেসব দুষ্কৃতকারীকে পাকড়াও করা হচ্ছে না কেন? জাতিগত সংঘাতের ফলে মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে ঘোলাটে হয়ে গেছে, তা কি তারা বুঝতে পারছে না? আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিয়ানমার যে আবারও একঘরে হয়ে পড়বে না সে গ্যারান্টি তাদের কে দেবে? মিয়ানমার সরকার কি জানে এ সমস্যার সমাধান কোথায়?
ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা লস অ্যাঞ্জেলেসে বাঙালি ব্যবসায়ীদের একটি সমিতি বাদাম-এর অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশের উচিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া। দুর্গত রোহিঙ্গাদের মানবিক দিকটি বিবেচনা করে তিনি এ কথা বলেছেন। সেটা ঠিকই বলেছেন তিনি।
রামুর ঘটনার আভাস স্থানীয় প্রশাসন টের পেলেও তারা নীরব ভূমিকাই পালন করেছে। স্থানীয় এক বড়ুয়া যুবকের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে 'কোরআন অবমাননা'টা ছিল অছিলামাত্র। রাজনৈতিক মানবিক সম্প্রদায় এবং সংস্থাগুলোর কাছে আমাদের আতিথ্যপরায়ণতা মুছে গিয়ে সেখানে বর্বরতা ও হিংস্রতারই প্রকাশ ঘটল। বাংলাদেশ সরকারের উচিত ছিল রোহিঙ্গাদের ওপর বৌদ্ধদের জাতিগত হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানানো। সেই সঙ্গে এটাও বলা উচিত ছিল যে তাদের কারণেই আজ বাংলাদেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রিত। এদের কারণে আমরা সমস্যায়ও জর্জরিত। সরকারের এই নীরবতাই রামু, উখিয়া, পটিয়ার ঘটনার জন্য দায়ী বলে আমরা মনে করি।
মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অং সান সু চি এখন মুক্তবিহঙ্গ। এই প্রতিবাদী রাজনীতিকের গলা কেন শুনতে পাচ্ছি না রোহিঙ্গা মুসলিম নিধনযজ্ঞ ও বাস্তুচ্যুতির মতো নির্মম ঘটনার প্রতিবাদে? তিনি তো সে দেশের গণতান্ত্রিক চেতনার ফল্গু হিসেবে পরিচিত। তিনি তো অন্যায় আর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। তাঁর কানে কি পৌঁছায়নি রোহিঙ্গা মুসলমানদের আর্তচিৎকার? তিনি কি বৌদ্ধ শাসকদের শেল কানে পুরে নিয়েছেন যে তা ভেদ করে তাঁর কর্ণকুহরে মানুষের মরণ চিৎকার পৌঁছাতে পারে না? রাজনীতির অঙ্কগুলো যে কোন কোন বাঁকা পথ ধরে চলে তা আমরা বলতে পারি না। গৃহবন্দি অং সান সু চিকে যখন নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হলো, আমরা ভেবেছিলাম তিনি ওটা পাওয়ারই যোগ্য। কিন্তু এখন দেখছি তিনি নিজের জাতিগত স্বার্থের ওপরে উঠতে পারেননি। আমরা তো তাঁকে আরো উঁচু দরের মানুষ ভেবেছিলাম!!!
লেখক : কবি, সাংবাদিক, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী
No comments