বাংলাদেশে পত্রিকার দায়িত্ব by নূরুল ইসলাম
আমি প্রথম আলোর একজন নিয়মিত ও উৎসাহী পাঠক। প্রবাস থেকে দীর্ঘদিন ধরেই ওয়েবসাইটে পত্রিকাটি আমি পড়ে আসছি। অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশের সংবাদপত্রজগতে প্রথম আলো একটি উচ্চমানের স্থান অধিকার করেছে। পত্রিকাটির সংবাদ পরিবেশনের পরিধি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বহু বিষয়েই বিস্তৃত।
সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ এবং চরমপন্থী ধর্মবাদ ও হিংসাবাদের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে এর অবস্থান বিশেষভাবে প্রশংসনীয়। সাম্প্রতিক কালে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান নিয়ে প্রথম আলো যেসব লেখালেখি প্রকাশ করে চলেছে, সেটিও লক্ষণীয়। যে প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছেন, ঢাকার বাইরের জেলা-উপজেলাসম্পর্কিত সংবাদ পরিবেশনের কারণে তাঁদের কাছে প্রথম আলো অত্যন্ত উপযোগী।সংবাদপত্র ও বাক্স্বাধীনতা গণতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর। গণতন্ত্রের প্রগতির জন্যও রাজনীতিবিদদের জনসমক্ষে জবাবদিহি ও তাঁদের কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা বিশেষ প্রয়োজন। এই মূল্যবোধ বাংলাদেশে এখনো সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। বর্তমান পরিবেশ সংবাদপত্রের কর্তব্য পালনের জন্য বিশেষ সহায়ক নয়। আরও দুঃখজনক এই যে, রাজনৈতিক বাদ-বিসম্বাদ বাংলাদেশের সর্বত্র বিদ্যমান। সব ক্ষমতাসীন সরকারই সমালোচনা সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। তবে সব বিষয়ে এই মনোভাব সমান কঠোর নয়। তাতে মনে হয়, সংবাদমাধ্যমে খোলাখুলি আলোচনা অনেক সময় সম্ভবপর।
এ প্রসঙ্গে প্রথম আলো বিচার করে দেখতে পারে যে সংবাদ সংগ্রহ, সরবরাহ ও বিশ্লেষণে বিনা দ্বিধায় কত দূর পর্যন্ত এগোনো যায়, যাতে ক্ষমতাসীন সরকার অথবা বিরোধী দল ঘোর আপত্তি প্রকাশ না করে। যেকোনো সংবাদপত্রের পক্ষেই বিভিন্ন কায়েমি স্বার্থ এবং বহুমুখী রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রবণতার বিশ্লেষণে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা কঠিন। অনেক সময় চরম বিতর্কিত বিষয় বিশ্লেষণে ও অভিমত প্রকাশে রাশ টানতে হয়। প্রথম আলোর সম্পাদক ৪ নভেম্বর পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠা দিবসের নিবন্ধে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতি সম্মান দেখানোর দায়িত্বের প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
এ ব্যাপারে উদাহরণস্বরূপ কিছু বিষয় উল্লেখের দাবি রাখে। প্রথম আলো প্রবাসী সমাজকে নানা বিষয়ে অবহিত করতে পারে—যেমন, বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসের জটিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণ ইত্যাদি। নতুন প্রজন্মকে বাদ দিলেও এখন যাঁদের বয়স ৪০ থেকে ৫০ বছর, তাঁদেরও এ বিষয়ে ধ্যান-ধারণা সম্পূর্ণ ও স্পষ্ট নয়। যেমন, স্বাধীনতা-উত্তর ৪০ বছরে যেসব উল্লেখযোগ্য ঘটনা ইতিহাসের ফলক হিসেবে গণ্য, তারও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নীতি ও আদর্শগত পার্থক্যগুলো ও সেগুলোর কারণেরও বিশদ ব্যাখ্যা দরকার। আশা করি, প্রথম আলো এসব বিষয়ে অগ্রণী হয়ে দলীয় প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ করবে এবং তাঁদের সুচিন্তিত বক্তব্য সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনসমক্ষে তুলে ধরবে। প্রায় সব উন্নত ও কিছু অনুন্নত দেশে সংবাদপত্রের এই ভূমিকা প্রচলিত।
একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তনের আলোচনা। শুধু সাফল্যই নয়, ব্যর্থতার কাহিনিও প্রবাসী বাঙালিদের কাছে তুলে ধরা দরকার। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ সমস্যার বিশ্লেষণ ও তা সমাধানের জন্য বিভিন্ন পথের আলোচনা প্রয়োজন। প্রবাসী বাঙালিরা যতই এসব বিষয়ে অবগত হবেন, তাঁদের মাধ্যমে বিদেশিরাও বাংলাদেশের সাফল্য ও সমস্যা সম্পর্কে ততই অধিকতর অবহিত হবেন।
দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঘটনা ও নীতিমালা সম্পর্কে বাংলাদেশের পাঠকদের পরিচিত করানোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো গ্রহণ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, তুলে ধরা যেতে পারে জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কীভাবে তৃণমূল সংগঠনের ওপর নির্ভরশীল। পার্লামেন্টারিয়ান ও প্রেসিডেনশিয়াল উভয় ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য হতে পারে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র এখনো সুপ্রতিষ্ঠিত নয়। এ কারণে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর স্বৈরাচারী শাসন থেকে গণতন্ত্রের দিকে বিবর্তনের ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক। এই দেশগুলো কীভাবে পশ্চিমি গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলো—নির্বাচনপদ্ধতি, নির্বাচনে অর্থের প্রভাব সংকুচিত করা, রাজনৈতিক দলগুলোর গঠন ও প্রক্রিয়া ইত্যাদি—আমদানি করে তাদের পরিবেশের উপযোগী করছে, তা বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিল যেভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গঠনে সচেষ্ট, সে অভিজ্ঞতা গণতন্ত্র গঠনে অনগ্রসর দেশগুলোর পক্ষে শিক্ষণীয় হতে পারে। যেসব দেশে কয়েক শতাব্দী ধরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত—যেমন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য—বাংলাদেশের জন্য সেগুলো সব সময় উপযুক্ত দৃষ্টান্ত নাও হতে পারে। যুগোপযোগী হওয়ার প্রয়োজনে এই দুই দেশে গণতন্ত্রের সাংগঠনিক বিবর্তনের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এই সূত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের দৃষ্টান্তও লক্ষ করা যেতে পারে—শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের নয়, বিশেষ করে কয়েকটি প্রদেশের অভিজ্ঞতাও। প্রশাসনে অর্থনৈতিক নীতিমালা ও তার বাস্তবায়ন, উন্নয়নমুখী রাজনৈতিক সংগঠন এবং সর্বোপরি নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা এ ব্যাপারে বাংলাদেশের জন্য উদাহরণ হতে পারে।
আরেকটা বিশেষ প্রসঙ্গ, বিদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার অভিজ্ঞতাগুলো আলোচনা করা প্রয়োজন। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ কী এবং বিভিন্ন দেশে তার ব্যবহারিক রূপ কেমন, বাংলাদেশ তা পর্যবেক্ষণ করতে পারে। রাজনীতিতে ইসলামের ভূমিকা সব মুসলিমপ্রধান দেশে একধরনের নয়। একদিকে যেমন আছে মরক্কো, তিউনিসিয়া, ইন্দোনেশিয়া বা তুরস্ক; অন্যদিকে তেমনি আছে বিভিন্ন আরব দেশ। তাদের তুলনামূলক অভিজ্ঞতা থেকে কি বাংলাদেশের শিক্ষণীয় কিছু আছে?
একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করতে চাই। বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশি গণমাধ্যম ও বৈদেশিক নীতি-সম্পর্কিত গবেষণাকেন্দ্রের জ্ঞান ও ধারণা বাংলাদেশের পাঠকদের অবহিত করা উচিত। বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের কী চিত্র তুলে ধরা হয়, সে বিষয়ে প্রবাসী বাঙালিরা অবশ্য বেশ অবগত। বেশির ভাগ সময়েই সে চিত্র বাংলাদেশের অনুকূল নয়। এসব চিত্র বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশে সংবাদপত্রের পাঠক বা বিদেশিরা এই ধারণা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত নন। এর অবসান হওয়া উচিত।
খুবই দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম চরম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিত। বিদেশিদের এই ধারণার কারণ বিশ্লেষণ ও তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা জনসমক্ষে তুলে ধরা সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অসফলতাও বিদেশিদের কাছে পরিচিত। এ ব্যাপারে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনের বিস্তারিত ব্যাখ্যা জনসমক্ষে তুলে ধরা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে এমন একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে, এসব প্রতিবেদন বাংলাদেশ সম্পর্কে বৈরী মনোভাবপ্রসূত। যদি তা-ই সত্য হয়, তাহলে এ ধরনের বৈরী মনোভাবের উদ্ভব কেন হলো, সেটা বিবেচনার বিষয় হওয়া উচিত। প্রসঙ্গত, বিদেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে অনুকূল ধারণার অভাবে সরকারি-বেসরকারি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সক্ষম ও প্রয়োজনীয় সংখ্যায় বাংলাদেশে কাজ করতে আগ্রহী বিশেষজ্ঞদের আকৃষ্ট করতে পারে না; যদিও তুলনামূলকভাবে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে অথবা পাকিস্তানেও তাঁরা কাজ করতে রাজি থাকেন। এ বিষয়ে আমার কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে।
আশা করি, প্রথম আলো এসব ব্যাপারে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ ও শিক্ষিত সমাজকে আত্মসমীক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে পারবে। আমার এসব বিচ্ছিন্ন ধারণা ও অভিমতগুলো আশা করি প্রথম আলো পর্যালোচনা করবে। প্রথম আলোর সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তা হয়তো কিছুটা সহায়তাও করতে পারে।
ড. নূরুল ইসলাম: বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) ইমেরিটাস ফেলো।
No comments